আকাইদ

শিরকমুক্ত আমল করা

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, الَّذِيْنَ آمَنُواْ وَلَمْ يَلْبِسُواْ إِيْمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُوْلَـئِكَ لَهُمُ الأَمْنُ وَهُمْ مُّهْتَدُوْنَ ‘যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের ঈমান যুলুমের সাথে (শিরকের সাথে) সংমিশ্রিত করেনি, প্রকৃতপক্ষে তারাই শান্তি ও নিরাপত্তার অধিকারী। তারাই হেদায়াত প্রাপ্ত’ (আন‘আম ৮২)

অনুরূপভাবে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন এ আয়াত নাযিল হ’ল ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলুমের দ্বারা কুলষিত করেনি। তখন তা মুসলমানদের পক্ষে কঠিন হয়ে গেল। তারা আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি আছে যে নিজের উপর যুলুম করেনি? তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, এখানে অর্থ তা নয়; বরং এখানে যুলুমের অর্থ হ’ল শিরক। তোমরা কি কুরআনে শুননি লোক্বমান তাঁর ছেলেকে নছীহত করার সময় কী বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, ‘হে আমার বৎস! তুমি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করো না। নিশ্চয়ই শিরক এক মহাপাপ’।[A11]

অতএব আমাদের প্রথম দাওয়াত হ’তে হবে তাওহীদের এবং শিরকী কাজ বর্জনের। এ মর্মে মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি একটি গাধার পিঠে মহানবী (ছাঃ)-এর পেছনে বসেছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, হে মু‘আয! বান্দার ওপর আল্লাহর হক কি এবং আল্লাহর ওপর বান্দার হক কি তা কি তুমি জান? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, বান্দার ওপর আল্লাহর হক্ব হ’ল, তারা শুধু তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার করবে না। আর আল্লাহর ওপর বান্দার হক্ব হ’ল, যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার সাব্যস্ত করে না তাকে শাস্তি না দেয়া। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি কি মানুষকে এ বিষয়ে সুসংবাদ দেব না? তিনি বললেন, না, তাহ’লে তারা আমল থেকে বিমুখ হয়ে পড়বে’।[A12]

শিরক করলে শিরককারীর সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَوْ أَشْرَكُواْ لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُواْ يَعْمَلُونَ ‘আর তারা যদি শিরক করতো তবে তারা যা কিছুই করতো, সবই নষ্ট হয়ে যেতো’ (আন‘আম ৮৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ ‘যদি তুমি আল্লাহর শরীক স্থির কর তবে নিঃসন্দেহে তোমার কর্ম তো নিষ্ফল হবে এবং অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (যুমার ৬৫)

শিরক কারীকে মহান আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। তিনি বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً بَعِيْداً ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপন করাকে ক্ষমা করেন না এবং এতদ্ব্যতীত তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে থাকেন। আর যে আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করল সে নিশ্চয়ই চরমভাবে গোমরাহ হয়ে গেল’ (নিসা ১১৬)

শিরক করলে চিরস্থায়ী জাহান্নামে থাকতে হবে এবং জান্নাত তার জন্য হারাম হয়ে যাবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّهُ مَن يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنصَارٍ ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার স্থাপন করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম, আর এরূপ অত্যাচারীদের জন্য কোন সাহায্যকারী হবে না’ (মায়েদাহ ৭২)

আল্লাহ তা‘আলা ওয়াদা করেছেন সৎ আমলের সাথে শিরক না করলে তাদের প্রতিনিধিত্ব দান করবেন। আর যদি তাদের আমল শিরক দ্বারা শুরু হয় তবে প্রতিনিধিত্ব প্রদান করবেন না। মহান আল্লাহ বলেন,

 وَعَدَ اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِيْنَهُمُ الَّذِيْ ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِّنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْناً يَعْبُدُونَنِيْ لاَ يُشْرِكُوْنَ بِيْ شَيْئاً وَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُوْنَ

‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে খেলাফত (প্রতিনিধিত্ব) দান করবেন। যেমন তিনি (প্রতিনিধিত্ব) দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য সুদৃঢ় করবেন তাদের দ্বীনকে যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন। আর ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। তারা শুধু  আমার ইবাদত করবে, আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না, অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা তো সত্যত্যাগী’ (ফাসিক্ব) (নূর ৫৫)

শিরককারীকে আল্লাহ জাহান্নামে দিবেন। যেমন নবী করীম (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা অবস্থায় মারা যাবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (রাবী বলেন) আমি বললাম, যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শিরক না করা অবস্থায় মারা যায়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[A13]

রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে তাঁর সমকক্ষ হিসাবে আহবান করা অবস্থায় মারা যায়, সে জাহান্নামে যাবে। আর (রাবী বলেন,) আমি বললাম, যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে সমকক্ষ হিসাবে আহবান না করা অবস্থায় মারা যায়? (তিনি বললেন) সে জান্নাতে যাবে’।[A14]

অন্যত্র তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার না করে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কোন অংশীদার সাব্যস্ত করে সাক্ষাৎ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’।[A15]

পবিত্র কুরআনের উল্লিখিত অমীয় বাণী এবং রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, শিরক করলে পরকাল হারাতে হবে এবং মর্মান্তিক শাস্তি ভোগ করতে হবে। এখানে শিরক মিশ্রিত কতিপয় আমল উল্লেখ করা হলো-

(১) রুকূ-সিজদা : রুকু-সিজদা আল্লাহর জন্যই করতে হবে। এ রুকূ-সিজদা আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোন মাযার, কবর, পীর বাবা বা অন্য কারো জন্য করা হ’লে সেটা হয়ে যাবে শিরক মিশ্রিত আমল। তাই কোন মাযার বা কবরকে সিজদা করা যাবে না। রুকূ-সিজদা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই করতে হবে। যেমন মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا ارْكَعُوْا وَاسْجُدُوْا وَاعْبُدُوْا رَبَّكُمْ وَافْعَلُوْا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা রুকূ কর, সিজদা কর এবং তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর ও সৎকর্ম কর যাতে সফলকাম হ’তে পার’ (হজ্জ ৭৭)

পৃথিবীর সকল জীব-জন্তু মহান আল্লাহকে সিজদা করে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلِلّهِ يَسْجُدُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ طَوْعاً وَكَرْهاً وَظِلاَلُهُمْ بِالْغُدُوِّ وَالآصَالِ ‘আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হয় আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এবং তাদের ছায়াগুলিও সকালে ও সন্ধ্যায়’ (রা‘দ ১৫)

অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلِلّهِ يَسْجُدُ مَا فِيْ السَّمَاوَاتِ وَمَا فِيْ الأَرْضِ مِنْ دَآبَّةٍ وَالْمَلآئِكَةُ وَهُمْ لاَ يَسْتَكْبِرُوْنَ ‘আল্লাহকেই সিজদা করে যা কিছু আছে আকাশমন্ডলীতে ও পৃথিবীতে জীব-জন্তু এবং ফেরেশতাগণও। আর তারা অহংকার করে না’ (নাহল ৪৯)

রুকূ-সিজদা শুধু আল্লাহকেই করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَمِنْ آيَاتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ لاَ تَسْجُدُوْا لِلشَّمْسِ وَلاَ لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوْا لِلَّهِ الَّذِيْ خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُوْنَ

‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রজনী ও দিবস, সূর্য ও চন্দ্র্ তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চন্দ্রকেও নয়; সিজদা কর আল্লাহকে, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত কর’ (হা-মীম-সাজদাহ ৩৭)

নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষের জন্য সমীচীন হবে না যে, একজন মানুষ অপর মানুষকে সিজদা করবে’।[A16] কোন মুসলমান কখনও আল্লাহকে ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করতে পারে না। আর অন্য কাউকে সিজদা করাটা শুধু কাফেরের দ্বারাই হয়ে থাকে। যেমন মূর্তিকে সিজদা করা এবং চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি ও ক্রুশকে সিজদা করা। যারা এগুলোকে সিজদা করে তারা প্রকাশ্য কুফরী করে।[A17]

কবরকে সিজদা করা কুফরী এবং বড় শিরক। তাই নবী করীম (ছাঃ) কবরে সিজদাকারীর জন্য ধ্বংসের দো‘আ করেছেন। আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা ইহুদীদের ধ্বংস করুন। কেননা তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে’।[A18]

হাফেয ইবনে আব্দিল বার্র বলেন, ‘নবীদের কবরকে সিজদা করা হারাম। এর অর্থ এই যে, অন্যদের কবরকে সিজদা করা হালাল নয়’।[A19] অনুরূপভাবে তিনি কবরকে সিজদা করা বড় শিরক বলেছেন।[A20]

যারা মানুষ বা কবরে সিজদা করে তারা আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্টতম জীব। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, উম্মু সালমাহ (রাঃ) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট তাঁর হাবশায় দেখা মারিয়া নামক একটা গির্জার কথা উল্লেখ করলেন। তিনি সেখানে যেসব প্রতিমূর্তি দেখেছিলেন, সেগুলোর বর্ণনা দিলেন। তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বললেন, এরা এমন সম্প্রদায় যে, এদের মধ্যে কোন সৎ বান্দা অথবা বলেছেন কোন সৎ লোক মারা গেলে তার কবরের উপর তারা মসজিদ বানিয়ে নিত। আর তাতে ঐসব ব্যক্তির প্রতিকৃতি স্থাপন করত। এরা আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জীব’।[A21]

নবী করীম (ছাঃ) নিজেই আল্লাহর নিকট দো‘আ করেছেন যেন তাঁর কবরকে ইবাদতখানা বানানো না হয়। তিনি বলেন, হে আল্লাহ! আমার কবরকে (পূজার ন্যায়) ইবাদতখানা বানায়ে নিও না’।[A22]

ইমাম আবু হানীফা এবং তাঁর অনুসারীগণ আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যকে (কবরে অথবা মাযারে) সিজদা করাকে বড় শিরক বলেছেন।[A23]

ইমাম মালেক এবং তাঁর অনুসারীগণও নবী-রাসূল এবং পীর-মাযার, ক্বূববাকে সিজদা করা বড় শিরক বলেছেন।[A24]

অনুরূপভাবে ইমাম শাফেঈ এবং ইমাম আহমাদ ও তাঁদের অনুসারীগণও আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যকে সিজদা করাকে বড় শিরক বলেছেন। ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, রুকূ-সিজদা, তাসবীহ, দো‘আ, ক্বিরাআত (কুরআন পড়া), ক্বিয়াম (রাতের ছালাত বা অন্য ছালাত) এসবই আল্লাহর জন্যই হ’তে হবে। কোন চন্দ্র, সূর্য, নবী-ফেরেশতা বা কোন সৎ মানুষ বা কোন কবরের জন্য নয়।

মোটকথা রুকূ-সিজদা এবং সমস্ত ইবাদত আল্লাহর জন্যই হ’তে হবে। যদি রুকূ-সিজদা কোন কবরে মাযারে বা অন্য কাউকে করা হয়, তাহ’লে বড় শিরক হবে। আর বড় শিরক করলে এবং তওবা না করে মারা গেলে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হয়ে যাবে, যদিও সে ছালাত-ছিয়াম হজ্জ-যাকাত প্রভৃতি ইবাদত পূর্ণভাবে আদায় করে থাকে। সুতরাং যে সকল ভাই-বোনেরা কবরে রুকূ-সিজদা করেন, সেখানে গিয়ে ছালাত আদায় করেন, তারা এখনই তওবা করুন এবং কবর পূজা ছাড়ুন। নইলে পরকালে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হ’তে হবে।

২. আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে কুরবানী করা : আল্লাহর নামে ও তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানী না করে কোন পীরের নামে মাযারে বা অন্যত্র কুরবানী করা শিরক। অনুরূপভাবে আল্লাহর নামে না করে অন্যের নামে উট, গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদি যবেহ করাও বড় শিরক। যেমন আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ- ‘তুমি বলে দাও, আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু সারা জাহানের মালিক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোন শরীক নেই, আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি। আর আত্মসর্মপণকারীদের (মুসলিমদের) মধ্যে আমিই হ’লাম প্রথম’ (আন‘আম ১৬২-১৬৩)

এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য যবেহ করা বড় শিরক।[B1] ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ও তাঁর অনুসারীগণ অন্যের জন্য কুরবানী করাকে বড় শিরক বলেছেন।[B2]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘অতএব তুমি তোমার প্রভুর জন্য ছালাত পড় ও কুরবানী কর’ (কাওছার ২)। এ আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ছালাত এবং কুরবানী দু’টিই ইবাদত। আর ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই করতে হবে। আল্লাহ ব্যতীত তা অন্যের জন্য করলেই শিরক হবে।

আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যের নামে অর্থাৎ কোন পীর, ছূফী, অলী-আওলিয়ার নামে বা তাদের জন্য কুরবানী করলে আল্লাহ তাকে অভিশাপ দেন। যেমন নবী করীম (ছাঃ) এরশাদ করেন, وَلَعَنَ اللهُ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ اللهِ وَلَعَنَ اللهُ مَنْ آوَى مُحْدِثًا وَلَعَنَ اللهُ مَنْ غَيَّرَ مَنَارَ الأَرْضِ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যের জন্য যবেহ করে, আল্লাহ তাকে অভিশাপ দেন। যে ব্যক্তি কোন বিদ‘আতীকে আশ্রয় দেয়, আল্লাহ তাকে অভিশাপ দেন। যে ব্যক্তি যমীনের সীমানা পরিবর্তন করে ফেলে, আল্লাহ তাকে অভিশাপ দেন’।[B3]

উপরোক্ত হাদীছ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, পীরের নামে যবেহ করলে শিরক হবে। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা অন্যের নামে যবেহকারীর উপর অভিশাপ করেছেন। আর আল্লাহর অভিশাপ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং তার ইহকাল-পরকাল উভয়ই ধ্বংস হওয়া। তাই আমাদের সবাইকে শিরকের অভিশাপ এবং আল্লাহর লা‘নত থেকে বেঁচে থাকতে হবে।

৩. আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য মানত করা : মানত একটি ইবাদত। সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে মানত করা যাবে না। অন্যের নামে মানত করলে শিরক হবে। তাই মানত কেবল আল্লাহর জন্যই করতে হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, يُوْفُوْنَ بِالنَّذْرِ وَيَخَافُوْنَ يَوْمًا كَانَ شَرُّهُ مُسْتَطِيْرًا ‘তারা মানত পূর্ণ করে এবং সেদিনের ভয় করে, যেদিনের অনিষ্টতা হবে ব্যাপক’ (দাহর ৭)

এ আয়াতটিতে আল্লাহ তা‘আলা মানত পূর্ণকারীদের প্রশংসা করেছেন। আর যেহেতু মানত ইবাদত, সেহেতু কেউ অন্যের নৈকট্য অর্জনের জন্য তা করলে সেটা শিরক হবে।[B4]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ نَفَقَةٍ أَوْ نَذَرْتُمْ مِنْ نَذْرٍ فَإِنَّ اللهَ يَعْلَمُهُ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ ‘আর যে কোন বস্ত্ত তোমরা ব্যয় কর না কেন, অথবা যেকোন নযর তোমরা গ্রহণ কর না কেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই তা অবগত হন। আর অত্যাচারীদের কোনই সাহায্যকারী নেই’ (বাক্বারাহ ২৭০)

আমরা যে সমস্ত টাকা-পয়সা ব্যয় করি এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য যে কোন মানত করি সবই তিনি জানেন ও এর প্রতিদান দেন। সুতরাং মানত কেবল তাঁর জন্যই হ’তে হবে। অন্যের জন্য করাই শিরক।[B5] আর আল্লাহর জন্য নযর করলে তা পূরণ করতে হবে এবং অন্যের জন্য করলে তা পরিত্যাগ করতে হবে।

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ نَذَرَ أَنْ يُطِيْعَ اللهَ فَلْيُطِعْهُ، وَمَنْ نَذَرَ أَنْ يَعْصِيَهُ فَلاَ يَعْصِهِ ‘যে লোক আল্লাহর আনুগত্য করার মানত করে সে যেন তাঁর আনুগত্য করে। আর যে লোক আল্লাহর অবাধ্যতা করার মানত করে সে যেন তাঁর অবাধ্যতা না করে’।[B6]

উপরের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, মানত হচ্ছে ইবাদত। আর ইবাদত শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করতে হবে। কোন সৎকাজের মানত করলে তা পূরণ করতে হবে এবং অন্যায় কাজে ও আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে মানত করলে তা পরিত্যাগ করতে হবে। আর মানত ভঙ্গের জন্য কাফফারা আদায় করতে হবে।

মানতের কাফফারা কসম ভঙ্গের কাফফারার ন্যায়।[B7] আর তা হচ্ছে ১০ জন ‘মসকিনকে খাদ্য অথবা বস্ত্র’ প্রদান করা অথবা একজন দাস বা দাসী মুক্ত করা। সামর্থ্য না থাকলে ৩দিন ছিয়াম পালন করা (মায়েদাহ ৮৯)

৪. আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকটে সাহায্য চাওয়া : যে কোন বিষয়ে সাহায্য আল্লাহর নিকটই চাইতে হবে। কোন মানুষ, পীর, মাযার বা কবরের নিকট নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ ‘আমরা শুধুমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং আপনারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি’ (ফাতিহা ১/৪)

মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, إِذْ تَسْتَغِيْثُوْنَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّيْ مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِنَ الْمَلاَئِكَةِ مُرْدِفِيْنَ ‘স্মরণ কর, যখন তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সাহায্যের আবেদন করেছিলে, আর তিনি সেই আবেদন কবুল করেছিলেন (আর তিনি বলেছিলেন), আমি তোমাদেরকে এক হাযার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করব, যারা ধারাবাহিকভাবে আসবে’ (আনফাল ৮/৯)। তিনি আরো বলেন, وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ إِنَّهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ ‘শয়তানের কুমন্ত্রণা যদি তোমাকে প্ররোচিত করে তবে তুমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আ‘রাফ ২০০)

অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা জীনদের কাছে সাহায্য চাইতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِنَ الْإِنْسِ يَعُوْذُوْنَ بِرِجَالٍ مِنَ الْجِنِّ فَزَادُوْهُمْ رَهَقًا ‘আর কতিপয় মানুষ কতক জিনের আশ্রয় প্রার্থনা করত, ফলে তারা নিজেদের সীমালংঘন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে’ (জিন ৬)

আল্লাহর নিকটে সাহায্য চাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নবী করীম (ছাঃ) বলেন,إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ ‘যখন তুমি কিছু চাইবে তখন আল্লাহর কাছে চাইবে। আর যখন সাহায্য চাইবে তখন আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে’।[B8]

কুরআনের উল্লিখিত আয়াত ও হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, সাহায্য ও আশ্রয় চাওয়া একটি ইবাদত। বিধায় তা আল্লাহর নিকটই চাইতে হবে। অন্যের নিকট সাহায্য চাওয়া শিরক। উল্লেখ্য, সৃষ্টিজীবের নিকট সাহায্য চাওয়াটা দু’প্রকার- (১) এমন সাহায্য-সহযোগিতা যা করার মত মানুষের ক্ষমতা আছে, সেটা যায়েজ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قَالَ مَا مَكَّنِّيْ فِيْهِ رَبِّيْ خَيْرٌ فَأَعِيْنُوْنِيْ بِقُوَّةٍ أَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ رَدْمًا ‘তিনি বললেন, আমার প্রতিপালক আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তাই উৎকৃষ্ট, সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দ্বারা সাহায্য কর, আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যস্থলে এক মযবুত প্রাচীর গড়ে দিব’ (ক্বাহফ ৯৫)

আল্লাহ তা‘আলা ভাল কাজে সাহায্য করতে বলেছেন, وَتَعَاوَنُوْا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلاَ تَعَاوَنُوْا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ  ‘তোমরা আল্লাহভীতি ও নেকীর কাজে পরস্পরকে সাহায্য কর এবং পাপ ও অবাধ্যতার কাজে পরস্পরকে সাহায্য কর না’ (মায়েদাহ ২)। অতএব মানুষের ক্ষমতার মধ্যে থাকলে মানুষের কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে। যেমন কারো নিকট টাকা ঋণ চাওয়া, কারো নিকট পানি চাওয়া ইত্যাদি।

(২) যা মানুষের ক্ষমতার বাইরে সে বিষয়ে মানুষের নিকট সাহায্য চাওয়া হ’লে শিরক হবে। যেমন কেউ যদি মৃত পীরের নিকট সাহায্য চায় এভাবে যে, আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার কর; আমাকে সন্তান দান কর; আমি ডুবে যাচ্ছি রক্ষা কর; বৃষ্টি দাও ইত্যাদি। এসব যেকোন মানুষের নিকট চাইলে বড় শিরক হবে। কেননা এসব মানুষের সাধ্যের বাইরে।

অনুরূপ মানুষের নিকট আশ্রয় চাওয়াও দু’প্রকার। যথা- (১) এমন আশ্রয় চাওয়া যা মানুষের ক্ষমতার মধ্যে সেটা যায়েজ। যেমন যুদ্ধের ময়দানে সাহায্যের জন্য অন্যকে বলা যাতে তাকে শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্য করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, فَاسْتَغَاثَهُ الَّذِيْ مِنْ شِيْعَتِهِ عَلَى الَّذِيْ مِنْ عَدُوِّهِ ‘মূসার দলের লোকটি তার শত্রুর বিরুদ্ধে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করল’ (ক্বাছাছ ১৫)। (২) এমন আশ্রয় চাওয়া, যার ক্ষমতা তার নেই, সেটা শিরক। যেমন অনেকে মাযারে গিয়ে পীরের নিকট আশ্রয় চায়, যা তার ক্ষমতার বাইরে। এরূপ আশ্রয় চাওয়া শিরক।

মোদ্দাকথা সমস্ত সাহায্য-সহযোগিতা আল্লাহর নিকটই চাইতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক মানুষ পীরের নিকট সাহায্য চায়। সুস্থতার জন্য, ধনী হবার জন্য প্রার্থনা করে, পীরের নিকট মানত করে, পীরকে সিজদা করে। এসবই শিরক।[B9]

৫. আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট প্রার্থনা বা দো‘আ করা শিরক :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  

وَلاَ تَدْعُ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لاَ يَنْفَعُكَ وَلاَ يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِيْنَ، وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلاَ كَاشِفَ لَهُ إِلاَّ هُوَ وَإِنْ يُرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلاَ رَادَّ لِفَضْلِهِ يُصِيْبُ بِهِ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَهُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيْمُ

‘আর আল্লাহকে ছেড়ে এমন কিছুকে আহবান করো না, যা না তোমার কোন উপকার করতে পারে, না কোন ক্ষতি করতে পারে। বস্ত্ততঃ যদি এরূপ কর তবে তুমি এমতাবস্থায় যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। যদি আল্লাহ তোমাকে কোন কষ্টে নিপতিত করেন, তবে তিনি ছাড়া কেউ তা মোচনকারী নেই। আর আল্লাহ যদি তোমার মঙ্গল চান, তবে তাঁর অনুগ্রহ রদ করার কেউ নেই। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মঙ্গল দান করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (ইউনুস ১০৬-১০৭)

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, وَمَنْ يَدْعُ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ لاَ بُرْهَانَ لَهُ بِهِ فَإِنَّمَا حِسَابُهُ عِنْدَ رَبِّهِ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الْكَافِرُوْنَ-  ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে ডাকে অন্য ইলাহকে যে বিষয়ে তার নিকট কোন প্রমাণ নেই; তার হিসাব তার প্রতিপালকের নিকট আছে, নিশ্চয়ই কাফিররা সফলকাম হবে না’ (মুমিনূন ১১৭)। আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডাকা এবং অন্যের সাহায্য ও আশ্রয় চাওয়া বড় শিরক।[B10]

ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এবং তাঁর কিছু সাথী বলেন, আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডাকা এবং অন্যের জন্য মানত করা, অন্যের জন্য যবেহ করা, অন্যের নিকট সাহায্য চাওয়া এবং আল্লাহকে ব্যতীত অন্যকে সিজদা করা সবই বড় শিরক।[B11]

আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে ডাকা হয় ক্বিয়ামতের দিন তারা তা অস্বীকার করবে। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنْ تَدْعُوهُمْ لاَ يَسْمَعُوْا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوْا مَا اسْتَجَابُوْا لَكُمْ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُوْنَ بِشِرْكِكُمْ- ‘তোমরা তাদেরকে আহবান করলে তারা তোমাদের আহবান শুনবে না এবং শুনলেও তোমাদের আহবানে সাড়া দিবে না। তোমরা তাদেরকে যে শরীক করেছ, তা তারা ক্বিয়ামতের দিন অস্বীকার করবে’ (ফাতির ১৪)

আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের ডাকা হয় তারা মানুষের কোন উপকার করতে পারবে না। যেমন আল্লাহ বলেন,وَالَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ مَا يَمْلِكُوْنَ مِنْ قِطْمِيْرٍ  ‘আর তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তারা তো খেজুরের অাঁটির সামান্য আবরণেরও অধিকারী নয়’ (ফাতির ১৩)। তিনি আরো বলেন,

وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُوْ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَنْ لاَ يَسْتَجِيْبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُوْنَ، وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ كَانُوْا لَهُمْ أَعْدَاءً وَكَانُوْا بِعِبَادَتِهِمْ كَافِرِيْنَ

‘তার চেয়ে অধিক বিভ্রান্ত কে হবে যে আল্লাহ ব্যতীত এমন কাউকে ডাকে যারা ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবে না এবং তারা তাদের আহবান সম্বন্ধেও অনবহিত? আর যখন মানুষকে একত্রিত করা হবে তখন তারা তাদের শত্রু হবে এবং তারা যে তাদের ইবাদত করেছিল তা অস্বীকার করবে’ (আহক্বাফ ৫-৬)

আল্লাহর সাথে বা তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে ডাকলে, অন্যের কাছে প্রার্থনা করলে বড় শিরক হবে। দুনিয়াতে যাদেরকে ডাকা হয়েছে কিয়ামতের দিন তারা তা অস্বীকার করবে। আর তারা কোন উপকারও করতে পারবে না। এমনকি আল্লাহর সাথে শিরক করার কারণে তাদের ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাতসহ সব আমল নষ্ট হয়ে যাবে এবং তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। তাই আমাদের সবার উচিত এসব শিরক থেকে বেঁচে থাকা।

জীবিত মানুষের জন্য মৃত মানুষের করার কিছু থাকে না; বরং জীবিতরা মৃতদেরকে কিছু দিতে পারে। যেমন তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারে। তার জন্য দান-ছাদাক্বা ও হজ্জ করতে পারে। এসবের বিনিময়ে কবরে বসেও সে ছওয়াব লাভ করবে। কিন্তু মৃতব্যক্তি জীবিতদের কোন উপকার করতে পারে না। এমনকি তার নিকট থেকে মাছি কিছু ছিনিয়ে নিয়ে গেলেও সে তা রক্ষা করতে পারবে না। অনুরূপভাবে সমস্ত মৃত মানুষ একত্রিত হয়ে যদি কারো উপকার বা অপকার করতে চায়, তা কখনই পারবে না। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  

يَا أَيُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوْا لَهُ إِنَّ الَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ لَنْ يَخْلُقُوْا ذُبَابًا وَلَوِ اجْتَمَعُوْا لَهُ وَإِنْ يَسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَيْئًا لاَ يَسْتَنْقِذُوْهُ مِنْهُ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوْبُ

‘হে লোক সকল! একটি উপমা দেয়া হচ্ছে, মনোযোগ সহকারে তা শ্রবণ কর, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এই উদ্দেশ্যে তারা সবাই একত্রিত হ’লেও এবং মাছি যদি সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের নিকট হ’তে, এটাও তারা ওর নিকট হ’তে উদ্ধার করতে পারবে না, পূজারী ও দেবতা কতই না দুর্বল’ (হাজ্জ ৭৩)

প্রকৃত উপাস্য কেবল মহান আল্লাহ। সুতরাং তাঁকেই ডাকতে হবে। আর অন্য সকল মা‘বূদ বাতিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ذَلِكَ بِأَنَّ اللهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ هُوَ الْبَاطِلُ  ‘এজন্যও যে, আল্লাহ, তিনিই সত্য এবং তাঁর পরিবর্তে তারা যাকে ডাকে ওটা তো অসত্য (বাতিল)’ (হজ্জ ৬২)

মানুষ বিপদে পড়লে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। বিপদ থেকে মুক্তি পেলে আল্লাহর সাথে শিরক করে। যেমন আল্লাহ বলেন,فَإِذَا رَكِبُوْا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُوْنَ  ‘তারা যখন নৌযানে আরোহণ করে তখন তারা বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে; অতঃপর তিনি যখন স্থলে ভিড়িয়ে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখন তারা শিরকে লিপ্ত হয়’ (আনকাবূত ৬৫)

তিনি আরো বলেন, وَإِذَا غَشِيَهُمْ مَوْجٌ كَالظُّلَلِ دَعَوُا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ فَمِنْهُمْ مُقْتَصِدٌ وَمَا يَجْحَدُ بِآيَاتِنَا إِلاَّ كُلُّ خَتَّارٍ كَفُوْرٍ ‘যখন তরঙ্গ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে মেঘছায়ার মত তখন তারা আল্লাহকে ডাকে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে। কিন্তু যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে পৌঁছান তখন তাদের কেউ কেউ মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করে আর বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিই তাঁর নিদর্শনাবলী অস্বীকার করে’ (লোক্বমান ৩২)

আল্লামা ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেন, ফেরেশতা, নবী-রাসূল অথবা নেক্কার ব্যক্তিদের মৃত্যুর পর তাদের কবরের নিকট গিয়ে তাদেরকে ডাকা সবচেয়ে বড় শিরক, যেটা মুশরিক-ইহুদী-নাছারাদের মধ্যে বিদ্যমান। তাদের মধ্যে থেকেই এ শিরকী কার্য মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করেছে। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوْا لَهُمْ مِنَ الدِّيْنِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللهُ-  ‘তাদের কি এমন কতকগুলো শরীকও আছে যারা তাদের জন্য দ্বীনের এমন বিধান প্রবর্তন করেছে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি’? (শূরা ২১)

যে ব্যক্তি কোন নবী-রাসূল এবং ওলী-আওলিয়াকে মৃত্যুর পর ডাকবে এবং তাদের প্রয়োজন মিটানোর জন্য সাহায্য-সহযোগিতা চাইবে, সে অবশ্যই সব থেকে বড় শিরক করবে। এ ধরনের লোকদেরকে মহান আল্লাহ তা‘আলা মুশরিক হিসাবে অবহিত করেছেন। কেননা তারা তাদের ওলী-আওলিয়াদের নিকট শাফা‘আত চাইত। তাদেরকে অসীলা হিসাবে গ্রহণ করত। তাদেরকে কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক মনে করত ও তাদের উপর আশা-ভরসা করত। সাথে সাথে তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করত। মহান আল্লাহ বলেন,

وَيَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لاَ يَضُرُّهُمْ وَلاَ يَنْفَعُهُمْ وَيَقُوْلُوْنَ هَؤُلاَءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللهِ-

‘আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন বস্ত্তসমূহেরও ইবাদত করে যারা তাদের কোন অপকারও করতে পারে না এবং তাদের কোন উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকট আমাদের সুফারিশকারী’ (ইউনুস ১৮)

অতএব যে ব্যক্তি কোন নবী-রাসূল এবং ওলী-আওলিয়াকে ডাকবে এবং তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম বানাবে, তাদের উপর আশা-ভরসা করবে, তাদের কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক মনে করবে, সে মুশরিক হয়ে যাবে।[B12]

৬. আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে ভয় করা : কোন মুমিন ব্যক্তির উচিত নয় যে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে প্রকাশ্য ও গোপনে ভয় করা। বরং সে কেবল আল্লাহকেই ভয় করবে। যেমন মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلاَ تَخْشَوُاْ النَّاسَ وَاخْشَوْنِ ‘তোমরা মানুষকে ভয় করো না, আমাকেই ভয় কর’ (মায়েদাহ ৪৪)। তিনি আরো বলেন, وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ ‘তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর’ (বাক্বারাহ ৪০, ৪১)

কোন সৃষ্টি জীবকে কোন কারণ ছাড়া ভয় করা যাবে না, যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ) সম্পর্কে বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর সাথে যা কিছু শরীক করছ আমি ওটাকে ভয় করি না, তবে যদি আমার প্রতিপালক কিছু চান। প্রতিটি বস্ত্ত সম্পর্কে আমার  প্রতিপালকের জ্ঞান খুবই ব্যাপক। এর পরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? তোমাদের মনগড়া ও বানানো শরীকদেরকে আমি কিরূপে ভয় করতে পারি? অথচ তোমরা এই ভয় করছ না যে, আল্লাহর সাথে যাদেরকে তোমরা শরীক করছ, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তোমাদের কাছে কোন দলীল প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। আমাদের দুই দলের মধ্যে যারা অধিক শান্তি ও নিরাপত্তা লাভের অধিকারী যদি তোমাদের জানা থাকে, তবে বলতো’? (আন‘আম ৮০-৮১)

আল্লাহ তা‘আলা হূদ এবং তাঁর সম্প্রদায় সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের কথা তো এই যে, আমাদের উপাস্য দেবতাদের মধ্যে হ’তে কেউ তোমাকে দুর্দশায় ফেলে দিয়েছে। তিনি বললেন, আমি আল্লাহকে সাক্ষী করছি এবং তোমরাও সাক্ষী থেকো, আমি ঐসব কিছু থেকে মুক্ত যাদেরকে তোমরা শরীক সাব্যস্ত করছ তাঁকে ছেড়ে। অনন্তর তোমরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাও, অতঃপর আমাকে সামান্য অবকাশও দিয়ো না’ (হূদ ৫৪-৫৫)

আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাঃ)-কে সম্বোধন করে বলেন, أَلَيْسَ اللهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ وَيُخَوِّفُوْنَكَ بِالَّذِيْنَ مِنْ دُوْنِهِ وَمَنْ يُضْلِلِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ ‘আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? অথচ তারা তোমাকে আল্লাহর পরিবর্তে অপরের ভয় দেখায়। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য কোন পথ প্রদর্শক নেই’ (যুমার ৩৬)

এ ভয়ের উদাহরণ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন, তোমাদেরকে আমি যে, রিযিক দিয়েছি তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের কেউ কি তাতে অংশীদার? বরং তোমরা তাতে সমপর্যায়ের অথচ তোমরা কি তাদেরকে  সেরূপ ভয় কর যেরূপ তোমরা পরস্পরকে ভয় কর? এভাবেই আমি বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলী বিবৃত করি’ (রূম ২৮)

উল্লিখিত আয়াতগুলো দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, গোপন ও প্রকাশ্যে কেবল আল্লাহকেই ভয় করতে হবে, অন্যকে নয়।

আমাদের সমাজে এমনও মানুষ আছে, যারা শুধু মানুষের ভয়ে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা হ’তে বিরত থাকে। এ ধরনের ভয় করা হারাম এবং এক প্রকার শিরক। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, الَّذِيْنَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوْا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيْمَاناً وَقَالُواْ حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيْلُ ‘যাদের লোকেরা বলেছিল, নিশ্চয়ই তোমাদের বিরুদ্ধে লোকজন সমবেত হয়েছে, অতএব তোমরা তাদেরকে ভয় কর। কিন্তু এতে তাদের বিশ্বাস আরো পরিবর্ধিত হয়েছিল এবং তারা বলেছিল আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং মঙ্গলময় কর্মবিধায়ক’ (আলে ইমরান ১৭৩)

ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন, যখন লোকেরা বলল, নিশ্চয়ই তোমাদের বিরুদ্ধে কাফিররা বিরাট সাজ-সরঞ্জামের সমাবেশ করেছে, সুতরাং তোমরা তাদের ভয় কর। একথা তাদের ঈমানের তেজ বাড়িয়ে দিল এবং তারা বলল, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কার্যনির্বাহক।[B13]

ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ آخِرَ قَوْلِ إِبْرَاهِيْمَ حِيْنَ أُلْقِىَ فِى النَّارِ حَسْبِىَ اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ ‘ইবরাহীম (আঃ) যখন আগুনে নিক্ষপ্ত হয়েছিলেন তখন তাঁর শেষ কথা ছিল, আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক’।[B14]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আল্লাহ মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁকে ব্যতীত অন্যকে ভয় না করার। নিশ্চয়ই এই হচ্ছে তোমাদের সেই শয়তান যে তার অনুসারীগণকে ভয় প্রদর্শন করে, কিন্তু যদি তোমরা বিশ্বাসী হও, তবে তাদেরকে ভয় করো না এবং আমাকেই ভয় কর’ (আলে ইমরান ৭৫)

অতএব আল্লাহকে ভয় করা এবং পরকালের শাস্তির ভয় করা, এ উভয়ই হচ্ছে প্রশংসিত ভয়। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্য রয়েছে দু’টি বাগান’ (আর-রহমান ৪৬)। তবে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না।

মোট কথা স্বভাব গত ভয় করতে কোন অসুবিধা নেই। যেমন শুত্রুর ভয়, সাপ বিচ্ছুর ভয়, ডুবে যাওয়ার ও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভয় ইত্যাদি। যেমন মূসা (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় তিনি তথা (মিসর) হ’তে বের হয়ে পড়লেন এবং বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যালিম সম্প্রদায় হ’তে আমাকে রক্ষা করুন’ (ক্বাছাছ ২৮/২১)

এখানে আরো কতিপয় আমল উল্লেখ করা হ’ল, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্যের জন্য করা হ’লে শিরক হবে। যেমন-

ক. মহববতে শিরক

ভালবাসা আল্লাহর জন্যই হ’তে হবে। আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ভালবাসা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُوْنِ اللهِ أَنْدَادًا يُحِبُّوْنَهُمْ كَحُبِّ اللهِ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ ‘আর মানবমন্ডলীর মধ্যে এরূপ কিছু লোক আছে, যারা আল্লাহর মোকাবিলায় অপরকে সমকক্ষ স্থির করে, আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায় তারা তাদেরকে ভালবেসে থাকে এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালবাসা দৃঢ়তর’ (বাক্বারাহ ১৬৫)

মহববত একটি ইবাদত। আলোচ্য আয়াতে এই ইবাদতের কথাই বলা হয়েছে। ইবনে জারীর তাবারী (রহঃ) বলেন, ঐ সমস্ত মুশরিকরা তাদের মূর্তিদেরকে আল্লাহর ইবাদতের সাথে সমকক্ষ স্থির করে এবং তাদেরকে এমনই মহববত করে যেমনভাবে মুমিনগণ আল্লাহকে মহববত করে। অবশ্য যারা মুমিন আল্লাহর প্রতি তাদের ভালবাসা অধিকতর। অন্য কেউ বলেন, এখানে সমকক্ষ স্থির করার অর্থ হ’ল তারা তাদেরকে পাপ কাজের মাধ্যমে অনুসরণ করে।[B15]

আমরা বর্তমান সমাজের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই যে, কবর পূজারীরা তাদের অনুসরণীয় পীরকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করে। আর এজন্য তারা কবরকে সিজদা করে, কবরের কাছে যবেহ করে, মানত করে এবং কবরে শায়িত ব্যক্তির কাছে জীবনের প্রয়োজনীয় সবই চায়। এটা প্রমাণ করে যে, তারা পীরকে আল্লাহর চেয়ে বেশী ভালবাসে? এর দ্বারা আরো প্রমাণিত হয় যে, জাহিলী যুগে যেমনভাবে মুশরিকরা তাদের মূর্তিকে মহববত করত, অনুরূপভাবে বর্তমানে কবর পূজারীরা পীরদেরকে মহববত করে।

মহববত দু’প্রকার : (১) মহববত শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট, এরূপ মহববত যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে করা হয় তাহ’লে তা শিরক হবে। যেমন মুশরিকরা তাদের মূর্তিকে মহববত করে এবং মুরিদরা যেমনভাবে পীরকে মহববত করে। (২) স্বভাবগত ভালবাসা, যেমন পিতা-মাতাকে ভালবাসা, সন্তানদের ভালবাসা, খানা-পিনার প্রতি ভালবাসা, স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ভালবাসা এবং আল্লাহর জন্য মুমিন ব্যক্তিকে আনুগত্যের ভিত্তিতে ভালবাসা ইত্যাদি। এ সকল ভালবাসা যায়েজ।[B16]

খ. আনুগত্যে শিরক :

যে সকল বিষয়ে আল্লাহর আনুগত্য করতে হয়, সে সকল বিষয়ে অন্যের আনুগত্য করা শিরক। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের আলিম ও ধর্ম-যাজকদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে এবং মারিয়ামের পুত্র মাসীহকেও। অথচ তাদের প্রতি শুধু এই আদেশ করা হয়েছিল যে, তারা শুধুমাত্র এক (সত্য) মা‘বূদের ইবাদত করবে যিনি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি তাদের অংশী স্থির করা হ’তে পবিত্র’ (তওবাহ ৩১)

এ আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে যে, ঐ সমস্ত মানুষের কথা যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের আলেম-ওলামাকে এবং ধর্মযাজককে পাপের কাজে অনুসরণ করে। আর তারা যেটা হালাল করে সেটা হালাল হিসাবে মেনে নেয়, অথচ আল্লাহ তা‘আলা সেটা তাদের উপর হারাম করেছেন। আর তাদের আলেম-ওলামা ও ধর্মযাজকরা যেটা হারাম করে সেটা তারা হারাম হিসাবে মেনে নেয়, অথচ আল্লাহ তা‘আলা সেটা হালাল করেছেন।[B17]

আদি বিন হাতেম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে এ আয়াত পড়তে শুনলেন اتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ ‘তারা (ইহুদী ও খৃষ্টানরা) আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় নেতা ও পুরোহিতদেরকে রব হিসাবে গ্রহণ করেছিল’। তখন আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বললাম, يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّهُمْ لَمْ يَكُوْنُوْا يَعْبُدُوْنَهُمْ ‘তারা তো তাদের ইবাদত করে না’? তিনি বললেন, أَجَلْ وَلَكِنْ يُحِلُّوْنَ لَهُمْ مَا حَرَّمَ اللهُ فَيَسْتَحِلُّوْنَهُ وَيُحَرِّمُوْنَ عَلَيْهِمْ مَا أَحَلَّ اللهُ فَيُحَرِّمُوْنَهُ فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ لَهُمْ ‘আচ্ছা আল্লাহর হালাল ঘোষিত জিনিষকে তারা হারাম বললে, তোমরা কি তা হারাম বলে গ্রহণ কর না? আর আল্লাহর হারাম ঘোষিত জিনিষকে তারা হালাল বললে, তোমরা কি তা হালাল বলে গ্রহণ কর না? তখন আমি বললাম, জি হ্যাঁ। তিনি তখন বললেন, এটাই তাদের ইবাদত করার শামিল’।[B18]

উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হচ্ছে যে, আল্লাহ যা হালাল করেছেন সেটাকে হারাম করা শিরক। অনুরূপ তিনি যা হারাম করেছেন সেটাকে হালাল সাব্যস্ত করাও শিরক।

গ. নিয়তে শিরক :

যেকোন কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন স্বার্থে হ’তে হবে। দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে কোন কাজ করলে তার জন্য পরকালে কোন বিনিময় পাওয়া যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যারা শুধু পার্থিব জীবন ও তার জাঁকজমক কামনা করে, আমি তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের (ফল) দুনিয়াতেই পরিপূর্ণ রূপে প্রদান করি এবং দুনিয়াতে তাদের জন্য কিছুই কম করা হয় না। এরা এমন লোক যে, তাদের জন্য আখেরাতে জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নেই। আর তারা যা কিছু করেছিল তা সবই আখেরাতে অকেজো হয়ে যাবে এবং যা কিছু করছে তাও বিফল হবে’ (হূদ ১৫-১৬)

সুতরাং যারা শুধু পার্থিব জীবনের কল্যাণ কামনা করে দুনিয়াতেই তাদের কৃতকর্মের ফল পরিপূর্ণ রূপে দেওয়া হবে। আখিরাতে তাদের জন্য কিছুই থাকবে না। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত করে কেবল পার্থিব জীবনের জন্য, দুনিয়াতে তাকে তার ফল দেওয়া হবে। আর সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

ক্বাতাদা বলেন, যে ব্যক্তির শুধুমাত্র দুনিয়া লাভ উদ্দেশ্য থাকে, দুনিয়াতে তার ফলাফল পরিপূর্ণ করে দেওয়া হবে। কিন্তু সে পরকালে লজ্জিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর মুমিন ব্যক্তিকে দুনিয়া ও আখেরাতে পরিপূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে।[B19]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘কেউ পার্থিব সুখ-সম্ভোগ কামনা করলে আমি যাকে যা ইচ্ছা সত্বর দিয়ে থাকি; পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি, সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও অনুগ্রহ হ’তে দূরীকৃত অবস্থায়। যারা বিশ্বাসী হয়ে পরলোক কামনা করে এবং এর জন্য যথাযথ চেষ্টা করে, তাদের চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে। তোমার প্রতিপালক তাঁর দান দ্বারা এদেরকে ও ওদেরকে সাহায্য করেন এবং তোমার প্রতিপালকের দান (কারো জন্যই) নিষিদ্ধ নয়। লক্ষ্য কর, আমি কিভাবে তাদের এক দলকে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম। পরকাল তো নিশ্চয়ই মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠতর’ (বনী ইসরাঈল ১৮-২১)

তিনি আরো বলেন, مَنْ كَانَ يُرِيْدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَّصِيْبٍ ‘যে আখিরাতের ফসল কামনা করে তার জন্য আমি তার ফসল বর্ধিত করে দিই এবং যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমি তাকে এরই কিছু দিই, আখিরাতে তার জন্য কিছুই থাকবে না’ (শূরা ২০)

নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, লাঞ্ছিত হোক দীনারের গোলাম, দিরহামের গোলাম এবং শালের গোলাম, তাকে দেয়া হ’লে সন্তুষ্ট হয়, না দেয়া হ’লে অসন্তুষ্ট হয়। এরা লাঞ্ছিত হোক, অপমানিত হোক। (তাদের পায়ে) কাঁটা বিদ্ধ হ’লে তা কেউ তুলে দিবে না। ঐ ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ, যে ঘোড়ার লাগাম ধরে জিহাদের জন্য প্রস্ত্তত রয়েছে, যার মাথার চুল উস্ক-খুসক এবং পা ধূলি মলিন। তাকে পাহারায় নিয়োজিত করলে পাহারায় থাকে। আর পিছনে পিছনে রাখলে পিছনেই থাকে। সে কারো সাক্ষাতের অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেয়া হয় না এবং কোন বিষয়ে সুফারিশ করলে, তার সুফারিশ কবুল করা হয় না’।[B20]

৬. আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকটে বরকত চাওয়া :

বরকতের মালিক কেবল আল্লাহ তা‘আলা। তাই আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন মানুষের নিকট বরকত চাওয়া যাবে না। আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকটে বরকত প্রার্থনা শিরক। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَفَرَأَيْتُمُ اللاَّتَ وَالْعُزَّى، وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও উযযা সম্বন্ধে এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্বন্ধে? (নাজম ১৯-২০)

আল্লামা ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালি (রহঃ) বলেন, মূর্তিপূজার অন্যতম হচ্ছে যে, মুরিদরা মূর্তির নিকট বরকত চায়, তাকে অধিক সম্মান করে, তার নিকট সাহায্য চায়, তার উপর আশা-ভরসা করে, তার কাছে শাফা‘আত চায় ইত্যাদি। এসব কাজ শিরক। যেমনটি কবরপূজারীরা নেক্কার ব্যক্তির কবরের নিকট করে থাকে। অনুরূপভাবে লাত, মানাত, উযযা এবং গাছপালা-পাথর ইত্যাদিকে মুশরিকরা পূজা করত। কোন ব্যক্তির মাযারে গিয়ে বরকত চাওয়া, সম্মান করা, শাফা‘আত ও সাহায্য চাওয়া, সবই শিরক।[C1]

আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এ ধরনের বরকত নিতে নিষেধ করেছেন। আবু ওয়াক্বীদ আল-লায়ছী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে হুনাইনের (যুদ্ধের) উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম। আমরা তখন সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছি। এক স্থানে মূর্তিপূজকদের একটি কুল গাছ ছিল; যার চার পার্শ্বে তারা বসত এবং তাদের সমরাস্ত্র ঝুলিয়ে রাখত। গাছটিকে তারা ‘যাতু আনয়াত’ বলত। আমরা একদিন একটি কুল গাছের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! মুশরিকদের যেমন ‘যাতে আনয়াত’ আছে, আমাদের জন্যও অনুরূপ যাতে আনয়াত (একটি গাছ নির্ধারণ) করুন। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আল্লাহু আকবার তোমাদের এ দাবীতো পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতি ছাড়া কিছুই নয়। যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর কসম করে বলছি, তোমরা এমন কথা বলছ, যা বাণী ইসরাঈল মূসা (আঃ)-কে বলেছিল। তারা বলেছিল, হে মূসা! তাদের যেরূপ মা‘বূদ রয়েছে, আমাদের জন্যও ঐরূপ মা‘বূদ বানিয়ে দিন। তখন মূসা বললেন, তোমরা একটি গন্ডমূর্খ জাতি (আ‘রাফ ১৩৮)। তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতিই অনুসরণ করছ।[C2]

কুরআন ও হাদীছ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, কুল গাছে অস্ত্র-শস্ত্র ঝুলিয়ে বরকত নেওয়া শিরক। ইমাম ত্বারতুশি বলেন, লক্ষ্য কর, আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করুন। তোমরা যেখানে কুল গাছ (অথবা যেকোন গাছ) যার দ্বারা মানুষের উদ্দেশ্য থাকে গাছটিকে সম্মান করা এবং তার থেকে কোন রোগের আরোগ্য কামনা করা এবং বরকতের উদ্দেশ্যে অস্ত্র-শস্ত্র ঝুলিয়ে রাখা, এরূপ গাছ যেখানেই পাবে, সেটাই যাতে আনয়াত। বিধায় তাকে কেটে ফেল।[C3]

ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যে গাছের নীচে বসে ছাহাবীদের বায়‘আত নিয়েছিলেন, সে গাছটিকে তিনি কাটতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কেননা মানুষেরা গাছটির ছায়াতলে আশ্রয় নিত (বরকত নেওয়ার জন্য)। ইবনে ওমর ফিৎনার ভয় করে গাছটি কেটে ফেলেন।[C4]

যেসব বিষয়ে মানুষকে ফিৎনা-ফাসাদে ফেলে সেগুলোকে সমূলে উৎখাত করা শরী‘আত সম্মত হবে, যদিও সেটা কোন মানুষ হয় কিংবা কোন জীব-জন্তু অথবা কোন জড় পদার্থ হয়।[C5]

ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, গাছ-পাথর, অথবা প্রতিমা-মূর্তি, ভাষ্কর্য ইত্যাদির পার্শ্বে (বরকতের উদ্দেশ্যে) অবস্থান করা অথবা নবী করীম (ছাঃ) বা অন্যদের কবরে, অথবা নবী যেখানে বসতেন সেখানে বা কোন পীর-আওলিয়ার স্থানে বসা, অবস্থান করা কোন মুসলমানদের দ্বীন নয়, বরং সেটা মুশরিকদের দ্বীনের ন্যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো এর পূর্বে ইবরাহীমকে সৎ পথের জ্ঞান দিয়েছিলাম এবং আমি তাঁর সম্বন্ধে ছিলাম সম্যক অবগত। যখন তিনি তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন; এই প্রতিমাগুলি কী? যেগুলোর পূজায় তোমরা রত আছ? তারা বলল, আমরা আমাদের পিতৃ পুরুষদেরকে এদের পূজাকারী হিসাবে পেয়েছি। তিনি বললেন, তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের পিতৃ-পুরুষরাও রয়েছে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে। তারা বলল, তুমি কি আমাদের নিকট সত্য বাণী নিয়ে এসেছ, না তুমি খেল-তামাশা করছ? তিনি বললেন, না, তোমাদের প্রতিপালক তো আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন এবং এই বিষয়ে আমি অন্যতম সাক্ষী। শপথ আল্লাহর! তোমরা চলে গেলে আমি তোমাদের প্রতিমাগুলি সম্বন্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা অবলম্বন করব। অতঃপর তিনি সেগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলেন তাদের বড় (প্রধান) প্রতিমাটি ব্যতীত, যাতে তারা তার দিকে ফিরে আসে’ (আম্বিয়া ৫১-৫৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘তাদের নিকট ইবরাহীমের বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। তিনি যখন তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা কিসের ইবাদত কর? তারা বলল, আমরা প্রতিমার পূজা করি এবং আমরা নিষ্ঠার সাথে তাদের সম্মানে রত থাকি। তিনি বললেন, তোমরা প্রার্থনা করলে তারা কি শোনে? অথবা তারা কি তোমাদের উপকার কিংবা অপকার করতে পারে? তারা বলল, বরং আমরা আমাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে এরূপই করতে দেখেছি। তিনি বললেন, তোমরা কি সেগুলো সম্বন্ধে ভেবে দেখেছ, যেগুলোর পূজা করছ? তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব পুরুষরা, তারা সবাই আমার শত্রু, জগত সমূহের প্রতিপালক ব্যতীত। তিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শ করেন। তিনিই আমাকে দান করেন আহার্য ও পানীয় এবং রোগাক্রান্ত হ’লে তিনিই আমাকে রোগ মুক্ত করেন। আর তিনিই আমার মৃত্যু ঘটাবেন। অতঃপর আমাকে পুনর্জীবিত করবেন। আশা করি তিনি ক্বিয়ামত দিবসে আমার অপরাধ সমূহ মার্জনা করে দিবেন’ (শু‘আরা ৬৯-৮২)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমি বাণী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করিয়ে দিলাম, অতঃপর তারা প্রতিমা পূজায় রত এক জাতির সংস্পর্শে আসল, তখন তারা বলল, হে মূসা! তাদের যেরূপ মা‘বূদ রয়েছে, আমাদের জন্যও ঐরূপ মা‘বূদ বানিয়ে দিন। তখন মূসা বললেন, তোমরা একটি গন্ডমূর্খ জাতি। এসব লোক যে কাজে লিপ্ত রয়েছে, তা তো ধ্বংস করা হবে, আর তারা যা করছে তা অমুলক ও বাতিল বিষয়। তিনি আরো বললেন, আমি কি আল্লাহকে ছেড়ে তোমাদের জন্য অন্য কোন মা‘বূদের সন্ধান করব? অথচ তিনিই হ’লেন একমাত্র আল্লাহ যিনি তোমাদেরকে বিশ্বজগতে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন’ (আ‘রাফ ১৩৮-১৪০)

সুতরাং এটাই হচ্ছে মুশরিকদের অবস্থান। আর মুমিনগণ আল্লাহর ঘর মসজিদে অবস্থান ও ইবাদত করেন, যিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। পক্ষান্তরে মুশরিকরা প্রতিমার পার্শ্বে, কবরের পার্শ্বে, মাযারের পার্শ্বে অবস্থান করে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের ইবাদত করে এবং তাদেরই নিকট আশা-ভরসা করে, তাদেরকেই ভয় করে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের কাছেই শাফা‘আত চায়।[C6]

৭. আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকটে শাফা‘আত প্রার্থনা করা :

শাফা‘আত আল্লাহর নিকট চাইতে হবে, কোন মাযার বা কোন পীর, ওলী-আওলিয়ার নিকটে নয়। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,أَمِ اتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِ اللهِ شُفَعَاءَ قُلْ أَوَلَوْ كَانُوْا لاَ يَمْلِكُوْنَ شَيْئًا وَلاَ يَعْقِلُوْنَ، قُلْ لِلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيْعًا لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ ‘তারা কি আল্লাহ ছাড়া অপরকে শাফা‘আতকারী গ্রহণ করেছে? বল, যদিও তারা কোন ক্ষমতা রাখে না এবং তারা বুঝে না? হে নবী! বলুন, যাবতীয় শাফা‘আত আল্লাহরই ইখতিয়ারে, আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। অতঃপর তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (যুমার ৪৩-৪৪)।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَيَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لاَ يَضُرُّهُمْ وَلاَ يَنْفَعُهُمْ وَيَقُوْلُوْنَ هَؤُلاَءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللهِ قُلْ أَتُنَبِّئُوْنَ اللهَ بِمَا لاَ يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلاَ فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُوْنَ ‘আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন বস্ত্ত সমূহেরও ইবাদত করে যারা তাদের কোন অপকারও করতে পারে না এবং তাদের কোন উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকট আমাদের সুফারিশকারী। আপনি বলুন! তোমরা কি আল্লাহকে এমন বিষয়ের সংবাদ দিচ্ছ যা তিনি অবগত নন, না আকাশ সমূহে, এবং না যমীনে? তিনি পবিত্র ও তাদের মুশরিকী কার্যকলাপ হ’তে অনেক ঊর্ধ্বে’ (ইউনুস ১৮)

আলোচ্য আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যের নিকট শাফা‘আত চাইবে, সে মুশরিক।[C7]

আল্লামা ইসমাঈল দেহলভী বলেন, আয়াতটি দ্বারা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, অবশ্যই যে কোন ব্যক্তি কোন সৃষ্টি জীবের ইবাদত করে এ বিশ্বাসে যে, সে তার জন্য আল্লাহর নিকট শাফা‘আত করবে, সে শিরক করল এবং মুশরিক হয়ে গেল। কেননা আল্লাহ বলেন, যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করে, তারা বলে আমরা তো এদের পূজা এজন্যই করি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে দিবে। তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে আল্লাহ তাঁর ফায়ছালা করে দিবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, আল্লাহ তাকে সৎপথে পরিচালিত করবেন না’।[C8]

আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্যই, তাঁর সাথে অন্যকে অংশীদার স্থাপন করার জন্য নয়। সুতরাং কোন ব্যক্তি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যের পূজা করলে, যে তার কোন উপকার ও অপকার কোনটাই করতে পারবে না, যদিও তিনি ফেরেশতা অথবা নবী হন। এ ধরনের ইবাদত শিরক হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে নবী! বলুন, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে মা‘বূদ মনে কর তাদেরকে আহবান কর; দেখবে তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করবার শক্তি তাদের নেই। তারা যাদেরকে আহবান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে তাদের মধ্যে কে কত নিকটতর হ’তে পারে, তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ’ (বানী ইসরাঈল ৫৬-৫৭)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘হে নবী বলুন! তোমরা আহবান কর তাদেরকে যাদেরকে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে (মা‘বূদ) মনে করতে, তারা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে অণু পরিমাণ কিছুর মালিক নয় এবং এতদুভয়ে তাদের কোন অংশও নেই এবং তাদের কেউ তার সহায়কও নয়। যাকে অনুমতি দেয়া হয়, তার ছাড়া আল্লাহর নিকট কারো সুফারিশ ফলপ্রসূ হবে না। পরে যখন তাদের অন্তর হ’তে ভয় বিদূরিত হবে তখন তারা পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, তোমাদের প্রতিপালক কি বললেন? তদুত্তরে তারা বলবে, যা সত্য তিনি তাই বলেছেন। তিনি সর্বোচ্চ মহান’ (সাবা ২২-২৩)

আলোচ্য আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, ক্বিয়ামতের দিন কারো কোন সুফারিশ কাজে আসবে না। তবে আল্লাহ তা‘আলা যাকে অনুমতি দিবেন এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন তাকে ব্যতীত। তাই মহান আল্লাহ বলেন, وَكَم مِّن مَّلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لاَ تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئاً إِلاَّ مِن بَعْدِ أَن يَأْذَنَ اللهُ لِمَن يَشَاءُ وَيَرْضَى ‘আকাশ সমূহে কত ফেরেশতা রয়েছে, তাদের কোন সুফারিশ কাজে আসবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন’ (নাজম ২৬)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, পীর বা অলী-আওলিয়াগণ ক্বিয়ামতের দিন তাদের মুরীদগণকে সুফারিশ করে জান্নাতে পাঠাবে, এ ধারণা ভুল ও বাতিল। ক্বিয়ামতের দিন সবাই ভয়ে ভীত হয়ে থাকবে, এমনকি নবী-রাসূলগণও। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, মা‘বাদ ইবনু হিলাল আল-আনাযী হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা বছরাবাসী কিছু লোক একত্রিত হয়ে আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-এর কাছে গেলাম। আমাদের সঙ্গে ছাবিত (রাঃ)-কে নিলাম, যাতে তিনি আমাদের কাছে আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত শাফা‘আত সম্পর্কে হাদীছ জিজ্ঞেস করেন। আমরা তাঁকে তাঁর মহলেই চাশতের ছালাতরত পেলাম। তাঁর কাছে প্রবেশের অনুমতি চাইলে তিনি আমাদেরকে অনুমতি দিলেন। তখন তিনি তাঁর বিছানায় উপবিষ্ট অবস্থায় ছিলেন। অতঃপর আমরা ছাবিত (রাঃ)-কে অনুরোধ করলাম, তিনি যেন শাফা‘আতের হাদীছটি জিজ্ঞেস করার পূর্বে অন্য কিছু জিজ্ঞেস না করেন। তখন ছাবিত (রাঃ) বললেন, হে আবূ হামযাহ! এরা বছরাবাসী আপনার ভাই, তারা শাফা‘আতের হাদীছ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছে। অতঃপর আনাস (রাঃ) বললেন, আমাদের নিকট মুহাম্মাদ (ছাঃ) হাদীছ বর্ণনা করেছেন যে, ‘ক্বিয়ামতের দিন মানুষ সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। তাই তারা আদম (আঃ)-এর কাছে এসে বলবে, আমাদের জন্য আপনার রবের নিকট সুফারিশ করুন। তিনি বলবেন, এ কাজের আমি যোগ্য নই। বরং তোমরা ইবরাহীম (আঃ)-এর কাছে যাও। কারণ তিনি হ’লেন আল্লাহর খলীফা। তখন তারা ইবরাহীম (আঃ)-এর কাছে যাবে। তিনি বলবেন, আমি এ কাজের জন্য নই। তবে তোমরা মূসা (আঃ)-এর কাছে যাও। কারণ তিনি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন। তখন তারা মূসা (আঃ)-এর কাছে আসবে। তিনি বলবেন, আমি তো এ কাজের জন্য নই। তোমরা ঈসা (আঃ)-এর কাছে যাও। কারণ তিনি আল্লাহর রূহ ও বাণী। তারা তখন ঈসা (আঃ)-এর কাছে আসবে। তিনি বলবেন, আমি তো এ কাজের জন্য নই। তোমরা বরং মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কাছে যাও। এরপর তারা আমার কাছে আসবে। আমি বলব, আমিই এ কাজের জন্য। আমি তখন আমার রবের নিকট অনুমতি চাইব। আমাকে অনুমতি দেওয়া হবে। আমাকে প্রশংসাসূচক বাক্য ইলহাম করা হবে, যা দিয়ে আমি আল্লাহর প্রশংসা করব। যেগুলো এখন আমার জানা নেই।

আমি সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে প্রশংসা করব এবং সিজদায় পড়ে যাব। তখন আমাকে বলা হবে, ইয়া মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। তুমি বল, তোমার কথা শোনা হবে। চাও, দেয়া হবে। সুফারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। তখন আমি বলব,  হে আমার প্রতিপালক! আমার উম্মত! আমার উম্মত! বলা হবে যাও, যাদের হৃদয়ে যবের দানা পরিমাণ ঈমান আছে, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে দাও। আমি গিয়ে এমনই করব। তারপর আমি ফিরে আসব এবং পুনরায় সেসব প্রশংসা বাক্য দ্বারা আল্লাহর প্রশংসা করব এবং সিজদায় পড়ে যাব। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। তোমার কথা শোনা হবে। চাও, দেয়া হবে। সুফারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। তখন আমি বলব, হে আমার রব! আমার উম্মত! আমার উম্মত! তখন বলা হবে, যাও, যাদের অন্তরে এক অণু কিংবা সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের কর। আমি গিয়ে তাই করব। আমি আবার ফিরে আসব এবং সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করব। আর সিজদায় পড়ে যাব। আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও বল, তোমার কথা শোনা হবে। চাও দেয়া হবে। সুফারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। আমি তখন বলব। হে আমার রব! আমার উম্মত। আমার উম্মত। এরপর আল্লাহ বলবেন, যাও যাদের অন্তরে সরিষার দানার চেয়েও অতি ক্ষুদ্র পরিমাণ ঈমান আছে, তাদেরকেও জাহান্নাম থেকে বের করে আন। আমি যাব এবং তাই করব।

আমরা যখন আনাস (রাঃ)-এর নিকট থেকে বের হয়ে আসছিলাম, তখন আমি আমার সঙ্গীদের কোন একজনকে বললাম, আমরা যদি আবু খলীফার বাড়িতে নিজেকে গোপনে রাখা হাসান বছরীর কাছে গিয়ে আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি তাঁর কাছে বর্ণনা করতাম। এরপর আমরা হাসান বছরীর কাছে এসে তাঁর কাছে অনুমতির সালাম দিলাম। তিনি আমাদের প্রবেশের অনুমতি দিলেন। আমরা তাঁকে বললাম, হে আবু সাঈদ! আমরা আপনার ভাই আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-এর নিকট হ’তে আপনার কাছে আসলাম। শাফা‘আত বিষয়ে তিনি যেমন বর্ণনা দিয়েছেন, তেমন বর্ণনা করতে আমরা আর কাউকে শুনিনি। তিনি বললেন, আমার কাছে সেটি বর্ণনা কর। আমরা তাঁকে হাদীছটি বর্ণনা করে শোনালাম। তিনি বললেন, আরো বর্ণনা কর। আমরা বললাম, তিনি তো এর অধিক আমাদের কাছে বর্ণনা করেননি। তিনি বললেন, জানি না, তিনি কি ভুলেই গেলেন, না তোমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়বে বলে বাকীটুকু বর্ণনা করতে অপসন্দ করলেন? বিশ বছর আগে যখন তিনি শক্তি-সামর্থ্যে ও স্মরণ শক্তিতে দৃঢ় ছিলেন, তখন আমার কাছেও হাদীছটি বর্ণনা করেছিলেন। আমরা বললাম, হে আবু সাঈদ! আমাদের কাছে হাদীছটি বর্ণনা করুন। তিনি হাসলেন এবং বললেন, মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে খুব বেশী ধ্রুততাপ্রিয় করে। আমিতো বর্ণনার উদ্দেশ্যেই তোমাদের কাছে বিষয়টি উল্লেখ করলাম। তিনি তোমাদের কাছে যা বর্ণনা করেছেন, আমার কাছেও তা বর্ণনা করেছেন, তবে পরে এটুকুও বলেছিলেন, আমি চতুর্থবার ফিরে আসব এবং সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করব এবং সিজদায় পড়ে যাব। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। বল, তোমার কথা শোনা হবে। চাও, দেয়া হবে। শাফা‘আত কর, গ্রহণ করা হবে। আমি বলব, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তাদের সম্পর্কে শাফা‘আত করার অনুমতি দান কর, যারা ‘লা-ইলা-হা ইল্লাহ’ বলেছে। তখন আল্লাহ বলবেন, আমার ইয্যত, আমার পরাক্রম, আমার বড়ত্ব ও আমার মহত্বের শপথ! যারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে, আমি অবশ্য অবশ্যই তাদের সবাইকে জাহান্নাম থেকে বের করব’।[C9]

আলোচ্য হাদীছ থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, কোন পীর, অলী-আওলিয়া বা কোন সৎ মানুষের শাফা‘আত করার কোন অধিকারই থাকবে না। শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলা যাকে অনুমতি দিবেন এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন সে ব্যতীত। উপরোক্ত হাদীছ দ্বারা আরো জানা যায় যে, সকল নবী-রাসূলই নিজ নিজ ওযর পেশ করবেন এবং বলবেন আমি এ কাজের যোগ্য নই। সবশেষে রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর প্রশংসা করবেন এবং সিজদায় পড়ে কাঁদবেন তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে শাফা‘আতের অনুমতি দিবেন। সেদিন নবী করীম (ছাঃ) শিরককারীদের জন্য শাফা‘আত করবেন না। শুধুমাত্র তাওহীদপন্থীদের জন্য শাফা‘আত করবেন। আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ক্বিয়ামতের দিন আপনার শাফা‘আত দ্বারা সমস্ত মানুষ থেকে অধিক ভাগ্যবান হবে কোন ব্যক্তি? তখন তিনি বলবেন, হে আবু হুরায়রাহ! আমি ধারণা করেছিলাম যে, তোমার আগে কেউ এ ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করবে না। কারণ হাদীছের প্রতি তোমার চেয়ে বেশী আগ্রহী আমি আর কাউকে দেখিনি। ক্বিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত দ্বারা সবচেয়ে ভাগ্যবান ঐ ব্যক্তি হবে যে বিশুদ্ধ অন্তরে বলে ‘আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা‘বূদ নেই’।[C10]

মানুষ গুনাহ করলেই কাফের হয়ে যায় না এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামীও হয় না। বরং জাহান্নামী হওয়া, না হওয়া আল্লাহর হাতে। যেমন হাদীছে এসেছে, উবাদাহ ইবনু ছামিত (রাঃ) যিনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও লায়লাতুল আকাবার একজন নকীব ছিলেন তিনি বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর পাশে একজন ছাহাবীর উপস্থিতিতে তিনি বলেন, তোমরা আমার নিকট এই মর্মে বায়‘আত গ্রহণ কর যে, আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে অংশীদার সাব্যস্ত করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করবে না এবং সৎ কাজে নাফরমানী করবে না। তোমাদের মধ্যে যে তা পূর্ণ করবে, তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট রয়েছে। আর কেউ এর কোন একটিতে লিপ্ত হ’লে এবং  দুনিয়াতে তার শাস্তি পেয়ে গেলে, তা হবে তার জন্য কাফফারা। আর কেউ এর কোন একটিতে লিপ্ত হয়ে পড়লে এবং আল্লাহ তা অপ্রকাশিত রাখলে, তবে তা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি যদি চান, তাকে মার্জনা করবেন আর যদি চান, তাকে শাস্তি প্রদান করবেন। আমরা এর উপর বায়‘আত গ্রহণ করলাম।[C11]

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘জান্নাতবাসীরা জান্নাতে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের বলবেন, যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান আছে, তাকে জাহান্নাম হ’তে বের করে আন। তারপর তাদের জাহান্নাম হ’তে এমন অবস্থায় বের করা হবে যে, তারা পুড়ে কালো হয়ে গেছে। অতঃপর তাদের বৃষ্টিতে বা হায়াতের (বর্ণনাকারী মালিক  (রহঃ) শব্দ দু’টোর কোনটি এ সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন) নদীতে নিক্ষেপ করা হবে। ফলে তারা সতেজ হয়ে উঠবে, যেমন নদীর তীরে ঘাসের বীজ গজিয়ে ওঠে। তুমি কি দেখতে পাও না সেগুলো কেমন হলুদ বর্ণের হয় ও ঘন হয়ে গজায়?[C12] ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) সূত্রে নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শাফা‘আতে একদল লোককে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদেরকে জাহান্নামী বলেই সম্বোধন করা হবে।[C13]

বরকত দান ও শাফা‘আতের মালিক কেবল মহান আল্লাহ। এগুলো করার কোন ক্ষমতা কোন মানুষের নেই। সেজন্য কোন মানুষ বা পীর, অলী, গাউছ-কুতুবকে শাফা‘আতকারী মানা যাবে না, তাদের নিকটে বরকতও প্রার্থনা করা যাবে না। যেখানে নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ব্যতীত অন্য কোন নবী-রাসূল শাফা‘আত করার সামর্থ্য রাখেন না, সেখানে সাধারণ মানুষ কি করে সুফারিশ করতে পারে। সুতরাং এ ব্যাপারে সকলকে সাবধান হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেফাযত  করুন- আমীন!

– হাফেয আব্দুল মতীন


[A11]. লোক্বমান ১৩; ছহীহুল বুখারী হা/৩৪২৯

[A12]. বুখারী হা/৬২৬৭, ৫৯৬৭, ২৮৫৬; মুসলিম হা/৩০, ১৪৪

[A13]. বুখারী হা/১২৩৮; মুসলিম হা/২৬৮

[A14]. বুখারী হা/৪৪৯৭

[A15]. মুসলিম হা/২৭০

[A16]. আহমাদ ২০/৬৫, হা/১২৬১৪, সনদ জাইয়িদ

[A17]. আশ-শেফা ২/২৯১-২৯২

[A18]. বুখারী হা/৪৩৭

[A19]. আত-তামহীদ ৬/৩৮৩

[A20]. আত-তামহীদ ৫/৪৫

[A21]. বুখারী হা/৪৩৪

[A22]. মুওয়াত্ত্বা মালেক ২/৭২ হা/৪৫২, সনদ ছহীহ মুরসাল, আত-তামহীদ ৫/৪২-৪৩; নাছীরুদ্দীন আলবানী একে ছহীহ বলেছেন।  দ্র. তাহযীরুস সাজেদ, পৃঃ ২৫ হা/১১।

[A23]. বাহরুর রায়েক ৫/১২৪; রূহুল মা‘আনী ১৭/২১৩; মিরক্বাত ২/২০২; আবু হানীফা, উছূলুদ্দীন পৃঃ ২৬০।

[A24]. জুহূদুল মালেকিয়্যাহ, পৃঃ ৪৩৯-৪৪৬

[B1]. শায়খ আব্দুল্লাহ সুলায়মান, তাইসীরুল আযীযিল হামীদ, পৃঃ ১৫২

[B2]. তুহফাতুল ফুকাহা ৩/৬৭ পৃঃ; উছূলুদ্দীন পৃঃ ২৬০

[B3]. ছহীহ মুসলিম হা/১৯৭৮

[B4]. তাইসীরুল আযীযিল হামীদ, পৃঃ ১৬১

[B5]. তদেব

[B6]. বুখারী হা/৬৭০০

[B7]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৪২৯

[B8]. তিরমিযী হা/২৫১৬, সনদ হাসান ছহীহ

[B9]. শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ ১/১১৫-১৬ পৃঃ

[B10]. তাইসীরুল আযীযিল হামীদ পৃঃ ১৯৫

[B11]. উছূলুদ দ্বীন, পৃঃ ২৬০

[B12]. ছিয়ানাতুল ইনসান, পৃঃ ১/৩৩৭

[B13]. বুখারী হা/৪৫৬৩

[B14]. বুখারী হা/৪৫৬৪

[B15]. ত্বাবারী, জামেউল বয়ান ৩/১৭ পৃঃ

[B16]. ইবনুল কায়্যেম, তরীকুল হিজরাতাইন, পৃঃ ২৪৪-৪৫

[B17]. জামেউল বয়ান ১১/৪১৭ পৃঃ

[B18]. তিরমিযী হা/৩০৯৫, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২৯৩

[B19]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৪/৩২৩-২৪

[B20]. বুখারী হা/২৮৮৭

[C1]. আদ-দ্বীনুল খালেছ ২/১৭৭-৭৮

[C2]. তিরমিযী হা/২১৮০, সনদ ছহীহ

[C3]. আল-হাওয়াদিছ ওয়াল বিদা‘ পৃঃ ১০৫

[C4]. তদেব, পৃঃ ১৪৮, ১৬০; ফতহুল বারী ৭/৪৪৮

[C5]. ফতহুল বারী ৮/৭৩

[C6]. ইবনু তায়মিয়া, ইকতেযাউছ ছিরাতিল মুস্তাকীম ২/৮১৮-১৯

[C7]. যিয়ারাতুল কুবূর আশ-শারইয়াহ ও শিরকিয়াহ, পৃঃ ৩৩-৩৫

[C8]. যুমার ৩; রিসালাতুত তাওহীদ, পৃঃ ৫৩-৫৪

[C9]. বুখারী হা/৭৫১০

[C10]. বুখারী হা/৬৫৭০

[C11]. বুখারী হা/১৮

[C12]. বুখারী হা/২২

[C13]. বুখারী হা/৬৫৬৬

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button