ভেষজ চিকিৎসার নামে ‘ইন্ডিয়া’ ও ‘কলিকাতা’ হারবালের প্রতারণা
চকচকে সাইনবোর্ড। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পরিপাটি কক্ষ। পেছনে ঝুলছে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-সাংসদের সঙ্গে তোলা ছবি। ছবির নিচে লেখা ‘হারবাল চিকিৎসক হিসেবে বিশেষ অবদানের জন্য মন্ত্রীর (নাম উল্লেখ করা হলো না) হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন হাকিম গোলাম ফারুক হাওলাদার’। টেবিলের পাশে সাজানো ডজন খানেক ‘শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকের’ ট্রফি। ‘ইন্ডিয়া হারবাল মেডিকেল কেয়ার’ নামে কথিত একটি চিকিৎসালয়ের কার্যালয় এটি।
রাজধানীর মগবাজার মোড়ে রাস্তার এ-পার ও-পারে অবস্থিত ‘ইন্ডিয়া হারবাল’ ও ‘কলিকাতা হারবাল’ নামে দুটি কথিত ভেষজ চিকিৎসালয়। দুটিরই মালিক গোলাম ফারুক (৩৬)। দুটি চিকিৎসালয়ের কোনোটিতেই চিকিৎসাসেবার ন্যূনতম অনুমোদন ও সরঞ্জাম নেই। গোলাম ফারুকসহ কারোরই চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অনুমোদন নেই। অথচ তাঁরা সব ‘কঠিন ও জটিল’ রোগের চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত এই দুটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে গোলাম ফারুকসহ চারজন কথিত ভেষজ চিকিৎসককে হাতেনাতে ধরে দুই বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন। দণ্ড পাওয়া অন্য তিনজন হলেন সাহেব আলী (৩০), মাসুদ ইসলাম (৩১) ও মশিউর রহমান (৩২)। র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা আদালত পরিচালনা করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম ও র্যাব-৩-এর সহকারী পুলিশ সুপার কুদরত-ই-খুদা। দুটি প্রতিষ্ঠানই সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিকদের সামনে নিজের দোষ স্বীকার করে গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমি অপরাধ করছি। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছি। ১০ টাকার ওষুধ ১০ হাজার টাকায় বেচছি।’ প্রতারণার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, তাঁর কাছে কোনো পুরুষ রোগী এলে প্রথমেই তিনি রোগীর প্রস্রাব পরীক্ষা করতে বলেন। কিন্তু তাঁর ওখানে প্রস্রাব পরীক্ষার কোনো উপকরণ নেই। শুধু কয়েকটি টেস্টটিউব রয়েছে। রোগীর সামনে তাঁর প্রস্রাব একটি টেস্টটিউবে ঢালা হয়। তাঁর সামনেই কয়েক ফোঁটা তারপিন তেল ও ফিটকারি ঢালা হয় টেস্টটিউবে। কিছুক্ষণ পরই টেস্টটিউবের ওপর একটা সাদা স্তর তৈরি হয়। তখন কথিত চিকিৎসক রোগীকে শঙ্কিত হয়ে বলেন, তাঁর (রোগীর) প্রস্রাবের সঙ্গে বীর্যপাত হচ্ছে। তাঁর যৌবন হুমকির মুখে, জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সব শেষ, টাকাপয়সার আর কোনো দামই থাকল না ইত্যাদি ইত্যাদি। রোগীকে ভড়কে দেওয়ার জন্য আরও বলা হয়, সাধারণ অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় এর নিরাময় সম্ভব নয়। একমাত্র সমাধান ভেষজ চিকিৎসা, তবে চিকিৎসাপদ্ধতি অনেক জটিল। মৃগনাভী, কস্তুরী, জাফরান, মাঝবিলের পদ্মের রেণু ইত্যাদি লাগবে। এসবের জন্য অনেক টাকা লাগবে। রোগী তখন উপায়ান্তর না পেয়ে টাকা দিতে রাজি হন। প্রতিষ্ঠানটির টাকা আদায়ের খাতা উল্টে দেখা গেছে, সর্বনিম্ন তিন হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত রোগীদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে। এ রকম প্রতারণার মাধ্যমে ছয়-সাত বছরের মধ্যেই কোটিপতি হয়েছেন গোলাম ফারুক।
গোলাম ফারুক বলেন, মূলত বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের গুঁড়া মিশিয়ে কথিত মহৌষধ তৈরি করা হয়। যেমন, বাতনাশক ওষুধ হিসেবে ডাইক্লোফেনাক-জাতীয় ব্যথানাশক, অ্যালার্জির জন্য অ্যালাট্রল, মোটা হওয়ার জন্য স্টেরওয়েড হরমোন আর যৌন রোগের মহৌষধ হিসেবে সিনেগ্রা-জাতীয় ট্যাবলেটের গুঁড়া মেশানো ‘গুলি’, ‘হালুয়া’ তৈরি করা হয়। এ রকম ওষুধ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা প্রতি ফাইল বিক্রি করা হয়। প্রতিষ্ঠানের প্রচারণার জন্য বিভিন্ন পত্রিকা, টিভি চ্যানেল ও কেব্ল লাইনে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। আর শহরময় পোস্টার ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও আলাদা লোক রয়েছে। জানতে চাইলে ফারুক বলেন, প্রচারণার জন্য বিভিন্ন ভুঁইফোড় সংস্থাকে বিজ্ঞাপন দেন তিনি। আর ওই সংস্থাগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও মন্ত্রীদের সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ করে দেয়। এভাবেই রোগীদের বিভ্রান্ত করতে তিনি সরকারের তিনজন মন্ত্রী আর এক সাংসদের কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণের সময় ছবি তুলে সাজিয়ে রেখেছেন নিজের কক্ষে।