ছালাত, দো'আ ও যিকর

মসজিদ পরিচালনায় কাঙ্খিত-অনাকাঙ্খিত

– আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

মসজিদ পরিচালনা কমিটিতে কাঙ্খিত-অনাকাঙ্খিত:
মসজিদ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান। পৃথিবীতে আল্লাহর প্রিয়তম জায়গা মসজিদ। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
«أَحَبُّ الْبِلَادِ إِلَى اللهِ مَسَاجِدُهَا، وَأَبْغَضُ الْبِلَادِ إِلَى اللهِ أَسْوَاقُهَا»
‘আল্লাহর কাছে সবচে প্রিয় স্থান দুনিয়ার মসজিদগুলো এবং আল্লাহর সবচে অপ্রিয় স্থান এর বাজারগুলো।’ [মুসলিম : ৬৭১]
মসজিদ আল্লাহর ঘর। এটি মুসলিমগণের মিলনকেন্দ্র। এখানে আমরা রোজ পাঁচবার মিলিত হয়ে রবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পাশাপাশি পারস্পরিক খোঁজ-খবর রাখি। গড়ে তুলি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। সমাজে ছড়িয়ে পড়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভালোবাসার আবেশ। গড়ে উঠে এক সুশীল সমাজ। মসজিদ নির্মাণের বিনিময়ে পুরস্কারস্বরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতে ঘর নির্মিত হবার সংবাদ দিয়েছেন। উছমান ইবন ‘আফফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« مَنْ بَنَى مَسْجِدًا لِلَّهِ تَعَالَى يَبْتَغِي بِهِ وَجْهَ اللهِ – بَنَى اللهُ لَهُ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ »
‘কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিমিত্তে যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার জন্য কোনো মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন।’ [মুসলিম : ৫৩৩]
মসজিদে গমনকারীর জন্য প্রতিটি কদমের বিনিময়ে উত্তম প্রতিদান, মর্যাদা ও গুনাহ মাফের ঘোষণা দিয়েছেন। বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ تَطَهَّرَ فِي بَيْتِهِ، ثُمَّ مَشَى إِلَى بَيْتٍ مَنْ بُيُوتِ اللهِ لِيَقْضِيَ فَرِيضَةً مِنْ فَرَائِضِ اللهِ، كَانَتْ خَطْوَتَاهُ إِحْدَاهُمَا تَحُطُّ خَطِيئَةً، وَالْأُخْرَى تَرْفَعُ دَرَجَةً»
‘যে ব্যক্তি তার বাড়ীতে পবিত্রতা অর্জন করল অতপর ফরয ইবাদত আদায়ের উদ্দেশ্যে আল্লাহর ঘরে (মসজিদে) গেল তার এক কদমের বিনিময়ে গুনাহ মার্জনা হবে এবং অপর কদমের বিনিময়ে মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।’ [মুসলিম : ৬৬৬]
দীনের মূলভিত্তি সালাত আদায়ের স্থান বিধায় দীনের অন্য কার্যাবলি সম্পাদনেও মসজিদের ভূমিকা প্রাসঙ্গিক ও অনস্বীকার্য। মসজিদের সঙ্গে মুসলিমগণের সম্পর্ক অন্য ধর্মাবলস্বীদের সঙ্গে তাদের পূজা-অর্চনার মন্দির-গির্জার মত নয়; বরং মসজিদের সঙ্গে মুসলিমদের দৈনন্দিন জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মদীনায় পদার্পণ করেই প্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববী নির্মাণ করেন। তারপর এই মসজিদকে রূপ দেন তিনি মদীনা রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্রে। রাসূল বিনির্মিত ওই রাষ্ট্রে সমাজ পরিবর্তনে মসজিদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। মসজিদ ছিল একই সঙ্গে দাওয়াতী কাজের প্রাণকেন্দ্র এবং রাষ্ট্রীয় ভবন। এখান থেকেই পরিচালিত হত দাওয়াতী কার্যক্রম। বিভিন্ন বিষয়ের পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণও হত এখানেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন দেশ ও এলাকা থেকে আগত প্রতিনিধি ও মেহমানদেরকে মসজিদেই স্বাগত জানাতেন। সাহাবায়ে কিরামের সঙ্গে মসজিদেই তিনি মিলিত হতেন। মসজিদেই তিনি তাঁদের শিক্ষাদান করতেন। এক কথায়: মসজিদ ছিল তৎকালীন মুসলিম সমাজের যাবতীয় কাজের কেন্দ্রস্থল।
তাই মুসলিম জীবনের প্রতিটি পর্বের সঙ্গে মসজিদের রয়েছে প্রত্যক্ষ সংযোগ এবং সরাসরি যোগাযোগ। এটি বাস্তবায়িত হলেই তা হবে জীবন্ত মসজিদ। পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমের জন্ম-মৃত্যু আর বিয়ের সংবাদ থেকে নিয়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার কর্মসূচি ঘোষণা হবার কথা যেখানে মসজিদ থেকে, সেখানে মসজিদের ভূমিকা সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে সালাতের জামাত অনুষ্ঠান পর্যন্ত। বিপুল মুসলিম জনগোষ্ঠীর গুটিকয় লোকের দৈনিক পাঁচবার এবং সিংহভাগের সপ্তাহে একবার হাজিরা দেওয়ার ঘর। ইসলামী খিলাফতের অনুপস্থিতি আর বিশ্বমোড়ল পাশ্চাত্যের সংখ্যাগুরু খ্রিস্টধর্মের প্রভাবে আজকাল অনেকে মসজিদকে নিছক উপসনালয়ে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন।
আল্লাহর নবী ঈসা ‘আলাইহিস-সালামের অপভ্রংশ ধর্ম খ্রিস্টবাদের আদলে মসজিদগুলোকেও রাষ্ট্র থেকে আলাদা বলে দাবী করা হচ্ছে। অথচ মুমিনের জন্য আল্লাহকে যেমন রব তথা প্রতিপালক ও অভিভাবক বানানো অপরিহার্য নিজের লালন-পালন ও জীবনধারণে তেমনি জীবনের প্রতিটি পর্বে তথা সমাজ ও রাষ্ট্রিক জীবনেও তাঁকেই বানাতে হবে রব, প্রতিপালক এবং বিধানদাতা। আল্লাহ যেমন মসজিদে আমাদের রব, মসজিদের বাইরের জীবনেও তিনিই আমাদের রব। এর অন্যথা হলে ঈমানের শর্ত পূরণ হয় না।
সমাজে মসজিদের ভূমিকা অপরিসীম বলে এর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজটিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সন্দেহ নেই মসজিদের মুখ্য কাজ সালাত। আর এই সালাত পরিচালনা করেন ইমাম ও খতীব সাহেবান। জুমাবারে তাঁরা জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়ে জাতিগঠনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ কারণে মসজিদের খতীব-ইমামের গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ইসলামে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সালাতের পর মসজিদের অবকাঠামোগত এবং আদর্শিক উন্নয়নের রূপকার ও ব্যবস্থাপক হলো এর পরিচালনা কমিটি। মসজিদ যেহেতু আল্লাহর বান্দা এবং আল্লাহতে সমর্পিত, ইবাদতে নিবেদিতদের ঘর, তাই বিশ্বাসী মুসলিম মাত্রেই এর নির্মাণ, পরিচালন বা রক্ষণাবেক্ষণের যে কোনো পর্বে অংশ নিতে পারাকে একান্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার ভাবেন। তাই বলে সামাজিকভাবে মুসলিম দাবী করলেই কেউ মসজিদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের বোঝা কাঁধে নিতে পারেন না। তাঁকে ন্যূনতম কিছু বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতায় উত্তীর্ণও হতে হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿ إِنَّمَا يَعۡمُرُ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَأَقَامَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَى ٱلزَّكَوٰةَ وَلَمۡ يَخۡشَ إِلَّا ٱللَّهَۖ فَعَسَىٰٓ أُوْلَٰٓئِكَ أَن يَكُونُواْ مِنَ ٱلۡمُهۡتَدِينَ ١٨ ﴾ [التوبة: ١٨]
‘একমাত্র তারাই আল্লাহর মসজিদসমূহ আবাদ করবে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায়, ওরা হিদায়াতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’। {সূরা তাওবা: ১৮}
সুতরাং অমুসলিমরা যেমন মসজিদ আবাদে যুক্ত হতে পারেন না। তেমনি ইসলামের শর্তভঙ্গকারী মুসলিম পরিচয় দানকারীরাও পারেন না মসজিদ কমিটির সহস্য হতে। কারো সামাজিক ক্ষমতা বা আর্থিক প্রতিপত্তি থাকলেই তাকে মসজিদ পরিচালনায় শ্রেয় ভাবা সঙ্গত নয়। মসজিদের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক পেশা বা স্বভাবের কেউ মসজিদ কমিটির যোগ্য হতে পারেন না। নিজের একাধিক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অধুনাকালে অনেক মসজিদেই কমিটি গঠনে মসজিদের লক্ষ্য-উদ্দেশের প্রতি তোয়াক্কা না করে হীন রাজনৈতিক এজেন্ডায় সদস্য ঢোকানো হয়। প্রত্যক্ষ সুদী কারবারে যুক্ত ব্যক্তিও মসজিদ কমিটির শীর্ষ পদে সমাসীন হয়ে ইমাম-খতীবের ওপর কর্তৃত্বের ছুড়ি ঘোরান!
অথচ ইমামের যোগ্যতা বিচারের মতো কমিটির সদস্যদের যোগ্যতা নিয়েও অনেক বিষয় বিবেচনা নেবার যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু সমাজে ইসলামী শিক্ষা না থাকা এবং পূর্ণাঙ্গ ইসলামের রূপরেখা বাস্তবায়িত না হওয়ায় খুঁটিনাটি বিষয়ে কিছুটা ছাড় দিতে হয় বৈ কি। মসজিদ পরিচালনায় জড়িতরা উপরোক্ত আয়াতের মানদণ্ডে না উৎরালেও অন্তত এসব পরিপন্থী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত না হন তা অবশ্যই নিশ্চিত হওয়া উচিত। অন্যথায় মসজিদ থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল আমরা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ঘরে তুলতে পারব না।
লেখার পরিসর বৃদ্ধি রোধে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবে যে কোনো তাফসীর গ্রন্থ থেকে উপরোক্ত আয়াতের পূর্বাপরের দুই আয়াতের ব্যাখ্যা পড়লে যে কারো সামনে পরিষ্কার হবে মসজিদ পরিচালনার লক্ষ্য কী আর কারা এর জন্য যোগ্যতর বিবেচিত হতে পারেন। আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় মসজিদ আবাদ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাফসীর বিশারদ ইমাম ইবন কাছীর রহ. বলেন,
وَلَيْسَ الْمُرَادُ مِنْ عِمَارَتِهَا زَخْرَفَتَهَا وَإِقَامَةَ صُورَتِهَا فَقَطْ، إِنَّمَا عِمَارَتُهَا بِذِكْرِ اللَّهِ فِيهَا وَإِقَامَةِ شَرْعِهِ فِيهَا، وَرَفْعِهَا عَنِ الدَّنَسِ وَالشَّرَكِ.
‘মসজিদ আবাদের অর্থ কেবল তার চাকচিক্য ও বাহ্যিক সৌন্দর্যবর্ধনই নয়, বরং মসজিদ আবাদ করার অর্থ তাতে আল্লাহর আলোচনা করা, আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা এবং মসজিদকে সবধরনের শির্ক ও পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রাখা’। [ইবন কাছির : ১/২৭০]
পরিতাপের বিষয় আমাদের সমাজে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইসলামের বুনিয়াদী ধারণা না থাকা এবং মসজিদ পরিচালনায় অযোগ্যদের অধিষ্ঠানের কারণে মসজিদ কমিটিগুলো বাহ্যিক চাকচিক্য শ্রী বৃদ্ধিকেই তাদের প্রধান দায়িত্ব বানিয়ে নিয়েছে। তেমনি আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন এবং শির্ক ও ইসলামী চেতনা পরিপন্থী বিশ্বাস নির্মূলে তাদের ভূমিকাও যথার্থ নয়। প্রসঙ্গত বলতে হয়, নাস্তিক্যবাদ যেখানে ইসলামের তাওহিদী বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক সেখানে ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় বলে মসজিদ থেকে তার সমর্থন আদায়ের ঈমানঘাতী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
সম্প্রতি ব্লগ ও ফেসবুকে নাস্তিক্যবাদী ও ধর্ম অবমাননাকারীদের কুকীর্তি ফাঁস হলে ইমামদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় যেখানে সাধারণ মুসলিমদের সজাগ করা, সেখানে তাঁদেরকে এ দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান করা হচ্ছে এটিকে উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক আলোচনা আখ্যায়িত করে। উপরন্তু ইমাম-খতীবগণ এ গুরুদায়িত্ব পালন করায় কিছু মসজিদ কমিটি কোথাও কোথাও তাঁদের বরখাস্তও করেছে। মসজিদের চেতনা ও ঈমানী বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার এরচে বড় নজির আর কী হতে পারে। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে আমাদের ধ্বংস ও সামাজিক অধঃপতন কেউ ঠেকাতে পারবে না। আল্লাহ আমাদের সঠিকভাবে তাঁর দীন অনুধাবন এবং পরিপালনের তাওফীক দান করুন। আমীন।

মন্তব্য করুন

Back to top button