নিফাকের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ

নিফাকের সংজ্ঞা:
আভিধানিক ভাবে নিফাক শব্দটি نافق ক্রিয়ার মাসদার বা মূলধাতু। বলা হয় نافقيُنَافِقُ نِفَاقَاًومَنَافَقَةً শব্দটি النافقاء থেকে গৃহীত যার অর্থ ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর গর্তের অনেকগুলো মুখের একটি মুখ। তাকে কোন এক মুখ দিয়ে খোঁজা হলে অন্য মুখ দিয়ে সে বের হয়ে যায়।
এও বলা হয়ে থাকে যে, নিফাক শব্দটি نفقٌ থেকে গৃহীত যার অর্থ সেই সুড়ঙ্গ পথ যাতে লুকিয়ে থাকা যায়। [আন-নিহায়া :ইবনুল আসীল , ৫ম খন্ড পৃঃ ৯৮।]
শরীয়তের পরিভাষায় নিফাকীর অর্থ হল ভেতরে কুফুরী ও খারাবী লুকিয়ে রেখে বাহিরে ইসলাম জাহির করা। একে নিফাক নামকরণের কারণ হলো সে এক দরজা দিয়ে শরীয়তে প্রবেশ করে অন্য দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়। এ জন্যই এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন:
নিশ্চয়ই মুনাফিকরাই ফাসিক পাপচারী। [সূরা তওবা,৬৭]
এখানে ফাসিক মানে হল শরীয়তের সীমানা থেকে যারা বের হয়ে যায়। আল্লাহ মুনাফিকদেরকে কাফিরদের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে গণ্য করেছেন।
নিঃসন্দেহে মুনাফিকরা থাকবে দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে। [সূরা নিসা,১৪৫]
‘তারা আল্লাহ এবং ঈমানদারগণকে প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে প্রতারিত করেনা, তা তারা বুঝতে পারেনা। তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে।আর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। বস্তুতঃ তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি
কারণ তারা মিথ্যাচার করে বেড়াত। [সূরা বাকারা,৯-১০]
নিফাকীর প্রকারভেদ:
নিফাকী দুই প্রকার:
প্রথম প্রকার: ইতেক্বাদ বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নিফাকী:
একে বড় নিফাকী বলা হয়। এতে মুনাফিক ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে ইসলামকে জাহির করে এবং কুফুরীকে গোপন রাখে। এ প্রকারের নিফাকী ব্যক্তিকে পুরোপুবিভাবে দ্বীন থেকে বের করে দেয়। উপরন্তু সে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে যায়।
আল্লাহ তাআলা এ প্রকারের মুনাফিকদেরকে যাবতীয় নিকৃষ্ট গুণাবলীতে অভিহিত করেছেন। কখনো কাফির বলেছেন, কখনো বেঈমান বলেছেন, কখনো দ্বীন ও দ্বীনদার লোকদের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রুপকারী হিসাবে তাদেরকে বর্ণনা করেছেন এবং এও বলেছেন যে, তারা দ্বীন ইসলামের শত্রুদের প্রতি পুরোপুরিভাবে অসক্ত, কেননা তারা ইসলামের শত্রুতায় কাফিরদের সাথে অংশগ্রহণ করে থাকে। এরা সবযুগেই বিদ্যমান, বিশেষ করে যখন ইসলামের শক্তি প্রবলভাবে প্রকাশ পায়।
যেহেতু এ অবস্থায় তারা প্রকাশ্যে ইসলামের মোকাবেলা করতে সক্ষম নয়, তাই তারা জাহির করে যে, তারা ইসলামের মধ্যে আছে, যেন ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভিতরে ভিতরে ষড়যন্ত্র পাকাতে পারে এবং মুসলমানদের সাথে মিলেমিশে থেকে নিজেদের জান মালের হেফাজত করতে পারে।
অতএব মুনাফিক বাহ্যিকভাবে আল্লাহ, তাঁর ফেরেস্তাগণ, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনার ঘোষণা দিলেও অন্তরে এসব কিছু থেকেই সে মুক্ত, বরং এগুলোকে সে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। আল্লাহর প্রতি তার ঈমান নেই, এবং এ বিশ্বাস ও নেই যে, তিনি তাঁর এক বান্দার উপর কালামে পাক নাযিল করেছেন, তাকে মানুষের প্রতি রাসূল করে পাঠিয়েছেন, আল্লাহর হুকুমে তিনি তাদেরকে হেদায়াত করবেন, তাঁর প্রতাপ সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করবেন এবং তাঁর শাস্তির ভয় প্রদর্শন করবেন। কুরআন পাকে আল্লাহ তাআলা এসব মুনাফিকদের স্বরূপ উম্মোচন করেছেন, তাদের রহস্য উদঘাটন করে দিয়েছেন এবং বান্দাদের সামনে তাদের মোয়ামেলা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, যাতে তারা এসব মুনাফিকদের ব্যাপারে সতর্ক থাকে।
আল্লাহ তাআলা সূরা বাক্বারার শুরুতে তিন শ্রেণীর লোকদের কথা বর্ণনা করেছেন: মুমিন, কাফির এবং মুনাফিক। মুমিনদের সম্পর্কে চারটি আয়াত, কাফিরদের সম্পর্কে দু‘টি আয়াত এবং মুনাফিকদের সম্পর্ক তেরটি আয়াত উল্লেখ করেছেন। সংখ্যায় মুনাফিকদের আধিক্য, মানুষের মধ্যে তাদের নিফাকীর ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং ইসলাম ও মুসলমানদের উপর তাদের ভীষণ ফিতনা সৃষ্টির কারণেই তাদের ব্যাপারে এত বেশী আলোচনা করা হয়েছে। মুনাফিকদের কারণে ইসলামের উপর অনেক বেশী বালা মুসীবত নেমে আসে। কেননা ইসলামের প্রকৃত দুশমন হওয়া সত্ত্বেও তারা মুসলিম হিসাবে পরিচিত এবং তাদেরকে ইসলামের সাহায্যকারী ও বন্ধু ভাবা হয়। তারা নানা উপায়ে ইসলামের শত্র“তা করে থাকে। ফলে অজ্ঞ লোকেরা ভাবে যে, এ হল তাদের দ্বীনী এলেম ও সংস্কার কাজের বহিঃপ্রকাশ। অথচ প্রকারান্তরে তা তাদের মূর্খতা এবং ফাসাদ সৃষ্টিরই নামান্তর।
এ প্রকারের নিফাকী আবার ছয় ভাগে বিভক্ত:
১. রাসূল সাল্লাল্লহু আলাইহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা।
২. রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনীত শরীয়তের কোন অংশকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
৩. রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লারেম প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা।
৪. তাঁর আনীত দ্বীনের কিয়দংশের প্রতি বিদ্বেষ রাখা।
৫. তাঁর আনীত দ্বীনের পতনে খুশী ওহয়া।
৬. তাঁর আনীত দ্বীনের বিজয়ে অখুশী হওয়া এবং কষ্ট অনুভব করা।
দ্বিতীয় প্রকার: আমলের নিফাকী
এ প্রকারের নিফাকী হল অন্তরে ঈমান রাখার পাশাপাশি মুনাফিকদের কোন কাজে লিপ্ত হওয়া। এ নিফাকীর ফলে ব্যক্তি ইসলামী মিল্লাতের গন্ডী থেকে বের হয়না, তবে বের হবার রাস্তা সুগম হয়ে যায়। এ ধরনের লোকদের মধ্যে ঈমান ও নিফাকী উভয়ের অস্তিত্বই রয়েছে। নিফাকীর পাল্লা ভারী হলে সে পূর্ণ মুনাফিকে পরিণত হয়। একথার দলীল হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী:
চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে সে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মধ্যে এ চারটি স্বভাবের কোন একটি থাকবে তার মধ্যে নিফাকের একটি স্বভাব থাকবে যে পর্যন্ত না সে তা পরিহার করে। যখন তাকে আমানতদার করা হয়, সে খিয়ানত করে। যখন সে কথা বলে, মিথ্যা বলে। যখন চুক্তি করে, বিশ্বাস ঘাতকতা করে, আর যখন ঝগড়া বিবাদ করে, অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করে। [বুখারি,মুসলিম]
অতএব যার মধ্যে এ চারটি স্বভাব একত্রিত হয় তার মধ্যে সকল প্রকার অসততার সম্মিলন ঘটে এবং মুনাফিকদের সব গুণাবলীই তার মধ্যে প্রকৃষ্ট ভাবে পাওয়া যায়। আর যার মধ্যে সেগুলোর যে কোন একটি পাওয়া যার তার মধ্যে নিফাকীর এ কটি স্বভাব বিদ্যমান। কেনান বান্দার মধ্যে কখনো একাধারে উত্তম ও মন্দ স্বভাবসমূহ এবং ঈমান ও কুফুরী নিফাকীর স্বভাবসমূহের সমাহার ঘটে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে তার ভালও মন্দ কাজ অনুযায়ী সে সওয়াব ও শাস্তির উপযুক্ত হয়।
আমলী নিফাকের মধ্যে রয়েছে মসজিদে জামায়াতের সাথে নামায আদায়ে অলসতা করা। কেননা এটি মুনাফিকদেরই একটি গুণ। মোট কথা নিফাকী অতীব খারাপ ও বিপজ্জনক একটি স্বভাবঅ সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম এতে লিপ্ত হওয়ার ভয়ে শংকিত থাকতেন। ইবনে আবি মুলাইকা বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ত্রিশজন সাহাবীর দেখা পেয়েছি যারা প্রত্যেকেই নিজের ব্যাপারে নিফাকে পতিত হবার ভয় করতেন।
বড় নিফাকী ও ছোট নিফাকীর মধ্যে পার্থক্য:
১. বড় নিফাকী বান্দাকে ইসলামী মিল্লাতের গন্ডী থেকে বের করে দেয়। পক্ষান্তরে ছোট নিফাকী (আমলী নিফাকী) মিল্লাত থেকে বের করেনা।
২. বড় নিফাকীর মধ্যে আক্বীদার ক্ষেত্রে ভেতরে ও বাহিরে (বাতেন ও জাহের) দু‘রকম থাকে। আর ছোট নিফাকীর মধ্যে আক্বীদাহ নয়, বরং শুধু আমলের ক্ষেত্রে অন্তর-বাহির দু‘রকম থাকে।
৩. বড় নিফাকী কোন মু‘মিন থেকে প্রকাশ পায়না। কিন্তু ছোট নিফাকী কখনো মু‘মিন থেকে প্রকাশ পেতে পারে।
৪. বড় নিফাকীতে লিপ্ত ব্যক্তি সাধারণতঃ তওবা করেনা। আর তওবা করলেও তার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। অথচ ছোট নিফাকীতে লিপ্ত ব্যক্তি অনেক সময়ই তওবা করে থাকে এবং আল্লাহ ও তার তওবা কবুল করেন।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন: অনেক সময় মু‘মিন বান্দা নিফাকীর কোন কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তার তাওবা কবুল করে নেন। কখনো তার অন্তনে এমন বিষয়ের উদয় হয় যা নিফাকীর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আল্লাহ ঐ বিষয়কে তার অন্তর থেকে দূর করে দেন। মুমিন বান্দা কখনো শয়তানের প্ররোচনায় এবং কখনো কুফুরীর কুমন্ত্রনায় পড়ে যায়। এতে তার হৃদয় সংকীর্ণতার সৃষ্টি হয়। যেমন সাহাবায়ে কেরাম রাদি আল্লাহু আনহুম বলেছিলেন:
হে রাসূলুল্লাহ! আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তার অন্তরে এমন কিছু অনুভর করে, যা ব্যক্ত করার চেয়ে আসমান থেকে জমীনের উপর পড়ে যাওয়াই সে অধিক ভাল মনে করে। একথা শুনে তিনি বললেন: এটা ঈমানেরই স্পষ্ট আলামত। [আহমদ,মুসলিম]
অন্য বর্ণনায় এসেছে:
‘‘অন্তরের কথাটি মুখে ব্যক্ত করাকে সে খুবই গুরুতর ও বিপজ্জনক মনে করে। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি এক ষড়যন্ত্রকে কুমন্ত্রণায় পরিণত করেছেন। ’’
একথার অর্থ হল প্রবল অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের কুমন্ত্রণা সৃষ্টি হওয়া এবং হৃদয় থেকে তা দূরীভূত হওয়া ঈমানের স্পষ্ট নিদর্শন।[কিতাবুল ঈমান,২৩৮]
আর বড় নিফাকীতে লিপ্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন:
‘তারা বধির, মূক, অন্ধ, সুতরাং তারা ফিরে আসবে না। [সূরা বাকারাহ ,১৮]
অর্থাৎ তারা অন্তরের দিক দিয়ে ইসলামে ফিরে আসবে না। এদের সম্পর্কে আল্লাহ আরো বলেন:
‘তারা কি দেখেনা যে, প্রতি বছর তারা একবার কি দুইবার বিপর্যস্ত হচ্ছে? এর পরও তারা তাওবা করেনা এবং উপদেশ গ্রহণ করেনা।’ [সূরা তাওবা,১২৬]
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন: প্রকাশ্যেভাবে তাদের তাওবা কবুল হওয়ার ব্যাপারে উলামাদের মতানৈক্য রয়েছে। কেননা তাদের অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়া সম্ভব হয়না। কারণ তারা তো সব সময়ই ইসলাম জাহির করে থাকে।
সমাপ্ত
লেখক : সালেহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান
অনুবাদ : মুহাম্মদ মানজুরে ইলাহী