মধ্যপ্রাচ্য ভাঙার নতুন পরিকল্পনা!
সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচটি দেশ ভেঙে ১৪টি দেশে পরিণত করার নতুন এক পরিকল্পনা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হইচই শুরু হয়েছে। শীর্ষ আমেরিকান দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসে তিন সপ্তাহ আগের এক সংখ্যায় বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক রবিন রাইট এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এই লেখা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশের সাময়িকী ও দৈনিকে পুনঃমুদ্রণ করা হয়। আনুষ্ঠানিক কোনো বিশ্ব ফোরামে এ নিয়ে দৃশ্যমান আলোচনা না থাকলেও গোয়েন্দাপর্যায়ে এটি নিয়ে তৎপরতা যে চলছে, তা অনেকটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে।
আসলেই মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে কী হচ্ছে তা যেমন এক অন্তহীন রহস্যের ব্যাপার, তেমনিভাবে পৃথিবীর এই স্পর্শকাতর অঞ্চলে যেকোনো পরিবর্তন অন্য সব অঞ্চলকে অনিবার্যভাবে প্রভাবিত করার আশঙ্কা থেকে যায়। এ ধরনের পরিকল্পনা কেউ বাস্তবায়ন করছে এমনটি রাইট না বললেও খ্যাতিমান এই মহিলা আমেরিকান সাংবাদিকের প্রতিবেদনটি পড়লে স্পষ্ট হয় যে, এই পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী শক্তি নেপথ্যে কাজ করছে। আর এর সাথে আন্তর্জাতিক কোনো পরিকল্পনার যোগসূত্র রয়েছে। ২০০৬ সালে একবার আমেরিকান ডিফেন্স জার্নালে র্যাল্ফ পিটার পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে বিভাজনের একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন। মার্কিন সেনাবাহিনীর মধ্যপর্যায়ের সাবেক কর্মকর্তার এ লেখা নিয়েও তখন ঝড় ওঠে। দু’টি লেখার পটভূমি খুঁজতে গেলে এর সাথে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় আশির দশকে ইসরাইলের নেয়া স্ট্র্যাটেজিক ইনোন পরিকল্পনার। এ পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল ইসরাইলের তার নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভাজন করে ইসরাইলের ওপর নির্ভরশীল করে ফেলতে চায়।
রবিন রাইটের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিভাজন চিত্রটি আঁকা হয়েছে সৌদি আরবকে কেন্দ্র করে। ফলে এ নিয়ে অস্থিরতা সৌদি অরবের সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদ আল ফয়সল জাতিসঙ্ঘের সিরিয়া নীতির প্রতিবাদে সম্প্রতি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য রাখা থেকে বিরত থাকেন। কয়েক দিন আগে সৌদি আরব নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদে নির্বাচিত হয়। কিন্তু দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয় সিরিয়ার ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদের উপেক্ষার নীতির প্রতিবাদে দেশটি নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী আসন গ্রহণ করবে না। সৌদি আরব আসলেই নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হতে না চাইলে আগেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে পারত। কিন্তু তা না করে নিরাপত্তা পরিষদে না যাওয়ার ঘোষণার মধ্যে এক ধরনের চাপ সৃষ্টির কৌশল থাকতে পারে। আঞ্চলিক পর্যায়ে সৌদি আরবের প্রধান প্রতিপক্ষ ইরানের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর যে সমঝোতার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে, রিয়াদ সম্ভবত তার ব্যত্যয় কামনা করে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাশ্চাত্যের কাছে ইরানের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। অন্য দিকে সৌদি আরবের সাথে পশ্চিমা শক্তির দূরত্ব যে ক্রমেই বাড়ছে, তা সাম্প্রতিক অনেকগুলো সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হচ্ছে। মিসর পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে সৌদি আরব রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক নির্মাণের একটি উদ্যোগও নিয়েছিল। এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় আমেরিকান কৌশলের অংশ হিসেবেও নিউ ইয়র্ক টাইমসে রাইটের লেখাটি প্রকাশ হয়ে থাকতে পারে।
রবিন রাইটের লেখায় বর্তমান সৌদি আরব চার টুকরো হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার কল্পনা অনুসারে উত্তর-পূর্বের দাম্মামসহ সন্নিহিত অঞ্চলটি হবে পূর্ব আরব। পারস্য উপসাগরীয় সীমান্তবর্তী এ অঞ্চলে আমেরিকান সৈন্যদের অবস্থান রয়েছে। আর ইরাক সীমান্তবর্তী উত্তর অঞ্চলকে উত্তর আরব হিসেবে দেখানো হয়েছে। পবিত্র মক্কা, মদিনা ও জেদ্দা এবং এর পাশের পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে দেখানো হয়েছে পশ্চিম আরব। দেশটির মধ্যাঞ্চলকে নিয়ে বর্তমান সৌদি আরবের অবস্থান দেখানো হয়েছে, যার নাম দেয়া হয়েছে ওহাবিস্তÍান। এই বিভাজনের পক্ষে রাইট যুক্তি দেখিয়েছেন, সৌদি আরব দীর্ঘ দিন ধরে অভ্যন্তরীণভাবে বিভিন্ন বিভাজনকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে। সৌদি রাজ পরিবারের যে অনৈক্য সুপ্ত রয়েছে, তা বাদশাহ আবদুল্লাহর পর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। গোত্রগত মতভেদ শিয়া-সুন্নি ব্যবধান এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো দেশটির ভৌগোলিক বিভাজনকে অনিবার্য করে তুলবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজ পরিবারের ব্যাপক দুর্নীতি, যার মধ্যে অস্ত্র কেনার বিপরীতে বিপুল কমিশন গ্রহণের বিষয়ও রয়েছে, বাদশাহ আবদুল আজিজের বিভিন্ন স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেয়া প্রিন্সদের মধ্যে মতপার্থক্য ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং ৩০ শতাংশ তরুণের বেকারত্ব ও সামাজিক বৈষম্যের বিষয়গুলো উঠে আসছে। এর বাইরে মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসি ও ব্রাদারহুডের ওপর যে রক্তক্ষয়ী ক্র্যাকডাউন চালানো হয়েছে, তা সৌদি আরবের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক আলেমদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষোভ ও বিভাজনকে কাজে লাগাতে চাইবে যারা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী বড় দেশকে বিভাজন করতে চায় তারা।
সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিয়া জনগোষ্ঠী রয়েছে। এ অঞ্চলটি হলো সবচেয়ে বেশি তেলসম্পদে সমৃদ্ধ। কিন্তু এ সম্পদের সামান্যের ওপরই স্থানীয়দের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
সৌদি রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকার জটিলতাও একটি বড় সমস্যা। বাদশাহ আবদুল আজিজ আল সৌদ জাজিরাতুল আরবের কর্তৃত্ব গ্রহণের মাধ্যমে রাজবংশীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পর উত্তরাধিকারের যে নিয়ম তৈরি করেছিলেন, তাতে জ্যেষ্ঠতা অনুসারে তার সব সন্তান সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হওয়ার কথা বলা হয়। এভাবেই সৌদ, ফয়সল, খালেদ, ফাহাদ ও আবদুল্লাহ বাদশাহ হয়েছেন। বর্তমান বাদশাহর বয়স ৯০-এর কোটায়। তিনি বাদশাহ হওয়ার পর মনোনীত দুই ক্রাউন প্রিন্স ইতোমধ্যে মারা গেছেন। তৃতীয় ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন সালমান বিন আবদুল আজিজ। এরপর কারা যুবরাজ হবেন, তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। বাদশাহ আবদুল আজিজের অনেক ছেলে রয়েছেন যারা তার নাতিদের চেয়ে বয়সে ছোট এবং তাদের কম অভিজ্ঞতা রয়েছে রাষ্ট্র চালানোর। বর্তমান ও অতীতের বাদশাহরা সরকারের কর্তৃত্ব নেয়ার পর ভাইদের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে সন্তান ও ভাতিজাদের বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এতে ক্ষমতার ভারসাম্যে বেশখানিকটা পরিবর্তন এসেছে। বাদশাহ আবদুল্লাহ ‘এলিজিয়েন্স কাউন্সিল’ করে ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করা আবদুল আজিজপুত্র পরিবারের একজন করে সদস্যকে তার অন্তর্ভুক্ত করেছেন নির্বাচিত প্রিন্সদের সাথে। ৩৫ সদস্যের এই গুরুত্বপূর্ণ ফোরামের সাথে পরামর্শ করে উত্তরাধিকার নিয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা ছিল। বাদশাহ আবদুল্লাহ সেটি অবশ্য অনুসরণ করেননি। এ নিয়ে বেশ মতানৈক্য রয়েছে রাজ পরিবারে। বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর এ নিয়ে সঙ্কট দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে প্রভাবশালী প্রিন্স মুকরিনের মা ইয়েমেনি হওয়ায় এবং আরেক প্রভাবশালী প্রিন্স ও সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান বন্দর বিন সুলতান তার বাবার রক্ষিতার সন্তান হওয়ার যুক্তি দেখিয়ে তাদের উত্তরাধিকারী না করার কথা বলা হচ্ছে। এসব বিষয় সামনে আরো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রবিন রাইট গৃহযুদ্ধে বিক্ষত সিরিয়া শেষ পর্যন্ত তিনটি ভাগে ভাগ হবে বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, সিরিয়ায় কয়েক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা শিয়া-আলভিরা কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারবে না। তারা পশ্চিমের উপকূল ঘেঁষে একটি স্বাধীন আলভিস্তান প্রতিষ্ঠা করে সেখানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে। অন্য দিকে ইতোমধ্যে কার্যত বিচ্ছিন্নœ হয়ে পড়া সিরীয় কুর্দিরা ইরাকি কুর্দিদের সাথে মিলে অথবা নিজেরা আলাদা কুর্দিস্তান গড়তে পারে। এর বাইরের বাকি অংশে সিরীয় সুন্নিস্তান হতে পারে।
একইভাবে ইরাক বিভাজনের কথাও বলেছেন রাইট। তার বক্তব্য অনুসারে ইরাকের উত্তর-পশ্চিমাংশ সুন্নি ইরাক এবং দণি পূর্বাংশ হবে শিয়া ইরাক। কুর্দি অংশটি অন্য কুর্দি এলাকার সাথে মিলতে পারে অথবা হতে পারে স্বাধীন। ইয়েমেন আবার উত্তর দক্ষিণে ভাগ হয়ে যাবে বলে মনে করেন রাইট। ইয়েমেনের দক্ষিণাংশ সৌদি আরবের সাথে মিলেও যেতে পারে বলে তার ধারণা।
লিবিয়ার ব্যাপারে তার বক্তব্য হলো দেশটি তিন ভাগে ভাগ হয়ে যাবে গোত্রপ্রাধান্যের ভিত্তিতে। এর মধ্যে উত্তর-পশ্চিম অংশ হবে ত্রিপোলিতানিয়া আর পূর্বাংশে হবে স্রিনানিয়া; যার মূল কেন্দ্র হবে বেনগাজি। লিবীয় তেল সম্পদের বড় অংশটির মালিক হবে এ দেশ। এর বাইরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হবে ফেজান রাষ্ট্র। এ এলাকাটি এখনো কার্যত স্বশাসনে পরিচালিত হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতা হলো এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে শক্তিমান একনায়কতান্ত্রিক শাসনের সময় শক্ত হাতে সব বিদ্রোহ ও ভিন্ন মত দমন করা হয়েছে। ফলে এসব দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিগুলোর সেভাবে বিকাশ ঘটেনি। আরব জাগরণের মাধ্যমে কয়েকটি দেশে শাসন পরিবর্তনের পর সেখানকার সামাজিক ভারসাম্য ওলট-পালট হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো যার যার স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কৌশলগত সুবিধায় রয়েছে ইসরাইল। আরব জাগরণ প্রধান চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে আরব রাজতান্ত্রিক শাসকদের সামনে। ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন ইসলামি বিপ্লবের পর যে চ্যালেঞ্জ তাদের সামনে সৃষ্টি হয়েছিল, তা দ্বিতীয়বার দেখা দেয় আরব বসন্তের পর। এটিকে ইসরাইলিরা প্রতিবেশী দেশগুলোকে বিভাজন করে দুর্বল এবং তেলআবিবের ওপর নির্ভরশীল করে তোলার কৌশল বাস্তবায়ন করছে। রবিন রাইটের লেখায় তারই সুপ্ত ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আমেরিকার বিভিন্ন থিংকট্যাংকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে আরব জাগরণ শেষ হয়নি। অর্থাৎ এর মাধ্যমে যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়েছে, তাকে স্থিতিশীল দেশগুলোতেও নিয়ে যাওয়া হবে। বিশেষভাবে এর শিকার হতে পারে সৌদি আরবসহ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশ। এ পরিস্থিতি সার্বিকভাবে মুসলিম উম্মাহর জন্য কল্যাণের চেয়ে অস্থিরতাই বেশি ডেকে আনতে পারে।
নয়াদিগন্ত