একটি মৃত্যু : কিছু জরুরী ভাবনা
গত ২১ ডিসেম্বর ২০১২ রোজ জুমাবার জুমার আজানের সময় আমার শ্বশুর ইন্তেকাল করেন। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। (তাঁর ভাষায়) ‘আলেম’ (আসলে তালিবুল ইলম) জামাই পেয়ে তাঁর তৃপ্তি ও গর্বের অন্ত ছিল না। পুত্রবৎ জামাই তাঁর জানাযার সালাত পড়াবে বলে তিনি কতবারই না আগাম তৃপ্তি ও মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন। সাতদিন আগে মৃত্যুশয্যা ও বাকরুদ্ধ হবার বার্তা শুনে তাঁর মেয়েসহ ছুটে এলাম। শিয়রে দাঁড়াতেই বোবা কান্নায় চোখ ভেসে দিলেন। মৃত্যুকালে যদি তাঁর পাশে না থাকতে পারি সে শংকায় তিনবার প্রস্তুতি নিয়েও ঢাকায় যাই নি। কেন জানি মন টানছিল না। মনে হচ্ছিল আমি যাওয়া মাত্র যদি তিনি চলে যান। স্নেহের ‘পুত্র’কে ডেকে কাছে না পান। মাওলানা লাবীব আব্দুল্লাহ ভাইয়ের মতো নেককার মানুষের পর আমার মনও বলছিল আমাদের নির্বিবাদী অতি সাদাসিধে মুরব্বী হয়তো জুমাবারেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন।
তারপর এলো সেই জুমাবার। আলালপুরের সফল ব্যবসায়ী মাওলানা এবং হবু ড. (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করছেন) মোস্তফা ভাইয়ের বহুল উচ্চারিত দাবি, ‘শুক্রবার আপনি ময়মনসিংহে থাকলে অবশ্যই জুমা পড়াতে হবে আমাদের মসজিদে’। তাঁর দাবি আর লাবীব আব্দুল্লাহ ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে সেখানেই জুমা পড়ার সিদ্ধান্ত হলো। আমার লাবীব ভাইয়ের সহযাত্রী হবার বার্তা পেয়ে আরও কয়েকজন সুহৃদ ও বন্ধু মাওলানা আমাদের সঙ্গী হলেন। গোসল সেরে দৌড়ে বের হলাম জুমা পড়াবার তাগিদে। গেট পেরিয়ে রাস্তামুখো হতে কেন যেন মন পেছনে টান দিল। বাসায় ফিরে এসে তাঁর চন্দ্রানন মুখে হাত বুলিয়ে বললাম, আব্বা, আপনি কী বলছেন? অস্ফূট স্বরে বললেন, ‘আল্লাহ’। ‘আপনি এটাই বলতে থাকেন আমি নামাজ পড়ে আসি বলে বেরিয়ে গেলাম’। মসজিদে গিয়ে যখন মিম্বারে বসতে যাচ্ছি তখনই ফোনটা কেঁপে উঠল। রিসিভ করার আগেই বুঝলাম কী হয়েছে! সমবেত মুসল্লির বিস্ফোরিত দৃষ্টির সামনে আমাকে পড়তে হলো, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজীঊন’। সেদিনের জুমার ভাষণে আমার আলোচনার বিষয় ছিল, ‘ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা’। মুহূর্তেই তা বদলে হয়ে গেল, ‘মৃত্যু : সকল প্রাণীর অপরিহার্য পরিণতি’।
বাদ মাগরিব নামাজে জানাযা হলো। মৃত্যুর দিন জুমাবার এবং জানাযায় মুসল্লির সংখ্যা দেখে বেদনার মধ্যেও সুখ অনুভব করলাম। মরহুমের প্রত্যাশা মতো নামাজ পড়ানোর সৌভাগ্যের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। বাসার সবাইকে শোক-কান্না ভুলে তাঁর জন্য দো‘আ করতে বলা হলো। কবরস্থ করা থেকে নিয়ে এখানে কাটানো বাকি দিনগুলোয় স্থানীয় অনেক কুসংস্কার ও কুপ্রথা দেখলাম। সাধ্যমত সংশোধন ও প্রতিহত করার চেষ্টা করলাম। তথ্যপ্রযুক্তির এই চরমোৎকর্ষের যুগেও মানুষ যে ধর্মীয় নিরেট জ্ঞান থেকে এত দূরে তা ভেবে যুগপৎ বেদনা এবং দাওয়াতী কাজ এবং লেখালেখিতে সক্রিয় হবার আরও প্রেরণা বোধ করলাম।
মৃত্যুর দ্বিতীয় দিন বাদ মাগরিব গেলাম শ্যালককে নিয়ে কবরস্থানে। শীতের তীব্রতায় সারাদেশ যখন জবুথবু, আমাদের মতো কর্মচঞ্চল জোয়ানরাও যখন বাধ্য হয়ে ঘরমুখো, তখন অশীতিপর শ্বশুরকে এই নিঃসঙ্গ কবরে শোয়ানোর সদ্যস্মৃতি ভাবনার জগতে ঝড় তুলল। ব্রহ্মপুত্র নদীঘেঁষা কবরস্থানে ঢুকে প্রথমে দেখলাম কেউ নেই। বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। কুয়াশাচ্ছন্ন কবরের কাছে গিয়ে যখন সুন্নাত মোতাবেক কাজ সারছিলাম, তখন নদীর শীতল জলচুম্বন করা বাতাস যেন শরীরে সুইয়ের মতো বিঁধতে লাগলো। অথচ হায়, এখানেই তো চব্বিশ ঘন্টা আগে আমাদের পরম প্রিয় শ্বশুরকে মাটির কাঁচা কবরে রেখে গেলাম। অবধারিত ওই সাদা পোশাক ছাড়া তাকে শীতবস্ত্র দেবার কোনো সুযোগ ছিল না সন্তানদের। যারা গতকালও তাঁর সুখের জন্য মুহূর্তে পানির মতো টাকা ঢেলেছে, মাটি বিছিয়ে একে একে তারা সবাই বিদায় নিয়েছে।
আমার নাতিদীর্ঘ জীবনে নিকটাত্মীয় কাউকে কবরে শোয়ানোর সুযোগ ঘটে নি। শ্বশুরকে কবরে শোয়াতে গিয়ে বুঝলাম এ কেমন নিঠুর সত্য। আজ আবার এ সত্যের মুখোমুখী হয়ে স্থির থাকতে পারলাম না। গতকাল লাশ দেখে সবার কান্নার স্রোতের বিপরীতে যেখানে কর্তব্যে অটল ছিলাম। আজ এ শীতার্ত সন্ধ্যায় কবরের কাছে সেই সংযমের যেন বাঁধ ভেঙ্গে গেল। শিকড় সাহিত্য মাহফিলের অফিসে প্রাণবন্ত সাহিত্য আড্ডার লোভনীয় হাতছানিতেও সাড়া দিতে পারলাম না। রাতে শোবার আগ পর্যন্ত চোখের অবিরল ধারা অবিরলই থাকল। কেবল স্ত্রীর কাছেই ব্যক্ত করলাম এ বাঁধহীন কান্নার আসল কারণ।
পবিত্র কুরআনে কতবার পড়লাম,
﴿كُلُّ نَفۡسٖ ذَآئِقَةُ ٱلۡمَوۡتِۗ وَنَبۡلُوكُم بِٱلشَّرِّ وَٱلۡخَيۡرِ فِتۡنَةٗۖ وَإِلَيۡنَا تُرۡجَعُونَ ٣٥﴾ [الانبياء: ٣٥]
‘প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে; আর ভাল ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।’ {সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত : ৩৫} -এর মতো কুরআনের অমীয় বাণী কতবার পড়েছি।
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ»
‘তোমরা সকল স্বাদের বিনাশকারী মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করো।’ [তিরমিযী : ২৩০৭; নাসাঈ : ১৮২৪]
এমন বাণীও পড়েছি বহুবার। কতবার মানুষের কাছে মৃত্যুর বাস্তবতা ও প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেছি, লিখেছি একাধিক লেখা, একবার মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরেও এসেছি; কিন্তু আজ যেভাবে মৃত্যুকে অনুভব করলাম, কবরের এই নিঃসঙ্গ দৃশ্য যেভাবে চিন্তার জগতে সাইমুমের সূচনা করলো, তা আগে হয় নি। শুনেছি ও পড়েছি- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় জামাতা তৃতীয় খলীফা ‘উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন কোনো কবরের পাশ দিয়ে যেতেন, তিনি এত বেশি কাঁদতেন যে তাঁর গণ্ড ও শ্মশ্রু বেয়ে বিপুল ধারায় অশ্রু নেমে আসত। আজ সম্যক উপলব্ধি হলো, কেন তিনি এভাবে কাঁদতেন। কেন তিনি এত অশ্রুপাত করতেন।
বড় আজব ব্যাপার হলো, আর সবার মতো আমিও হয়তো কদিন পর ভুলে যাব এসব অনুভূতির কথা! আবারও আমার কাছে এক সময় পার্থিব জীবন ও জগত বড় হয়ে উঠবে! নশ্বর জীবনের মোহে আবারও হয়তো পাপের সংস্পর্শে চলে যাব। মুক্ত থাকতে পারব না গুনাহের ছোবল থেকে।
পাকিস্তানের সাবেক বিচারপতি ও প্রখ্যাত আলেমে দীন মাওলানা তাকী উসমানী বলেছেন, মানুষ এ যাবত অনেক কিছু অস্বীকার করেছে। জন্মদাতা পিতামাতাকে অস্বীকার করেছে। পিতৃতুল্য শিক্ষককে অস্বীকার করেছে। পৃথিবীর বহু উপকারীর উপকার অস্বীকার করেছে। এমনকি খোদ তার স্রষ্টা আল্লাহকে অস্বীকার করেছে; কিন্তু মৃত্যুকে কেউ অস্বীকার করে নি। মৃত্যুকে অস্বীকারের মতো মূঢ়তা কেউ দেখায় নি কোনোদিন। পাঁড় নাস্তিকও এ জায়গায় আস্তিকের সমান্তরাল ভাবনায় উপনীত। কিন্তু হায়, এ মৃত্যুকেই কিনা আমরা ভুলে থাকি! হাজার মৃত্যু দেখে, প্রিয় স্বজনকে নিজ হাতে কবরে নামিয়েও আমাদের মৃত্যুর চেতনা জাগ্রত হয় না। শাশ্বত মৃত্যুর চেয়ে কিনা বড় হয়ে ওঠে আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবন-সংসার!
বলতে দ্বিধা নেই মুহুর্মুহু মৃত্যুর স্মরণ আর মৃত্যুর তেতো বাস্তবতার নিত্যনতুন উপলব্ধিই পারে আমাদের গুনাহের স্পর্শ থেকে বাঁচাতে। দুনিয়ার জীবনের যাবতীয় লোভ-লালসা আর হিংসা-পরশ্রীকাতরতার মতো অনেক কুপ্রবৃত্তিকে সংযত করতে। সব ধরনের অবাধ্যতা পরিহার করে এক আল্লাহর অনুগত এবং নির্দেশ মতো জীবন যাপন করতে।
হে আল্লাহ, আপনি আমাদের মৃত্যুর যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণের তাওফীক দিন। আমাদেরকে শামিল করুন আপনি মুত্তাকী বান্দাদের কাতারে। নসীব করুন ঈমানের সঙ্গে এবং শাহাদাতের মৃত্যু। আমীন।
আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া