প্রেম – ২
‘আপু, একটা বিষয়ে আপনার পরামর্শ চাচ্ছিলাম’।
‘বল’।
‘হয়েছে কি, আমি একটা মেয়েকে পড়াই। মেয়েটার বাবামা খুব বিশ্বাস করে আমাকে এই দায়িত্বটি দিয়েছেন। মেয়েটির স্বভাব চরিত্র অত্যন্ত ভাল। আমি ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই’।
‘ছাত্রীদের বিয়ে করা কোন ভাল কথা নয়, এটা আমার ব্যাক্তিগত অভিমত। শিক্ষক যে বয়সেরই হোক না কেন তাঁকে আমি সবসময়ই পিতৃসম সম্মানার্হ মনে করি। শিক্ষকরা যদি ছাত্রীদের দিকে নজর দেয়া শুরু করেন তাহলে তো সমাজে বিশ্বাসের কোন মূল্য থাকবেনা। তবু যদি তুমি তাকে বিয়ে করতে চাও তাহলে তোমার অবিলম্বে কথা বলা উচিত’।
‘তাহলে কি আমি ওকে প্রপোজ করব?’
‘কাকে?!’
‘মেয়েটিকে’।
এবার সত্যি সত্যি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।
‘মেয়েটিকে কেন প্রপোজ করবে? মেয়েটিকে কি প্রপোজ করবে?!’
‘বলব তাকে আমার ভাল লাগে, আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। এই উদ্দেশ্যে তাকে নিয়ে কিছুদিন ঘুরাঘুরি করে, তার সাথে কথা বলে দেখতে চাই আমাদের কতটুকু বনবে’।
‘বাবারে! এই নিয়ম কোথায় পেলে ভাই? ইসলামের নিয়ম হোল তোমার কাউকে পছন্দ হলে তার বাবা, ভাই বা যিনি অভিভাবক তার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। ওরা তোমার সাথে কথা বলে, তোমার এবং তোমার পরিবারের সম্পর্কে খোঁজখবর করে বিবেচনা করে অতঃপর মেয়েকে জানাবেন। তারপর মেয়ের পছন্দ হলে বিয়ে হবে। তারপর তোমরা সারাজীবন ঘুরে ঘুরে প্রেম করতে পারো, দিনরাত কথাবার্তা বলতে পারো মনের সুখে। বিয়ের আগেই কেন সব করে ফেলতে চাও?’
‘বিয়ের পর না বনলে?’
‘বিয়ের আগে কারো সাথে যতই ঘোরাফেরা কর না কেন তোমাদের উভয়ের উদ্দেশ্য থাকবে পরস্পরকে ইমপ্রেস করা। ক’দিন সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পরে দামী দামী রেস্টুরেন্টে বসে কটা শানিত বুদ্ধিদীপ্ত কথা বললে কি বোঝা যায় সেই মানুষটা কিভাবে রি-অ্যাক্ট করবে যখন তোমার সাথে সংসার করতে গিয়ে তোমার দামী শার্টের নীচে গেঞ্জির বিশাল ফুটোটা ওর চোখে পড়বে, কিংবা যখন ঘরে চিনি ফুরিয়ে গেলে আবার কেনার জন্য পরবর্তী বেতনের অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে, কিংবা সে বুঝতে পারবে তুমি একটা বাল্ব পর্যন্ত মিস্ত্রীর সাহায্য ছাড়া নিজে বদলাতে জানোনা? কিন্তু যে মেয়েটা তোমার বৌ হয়ে আসবে সে তোমার ভালমন্দ সবটুকু গ্রহন করার মানসিকতা নিয়েই আসবে। তাকে ইমপ্রেস করার জন্য তোমার প্রতিনিয়ত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবেনা। বরং তোমার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রচেষ্টা তার সন্তুষ্টির কারণ হবে, তোমার বৃহৎ বৃহৎ ভুলগুলোও সে নিজ চেষ্টায় শুধরে নেবে যেহেতু সে তোমাকে জীবনের একমাত্র অপশন মনে করে’।
‘কিন্তু আপু, তারপরও তো অনেকের বিবাহবিচ্ছেদ হয়’।
‘হুমম, তা হয়। হবেনা কেন? দু’জন মানুষ সম্পূর্ন ভিন্ন দু’টি পরিবার এবং পরিবেশ থেকে এসে একসাথে মিলে যাওয়া কি এতই সহজ? দু’জনের মাঝেই প্রয়োজন ধৈর্য্য, সহনশীলতা, সংবেদনশীলতা এবং অপর ব্যাক্তিটির প্রতি বিশ্বাস ও সহমর্মিতা। আবার ধর, একটি ছেলে বা মেয়ে যে বিয়ের আগেই অনেককে পরখ করে নিয়েছে, সে তার পার্টনারের মাঝে সেই সকল গুন খুঁজবে কিংবা তাকে তাদের সাথে তুলনা করবে অবচেতনেই। তখন বর্তমান পার্টনারের গুনগুলো তার যতটা না চোখে পড়বে বরং তার ঘাটতিগুলোই তার কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে। তখন বিচ্ছেদ হবে বৈকি! কিন্তু কি জানো?’
‘কি?’
‘সামাজিকভাবে বিবাহিতা একটি মেয়ের যদি বিচ্ছেদ হয়ে যায় তবে তার পরিবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, আবার বিয়ে দেয় কিংবা প্রয়োজন হলে আজীবন তার দেখাশোনা করে কিংবা অন্তত তার বিপদ আপদে পাশে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু বিয়ের আগে তুমি যদি একটি মেয়ের সঙ্গ উপভোগ করে অতঃপর বনবেনা ভেবে ফিরিয়ে দাও সে পরিবার পরিজন বন্ধুবান্ধব কারো কাছে সহানুভূতি বা সহায়তা পাবেনা, তদুপরি মেয়েটিকে বিয়ে দেয়াও মুশকিল হয়ে যাবে। তুমি যদি কাউকে সত্যিই ভালোবাসো তাহলে তার দায়িত্ব নিতে বা দায়িত্ব নেয়ার উপযোগী হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তোমার আপত্তি কোথায়? এ’ কেমন প্রেম যেখানে শুধু ভোগ আছে অথচ ত্যাগ নেই?’
‘কিন্তু আমি তো তাকে বিয়ে করতে চাই!’
‘কিন্তু করবে কি’না তা নিশ্চিত নও’।
‘আমার উদ্দেশ্যটা তো তাই’।
‘ভাইরে, শোন। প্রবাদে যাই বলুক না কেন, the end does NOT justify the means. এই যে সমাজে প্রেমের নামে এত বিশৃংখলা আর কষ্টের ছড়াছড়ি – নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে ধর্ষন, নিজের চাহিদায় লাগাম দিতে না পেরে অনাকঙ্খিতভাবে সন্তানধারণ, প্রেমে ব্যার্থ হয়ে আত্মহত্যা, বিয়ের পর প্রাক্তন প্রেমিক প্রেমিকার প্রতি আবেগ উথলে ওঠার কারণে বর্তমান সম্পর্কের প্রতি অমনোযোগী হয়ে সংসারে অশান্তি – এখানে কোনটার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল ভাই? কিন্তু এখানে end বা means কোনটি justify করা যায়? আমাদের নিজেদের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণের মাত্রা সম্পর্কেও তো কোন ভুল ধারণা থাকা উচিত না। আমাদের ভেতর থেকে নাফস এবং বাইরে থেকে চিরশত্রু ইবলিস সারাক্ষণ ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাদের সূঁচ পরিমাণ ছাড় দিলে তারা কোদাল দিয়ে আমাদের কবরের মাটি খুঁড়তে থাকে’।
‘এভাবে তো ভাবা হয়নি!’
‘এখন ভাবো। তুমি যে মেয়েটিকে ভালোবাসো সে তো হবে তোমার সম্মানের পাত্রী যার প্রতি তোমার কল্পনাগুলোও হবে পবিত্র এবং সংযত, সেখানে তোমার আচরনে যদি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় তাতে কি ভালোবাসার সম্মান রক্ষা হয় ভাই? বিয়ের পর সে হবে তোমার দূর্গ যেখানে তুমি শয়তানের কবল থেকে আশ্রয় খুঁজে পাবে। কিন্তু সেই দূর্গের দ্বার যদি তুমি আজ নিজ হাতে ভেঙ্গে ফেল তাহলে সেই দূর্গের ওপর কি তুমি কোনদিন আর আস্থা রাখতে পারবে?’
অনেকক্ষণ ভাবল সে।
‘ঠিক বলেছেন আপু। তখন আমার কেবল মনে হবে আমার আগে সে কার কার সাথে মিশেছে, ওদের সাথে ওর কতটুকু ভাব ছিল, কাউকে ওর আমার চেয়ে বেশি পছন্দ ছিল কিনা। আমি তার জীবনে একমাত্র পুরুষ হতে চাই। কিন্তু সত্যিই যদি আমি তাই হই তবু আমার মনে হবে সে আমার মন ভোলানোর জন্য এমন বলছে, নিশ্চয়ই সে যেমন আমার সাথে মিশেছে তেমনি অন্য কারো সাথেও মিশে থাকবে’।
‘তাহলে কেন জেনেশুনে একটি সহজসরল মেয়েকে এমন পথে পরিচালিত করতে চাও ভাই যেখানে তার জীবনটা সাজাতে গিয়ে জীবনটা শেষও করে ফেলতে পারো তুমি? তার চেয়ে তুমি ওর বাবার সাথে কথা বল। তুমি বলেছ তিনি তোমাকে বিশ্বাস করেন। তিনিও খুশি হবেন যে তুমি তাঁর বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছ, তিনিই তখন মেয়েটিকে তোমার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সচেষ্ট হবেন। তুমি তোমার লক্ষ্যে উপনীত হবে নির্ঝঞ্ঝাটে এবং মেয়েটিরও সম্মানের কোন ক্ষতি হবেনা’।
‘কিন্তু আপু, ধরেন আমি প্রস্তাব করলাম কিন্তু ওরা রাজী হলেন না?’
‘শোন ভাই, তুমি কি সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস কর?’
‘অবশ্যই’।
‘তুমি কি বিশ্বাস কর যে তিনি তোমাকে এবং তোমার লাইফ পার্টনারকে জোড়া মিলিয়ে সৃষ্টি করেছেন?’
‘জ্বী’।
‘তাহলে বিশ্বাস রাখো, এই মেয়েটি যদি তোমার নির্ধারিত লাইফ পার্টনার হয় তাহলে সে তোমার কাছেই আসবে। তা নইলে তোমার সততা এবং উত্তম নিয়াতের জন্য আল্লাহ তোমাকে এর চেয়ে ভাল লাইফ পার্টনার দান করবেন’।
‘আমার যদি অন্য কোন মেয়েকে পছন্দ না হয়?’
‘তুমি যদি একজনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখো তাহলে অন্যের দিকে তাকাবে কি করে? তাকে যাচাই করবেই বা কিভাবে? কিন্তু তুমি যদি সাদা মন নিয়ে তার কাছে যাও, তাকে সুযোগ দাও, তাহলে সে তোমার মনের সাদা ক্যানভাসে রঙিন তুলি দিয়ে ছবি আঁকবে, তুমি বুঝতে পারবে তুমি যা চেয়েছিলে তার তুলনায় তুমি কত বেশি পেয়েছ। নইলে তুমি অন্য কারো লাইফ পার্টনারকে নিজের করে নেয়ার প্রচেষ্টায় কি পেয়েছ তা অ্যাপ্রিশিয়েট করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে’।
‘হুমম’।
‘এবার একটু ভেবে দেখ তো তোমার লাইফ পার্টনার নিয়ে অন্য কেউ টানাটানি করছে এমনটা কল্পনা করতে তোমার কেমন লাগছে?’
কিছুক্ষণ ভেবে সে বলল, ‘ভীষণ খারাপ লাগছে আপু। আমি ভাবতেই পারছিনা। কিন্তু আমি কি করে বুঝব যে আসলেই আমার লাইফ পার্টনার আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে আমি তার কাছে পৌঁছনো পর্যন্ত?’
‘একটাই উপায় আছে ভাই। যিনি সর্বস্রষ্টা এবং সর্বদ্রষ্টা তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে হবে যেন আমাদের পছন্দের মানুষটি নিজেকে সংরক্ষণ করে কেবল আমাদের জন্যই। সাথে নিজেকেও এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যেন আমি তাকে গিয়ে বলতে পারি, ‘এই যে দেখ, আমার সবটুকু আমি বাঁচিয়ে রেখেছি কেবল তোমার জন্য। এর কোথাও কখনো তোমার ছাড়া আর কারো অধিকার ছিলোনা, আজ থেকে আমার সবকিছুর ওপর তোমার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোল’। কি, বল? এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারবে তো?’
লাজুক হেসে ভাইটি বলে, ‘জ্বী আপু, এটুকু যে আমাকে পারতেই হবে!’
আসলে আমরা সবাই সৎ উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করতে চাই, কিন্তু অনেকসময় লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং পন্থা মিলাতে পারিনা। এত সীমিত বুদ্ধি এবং ক্ষমতা নিয়ে আমাদের এমন অনিশ্চিত পথে যাত্রা করার চেয়ে যিনি সর্বজ্ঞানী তাঁর জ্ঞানের ওপর ভরসা রেখে তাঁর নির্দেশিত পন্থায় পথ চলাই শ্রেয় নয় কি?
– রেহনুমা বিনত আনিস