আল-কুরআনের আলোকে জাহান্নামের বিবরণ – ২
-বযলুর রহমান
আল্লাহ তা‘আলা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তিনি কারো উপর যুলুম করেন না। পৃথিবীতে মানুষের কর্মকান্ডের উপরে ভিত্তি করেই তার পরকালীন জীবনের চূড়ান্ত ঠিকানা নির্ধারিত হবে। আল্লাহ মানুষের মধ্যে ফায়ছালা করবেন। তাদের কর্মকান্ডের ভিত্তিতে জাহান্নামের আযাবে তারতম্য হবে। যেমন মুনাফিক্বদের স্থান জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে হবে (নিসা ৪/১৪৫)। আবার জাহান্নামের জ্বলন্ত হুতাশন কারো টাখনু পর্যন্ত, কারো হাঁটু পর্যন্ত, কারো কোমর পর্যন্ত আবার কারো মাথা পর্যন্ত পৌঁছবে।[1] কারো দু’পায়ের নিচে আগুনের দু’টি অঙ্গার রাখা হবে, যাতে তার মাথার মগয টগবগ করে ফুটতে থাকবে।[2] কাউকে আবার আগুনের ফিতা সহ দু’খানা জুতা পরিয়ে দেওয়া হবে।[3] এমনিভাবে জাহান্নামে পাপিষ্ঠদের বিভিন্ন আযাব দেওয়া হবে। নিম্নে জাহান্নামে শাস্তি প্রদানের কতিপয় ধরন আলোচনা কর হ’ল।-
ক. আগুনের বেড়ী ও শৃঙ্খল :
জাহান্নামে জাহান্নামীকে প্রবেশ করানোর জন্য সত্তর হাত আগুনের শিকল দিয়ে শৃঙ্খলিত করা হবে এবং তাকে আগুনের ভারী বেড়ী পরিধান করানো হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, خُذُوْهُ فَغُلُّوْهُ، ثُمَّ الْجَحِيْمَ صَلُّوْهُ، ثُمَّ فِيْ سِلْسِلَةٍ ذَرْعُهَا سَبْعُوْنَ ذِرَاعًا فَاسْلُكُوْهُ، إِنَّهُ كَانَ لاَ يُؤْمِنُ بِاللهِ الْعَظِيْمِ، وَلاَ يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِيْنِ. ‘তাকে ধর এবং গলায় বেড়ী পরিয়ে দাও। তারপর জাহান্নামে নিক্ষেপ কর। অতঃপর সত্তর হাত শৃঙ্খল দ্বারা তাকে শৃঙ্খলিত কর। কেননা সে মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল না আর ইয়াতীমদের খাদ্যদানে উৎসাহিত করত না’ (হা-ক্কাহ ৬৯/৩০-৩৪)। এ মর্মে তিনি আরো বলেন, إِذِ الْأَغْلاَلُ فِيْ أَعْنَاقِهِمْ وَالسَّلاَسِلُ يُسْحَبُوْنَ، فِي الْحَمِيْمِ ثُمَّ فِيْ النَّارِ يُسْجَرُوْنَ. ‘যখন তাদের গলদেশে বেড়ী ও শৃঙ্খল থাকবে, তাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হবে ফুটন্ত পানিতে। অতঃপর তাদের দগ্ধ করা হবে অগ্নিতে’ (মুমিন ৪০/৭১-৭২)।
পৃথিবীতে যারা যাকাত আদায় করে না বরং সম্পদ গচ্ছিত করে রাখে ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে বিষাক্ত সাপের বেড়ী পরিধান করানো হবে। এগুলি তাদেরকে ছোবল মারতে থাকবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
مَنْ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ مَالُهُ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَهُ زَبِيبَتَانِ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ يَعْنِى بِشِدْقَيْهِ يَقُوْلُ أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ ثُمَّ تَلاَ هَذِهِ الآيَةَ وَلاَ يَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ يَبْخَلُوْنَ بِمَا آتَاهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلَّهِ مِيْرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌ.
‘যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দিয়েছেন অথচ সে উহার যাকাত আদায় করেনি, ক্বিয়ামতের দিন উক্ত ধন-সম্পদ টাকমাথাওয়ালা এক বিষধর সর্পের আকৃতি ধারণ করবে। যার চোখের উপর দুটি কালো দাগ থাকবে, যা তার গলদেশে পেঁচিয়ে দেওয়া হবে এবং ঐ সাপটি তার দু’চোয়ালে দংশন করে বলবে, আমিই তোমার ধন-সম্পদ, আমিই তোমার গচ্ছিত ধন-সম্পদ। অতঃপর তিনি এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন, ‘আল্লাহ তাদের স্বীয় অনুগ্রহ থেকে যা দিয়েছিলেন তাতে যারা কৃপণতা করে, এ কার্পণ্য তাদের জন্য কল্যাণকর হবে বলে তারা যেন মনে না করে। বরং এটা তাদের জন্য ক্ষতিকর। তারা যে বিষয়ে কার্পণ্য করেছে ক্বিয়ামতের দিন সেই ধন-সম্পদ তাদের গলার বেড়ী হবে। আর আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের একক স্বত্বাধিকারী এবং তোমরা যা করছ তা তিনি পূর্ণ খবর রাখেন’ (আলে-ইমরান ৩/১৮০)।[4]
খ. আগুনের খুঁটিতে বেঁধে রাখা :
জাহান্নামে অসংখ্য অগ্নিনির্মিত লম্বা লম্বা খুঁটি থাকবে। যাতে বিভিন্ন অপরাধীদের অত্যন্ত মযবূত করে বেঁধে রেখে আযাব দেওয়া হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,كَلَّا لَيُنْبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ، وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ، نَارُ اللهِ الْمُوْقَدَةُ، الَّتِيْ تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ، إِنَّهَا عَلَيْهِمْ مُؤْصَدَةٌ، فِيْ عَمَدٍ مُمَدَّدَةٍ. ‘কখনো নয়, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায়। আপনি কি জানেন হুতামা কি? এটি আল্লাহর জ্বলন্ত প্রজ্বলিত আগুন। যা হৃদয়কে গ্রাস করবে। নিশ্চয়ই তা তাদের আবদ্ধ করে রাখবে লম্বা লম্বা স্তম্ভসমূহে’ (হুমাযাহ ১০৪/৪-৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, فَيَوْمَئِذٍ لاَ يُعَذِّبُ عَذَابَهُ أَحَدٌ، وَلاَ يُوْثِقُ وَثَاقَهُ أَحَدٌ ‘সেদিন তাঁর আযাবের ন্যায় কেউ আযাব দিতে পারবে না এবং তাঁর বন্ধনের মতো কেউ বাঁধতে পারবে না’ (ফাজর ৮৯/২৫-২৬)।
গ. বিষাক্ত সাপ ও বিচ্ছুর দংশন :
জাহান্নামে অসংখ্য বিষাক্ত সাপ ও বিচ্ছু থাকবে। সেখানের সাপ ও বিচ্ছুর আকৃতি হবে উট ও খচ্চরের সমান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ فِي النَّارِ حَيَّاتٍ كَأَمْثَالِ أَعْنَاقِ الْبُخْتِ تَلْسَعُ إِحْدَاهُنَّ اللَّسْعَةَ فَيَجِدُ حَمْوَتَهَا أَرْبَعِيْنَ خَرِيْفًا وَإِنَّ فِي النَّارِ عَقَارِبَ كَأَمْثَالِ الْبِغَالِ الْمُوْكَفَةِ تَلْسَعُ إِحْدَاهُنَّ اللَّسْعَةَ فَيَجِدُ حَمْوَتَهَا أَرْبَعِيْنَ سَنَةً.
‘জাহান্নামের সাপগুলো বুখতী নামক উটের ন্যায় হবে। এর একটি সাপের দংশনের বিষক্রিয়া জাহান্নামী চল্লিশ বছর পর্যন্ত অনুভব করবে। আর জাহান্নামের বিচ্ছু খচ্চরের সমান হবে। এর একটি বিচ্ছুর দংশনের বিষক্রিয়া জাহান্নামী চল্লিশ বছর অনুভব করবে’।[5]
ঘ. উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া :
আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতাগণ কাফেরদেরকে উল্টো করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। এমতাবস্থায় তারা অন্ধ, মূক ও বধির হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّ الْمُجْرِمِيْنَ فِيْ ضَلاَلٍ وَسُعُرٍ، يَوْمَ يُسْحَبُوْنَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوْهِهِمْ ذُوْقُوْا مَسَّ سَقَرَ. ‘নিশ্চয়ই অপরাধীরা বিভ্রান্ত ও বিকারগ্রস্ত। যেদিন তাদেরকে উপুড় অবস্থায় মুখের উপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে, সেদিন বলা হবে, জাহান্নামের যন্ত্রণা আস্বাদন কর’ (ক্বামার ৫৪/৪৭-৪৮)। অন্যত্র তিনি আরো বলেন, وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى وُجُوْهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمًّا، مَّأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ، كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيْرًا. ‘ক্বিয়ামতের দিন আমি তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখের উপর ভর দিয়ে চলা অবস্থায় অন্ধ, মূক ও বধির করে। আর তাদের আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। যখনই তা স্তিমিত হওয়ার উপক্রম হবে, তখনই তাদের জন্য অগ্নিশিখা বৃদ্ধি করে দেব’ (বনী ইসরাঈল ১৭/ ৯৭)।
সেদিন পাপিষ্ঠদের পা ও মাথার ঝুঁটি ধরে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। বাধা দেওয়ার মত কেউ থাকবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يُعْرَفُ الْمُجْرِمُوْنَ بِسِيْمَاهُمْ فَيُؤْخَذُ بِالنَّوَاصِي وَالْأَقْدَامِ ‘সেদিন অপরাধীদের চেনা যাবে তাদের (মলিন) চেহারা দেখে। তাদেরকে সেখানে পাকড়াও করা হবে তাদের পা ও মাথার ঝুঁটি ধরে’ (আর-রহমান ৫৫/৪১)। তিনি আরো বলেন, كَلَّا لَئِنْ لَمْ يَنْتَهِ لَنَسْفَعًا بِالنَّاصِيَةِ، نَاصِيَةٍ كَاذِبَةٍ خَاطِئَةٍ ‘(আবু জাহালকে লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেন) সাবধান! সে যদি বিরত না হয় তবে অবশ্যই আমি তাকে হিঁচড়ে নিয়ে যাব, মস্তকের সম্মুখ ভাগের কেশগুচ্ছ ধরে- মিথ্যাচারী, পাপিষ্ঠের কেশগুচ্ছ’ (‘আলাক্ব ৯৬/১৫-১৬)। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ t أَنَّ رَجُلاً قَالَ يَا نَبِىَّ اللَّهِ r يُحْشَرُ الْكَافِرُ عَلَى وَجْهِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ أَلَيْسَ الَّذِى أَمْشَاهُ عَلَى الرِّجْلَيْنِ فِى الدُّنْيَا قَادِرًا عَلَى أَنْ يُمْشِيَهُ عَلَى وَجْهِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর নবী (ছাঃ)! মুখের উপর ভর করে কাফিরদেরকে কিভাবে ক্বিয়ামতের দিন উঠানো হবে? উত্তরে তিনি বললেন, দুনিয়াতে যে সত্তা দু’পায়ের উপর হাঁটান, তিনি কি ক্বিয়ামতের দিন মুখের উপর ভর করে হাঁটাতে সক্ষম নন?[6]
ঙ. লোহার হাতুড়ি দ্বারা আঘাত :
জাহান্নামে কাফেরদের ভারী হাতুড়ির আঘাতের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হবে। এতে তার মাথা দলিত-মথিত হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَهُمْ مَقَامِعُ مِنْ حَدِيْدٍ، كُلَّمَا أَرَادُوْا أَنْ يَخْرُجُوْا مِنْهَا مِنْ غَمٍّ أُعِيْدُوْا فِيْهَا وَذُوْقُوْا عَذَابَ الْحَرِيْقِ. ‘আর তাদের জন্য থাকবে লৌহ নির্মিত (ভারী) হাতুড়িসমূহ। যখনই তারা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে জাহান্নাম থেকে বের হ’তে চাইবে, তখনই তাদেরকে সেখানে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং বলা হবে, আস্বাদন কর দহন যন্ত্রণা’ (হজ্জ ২২/২১-২২)।
কবরে মৃত ব্যক্তিকে রাখার পর ফেরেশতা কর্তৃক প্রশ্নোত্তর সংক্রান্ত হাদীছে কাফির-মুনাফিকদের যে শাস্তির বিবরণ পেশ করা হয়েছে সেখানেও তাকে হাতুড়ি দিয়ে শাস্তির বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। যেমন-
عَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ t عَنْ رَسُوْلِ اللهِ r قَال…فَيُنَادِيْ مُنَادٍ مِنَ السَّمَاءِ اَنْ كَذَبَ فَاَفْرِشُوْهُ مِنَ النَّارِ وَاَلْبِسُوْهُ مِنَ النَّارِ وَافْتَحُوْا لَهُ بَابًا إِلَى النَّارِ قَالَ فَيَأْتِيْهِ مِنْ حَرِّهَا وَسَمُوْمِهَا قَالَ وَيُضَيِّقُ عَلَيْهَ قَبْرُهُ حَتَّي يَخْتَلِفَ فِيْهِ اَضْلَاعُهُ ثُمَّ يُقَيِّضُ لَهُ اَعْمَي اَصَمُّ مَعَهُ مِرْزَبَةٌ مِنْ حَدِيْدٍ لَوْ ضُرِبَ بِهَا جَبَلٌ لَصَارَ تُرَابًا فَيُضْرَبُهُ بِهَا ضَرْبَةً يَسْمَعُهَا مَا بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ اِلَّا الثَّقَلَيْنِ فَيَصِيْرُ تُرَابًا ثُمَّ يُعَادُ فِيْهِ الرُّوْحُ.
বারা ইবনে আযেব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,…(কাফির ব্যক্তিকে কবরে কৃত প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারায়) আকাশ থেকে একজন আহবানকারী বলেন, সে মিথ্যা বলেছে। তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে জাহান্নামের পোশাক পরিয়ে দাও। তারপর তার জন্য জাহান্নামের দিকে একটি দরজা খুলে দাও। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, তখন তার দিকে জাহান্নামের গরম হাওয়া আসতে থাকে। কবরকে তার জন্য এত সংকীর্ণ করে দেয়া হয় যাতে তার এক দিকের পাঁজর অপর দিকের পাঁজরের মধ্যে ঢুকে যায়। অতঃপর তার জন্য একজন অন্ধ ও বধির ফেরেশতাকে নিযুক্ত করা হয়, যার সাথে একটি লোহার হাতুড়ি থাকে। যদি এই হাতুড়ি দ্বারা কোন পাহাড়কে আঘাত করা হয়, তাহ’লে সেটি ধূলিকণায় পরিণত হয়ে যাবে। সেই ফেরেশতা এ হাতুড়ি দ্বারা আঘাত করেন, আর সে আঘাতের চোটে এত বিকট চিৎকার করে যে, মানুষ ও জিন ব্যতীত পৃথিবীর সব কিছুই শুনতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে সে মাটির সাথে মিশে যায়। তারপর আবার তার দেহে আত্মা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে তার শাস্তি চলতে থাকে’।[7]
চ. মুখমন্ডল বিদগ্ধকরণ :
জাহান্নামে জাহান্নামীদের মুখমন্ডল ওলট-পালট করে দগ্ধিভূত করা হবে। তাদের চেহারাকে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা আবৃত করে রাখবে এবং আলকাতরা সদৃশ কালো জামা পরিধান করানো হবে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوْهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُوْلُوْنَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُوْلاَ ‘যেদিন তাদের মুখমন্ডল জাহান্নামের আগুনে ওলট-পালট করা হবে, সেদিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অনুসরণ করতাম’ (আহযাব ৩৩/৬৬)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَتَرَى الْمُجْرِمِيْنَ يَوْمَئِذٍ مُقَرَّنِيْنَ فِيْ الْأَصْفَادِ، سَرَابِيْلُهُمْ مِنْ قَطِرَانٍ وَتَغْشَى وُجُوْهَهُمُ النَّارُ. ‘সেদিন তুমি অপরাধীদের দেখবে শৃঙ্খলিত অবস্থায়, তাদের জামা হবে আলকাতরার এবং আগুন দগ্ধিভূত করবে তাদের মুখমন্ডলকে’ (ইবরাহীম ১৪/৪৯-৫০)। যাহ্হাক (রহঃ) বলেন, জাহান্নাম এমন একটি ভয়ংকর আবাসস্থল যেখানে সকল কিছু কৃষ্ণবর্ণের হবে। তার পানি হবে কালো, তার গাছ হবে কালো এমনকি তার অধিবাসীরাও হবে কৃষ্ণবর্ণের।[8]
জাহান্নামে কাফেরদের মুখমন্ডল যখন কঠিন আযাবে পতিত হবে, তখন তারা তাদের সুন্দর মুখমন্ডলকে আগুন থেকে রক্ষা করার ব্যর্থ চেষ্টা করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَفَمَنْ يَتَّقِيْ بِوَجْهِهِ سُوْءَ الْعَذَابِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَقِيْلَ لِلظَّالِمِيْنَ ذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْسِبُوْنَ ‘যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন তার মুখমন্ডল দ্বারা কঠিন আযাব ঠেকাতে চাইবে, (সে কি তার মতো যে নিরাপদ?) অতঃপর যালেমদের বলা হবে, তোমরা যা অর্জন করতে তার আযাব আস্বাদন কর’ (যুমার ৩৯/২৪)। অন্যত্র তিনি বলেন, لَوْ يَعْلَمُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا حِيْنَ لاَ يَكُفُّوْنَ عَنْ وُجُوْهِهِمُ النَّارَ وَلاَ عَنْ ظُهُوْرِهِمْ وَلاَ هُمْ يُنْصَرُوْنَ ‘হায় আফসোস! কাফেররা যদি সেই সময়ের কথা জানতে পারত যেদিন তারা জাহান্নামের অগ্নিশিখা সম্মুখ ও পশ্চাৎ দিক থেকে প্রতিরোধ করতে পারবে না এবং তাদেরকে (একাজে) কোন সাহায্যও করা হবে না’ (আম্বিয়া ২১/৩৯)। এছাড়া জাহান্নামে বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্য বৃদ্ধিকরণ, তীব্র তৃষ্ণা, কৃষ্ণকায় আগুনের গভীর অন্ধকার ও সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ, তীব্র ঠান্ডা, আগুনের পাহাড়ে চড়ানো প্রভৃতির মাধ্যমে জাহান্নামীদের শাস্তি প্রদান করা হবে।
জাহান্নামীদের কথোপকথন :
জাহান্নামবাসীরা জাহান্নামের আযাবের তীব্রতা ও প্রখরতা থেকে পরিত্রাণের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা করবে। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা সর্বদা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। সে সময় তারা কখনো আল্লাহর সাথে, কখনো জাহান্নামের প্রহরীদের সাথে, কখনো পৃথিবীতে তাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে, কখনো দুনিয়ার রাজনৈতিক নেতাদের সাথে, আবার কখনো জান্নাতবাসীদের সাথে জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য কথোপকথন করবে। সেদিন তাদের এসব কথোপকথন কোন কাজে আসবে না। থাকবে না কোন সাহায্যকারী বন্ধু। নিম্নে জাহান্নামীদের কথোপকথনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপস্থাপন করা হ’ল।-
ক. আল্লাহর সাথে কাফেরদের কথোপকথন :
জাহান্নামীরা যখন আল্লাহর নিকটে জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য আবেদন করবে, তখন আল্লাহ ও তাদের মাঝে যে কথোপকথন হবে তা নিম্নরূপ-
‘তোমাদের নিকট কি আমার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করা হ’ত না, অথচ তোমরা ওগুলো অস্বীকার করতে? তখন তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! দুর্ভাগ্য আমাদেরকে পেয়ে বসেছিল এবং আমরা ছিলাম এক পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়। (তারা বলবে) হে আমাদের প্রতিপালক! এই আগুন হ’তে আমাদেরকে রক্ষা করুন, অতঃপর আমরা যদি পুনরায় কুফরী করি তাহ’লে আমরা অবশ্যই সীমালংঘনকারী হব। আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা হীন অবস্থায় এখানেই থাক এবং আমার সাথে কোন কথা বলো না। আমার বান্দাদের মধ্যে একদল ছিল যারা বলত, হে আমাদের প্রভু! আমরা ঈমান এনেছি, সুতরাং আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন এবং আমাদের উপর দয়া করুন, আপনি তো দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু। কিন্তু তাদেরকে নিয়ে তোমরা এত ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে যে, তা তোমাদেরকে আমার কথা ভুলিয়ে দিয়েছিল। বস্ত্ততঃ তোমরা তো তাদেরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টাই করতে। আমি আজ তাদেরকে তাদের ধৈর্যের কারণে এমনভাবে পুরস্কৃত করলাম যে, তারাই হ’ল সফলকাম। আল্লাহ বলবেন, তোমরা পৃথিবীতে কত বছর অবস্থান করেছিলে? তারা বলবে, আমরা অবস্থান করেছিলাম একদিন অথবা একদিনের কিয়দংশ, আপনি না হয় গণনাকারীদের জিজ্ঞেস করুন! তিনি বলবেন, তোমরা অল্পকালই অবস্থান করেছিলে, যদি তোমরা জানতে। তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না?’ (মুমিনূন ২৩/১০৫-১১৫)।
অন্যত্র আরো বর্ণিত হয়েছে, وَلَوْ تَرَى إِذْ وُقِفُوْا عَلَى رَبِّهِمْ قَالَ أَلَيْسَ هَذَا بِالْحَقِّ قَالُوْا بَلَى وَرَبِّنَا قَالَ فَذُوْقُوْا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُوْنَ. ‘হায়! তুমি যদি দেখতে যখন তাদের প্রভুর সামনে দন্ডায়মান করা হবে। তখন আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, ক্বিয়ামত কি সত্য নয়? উত্তরে (জাহান্নামীরা) বলবে, হে আমাদের প্রভু! আমরা আমাদের প্রতিপালকের শপথ করে বলছি, এটা বাস্তব সত্য বিষয়। তখন আল্লাহ বলবেন, তবে তোমরা এটাকে অস্বীকার করার ফলস্বরূপ শাস্তি আস্বাদন কর’ (আন‘আম ৬/৩০)। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَدِىِّ بْنِ حَاتِمٍ t يَقُوْلُ كُنْتُ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ r فَجَاءَهُ رَجُلاَنِ أَحَدُهُمَا يَشْكُو الْعَيْلَةَ وَالآخَرُ يَشْكُوْ قَطْعَ السَّبِيْلِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ r أَمَّا قَطْعُ السَّبِيْلِ فَإِنَّهُ لاَ يَأْتِىْ عَلَيْكَ إِلاَّ قَلِيْلٌ حَتَّى تَخْرُجَ الْعِيْرُ إِلَى مَكَّةَ بِغَيْرِ خَفِيْرٍ وَأَمَّا الْعَيْلَةُ فَإِنَّ السَّاعَةَ لاَ تَقُوْمُ حَتَّى يَطُوْفَ أَحَدُكُمْ بِصَدَقَتِهِ لاَ يَجِدُ مَنْ يَقْبَلُهَا مِنْهُ، ثُمَّ لَيَقِفَنَّ أَحَدُكُمْ بَيْنَ يَدَىِ اللهِ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهُ حِجَابٌ وَلاَ تَرْجُمَانٌ يُتَرْجِمُ لَهُ ثُمَّ لَيَقُوْلَنَّ لَهُ أَلَمْ أُوْتِكَ مَالاً فَلَيَقُوْلَنَّ بَلَى ثُمَّ لَيَقُوْلَنَّ أَلَمْ أُرْسِلْ إِلَيْكَ رَسُوْلاً فَلَيَقُوْلَنَّ بَلَى فَيَنْظُرُ عَنْ يَمِيْنِهِ فَلاَ يَرَى إِلاَّ النَّارَ ثُمَّ يَنْظُرُ عَنْ شِمَالِهِ فَلاَ يَرَى إِلاَّ النَّارَ فَلْيَتَّقِيَنَّ أَحَدُكُمُ النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ فَإِنْ لَمْ يَجِدْ فَبِكَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ.
আদী ইবনু হাতিম (রাঃ) বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে ছিলাম। এমতাবস্থায় দু’জন লোক আগমন করল। তাদের একজন দারিদ্রে্যর অভিযোগ করল এবং অপরজন রাহাজানির অভিযোগ করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বললেন, রাহাজানির অবস্থা এই যে, কিছুদিন পর এমন সময় আসবে যখন এটা অতি সামান্যই থাকবে, এমনকি কোন কাফেলা মক্কায় বিনা পাহারায় পৌঁছে যাবে। আর দারিদ্রে্যর অবস্থা এই যে, তোমাদের কেউ ছাদাক্বা নিয়ে ঘুরাফেরা করবে কিন্তু তা গ্রহণ করার মত কাউকে পাবে না। এমন সময় না আসা পর্যন্ত ক্বিয়ামতও কায়েম হবে না। তোমাদের মধ্যে কেউ ক্বিয়ামতের দিন এমনভাবে দাঁড়াবে যে, তার ও আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকবে না। থাকবে না কোন অনুবাদকও। অতঃপর তিনি বলবেন, আমি কি তোমাকে সম্পদ দান করিনি? সে অবশ্যই বলবে, হ্যাঁ। এরপর তিনি বলবেন, আমি কি তোমার নিকটে রাসূল প্রেরণ করিনি? সে অবশ্যই বলবে, হ্যাঁ। তখন সে ব্যক্তি ডান দিকে তাকিয়ে শুধু আগুন দেখতে পাবে, তেমনিভাবে বাম দিকে তাকিয়েও আগুন দেখতে পাবে। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকের উচিত, এক টুকরা খেজুর (ছাদাকা) দিয়ে হলেও আগুন হ’তে আত্মরক্ষা করা। কেউ যদি তাও না পায় তবে সে যেন উত্তম কথা দিয়ে হ’লেও (আগুন থেকে আত্মরক্ষা করে)’।[9]
খ. জাহান্নামের প্রহরীদের সাথে কাফেরদের কথোপকথন :
জাহান্নাম হাশরের মাঠে কাফেরদের দেখে ক্রোধে ফেটে পড়বে। সে দূর থেকে যখন কাফেরদের দেখবে, তখন তারা তার ক্রুদ্ধ গর্জন ও ভয়ংকর চিৎকার শুনতে পাবে। যখন তাদেরকে জাহান্নামের নিকট উপস্থিত করা হবে তখন তার প্রবেশদারগুলো খুলে দেওয়া হবে। অতঃপর তার প্রহরীরা কাফেরদের সাথে কথা বলবে। মহান আল্লাহ বলেন,
تَكَادُ تَمَيَّزُ مِنَ الْغَيْظِ كُلَّمَا أُلْقِيَ فِيْهَا فَوْجٌ سَأَلَهُمْ خَزَنَتُهَا أَلَمْ يَأْتِكُمْ نَذِيْرٌ، قَالُوْا بَلَى قَدْ جَاءَنَا نَذِيْرٌ فَكَذَّبْنَا وَقُلْنَا مَا نَزَّلَ اللهُ مِنْ شَيْءٍ إِنْ أَنْتُمْ إِلَّا فِيْ ضَلاَلٍ كَبِيْرٍ، وَقَالُوْا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِيْ أَصْحَابِ السَّعِيْرِ، فَاعْتَرَفُوْا بِذَنْبِهِمْ فَسُحْقًا لِأَصْحَابِ السَّعِيْرِ.
‘ক্রোধে জাহান্নাম যেন ফেটে পড়বে, যখনই তাতে কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে, (জাহান্নামের) রক্ষীরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে, তোমাদের নিকট কি কোন সতর্ককারী আসেনি? তারা বলবে, অবশ্যই আমাদের নিকট সতর্ককারী এসেছিল। আমরা তাদেরকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছিলাম এবং বলেছিলাম, আল্লাহ কিছুই অবতীর্ণ করেননি। তোমরা তো স্পষ্টতঃ মহাভ্রান্তিতে রয়েছ। তারা আরো বলবে, আমরা যদি শুনতাম এবং বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতাম, তাহ’লে আমরা জাহান্নামবাসী হ’তাম না। তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করবে, অভিশাপ জাহান্নামীদের জন্য!’ (মুলক ৬৭/৮-১১)। এ মর্মে অন্যত্র বলা হয়েছে,
وَسِيْقَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا إِلَى جَهَنَّمَ زُمَرًا حَتَّى إِذَا جَاءُوْهَا فُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِنْكُمْ يَتْلُوْنَ عَلَيْكُمْ آيَاتِ رَبِّكُمْ وَيُنْذِرُوْنَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَذَا قَالُوْا بَلَى وَلَكِنْ حَقَّتْ كَلِمَةُ الْعَذَابِ عَلَى الْكَافِرِيْنَ، قِيْلَ ادْخُلُوْا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِيْنَ فِيْهَا فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِيْنَ.
‘কাফেরদের জাহান্নামের দিকে দলে দলে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা জাহান্নামের নিকট উপস্থিত হবে তখন তার প্রবেশদ্বারগুলো খুলে দেওয়া হবে। আর জাহান্নামের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতি কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আসেনি? যারা তোমাদের প্রতিপালকের আয়াত তেলাওয়াত করত এবং তোমাদের এ দিনের সাক্ষাৎ সম্পর্কে সাবধান করত। তখন তারা বলবে, অবশ্যই এসেছিল। বস্ত্তত কাফেরদের প্রতি শাস্তির কথা বাস্তবায়িত হয়েছে। তাদের বলা হবে, জাহান্নামের দ্বারসমূহে প্রবেশ করো তাতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য। আর কতই না নিকৃষ্ট উদ্ধতদের আবাসস্থল’ (যুমার ৩৯/৭১-৭২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَقَالَ الَّذِيْنَ فِي النَّارِ لِخَزَنَةِ جَهَنَّمَ ادْعُوْا رَبَّكُمْ يُخَفِّفْ عَنَّا يَوْمًا مِنَ الْعَذَابِ، قَالُوْا أَوَلَمْ تَكُ تَأْتِيْكُمْ رُسُلُكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوْا بَلَى قَالُوْا فَادْعُوْا وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِيْنَ إِلَّا فِيْ ضَلاَلٍ.
‘আর যারা জাহান্নামে থাকবে তারা জাহান্নামের দারোয়ানদেরকে বলবে, তোমাদের রবকে একটু ডাক না! তিনি যেন একটি দিন আমাদের আযাব লাঘব করে দেন। তারা বলবে, তোমাদের নিকট কি সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ তোমাদের রাসূলগণ আসেননি? জাহান্নামীরা বলবে, হ্যঁা অবশ্যই। দারোয়ানরা বলবে, তবে তোমরাই দো‘আ কর। আর কাফিরদের প্রার্থনা কেবল নিষ্ফলই হয়’ (মুমিন ৪০/৪৯-৫০)।
গ. পৃথিবীর অনুসরণীয় ব্যক্তি ও অনুসরণকারীদের মাঝে কথোপকথন :
দুনিয়াতে ছোট হোক বা বড় হোক সকল অনুসৃত ব্যক্তি এবং তার অনুসারীদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। জাহান্নামের আগুনের তীব্রতা এবং আযাবের ভয়াবহতা দেখে জাহান্নামে প্রবেশের জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করবে। অনুসারীরা অনুসৃত ব্যক্তির কাছে জাহান্নামের আগুনের আযাব থেকে পরিত্রাণ চাইবে। কিন্তু তাদের সেদিন কোন কিছুই করার ক্ষমতা থাকবে না। এমতাবস্থায় তাদের মাঝে চরম তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হবে। যা আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন এভাবে-
هَذَا فَوْجٌ مُقْتَحِمٌ مَعَكُمْ لاَ مَرْحَبًا بِهِمْ إِنَّهُمْ صَالُوْ النَّارِ، قَالُوْا بَلْ أَنْتُمْ لاَ مَرْحَبًا بِكُمْ أَنْتُمْ قَدَّمْتُمُوْهُ لَنَا فَبِئْسَ الْقَرَارُ، قَالُوْا رَبَّنَا مَنْ قَدَّمَ لَنَا هَذَا فَزِدْهُ عَذَابًا ضِعْفًا فِي النَّارِ.
‘এ এক বাহিনী, তোমাদের সাথে (জাহান্নামে) প্রবেশকারী। তাদের জন্য নেই কোন অভিনন্দন। বরং তারা জাহান্নামে জ্বলবে। (তখন অনুসারীরা) বলবে, বরং তোমরাও তো (জাহান্নামী), তোমাদের জন্যও কোন অভিনন্দন নেই। তোমরাই তো পূর্বে আমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছ। কত নিকৃষ্ট এ আবাসস্থল। তারা বলবে, হে আমাদের প্রভু! এটা যে আমাদের সম্মুখীন করেছে, জাহান্নামে তার শাস্তি দ্বিগুণ বর্ধিত করুন’ (ছোয়াদ ৩৮/৫৯-৬১)। অন্যত্র তিনি আরো বলেন,
وَإِذْ يَتَحَاجُّوْنَ فِي النَّارِ فَيَقُوْلُ الضُّعَفَاءُ لِلَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْا إِنَّا كُنَّا لَكُمْ تَبَعًا فَهَلْ أَنْتُمْ مُغْنُوْنَ عَنَّا نَصِيْبًا مِنَ النَّارِ، قَالَ الَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْا إِنَّا كُلٌّ فِيْهَا إِنَّ اللهَ قَدْ حَكَمَ بَيْنَ الْعِبَادِ.
‘যখন তারা জাহান্নামে পরস্পরে বিতর্কে লিপ্ত হবে, তখন দুর্বলেরা অহংকারীদেরকে বলবে, আমরা তো তোমাদেরই অনুসারী ছিলাম। এখন কি তোমরা আমাদের থেকে জাহান্নামের (আযাবের) কিছু নিবারণ করবে? অহংকারীরা বলবে, আমরা তো সবাই জাহান্নামে আছি। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের বিচার করে ফেলেছেন’ (মুমিন ৪৭/৪৮)।
পৃথিবীতে যারা মূর্খ ও পথভ্রষ্ট আলেম এবং তাদের যারা অনুসারী ছিল জাহানণামে তারা পরস্পরে তর্ক-বিতর্ক করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُوْنَ، قَالُوْا إِنَّكُمْ كُنْتُمْ تَأْتُوْنَنَا عَنِ الْيَمِيْنِ، قَالُوْا بَلْ لَمْ تَكُوْنُوْا مُؤْمِنِيْنَ، وَمَا كَانَ لَنَا عَلَيْكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ بَلْ كُنْتُمْ قَوْمًا طَاغِيْنَ، فَحَقَّ عَلَيْنَا قَوْلُ رَبِّنَا إِنَّا لَذَائِقُوْنَ، فَأَغْوَيْنَاكُمْ إِنَّا كُنَّا غَاوِيْنَ، فَإِنَّهُمْ يَوْمَئِذٍ فِي الْعَذَابِ مُشْتَرِكُوْنَ.
‘আর তারা একে অপরের মুখোমুখি হ’য়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তারা বলবে, তোমরা তো আমাদের ডান দিক থেকে আসতে। তারা বলবে, বরং তোমরাতো বিশ্বাসী ছিলে না এবং তোমাদের উপর আমাদের কোন কর্তৃত্বও ছিল না। বস্ত্ততঃ তোমরাই ছিলে সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়। আমাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিপালকের কথা সত্য হয়েছে। আমাদেরকে অবশ্যই শাস্তি আস্বাদন করতে হবে। আমরা তোমাদের বিভ্রান্ত করেছিলাম, কারণ আমরা নিজেরাই বিভ্রান্ত ছিলাম। সুতরাং তারা সকলেই সেইদিন শাস্তিতে শরীক হবে’ (ছা-ফফাত ৩৭/২৭-৩৩)।
ঘ. রাজনৈতিক নেতা ও তাদের অনুসারীদের মাঝে কথোপকথন :
রাজনীতি ও সমাজনীতির নামে যারা আল্লাহর আইনের বিরোধিতা করে এবং সমাজে সংঘাত-সহিংসতা বৃদ্ধির জন্য গুপ্ত ক্যাডার বাহিনী পরিচালনা করে, ক্বিয়ামাতের দিন তাদের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ এবং কঠিন হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَقَالُوْا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلاَ، رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيْرًا.
‘আর তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় লোকদের অনুসরণ করেছিলাম এবং তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের প্রভু! তাদের দ্বিগুণ আযাব প্রদান করুন এবং তাদের উপর মহা লা‘নত বর্ষণ করুন’ (আহযাব ৩৩/৬৭-৬৮)। এ মর্মে আরো বলা হয়েছে,
يَقُوْلُ الَّذِيْنَ اسْتُضْعِفُوْا لِلَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْا لَوْلاَ أَنْتُمْ لَكُنَّا مُؤْمِنِيْنَ، قَالَ الَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْا لِلَّذِيْنَ اسْتُضْعِفُوْا أَنَحْنُ صَدَدْنَاكُمْ عَنِ الْهُدَى بَعْدَ إِذْ جَاءَكُمْ بَلْ كُنْتُمْ مُجْرِمِيْنَ، وَقَالَ الَّذِيْنَ اسْتُضْعِفُوْا لِلَّذِيْنَ اسْتَكْبَرُوْا بَلْ مَكْرُ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ إِذْ تَأْمُرُوْنَنَا أَنْ نَكْفُرَ بِاللهِ وَنَجْعَلَ لَهُ أَنْدَادًا وَأَسَرُّوْا النَّدَامَةَ لَمَّا رَأَوُا الْعَذَابَ وَجَعَلْنَا الْأَغْلاَلَ فِيْ أَعْنَاقِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا هَلْ يُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ.
‘দুর্বলরা ক্ষমতাদর্পীদেরকে বলবে, তোমরা না থাকলে আমরা অবশ্যই মুমিন হ’তাম। অতঃপর ক্ষমতাদর্পীরা দুর্বলদের বলবে, তোমাদের নিকট সৎপথের দিশা আসার পরেও আমরা কি তোমাদেরকে ওটা হ’তে নিবৃত করেছিলাম? বস্ত্ততঃ তোমরাই তো ছিলে অপরাধী। অতঃপর দুর্বল লোকেরা পুনরায় বলবে, বরং প্রকৃতপক্ষে তোমরাই তো রাত-দিনে চক্রান্তে লিপ্ত ছিলে, আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলে যেন আমরা আল্লাহকে অমান্য করি এবং তাঁর শরীক স্থাপন করি। যখন তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন তারা অনুতাপ গোপন রাখবে এবং আমি কাফেরদের গলায় শৃঙ্খল পরিয়ে দেব। সুতরাং তাদেরকে (দুর্বলদেরকে) তারা (ক্ষমতাদর্পীরা) যা করতো তারই প্রতিফল দেওয়া হবে’ (সাবা ৩৪/৩১-৩৩)।
ঙ. জান্নাতী ও জাহান্নামীদের মাঝে কথোপকথন :
জাহান্নামীরা দুনিয়ায় যে সমস্ত মুমিনদের সাথে বসবাস করত জাহান্নামের ভয়ংকর আগুনের লেলিহান শিখা থেকে মুক্তির জন্য তারা তাদের নিকটে প্রার্থনা করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَوْمَ يَقُوْلُ الْمُنَافِقُوْنَ وَالْمُنَافِقَاتُ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا انْظُرُوْنَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُوْرِكُمْ قِيْلَ ارْجِعُوْا وَرَاءَكُمْ فَالْتَمِسُوْا نُوْرًا فَضُرِبَ بَيْنَهُمْ بِسُوْرٍ لَهُ بَابٌ بَاطِنُهُ فِيْهِ الرَّحْمَةُ وَظَاهِرُهُ مِنْ قِبَلِهِ الْعَذَابُ، يُنَادُوْنَهُمْ أَلَمْ نَكُنْ مَعَكُمْ قَالُوْا بَلَى وَلَكِنَّكُمْ فَتَنْتُمْ أَنْفُسَكُمْ وَتَرَبَّصْتُمْ وَارْتَبْتُمْ وَغَرَّتْكُمُ الْأَمَانِيُّ حَتَّى جَاءَ أَمْرُ اللهِ وَغَرَّكُمْ بِاللهِ الْغَرُوْرُ.
‘সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মুমিনদের বলবে, তোমরা আমাদের জন্য একটু থাম। যেন আমরা তোমাদের জ্যোতির কিছু অংশ গ্রহণ করতে পারি। বলা হবে, তোমরা তোমাদের পিছনে ফিরে যাও এবং আলো তালাশ কর। অতঃপর উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর। সেখানে একটি দরজা থাকবে, যার অভ্যন্তরে থাকবে রহমত ও বহির্ভাগে থাকবে আযাব। মুনাফিক্বরা মুমিনদের ডেকে বলবে, আমরা কি পৃথিবীতে তোমাদের সাথে ছিলাম না? তারা বলবে, হ্যাঁ, তবে তোমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছ। তোমরা প্রতীক্ষা করেছিলে, সন্দেহ পোষণ করেছিলে এবং অলীক আকাঙ্খা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল আল্লাহর হুকুম (মৃত্যু) আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের ধোঁকা দিয়েছিল এক মহা প্রতারক’ (শয়তান) (হাদীদ ৫৭/১৩-১৪)।
জাহান্নামে ইবলীস শয়তানের বক্তব্য :
দুনিয়াতে যারা শয়তানী প্ররোচনায় জড়িয়ে ছিল অর্থাৎ যারা ইবলীসের অনুসরণ ও উপাসনা করত জাহান্নামে প্রবেশের পর তাদের লক্ষ্য করে ইবলীস একটি বক্তব্য দিবে। যেখানে সে তার অনুসারী পাপিষ্ঠদের ভৎর্সনা করবে। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَقَالَ الشَّيْطَانُ لَمَّا قُضِيَ الْأَمْرُ إِنَّ اللهَ وَعَدَكُمْ وَعْدَ الْحَقِّ وَوَعَدْتُكُمْ فَأَخْلَفْتُكُمْ وَمَا كَانَ لِيَ عَلَيْكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ إِلَّا أَنْ دَعَوْتُكُمْ فَاسْتَجَبْتُمْ لِي فَلاَ تَلُوْمُوْنِيْ وَلُوْمُوْا أَنْفُسَكُمْ مَا أَنَا بِمُصْرِخِكُمْ وَمَا أَنْتُمْ بِمُصْرِخِيَّ إِنِّي كَفَرْتُ بِمَا أَشْرَكْتُمُوْنِ مِنْ قَبْلُ إِنَّ الظَّالِمِيْنَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ .
‘যখন সবকিছুই মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান (তার অনুসারীদের) বলবে, আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি। আমিও তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। তবে আমি তোমাদের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। আমার তো তোমাদের উপর কোন ক্ষমতা ছিল না। আমি শুধুমাত্র তোমাদের আহবান করেছিলাম। আর তোমরা আমার আহবানে সাড়া দিয়েছিলে। কাজেই তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ কর না। তোমরা তোমাদের প্রতিই দোষারোপ কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমাকে উদ্ধার করতে সক্ষম নও। তোমরা যে পূর্বে আমাকে আল্লাহর শরীক সাব্যস্ত করেছিলে, তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। যালিমদের জন্য তো বেদনাদায়ক শাস্তি রয়েছে’ (ইবরাহীম ১৪/২২)।
[চলবে]
[1]. মুসলিম হা/৭৩৪৯।
[2]. বুখারী হা/৬৫৬২।
[3]. মুসলিম হা/৫৩৯; মিশকাত হা/৫৪২৩।
[4]. বুখারী হা/১৪০৩, ৪৫৬৫; নাসাঈ হা/২৪৮২; মিশকাত হা/১৭৭৪।
[5]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৭৪৯; মিশকাত হা/৫৬৯১; ইবনু হিববান হা/৭৪৭১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৪২৯।
[6]. ছহীহ বুখারী হা/৪৭৬০, ৬৫২৩; মিশকাত হা/৫৫৩৭।
[7]. আবুদাঊদ হা/৪৭৫৩; আহমাদ হা/১৮৫৫৭; মিশকাত হা/১৩১; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব ৩/২১৯ পৃঃ, হাদীছ ছহীহ।
[8]. তাফসীরে কুরতুবী ১০/৩৯৪ পৃঃ ‘সূরা কাহফ-এর ব্যাখ্যা দৃষ্টব্য।
[9]. বুখারী হা/১৪১৩ ‘যাকাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৪; ইবনু হিববান হা/৭৩৭৪।