হিল্লা কাহিনী
‘খলীলিয়াহ’ নদীর দক্ষিণ প্রান্তে ‘মাহারীক’ শহরের নিকটে একটি ছোট্ট নিরালা স্থান- যা কেবল একজন বুযর্গের ছালাতের জন্য নির্দিষ্ট। জায়গাটি ছোট হ’লেও উহা পাঁচ ওয়াক্তের মুছল্লী হ’তে কখনোই খালি থাকে না। বিশেষ করে জুম‘আর দিন আশপাশের এলাকাসমূহ হ’তে দলে দলে লোক এসে ভিড় করে। ফলে হুজরার আঙ্গিনা ছাড়িয়ে রাস্তার ধারেও মুছল্লীদের জায়গা নিতে হয়।
খলীলিয়ার তীরে এই ছোট্ট হুজরাটির প্রতি লোকদের এত আকর্ষণের মূল কারণ হ’ল উহার ইমাম মাননীয় শায়খ নাঈম। তাঁর সুনাম-সুখ্যাতি পার্শ্ববর্তী গ্রাম-গঞ্জ পেরিয়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে গেছে। কেননা সকলেরই এ ব্যাপারে অটুট বিশ্বাস যে, উক্ত শায়খের দো‘আ ও আসমানের মাঝে কোন পর্দা নেই। তিনি যা দো‘আ করেন, আল্লাহ তাই-ই কবুল করেন। তাই লোকেরা তাঁর সঙ্গে ছালাত আদায় করা ও তাঁর দো‘আ পাওয়াকে চরম সৌভাগ্য ও পরকালীন মুক্তির উপায় বলে মনে করে।
শায়খ নাঈম তাঁর জীবনকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছেন। তাঁর সমস্ত কর্মশক্তিকে দ্বীনের তাবলীগ ও লোকদেরকে ‘ছিরাতুল মুস্তাক্বীমের’ দিকে হেদায়াতের কাজে নিয়োজিত করেছেন। যখন তিনি কথা বলেন, তাঁর মুখ দিয়ে কেবল পবিত্র কুরআনের আয়াত, রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ ও বিগত যুগের নেককার ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তসমূহ বেরিয়ে আসে। যখন তিনি রাস্তা দিয়ে চলেন, দৃষ্টি নীচু করে তসবীহছড়া হাতে গুনগুনিয়ে যিকর করতে করতে চলেন। যখন তিনি জুম‘আর খুৎবা দিতে মিম্বরে ওঠেন, শুদ্ধ ভাষায় সুন্দর বক্তৃতা করেন। কখনও সে মুখে অনল বর্ষিত হয়, কখনও বা মধুশ্রাবী বাণী সুধায় মুছল্লীদের হৃদয় বিগলিত হয়। যখন তিনি লাঠিরূপ তরবারিখানা ডাইনে অথবা বামে ঘুরান, সমস্ত হুজরাটা ভয়ে কাঁপতে থাকে, যেন সেখানে ভূমিকম্প লেগেছে। বিস্ফারিত নেত্র, নির্বাক, ভীত-বিহবল শ্রোতাদের লাঠির তালে তালে দোলায়মান অবস্থা দেখলে মনে হয় যেন তাদের যাদুতে পেয়েছে।
শায়খ নাঈম বিশ্বাস করেন যে, তিনি রাসূলের একজন বংশধর। আল্লাহ তাঁকে এই শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের হেদায়াতের জন্য বেছে নিয়েছেন। কেননা তিনি প্রায়ই স্বপ্নে নিজেকে ফেরেশতা পরিবেষ্টিত অবস্থায় দেখেন এবং কোন কোন সময় গভীর রাতে গায়েবী আওয়ায দ্বারা তাঁকে জনগণের হেদায়াতের জন্য তাগিদ দেওয়া হয়। সেজন্য কোন রোগীর কথা শুনলেই তিনি সেখানে ছুটে যান। দিবারাত্র জেগে তার শিয়রে বসে তসবীহ তেলাওয়াত করেন। ফকীর-মিসকীনদের সাধ্যমত দান-খয়রাত করেন। কখনও আপনি তাঁকে দেখবেন পাতের খানা অন্যকে দিয়ে নিজে ক্ষুধার্ত থাকছেন। কখনও দেখবেন মাঠে যেয়ে কৃষকদের হালচাষে সাহায্য করছেন। মুখে তাঁর প্রশান্ত হাসি। উদ্দেশ্য কেবল একটাই আল্লাহর সন্তষ্টি।
শায়খ নাঈম বাড়ী আর হুজরা ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছু বুঝেন না। কেবল খানা-পিনার জন্যে যা একটু বাড়ী যান। বাকী সময়টা হুজরায় বসে ভক্তদের উপদেশবাণী শুনান। শায়খের বাড়ীটাকে আপনি রীতিমত একটা ঝুপড়ি বলতে পারেন। সেখানে কেবল তাঁর স্ত্রী থাকেন। যাকে তিনি প্রথম যৌবনে বিবাহ করেছিলেন। যদিও স্ত্রীর বয়স তাঁর চাইতে কয়েক বৎসরের বেশী। মহিলার ইতিপূর্বে একবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু স্বামীর মৃত্যু হওয়ায় শায়খ দয়াপরবশ হয়ে তাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নেন।
একদিন শায়খ নাঈম জুম‘আর ছালাতান্তে বাড়ীর দিকে আসছেন। তসবীহছড়া হাতে নিয়ে যথারীতি অধোমুখে গুনগুনিয়ে চলেছেন। এমন সময় পিছন দিক হ’তে একটা সন্ত্রস্ত কণ্ঠস্বর তাঁর কানে এলো। তিনি চট করে ফিরে তাকিয়ে দেখেন যে, একজন লোক লঘুপদে সসংকোচে তাঁর পিছে পিছে আসছে। তিনি স্নেহভেজাসুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে’? আগন্তুক নিজের নাম বললো ‘আব্দুত তাউয়াব’। কোথা হ’তে আসছো? পার্শ্ববর্তী গ্রাম হ’তে। কি খবর? লোকটি শায়খের লম্বা জুববার আস্তীন ধরে ভক্তিভরে চুমু খেয়ে তা চোখের পানিতে ভিজিয়ে দিলো। শায়খ তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, শান্ত হও বাছা। বলো তোমার কিসের কষ্ট? লোকটি তখন সসম্ভ্রমে একপাশে ডেকে নিয়ে শায়খকে নিম্নস্বরে বলল যে, সে তার স্ত্রীকে এক সঙ্গে তিন তালাক দিয়েছে। কিন্তু এখন সে তাকে ফিরে পেতে চায়।
শায়খ তখন তালাকের ব্যাপারে ভালভাবে নিশ্চিত হওয়ার পরে মাথা নেড়ে ফৎওয়া দিলেন যে, ঐ স্ত্রীর সঙ্গে তার পুনর্মিলন কখনোই সম্ভব নয়। যতক্ষণ না উক্ত স্ত্রীর অন্য কারু সঙ্গে বিবাহ হচ্ছে। লোকটি তখন হতাশ হয়ে বলল, এছাড়া কি অন্য কোন উপায় নেই? শায়খ গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, না বাছা এ যে আল্লাহর বিধান।
পরদিন আছর বাদ শায়খ নাঈম হুজরা থেকে বের হয়ে দেখেন যে, গতকালের সেই লোকটি দাঁড়িয়ে। সে তাঁকে একপাশে ডেকে নিয়ে দু’হাত মলতে মলতে মুখ কাচুমাচু করে বলল, ‘হে আমাদের শায়খ! আপনি গতকাল আমার তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে অন্যত্র পুনর্বিবাহ দেওয়ার কথা বলেছিলেন, নইলে সে আমার জন্য হালাল হবে না।
…‘হাঁ নিশ্চয়ই। এছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই’। শায়খের কণ্ঠে দৃঢ়তার সুর।
লোকটি তখন শায়খের হাতের উপর আরও ঝুঁকে পড়ে প্রায় অস্ফুটস্বরে নিবেদন করলো, ‘যদি আমাদের মহামান্য শায়খ আল্লাহর সন্তুষ্টি হাছিলের উদ্দেশ্যে আমার স্ত্রীকে বিবাহ করার খিদমতটুকু দয়া করে আনজাম দিতেন…’?
কথাটা শোনার সাথে সাথে শায়খের যবান আটকে গেল। তাড়াতাড়ি চাঞ্চল্য ঢাকবার জন্য ঘনঘন তসবীহ গুণতে লাগলেন। অবশেষে লোকটির বারংবার অনুরোধে বাধ্য হয়ে তিনি বললেন, আমাকে একদিন সময় দাও হে আব্দুত তাওয়াব। আমি আল্লাহর নিকট ‘ইস্তেখারা’ করবো। অতঃপর একাজে মঙ্গল আছে… এই মর্মে যদি ‘কাশফ’ হয়, তাহ’লে তোমার দাবী পূরণ করা যেতে পারে। নইলে একেবারেই অসম্ভব। বৎস! তুমি আগামীকাল একবার এসো। আল্লাহ সবকিছুর মালিক’।
ঐ পর্যন্ত বলেই শায়খ বাড়ীর দিকে পা বাড়ালেন। কিন্তু আগন্তুক যুবক তাঁকে একটু দাঁড়াতে বলে আড়াল থেকে তার স্ত্রীকে সামনে নিয়ে এলো। উদ্ভিন্নযৌবনা, অনিন্দ্যসুন্দরী এই তন্বীবধু লাজনম্রবেশে শায়খের সামনে এসে দাঁড়ালে যুবকটি তাকে শীঘ্র শায়খের হাতে চুমু খেতে বলল। মেয়েটি চুমু খাওয়ার জন্য ঝুঁকে পড়লে শায়খ ঝট করে হাত টেনে নিলেন এবং চকিতে মেয়েটির সুন্দর মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। এভাবে আচম্বিতে দৃষ্টি বিনিময়ে তিনি লজ্জায় চক্ষু নামালেন এবং যুবকটিকে বললেন, তোমার স্ত্রীকে আজ নিয়ে যাও। আব্দুত তাউয়াব শায়খের হাতে গভীরভাবে চুমু খেয়ে দো‘আ করলো.. ‘আল্লাহ যেন তাঁকে এই নেক কাজের অফুরন্ত ছওয়াব দান করেন’।
শায়খ বাড়ীর পথ ধরলেন ধীরপদে, অধোবদনে গভীরভাবে যিকরে মশগুল অবস্থায়। মহামতি শায়খ সারাটা রাত সুখস্বপ্নে বিভোর থাকলেন। তিনি স্বপ্নে নিজকে জান্নাতের ফুলবাগিচায় অসংখ্য হূরপরীবেষ্টিত অবস্থায় দেখলেন। তাদের মধ্যে লাজুকলতার মতো আজকের গোধূলীলগ্নের সেই কামনাময়ী তন্বী বধুটিকেও দেখতে পেলেন।
আনন্দের আতিশয্যে শায়খ ফজরের কিছু আগে-ভাগেই উঠে পড়লেন। অতঃপর ফজর ছালাত শেষে ‘ইস্তেখারা’য় মগ্ন হ’লেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন লক্ষণ-প্রমাণের সাহায্যে তিনি পরিস্কার বুঝে নিলেন যে, এ বিয়ে তিনি নিঃসংকোচেই করতে পারেন।
যথাসময়ে বিবাহকার্য সম্পন্ন হ’ল। ওয়াদামত তালাকও হয়ে গেল। কিন্তু আব্দুত তাউয়াবের স্ত্রী শায়খ নাঈমের মনে এক অনির্বচনীয় সুখানুভূতির স্থায়ী স্বাক্ষর রেখে গেল। তাঁর সমস্ত শিরা-উপশিরায় যেন আগুন ধরে গেল। ঐ সুন্দরী বধুটি হূরের বেশে প্রায়ই তাঁর সঙ্গে মোলাকাত করে, হাসি-ঠাট্টা করে, গল্প-গুজব করে। ফলে রাতটা শায়খের একভাবে কাটলেও সারাটা দিন তার দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনায় অতিবাহিত হ’তে থাকে।
কখনও শায়খ ভাবেন যে, এই স্বপ্নের পশ্চাতে হয়তবা অদৃশ্য কোন বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। আবার ভাবেন হ’তে পারে এসব শয়তানী কারসাজি। এমনিতরো ভাবনা-চিন্তার মাঝে একদিন দুপুরে তন্দ্রাবস্থায় তিনি গায়েবী নির্দেশ পেলেন- ‘শান্ত হও নাঈম। তোমার উপর শয়তানের কোন ক্ষমতা নেই। তুমি যে তরীকা তোমার জন্য বেছে নিয়েছ, সেই তরীকার উপরে কায়েম থাকো এবং এই পথে যথাসাধ্য নেককাজ করে যাও’।
এই ‘ইলহাম’ পাওয়ার সাথে সাথে শায়খ নাঈম ‘আল-হামদুলিল্লা-হ’ বলে উঠে বসলেন। তাঁর চেহারা খুশীতে ঝলমল করে উঠলো।
আব্দুত তাউয়াবের স্ত্রীকে হালাল করে দেওয়ার ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে এই ধরনের তালাকদাতা স্বামীরা চারদিক থেকে এসে শায়খের নিকট ভিড় করতে লাগলো। কেননা তাদের দৃষ্টিতে মহামান্য শায়খই এ ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত ব্যক্তি। শায়খও কোন পাণিপ্রার্থিনীকে নিরাশ করতেন না। কেননা তাঁর বিশ্বাস যে, তিনি একাজ করছেন স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টি হাছিলের জন্য এবং আল্লাহর বান্দাদের উপকার করবার জন্য। তাছাড়া এমন একটি মহান খিদমত হ’তে তিনি কেমনে দূরে থাকতে পারেন, যার দ্বারা দাম্পত্য বন্ধন পুনঃস্থাপিত হয় এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার সূত্রসমূহ পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়।
এইভাবে সময় অতিবাহিত হয়। শায়খ নাঈম একটি মহিলাকে তালাক দেন। সাথে সাথে আরেকটি মহিলার পাণি গ্রহণ করেন। ফলে তাঁর প্রতিটি রাতই হয় বাসর রাত। নিত্য নতুন রঙের ঢেউ খেলে যায় তাঁর মনে। যা ইতিপূর্বে কখনই তিনি অনুভব করেননি।
শায়খ এখন রাস্তায় চলেন সুন্দর ভঙ্গিতে। দাড়িগুলিকে ‘খেযাব’ দিয়ে ঝকঝকে করেছেন। পাগড়ীটার উপরি অংশ ঝান্ডার মত খাড়া করে রাখেন। সুন্নত পালনার্থ সর্বদা আতর মেখে চলেন। কথার মধ্যে বেশ হাস্যরস মিশিয়ে বলেন। কেননা মুমিনকে যে সব সময় খোশমেযাজ থাকতে হয়।
একদিন বিকালে মহামান্য শায়খ তাঁর ঘরের আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে নদীতে পানি নিতে আসা মহিলাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এমন সময় একটি যুবক সেখানে উপস্থিত হ’ল। সঙ্গে একজন মহিলা। যুবকটি কোন এক বন্দর এলাকার হবে। হালকা-পাতলা গড়নের কুৎসিত এই যুবকটির চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছিল যে, সে একজন সমাজ ছাড়া নচ্ছার ব্যক্তি। যাদের কাছ থেকে ঘরের শান্তি ও পারিবারিক শৃংখলা কামনা করা যায় না।
যুবকটি শায়খের নিকটে এসে গদগদচিত্তে আকণ্ঠ ভক্তি মিশিয়ে বলে উঠলো, ‘হে আমাদের সাইয়েদ (নেতা)! আপনার খাদেম ‘তেহামী’ হাযির’। শায়খ মুচকি হেসে বললেন, ‘হয়েছে, হয়েছে আফেন্দী। এখন বলো তোমার কি ব্যাপার’?
যুবকটি সংক্ষেপে যা বলল তার মর্ম দাঁড়ায় এই যে, সে তার স্ত্রীকে একসঙ্গে তিন তালাক দিয়ে ফেলেছে। এক্ষণে স্ত্রী ফক্বীহদের ফৎওয়া না শোনা পর্যন্ত তার সঙ্গে বসবাস করতে চায় না। ওদিকে সকল ফক্বীহ বলছেন যে, অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে বিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত সে আমার ঘর করতে পারবে না। অতএব একমাত্র এ কারণেই এই অবেলায় হুযূরের দরবারে আসা…’।
শায়খ ঘটনাটি শোনার সাথে সাথেই এই মহান খিদমত আনজাম দিবার জন্য নিজকে সদা প্রস্ত্তত বলে ঘোষণা করলেন। যুবকটি খুশী হয়ে স্ত্রী ছাবিহাকে শায়খের ঝুপড়িতে রেখে চলে গেল।
ছাবিহার যৌবন ছিল কানায় কানায়। চটুল-চপল অঙ্গভঙ্গি, আর উপচেপড়া যৌবনের ভারে সে ছিল অবনমিত। স্বর্ণ লতিকার মত সারা অঙ্গে তার বসন্তের ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছিল। ফলে মাত্র কয়দিনের মধ্যেই সে শায়খের মনে ঘর করে নিলো। দিনের অধিকাংশ সময় এখন তিনি ঘরেই কাটান। এমনকি সকল ওয়াক্তে হুজরায় ছালাত পড়তে যাওয়াও বন্ধ হ’তে লাগলো। এখন তিনি প্রায়ই বাজারে যান এবং ছাবিহার জন্য দামী গহনা, কাপড়-চোপড়, ফল-মূল, মিঠাই-মন্ডা ইত্যাদি কিনে আনেন।
এদিকে ছাবিহা দেখলো যে, সে এখন পূর্বের তুলনায় যথেষ্ট বিলাস-ব্যসনের মধ্যে আছে। তাছাড়া বর্তমান এ ব্যক্তি তার প্রেমে বিভোর এবং অনুগত। পক্ষান্তরে তার স্বামী যুবক হ’লেও দরিদ্র। সে তার সঙ্গে এত ভাল ব্যবহার কোনদিন করেনি। অতএব সবদিক বিবেচনা করে যুবতী ছাবিহা আমাদের বুড়া শায়খের পদতলে তার সমস্ত প্রেম ঢেলে দেবার মনস্থ করলো। শায়খ যখন বাইরে থাকেন, তখন সে উন্মুখ হয়ে পথপানে চেয়ে থাকে। আর যখন ঘরে থাকেন, তখন তার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়। ভাবখানা এই যে, সে যেন আজই কেবল নতুন দাম্পত্যজীবন শুরু করলো।
একদিন ফজর বাদ শায়খ নাঈম তাঁর পুরানো স্ত্রীর নিকটে যেয়ে বললেন যে, আমি আজ রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। যার সঠিক ব্যাখ্যা এই যে, তোমার বৃদ্ধা মাতা কঠিন অসুখে শয্যাশায়ী হয়েছেন। অতএব তোমার কর্তব্য এই মুহূর্তে গ্রামে রওয়ানা হওয়া এবং মৃত্যুর আগে আগেই মায়ের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা। শায়খ আরও বললেন, এদিকে সবকিছু ঠিকঠাক করে আমিও দু’একদিনের মধ্যে আসছি।
স্বপ্নের এই ব্যাখ্যা শোনার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মহিলাটি সাজগোজ করে দূরগাঁয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেল।
এদিকে তেহামী তার স্ত্রী ছাবিহাকে নেওয়ার জন্য এসেছে। তাকে দেখেই শায়খের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। ঘর হ’তে বেরিয়ে এসে নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে তিনি যুবককে আপাততঃ মিষ্ট কথায় বিদায় করলেন। যুবকটি দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে গেল। ওদিকে শায়খ তার হুজরায় খবর পাঠালেন যে, অসুখের কারণে একটানা কয়েকদিন তাঁকে বাড়ী থাকতে হবে।
শায়খ এবার ছাবিহাকে নিয়ে পড়লেন। মুহূর্তের জন্য তাকে পাছ ছাড়া করেন না। প্রায়ই তাকে দু’হাতে জড়িয়ে রাখেন। যেন ছাবিহাকে কেউ তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
অতঃপর একদিন তন্দ্রাবস্থায় শায়খ গায়েবী আওয়ায শুনতে পেলেন, ‘হে নাঈম! ছাবিহার ব্যাপারে তুমি আর দেরী করো না। আল্লাহ ওকে তোমার হাতে পৌঁছে দিয়েছেন ওর স্বামী ঐ ক্ষুধার্ত নেকড়ের হাত হ’তে মুক্তি দেওয়ার জন্য। ছাবিহা আসলে তোমার স্ত্রী এবং তুমিই ওর স্বামী।
এই সময় তেহামী তার স্ত্রীকে পুনরায় নিতে এলো। শায়খ তাকে দেখে গর্জে উঠে বললেন, আমি কি তোমাকে বলি নাই যে, ব্যস্ত হয়ো না। ‘ইন্নাল্লাহা মা‘আছ ছাবেরীন’ (নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন)।
তেহামী শায়খের এই ধৈর্যের অর্থ বুঝতে পারে না। কেননা নির্দিষ্ট মেয়াদের ঊর্ধে বেশ কিছু দিন যাবত তার স্ত্রী শায়খের কাছে রয়েছে।
তেহামী অনেক কষ্টে রাগ দমন করলো এবং শায়খকে বলে গেল যে, সে আগামী সপ্তাহে পুনরায় আসবে তার স্ত্রীকে নিতে।
সপ্তাহ শেষে তেহামী এলো। জুম‘আর ছালাত শেষে হুজরার দরজায় শায়খের সঙ্গে তার দেখা হ’ল। শায়খ তাকে দেখা মাত্রই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, ‘তুমি আবার এসেছ? এতদূর দুঃসাহস তোমার’?
তেহামী হতভম্বের মত কয়েকমুহূর্ত চুপ রইলো। তারপর চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো, ‘দুঃসাহসী কে? আমি না তুমি? আমি এসেছি তোমার কাছ থেকে আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে’।
শায়খ কিছুক্ষণ পায়চারী করলেন এবং আসমানের দিকে ঘনঘন তাকাতে লাগলেন। হঠাৎ তার ক্রুদ্ধ চেহারাটা খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। গম্ভীর স্বরে সবাইকে ডাক দিলেন, ‘ওহে আল্লাহর বান্দারা! ওহে আল্লাহর বান্দারা’! সঙ্গে সঙ্গে চারদিক হ’তে লোক জড়ো হয়ে গেল। সকলে ভীতবিহবল দৃষ্টিতে শায়খের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ শায়খ তীব্রকণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করো’? সকলে সমস্বরে বলে উঠলো, ‘নিশ্চয়ই করি’। শায়খ বললেন, ‘আল্লাহ আমাকে এই যুবকের তালাক দেওয়া স্ত্রীকে তার দুষ্কৃতির কবল হ’তে উদ্ধার করার জন্য হেদায়েত পাঠিয়েছেন। এক্ষণে আমি কি আল্লাহর হুকুম অমান্য করতে পারি’? সকলে সমস্বরে বলল, ‘কখনোই নয়। বরং আপনি আল্লাহর পাঠানো হেদায়েত অনুযায়ী চলুন’।
শায়খ এবার ঢোক গিলে নিয়ে বললেন, ‘আমি মুসলমান নারী-পুরুষের জন্য আমার জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছি। আল্লাহ আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব পালন হ’তে দূরে থাকার কোন সাধ্য আমার নেই। যদি তাতে আমার মৃত্যুও হয়ে যায় তথাপিও…। এতে কি আমি নিন্দার পাত্র হবো’?।
সকলে বলল, ‘এতে আপনার বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ নেই’। তখন শায়খ উক্ত যুবকটির দিকে ইশারা করে লোকদেরকে বললেন, ‘ওকে এখান থেকে বের করে দাও’।
শায়খের কথা শেষ হ’তে না হ’তেই লোকেরা তেহামীকে ঘিরে ফেললো। অতঃপর তাকে শহর হ’তে বের করে দিয়ে শাঁসিয়ে দিল যে, পুনরায় এলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।
শায়খ নাঈম এবার বিজয়গর্বে খুশীমনে বিপুল গাম্ভীর্য সহকারে ধীরপদে বাড়ীর দিকে অগ্রসর হলেন।
[মাহমূদ তায়মূর (মিসর), শাবাব ওয়া গানিয়াত, পৃঃ ১৪৭-১৬২]