দেবী উপাখ্যান: সেকাল-একাল
আমার মেয়ের স্কুল কারিকুলামে এই বছর একটি সাবজেক্ট যুক্ত হয়েছে, World Ancient Culture। যারা সাইন্সে মেজর করতে চায় তাদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক সাবজেক্ট। খুবই আনন্দ আর আগ্রহ নিয়ে সে এই সাবজেক্ট পড়া শুরু করেছে। প্রথমে তারা শুরু করেছে ইজিপ্সিয়ান কালচার। আমাকে মাঝে মাঝে হাইরোগ্লিফিক লেখা শেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। আর নতুন কিছু শিখলেই হল, আমাকে তো তার বলা চাই ই চাই (স্কুলের গেট থেকেই বলা শুরু করে)। দুই সপ্তাহ আগে মুখ অন্ধকার করে এসে বলল, “মা, আমাকে একটা প্রেজেন্টেশন করতে হবে ইজিপ্সিয়ান এক দেবীর উপর, মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে”।
আমি একটু অবাকই হলাম কারণ, আমি যতটুকু জানি সে এই সাবজেক্টটা পছন্দ করে। আমি বললাম, “কেন, সমস্যা কি? তোমার কি আর Ancient Culture ভালো লাগছে না”? সে উত্তরে বলল, “আরে না, সাবজেক্ট তো ঠিকই আছে, যার সম্পর্কে প্রেজেন্টেশন করতে হবে সেই নুত দেবীর মধ্যে বিরাট সমস্যা আছে, তোমার ভাষায় ‘নুত দেবীর চরিত্র, ফুলের মত পবিত্র’ ”! আমি হেসে বললাম, “ঘটনা কি?” সে চরম বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল, “ঘটনা তো তোমাকে বলবো, তার ছবিও দেখাবো। কিন্তু তুমি তো মাত্র অজু করে এসেছ, আগে এশার নামায পড়ে আসো। তানা হলে এই মহিলার ছবি দেখলে আর গল্প শুনলে সম্ভবত তোমাকে আবার অজু করতে হবে!” কিছুক্ষণ পর যখন আমার মেয়ে আমাকে এই ‘দেবীর’ সবচেয়ে ‘ডিসেন্ট’ ছবিটা দেখাল এবং তার ‘কর্মমুখর’ জীবনের গল্প বলল, তখন আমি বুঝতে পারলাম ‘অজু বিষয়ক’ কথাটা সে খুব একটা ভুল বলেনি!
সংক্ষেপে দেবী নুতের গল্প নিম্নরূপঃ
ইজিপ্সিয়ান দেবী নুত [nout] (Godess of Sky and star)। তার সাথে তার ভাই গেব [geb] (god of earth) এর গভীর প্রণয় চলছে (আস্তাগফিরুল্লাহ)! তাদের বাবা শো [sho] (god of Air) যখন সেটি জানতে পারে, তখন স্বভাবতই চায় না যে তাদের ভাইবোনের ভেতর এই সম্পর্ক হোক। সে তাদেরকে বলল তারা যেন ৩৬০ দিন (তখন ৩৬০ দিনে বছর ছিল!) আলাদা থাকে। বাবার কথায় নুত অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে থট [thot] (god of time) এর কাছে গেল সমাধানের আশায়। সে (নুত) সময়ের দেবতা থট কে একটি ডাইসের খেলায় চ্যালেঞ্জ করলো এবং বলল যদি সে খেলায় জিতে যায় তাহলে বছরে আরও ৫ দিন যোগ করে ৩৬৫ দিন করতে হবে। থট এই খেলায় নুতের কাছে হেরে গেল তাই বাধ্য হয়ে ৩৬৫ দিনে বছর ঘোষণা করতে বাধ্য হল। নুত বছরের বাকি ৫ দিন তার ভাইয়ের সাথে সহবাস করে ইসিস [isis] (godess of death & divinity of mother), অসিরিস [Osiris] (god of fertility and crop), সেথ [seth] (god of thunder & strom), এবং নেফথিস [nephtys] (godess of mourning) নামক ৪ টি বাচ্চা প্রসব করে (নাউজুবিল্লাহ মিন জালিক)! [ ভারতীয় উপমহাদেশের পিরালী ব্যবসায় সম্ভবত ইজিপ্সিয়ান কালচার এর কিছু ছোঁয়া আছে। পীরের ছেলেমেয়ে যেমন পীরজাদা/পীরজাদী হয়, তেমন গড আর গডেস এর বাচ্চা-কাচ্চাও ‘পারিবারিক ব্যবসা’ ধরে রাখে! বর্তমানে মাশা’আল্লাহ রাজনীতিতেও এর ছোঁয়া লেগেছে!!]
আমার মেয়ে কিছুক্ষন পর বলল, “জানো মা, আমার মনে হয় আগের দিনে মানুষের মাথায় বুদ্ধি খুবই কম ছিল। তা না হলে এই রকম ‘গারবেজ ক্যারেক্টার’ দের কেন তারা দেব-দেবী হিসাবে মেনে নিবে এবং এদের পুজা করবে? আমার মনে হয় না যদি কারো মাথায় সামান্য গ্রে-ম্যাটার (ব্রেইন) থাকে তাহলে সে কক্ষনই এমন morality ছাড়া ক্যারেক্টারদের পুজা করবে”। কিন্তু আমি ভেবে দেখলাম, আসলে কি তাই? এখন কি আমাদের মাথার বুদ্ধি অনেক বেশী হয়ে গিয়েছে? আমার মেয়েকে তখন বললাম, “খেয়াল করে দেখ মা, তোমাদের স্কুলের অল্প কিছু student ছাড়া বাকি সবার ব্যাগ, ফাইল, পেন্সিল কেস, জিএসএম বা আইফোন এর কাভার- সব কিছুর গায়েই High school musical, The Twilight Saga, Justin Bieber, Hannah Montana ইত্যাদি সিনেমা বা সিরিজ গুলির নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকার ছবি। ভাগ্যিস তোমাদের স্কুলে ইউনিফর্ম ছিল, তা না হলে কাপড়-চোপড়-জুতাও বাদ থাকতো না। এদের নৈতিক চরিত্রের অবস্থা কি সেটা তো তুমি জানই, তাই না? আরও দেখ, মেরেলিন মনরো থেকে ম্যাডোনা এমনকি হালের হানা মন্টানা খ্যাত মাইলি সাইরাস, কিম্বা সোফিয়া লরেন, লিজ টেইলার ইত্যাদি হলিউড সুপার স্টাররা কোন পথ অবলম্বন করে সুপার স্টার হয় সেটা তো কারো অজানা নয়। এমন কোন অসামাজিক কর্মকাণ্ড নাই, যা তারা করে নি বা করছে না। তারপরও তারা এক শ্রেণীর মানুষের হার্ট থ্রব। তাদের পোষ্টার রুমের দেয়ালে ঝোলানো হয়। বহু টিন-এজার ছেলেমেয়ের রোল মডেল তারা। শয়নে-স্বপনে-জাগরনে তাদের মত হওয়ার স্বপ্ন দেখে তারা। ব্যক্তি পুজাও তো এক ধরনের পুজা, তাই না? তোমার কি মনে হয়, এই সব মানুষের মাথায় গ্রে-ম্যাটার কম ছিল বা আছে? তুমি বোধহয় জানো না, ইনডিয়াতে অনেক বলিউড নায়িকাদের নামে মন্দির পর্যন্ত আছে। সেখানে তাদের পুজা হয়! বাংলাদেশে যদিও এখনো নায়িকাদের নামে মন্দির তৈরি হয় নাই, কিন্তু সেই বলিউড নায়িকাদের কেউ যদি এখন বাংলাদেশে যায় এবং আধ ঘণ্টাও বাংলাদেশে থাকে তাহলে তাকে একনজর দেখার জন্য ১০০ ইউরো বা তার চাইতেও বেশী দিয়ে টিকেট কেনার লোকের অভাব হবে না। এমনকি গত ঈদে পর্ণ স্টারের নামে বাংলাদেশের বাজারে ড্রেস বিক্রি হয়েছে এবং বাবা-মা তাদের মেয়েদের খুশি মনে সেই ড্রেস কিনে দিয়েছে, সুবাহান’আল্লাহ! কিছুদিন আগে বাংলাদেশের জনপ্রিয় কিছু তারকার পারিবারিক হাল-চাল সম্পর্কে পড়লাম। যদিও মিডিয়ার ভাষায় তারা “আসলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন”; কিন্তু পারিবারিক জীবনে তাদের অবস্থা হল তারা “দেখলেন, ধরলেন এবং ছাড়লেন”! কিন্তু তারাও এক শ্রেণীর মেয়ে এবং তাদের অভিভাবকদের নয়নের মণি! তাদের মত ক্যারিয়ার পাবার জন্য এক শ্রেণীর অভিভাবক তাদের মেয়েদের সকালে গান, দুপুরে নাচ, বিকালে আবৃত্তি আর সন্ধ্যায় অভিনয় শেখায়। যদিও আমরা সবাই জানি, অধিকাংশ সুপার মডেল, নায়িকা, গায়িকা আর নর্তকীদের (যদি তাদের অপমৃত্যু না হয়) মধ্যবয়সের ঠিকানা হয় আস্তাকুঁড়! তারপরও জেনে বুঝে তারা তাদের মেয়েদেরকে Sewerage system এর ভেতর ঠেলে দেয়, যেখানে বিড়ালের খাবার বিক্রির এডের জন্যও তারা উলংগ হয়ে নাচে।
সেই যুগ আর এই যুগের ভেতর পার্থক্য শুধু একটাই, সেই যুগে দেবী বানানো হয়েছিল মিথ্যা ধর্মের মোড়কে সাজিয়ে আর আজকের যুগে দেবী বানানো হয়েছে সংস্কৃতি ও কালচারের মন ভোলানো মোড়কে সাজিয়ে। ব্রেইন বা গ্রে ম্যাটার শুধু মাথার ভেতর থাকলেই হয় না, তাকে ব্যবহার করতে জানতে হয়। সেই যুগেও অধিকাংশ মানুষ সেটা ব্যবহার করে নাই, এই যুগেও করে না”!
– সিফাত মেহজাবিন