পশ্চিমা সংস্কৃতির কুপ্রভাব
(আলোচ্য বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পেতে আগে বাস্তব তিনটি ঘটনা পড়ুন)
ঘটনা : ১
চামেলীর (ছদ্ম নাম) বয়স এখন ৩৫ ছুঁইছুঁই। প্রায় এক যুগ আগে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় থেকে অভিভাবকরা তার জন্য একেরপর এক বিয়ে ঠিক করে আসছেন। কোনো বিয়েতেই মত দেয় না সে। রুবেল নামের একটি ছেলেকে সে ভালোবাসে। এদিকে প্রেমিক রুবেলকেও তার অভিভাবকরা বিয়ের জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করেন। সেও রাজি হয় না। অনেক দিন পর মেয়ের অভিভাবকদের এক হাত দেখিয়ে দিতে সে একটি বিয়েতে রাজি হয়। কিন্তু বিয়ের মাত্র এক মাসের মাথায় সে ওই বউকে ডিভোর্স দেয়। তার কথা, ‘একে আমার ভালো লাগে না। এর প্রতি আমি কোনো আকর্ষণ বোধ করি না। আমার পক্ষে চামেলী ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়।’ এদিকে ভালোবাসার শপথ ভঙ্গ করে বিয়েতে রাজি হওয়ায় অভিমানে ফেটে পড়ে চামেলী। ‘যার জন্য আমি পরিবারের প্রবল চাপ আর সামাজিক বাধার স্রোত উজিয়ে এতগুলো বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত করেছি, সে কি-না আমাকে রেখে অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে গেল! ঠিক আছে আমিও কম না। আমিও তবে রুবেলকে দেখে নেব।’
পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে চামেলী অকস্মাৎ তার বাবাকে ছেলে দেখতে বলল। অবাক হলেও বাবা যারপরনাই খুশি হন। পরিবারের সবাই বলাবলি করতে লাগল যাক অবশেষে চামেলীর সুমতি হলো! বাবা ব্যস্ত হয়ে একটি পাত্র ঠিক করলেন। চামেলী রুবেলকে সংবাদ পাঠাল, ‘তুমি আমার ভালোবাসার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে অন্য মেয়ের বিয়েতে সম্মতি দিয়েছো। ঠিক আছে আমিও আর তোমাকে বিয়ে করছি না। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই তুমি আমার বিয়ের দাওয়াত পাবে।’ রুবেলের মাথায় যেন মেঘ ভেঙ্গে পড়ল। তবে অভিমানী নয়; সে হয়ে উঠল প্রতিহিংসাপরায়ন। চামেলীকে চমকে দিয়ে রুবেল জানাল, ‘আমাকে ছাড়া যদি অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাও, তবে আমি সে বিয়ে ভেস্তে দেব। আমার সঙ্গে তোলা তোমার সবগুলো অন্তরঙ্গ ছবি সবার সামনে তুলে ধরব।’ চামেলী বিমূঢ় হতভম্ভ হয়ে গেল। প্রেমিকের কাছে সে এমন নোংরা হুমকি প্রত্যাশা করেনি। অনেক কষ্টে চামেলী নিজের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকল। আর যাই হোক সে এমন মহাপাপ করতে চায় না। তবে একদিন বাদেই সে তার বাবা ও প্রেমিক পুরুষকে জানিয়ে দেয়, ‘আমার বিয়ে নিয়ে যখন এত হাঙ্গামা, তখন আমি আর বিয়েই করব না। আমার জন্য চির কুমারী হয়ে থাকার সিদ্ধান্তই যথার্থ।’
পরিবারের চাপ আর রুবেলের দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে সে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে। এখানে সে একটি গার্মেন্টে চাকরি করে। নিজে কামাই করে আত্মীয়ের বাসায় খরচ দিয়ে থাকে। চামেলী জানে না তার ভবিষ্যৎ কী। মেয়ের অনিশ্চিত গন্তব্যের কথা ভেবে বাবা-মা শুধু চোখের পানিই ফেলেন। মেয়েকে বাধ্য করার সাহস তাদের নেই। তারা জানেন তাদের এ সন্তান কত জেদী ও একরোখা। (উল্লেখ্য, এই মেয়েটি আমার বাসার নিচ তলায় থাকে।)
ঘটনা : ২
স্বামীর চরম অবহেলা-নির্যাতন। অন্যদিকে শ্বশুর-শাশুড়ি ও ননদদের সীমাহীন লাঞ্ছনা- সবকিছু মিলিয়ে বিষিয়ে উঠেছিল গৃহবধু ফারজানা হোসেন রিতার জীবন। দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এতদিন মুখ বুজে সব সহ্য করলেও আর পারছিলেন না তিনি। অবশেষে স্বামীর অবজ্ঞা আর শ্বশুরবাড়ির লোকদের গঞ্জনা-অপমান থেকে চিরকালের জন্য মুক্তি পেতে ‘আত্মহননের’ পথ বেছে নেন। একা নয়; নিজ গর্ভের দুই সন্তানকেও স্বেচ্ছামরণে সহযাত্রী করে নেন। গত ১১ জুন ২০১০ (শুক্রবার) এই হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে রাজধানীর কদমতলীর আরামবাগের একটি বাসায়।
রিতার বড়বোন জানান, প্রায় ১৭ বছর আগে রিতা ও রাশেদুল কবীর নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেন। প্রথমে দুই পরিবারের কেউই এ বিয়ে মেনে নেননি। পরে দুই পরিবারের সম্মতিতেই আনুষ্ঠানিকভাবে রিতাকে ঘরে তুলে নেন রাশেদুল কবীরের বাবা শফিকুল কবীর।
রিতার পারিবারিক সূত্র জানায়, কয়েক বছর আগে রিতার মামাতো বোন রাজিয়া সুলতানা স্মৃতির সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন রাশেদ। তখন থেকে রাশেদ তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের সঙ্গে খারাপ আচরণ শুরু করেন। ২০০৮ সালের আগস্টে রিতা ও তার দুই সন্তান ভারতের আজমির যান। কাজের অজুহাতে রাশেদ ঢাকায় থেকে যান। স্ত্রী ও সন্তানের অনুপস্থিতিতে তিনি ৮ আগস্ট গোপনে স্মৃতিকে বিয়ে করেন। দেড় বছর পর গত রমজানে বিষয়টি জানাজানি হয়। এতে রাশেদের সঙ্গে রিতার দাম্পত্যকলহ আরো বেড়ে যায়।
রিতা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে (সমাজবিজ্ঞান) পড়ার সময় রাশেদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন আলমবাগ এলাকায় একটি ভিডিওর দোকান ছিল রাশেদের। পরিচয় থেকে প্রেম তারপর প্রেম থেকে পরিণয়। প্রথম সন্তান পেটে থাকতে নিজের কাজে সহযোগিতার জন্য রিতা স্মৃতি নামের তার এই মামাতো বোনকে নিজের বাসায় আনে। দুলাভাইয়ের সাথে অবাধ মেলামেশার সুযোগ। তারপর যা হবার তা-ই হলো। (বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক)
ঘটনা : ৩
পরনে সুতির থ্রি পিস। রক্তাক্ত পুরো শরীর। মাথার লম্বা চুলও রক্তের স্রোতে ভিজে চুপচুপে। ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত শরীর থেকে ঝরছে তাজা রক্ত। বেরিয়ে পড়েছে নাড়িভুঁড়িও। লাল রক্তে রাঙা পায়ের আঙুল। ভয়ঙ্কর সে দৃশ্য সহ্য করা সত্যি কঠিন।
প্রেমিক তারিকুজ্জামান কবির উপর্যপুরি ছুরিকাঘাতে ও গলা কেটে খুন করে উডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের ছাত্রী মহসীনা রাব্বানী মেনকাকে। ঘাতক কবির মেনকার খালা জেসমিনের দেবর। গত ১৫ জুলাই ২০১০ ইং রাজধানী ঢাকার পাইকপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত মেনকা পড়াশুনার পাশাপাশি মিরপুরের শাহ আলীবাগের এফএম ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।
যেভাবে খুন করা হয় : ঘাতক কবির জানায়, ঘটনার দিন দুপুর ১২ টায় মেনকাদের বাসায় আসে সে। এ সময় মেনকা তাকে বলে, আপনার আজ সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা। কিছু সময় পর মেনকার মা প্রেশারের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এই সুযোগে মেনকাকে নিয়ে তার বেডরুমে যায় কবির। এরপর ব্যাগ থেকে একটি ছুরি বের করে কবির। ছুরিটি মেনকাকে দেখিয়ে বলে, আজ তোমাকে কিছু প্রশ্ন করব। সত্য জবাব না পেলে এই ছুরি দিয়ে তোমাকে খুন করে ফেলব। মেনকাকে কবির জিজ্ঞেস করে, কার সঙ্গে প্রতি রাতে সে কথা বলছে। কার সঙ্গে প্রেম করছে মেনকা। অনেক পীড়াপীড়ির পর মেনকা স্বীকার করে সম্রাট নামে এক ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। এ কথা শোনার পরপরই মেনকার পেটে প্রথমে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। এরপর সারা শরীরে এলোপাতাড়ি ছুরি দিয়ে আঘাত করে। (দৈনিক সমকাল)
সম্প্রতি বাংলাদেশে আত্মহত্যার ঘটনা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা খুললেই চোখে পড়ছে প্রেমিকের হাতে প্রেমিকার প্রাণনাশ, কাঙ্ক্ষিত জনকে না পাওয়ায় প্রেমিক বা প্রেমিকার আত্মহত্যা, মায়ের হাতে সন্তান খুন, নিষ্পাপ শিশুসহ পারিবারিকভাবে অসুখী নারীর আত্মহনন, ধর্ষণ বা ইভটিজিংয়ের অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনা। বাংলাদেশে সদ্য সমাপ্ত রমজান মাসেও ঘটে বেশ কয়েক নারীর আত্মহত্যার ঘটনা। রাজধানীর খিলক্ষেতে পাতানো মামার আহ্বানে তার বাসায় ইফতার করতে গিয়ে খুন হন ইডেন কলেজের এক ছাত্রী। তার শরীরে শারীরিক নির্যাতনের অনেক চিহ্ন দেখে গেছে বলে খবরে প্রকাশ।
এসব ঘটনায় সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রেই আজ চিন্তিত ও বিস্মিত। এ নিয়ে জাতীয় দৈনিকগুলোতে রোজ প্রকাশিত হচ্ছে নানা ধরনের প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও প্রতিবেদন। এসবের প্রতিকারে কঠোর আইন পাশ, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি, অপরাধীদেরকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করাসহ নানা মুনী নানা মত দিয়ে আসছেন। এসব ঘটনায় হতবিহ্বল সমাজ ও মনোবিজ্ঞানী এবং শিক্ষকশ্রেণির অনেকের লেখায় ক্ষীণকণ্ঠে হলেও উঠে আসছে সমাজে চারিত্রিক অবক্ষয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবের কথা। প্রসঙ্গত, কয়েকদিন আগে লন্ডনে যে সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলার ঘটনায় পুরো ইংল্যান্ড কেঁপে উঠেছিল, তার পেছনেও নৈতিক মূল্যবোধের অভাবের হাত রয়েছে বলে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন। তবে যে যাই বলুন আত্মহত্যার এসব ঘটনা বাড়ছে বৈ কমছে না।
আসলে আত্মঘাতী কাফেলার এই স্রোত ঠেকাতে সবাই স্রোতের বিপরীতে বালু আর ইট-সুরকির বস্তা দিয়ে প্রতিরোধের সমাধান পেশ করছেন। কেউ স্রোতের উৎস বন্ধ করার কথা বলছেন না। আমরা জানি, স্রোতের উৎস বন্ধ না করে তার বিপরীতে বাঁধ তৈরি সমাধান বটে। কিন্তু তা স্থায়ী নয়; সাময়িক। তাহলে এই আত্মঘাতী স্রোতের উৎস কী? হ্যা, মোটাদাগে বলতে গেলে তা হলো, আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন এবং পর্দা বিধানকে উপেক্ষা। ওপরে উদ্ধৃত শুধু এ গল্পত্রয়ই নয়; এ ধরনের যেকোনো ঘটনা মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবেন এর জন্য প্রধানত পর্দা বিধান লঙ্ঘনই দায়ী। আল্লাহর বিধান লঙ্ঘনের অনেকগুলো পাপের যোগফলেই এমন চূড়ান্ত ঘটনা। প্রথম গল্পে চামেলীর উদ্দেশে প্রেমিক রুবেলের হুমকি ‘আমার সঙ্গে তোলা তোমার সবগুলো অন্তরঙ্গ ছবি সবার সামনে তুলে ধরব’ অন্তত তা-ই প্রমাণ করছে। বিয়ের আগে একজন পুরুষের সঙ্গে ছবি ওঠানো হয় কীভাবে? তাও আবার অন্তরঙ্গ ছবি?
দ্বিতীয় গল্পে দেখুন কীভাবে পদে পদে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ উপেক্ষিত হয়েছে। (ক) রিতা-রাশেদের ভালোবাসার সম্পর্ক। (খ) রিতার পরিবারে স্মৃতিকে স্থান দিয়ে দুলাভাইয়ের সঙ্গে অবাধ মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি করা। (গ) স্বামীকে (মাহরাম) না নিয়ে বিদেশ সফর করা। (ঘ) মক্কা-মদীনা নয়; মানত পূরণের জন্য আজমির শরীফ গমন!
তৃতীয় গল্পটি আমি পত্রিকার ভাষায় তুলে ধরেছি। এতে শুধু একটি বাক্য খেয়াল করুন ‘এই সুযোগে মেনকাকে নিয়ে তার বেডরুমে যায় কবির।’ মেনকার দূর সম্পর্কের আত্মীয় কবির কেন তাকে নিয়ে বেডরুমে যাবে? সে কি তার স্বামী?
ইদানীং অনেক শিক্ষিত পরিবারই মেয়ের কাছে কোনো বেগানা পুরুষের আগমন বা বন্ধুত্বের অধিকার নিয়ে মেলামেশাকে দোষণীয় মনে করছে না। তাদের দৃষ্টিতে তারা কেউ তার ‘বয়ফ্রেন্ড’, কেউবা তথাকথিত ‘ভাইয়া’। বাবা-মায়েরাও এতে দোষের কিছু দেখেন না। বেগানা আবার কিসের? ওসব সেকেলে শব্দ! এই হলো পাশ্চাত্য সভ্যতার আগ্রাসন। অথচ মাত্র এক শতাব্দী আগেই এ দৃশ্য একটি হিন্দু পরিবারেও বেমানান ছিল। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়েননি এমন শিক্ষিত বাঙালী কমই পাওয়া যাবে। তার এক উপন্যাসে পড়েছিলাম যখন ছেলে পড়ানোর জন্য পণ্ডিত মশাই বাড়িতে প্রবেশ করলেন, মা অন্দরমহলে চলে গেলেন। প্রয়োজনে যখন মাস্টারের সামনে আসতে হয় তিনি মুখে লম্বা ঘোমটা টেনে সামনে আসেন। আজো কিন্তু মুসলিম সভ্যতার বিলীয়মান নিদর্শন হিসেবে ভারতের গ্রামাঞ্চলের হিন্দু মহিলারা ফুলহাতা ব্লাউজ পরেন।
অথচ পাশ্চাত্য সভ্যতার সবক আমরা এতোটা রপ্ত করেছি যে, নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল সামাজিক মূল্যবোধ আর আমাদের কাছে ভালো লাগে না। ভালো লাগে স্বাধীনতার নামে গোলামীর জিঞ্জিরে হাঁপিয়ে ওঠা পাশ্চাত্য মূল্যবোধ। তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশে আজ বিশ্ববিদালয়ের ক্লাসে পর্দাকে উপহাস করা হয়। ক্লাসে নগ্নতার সবক দিলে দোষ হয় না। দোষ হয় শালীনতার সবক দিলে। টুপি আর বোরকা দেখলে শুধু ফ্রি সেক্সের দেশ ফ্রান্সেই নয়; ইদানীং বাংলাদেশেও অনেকের গা চুলকাতে শুরু করে।
প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ছুটির দিনে শাহ জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনাদের সময় আর এখনকার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পার্থক্য দেখতে পান? একটি অনুষ্ঠানে নিজের ছাত্রীদের সঙ্গে বল্গাহীন ড্যান্স দিয়ে সমালোচিত হওয়া এ কাল্পনিক জগতের লেখক উত্তর দেন, ‘তখনকার দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বোরকা দেখা যেত না। বর্তমানের মতো মৌলবাদীদের এত উৎপাত ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।’
হ্যা, এরা কিন্তু পাশ্চাত্যের কেউ নন। এরা পাশ্চাত্য সভ্যতার গর্বিত আমদানিকারক। এদের সম্পর্কে দুঃখ করতে গিয়ে গত শতাব্দীর অন্যতম বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী বলেন, ‘আজ আমরা এমন এক মুসলিম প্রজন্ম দেখতে পাচ্ছি, যাদের কাছে পশ্চিমের সবই সুন্দর। সবই অনুকরণীয়। এদের কাছে যেন পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণই সব সমস্যার সমাধান। পশ্চিমেও যে অশান্তি আছে, পশ্চিমারাও যে জীবনের নানা ক্ষেত্রে ব্যর্থ- এরা তা কিছুতেই মানতে রাজি নয়।’
একটি সরল বাস্তবতা হলো, যেকোনো বস্তুর আবিষ্কারকই সেই বস্তুর পরিচালনা বিধি ভালো জানেন। তাইতো আধুনিক সব যন্ত্রের সাথে কোম্পানির পক্ষ থেকে তার ব্যবহার বিধিও সরবরাহ করা হয়। এই বিশ্বচরাচরের নিপুণ কারিগর, বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি মানুষের স্রষ্টা ও পরিচালক আল্লাহই কিন্তু ভালো জানেন- কীসে তাদের শান্তি। কীসে তাদের মুক্তি ও নিরাপত্তা। সে আল্লাহই কিন্তু নারীর জন্য পর্দা ফরজ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰنِسَآءَ ٱلنَّبِيِّ لَسۡتُنَّ كَأَحَدٖ مِّنَ ٱلنِّسَآءِ إِنِ ٱتَّقَيۡتُنَّۚ فَلَا تَخۡضَعۡنَ بِٱلۡقَوۡلِ فَيَطۡمَعَ ٱلَّذِي فِي قَلۡبِهِۦ مَرَضٞ وَقُلۡنَ قَوۡلٗا مَّعۡرُوفٗا ٣٢ وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ وَأَقِمۡنَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتِينَ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَطِعۡنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذۡهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجۡسَ أَهۡلَ ٱلۡبَيۡتِ وَيُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِيرٗا ٣٣﴾ [الأحزاب: ٣٢، ٣٣]
‘হে নবী-পত্নীগণ, তোমরা অন্য কোনো নারীর মত নও। যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে (পরপুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, তাহলে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে। আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক- জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। হে নবী পরিবার, আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’ {সূরা আল-আহযাব, আয়াত : ৩২-৩৩}
আল্লাহ তা‘আলা আরো ইরশাদ করেন,
﴿وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ وَيَحۡفَظۡنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ﴾ [النور: ٣١]
‘আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। আর তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে।’ {সূরা আ-নূর, আয়াত : ৩১}
অন্যত্র তিনি বলেন,
﴿ٱلرِّجَالُ قَوَّٰمُونَ عَلَى ٱلنِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ ٱللَّهُ بَعۡضَهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٖ وَبِمَآ أَنفَقُواْ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡۚ فَٱلصَّٰلِحَٰتُ قَٰنِتَٰتٌ حَٰفِظَٰتٞ لِّلۡغَيۡبِ بِمَا حَفِظَ ٱللَّهُۚ﴾ [النساء : ٣٤]
‘পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক, এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু তারা নিজদের সম্পদ থেকে ব্যয় করে। সুতরাং পুণ্যবতী নারীরা অনুগত, তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে হিফাযতকারিনী ঐ বিষয়ের যা আল্লাহ হিফাযত করেছেন।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৩৪}
আজ সমাজে যা দেখতে পাচ্ছি, তা পাশ্চাত্য সভ্যতার অবদান। তাদের অন্ধ অনুকরণের এই আত্মঘাতী পথ যত দীর্ঘ হবে আত্মহত্যার এই কাফেলাও ততো বড় হবে। পাশ্চাত্যের সংবাদপত্রগুলিতে দৃষ্টি দিলেই দেখতে পাবেন সেখানে রোজ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। স্ত্রীরা অহরহ স্বামীকে ডিভোর্স দিচ্ছে। পাশ্চাত্যে সামাজিক শান্তি বলতে কিছু নেই। তাদের সব আছে; শুধু নেই শান্তি।
২০১০ সালের একদিন দৈনিক ইত্তেফাকে একটি আন্তর্জাতিক জরিপের রিপোর্ট পড়েছিলাম। তাতে সারা বিশ্বের সুখী মানুষদের তালিকায় বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে প্রথম স্থানে আর অনেকরই স্বপ্নের দেশ আমেরিকার স্থান ৪৬ নাম্বারে। সুখী দেশগুলোর তালিকার ওপরের দিককার অধিকাংশ দেশই ছিল মুসলিম দেশ। কারণ বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষকে সারা বছর দারিদ্র ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করতে হয় ঠিক; কিন্ত অল্পে তুষ্টি ও সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধনের কারণে তারা মানসিকভাবে অনেক সুখী। আর আমেরিকাসহ পশ্চিমের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হলেও তাদের মধ্যে সামাজিক ও পারিবারিক অশান্তি লেগেই থাকে।
বস্তুত আমাদের সমাজে যত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে বা ঘটছে তার সিংহভাগই আমাদের মন্দ কর্মের ফসল মাত্র। আল্লাহর বিধান ও আদেশ উপেক্ষা করে, অহরহ পাপ ও জুলুম করে নিজেরাই আমরা নিজেদের জন্য বিপদ ডেকে আনছি। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ظَهَرَ ٱلۡفَسَادُ فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِ بِمَا كَسَبَتۡ أَيۡدِي ٱلنَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعۡضَ ٱلَّذِي عَمِلُواْ لَعَلَّهُمۡ يَرۡجِعُونَ ٤١﴾ [الروم: ٤١]
‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে বিশঙ্খলা প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ {সূরা আর-রূম, আয়াত : ৪১}
আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা এবং তাঁর বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার শাস্তি সম্পর্কে আরেক সূরায় আল্লাহ তা‘আলা আরও স্পষ্ট করে বলেন,
﴿وَمَنۡ أَعۡرَضَ عَن ذِكۡرِي فَإِنَّ لَهُۥ مَعِيشَةٗ ضَنكٗا وَنَحۡشُرُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ أَعۡمَىٰ ١٢٤ قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرۡتَنِيٓ أَعۡمَىٰ وَقَدۡ كُنتُ بَصِيرٗا ١٢٥ قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتۡكَ ءَايَٰتُنَا فَنَسِيتَهَاۖ وَكَذَٰلِكَ ٱلۡيَوۡمَ تُنسَىٰ ١٢٦﴾ [طه: ١٢٤، ١٢٦]
‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, ‘হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন’ ? তিনি বলবেন, ‘এমনিভাবেই তোমার নিকট আমার নিদর্শনাবলী এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল।’ {সূরা ত্ব-হা, আয়াত : ২৪-২৬}
অতএব আমরা যদি সত্যিকারার্থে শান্তি চাই, সামাজিক স্থিতি ও নিরাপত্তা চাই, নারীর মুক্তি ও উন্নতি চাই। অসহায় নারীদের এই দুঃখজনক পরিণতির পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে চাই, অনাকাঙ্ক্ষিত এসব মৃত্যুর মিছিল রুখতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের ফিরে আসতে হবে শান্তির সেই শ্বাশত পথে। চৌদ্দশ বছর আগে বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়া অনুপম শান্তির সমাজ গড়া ইসলামী আদর্শের কাছে। যাবতীয় পাপাচার থেকে তাওবা করে সমাজে জাগ্রত করতে হবে ইসলামী মূল্যবোধ। নারীকে আসতে হবে পর্দার নিরাপদ ঠিকানায়। সর্বোপরি সবধরণের শিক্ষা-সিলেবাসে বাধ্যতামূলক করতে হবে ইসলামী শিক্ষা। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
– আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. মোঃ আব্দুল কাদের