সংবাদ

গ্রিনিচ নয় এবার মক্কামান সময়

এবারের মাহে রমজান পৃথিবীর ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। কারণ বিশ্ব ইতিহাসের অংশ হতে চলেছে এবারের রমজান। বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় হয়তো এটাই মনে মনে চেয়েছিল- একদিন তাদেরও নিজস্ব মানদণ্ড হবে সময়ের। সর্বজনীন বা স্ট্যান্ডার্ড টাইম হিসেবে আমরা ধরে নেই গ্রিনিচমান সময় (গ্রিনিচ মিন টাইম) বা ‘জিএমটি’কে। কিন্তু এবারের রমজান ১২৬ বছরের পুরনো এই আন্তর্জাতিক সময়ের মানদণ্ডকে ভেঙে ফেলতে যাচ্ছে।

অবাক হওয়ারই কথা। তবে এ ক্ষেত্রে রমজানের ভূমিকা মুখ্য নয়। রমজান অত্যন্ত বরকতময় মাস বলেই তাকে বেছে নেওয়া হয়েছে এমন একটি ঐতিহাসিক কাজের জন্য। কাজটা হচ্ছে- ইসলামের পবিত্র নগরী মক্কাকে যেহেতু গোটা মুসলিম জাহান পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ‘কেবলা’ হিসেবে বরণ করে নিয়েছে, সেই মক্কাই হোক মুসলমানদের সময়েরও মানদণ্ড। তাই সৌদি আরব সরকার চাচ্ছে পবিত্র মক্কাকে গ্রিনিচমান টাইমের বিকল্প স্ট্যান্ডার্ড টাইমের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। আর সে লক্ষ্যেই পৃথিবীর বৃহত্তম ঘড়িটি বসানো হয়েছে এই মক্কায়। ১৯৮৩ ফুট উঁচুতে এক গগণচুম্বী অট্টালিকায় এবং ঘড়িটি চালু করা হলো মাহে রমজানের শুরুতে। টিক… টিক… টিক…। সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদের নির্দেশে ঘড়িটি রমজান মাসের প্রথম দিন অর্থাৎ গত ১১ আগষ্ট বেলা ১২ টা থেকে চলতে শুরু করেছে।

সেই ১৮৮৪ সালে বিশ্ববাসীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল জিএমটি বা গ্রিনিচমান সময়কে। চাপিয়ে দিয়েছিল পশ্চিমা বিশ্ব। সেই থেকে স্থানীয় সময় যাই থাকুক না কেন, স্ট্যান্ডার্ড টাইম হিসেবে আমরা গণনা করে চলেছি গ্রিনিচমান সময়কে। কিন্তু দিনবদলের জোয়ার চলছে পৃথিবীজুড়ে। সময় কেন বদলাবে না? ২০০৮ সালে দোহায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মুসলিম বিজ্ঞানী-উলামারা বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে বলেছিলেন, ইউনিভার্সাল স্ট্যান্ডার্ড টাইম বা বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন মান সময় হিসেবে ‘মক্কা টাইম’ হবে সর্বাধিক বিজ্ঞানসম্মত। কারণ জিএমটির নির্দেশক পূর্ব লন্ডনের ওই গ্রিনিচ নামক স্থানটিকে পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ মানুষই চেনে না। অথচ প্রতিবছর হজের সময় বিশ্বের সব পথ গিয়ে শেষ হয় মক্কায়। মক্কা হচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্র বা মধ্যমণি। গোটা বিশ্ব থেকে প্রতিবছর লাখো হাজি সমবেত হন এই মক্কায়। সুতরাং সৌদি আরব আশা করছে, আর জিএমটি নয়, এখন থেকে ‘এরাবিয়ান স্টান্ডার্ড টাইম’ অর্থাৎ ‘মক্কা মীন টাইম’ বা ‘এমএমটি’ হবে ইউনিভার্সাল স্ট্যান্ডার্ড টাইম। এ দুটোর মধ্যে সময়ের ব্যবধান ৩ ঘন্টা । জিএমটি’র চেয়ে তিন ঘন্টা এগিয়ে থাকবে এমএমটি। অন্তত দেড়শ কোটি মুসলমানের জন্য তো বটেই।

লন্ডনের বিগবেনকে টেক্কা দেওয়া এই ঐতিহাসিক ঘড়িটি কেমন? নাম কি? কত বড়? অনেক প্রশ্ন। কিন্তু এর একটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে গেলে পত্রিকায় জায়গা হবে না। কারণ বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ঘড়িটি দেখার জন্য এটিকে ২০ লাখ সাদা ও সবুজ বিজলিবাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। আর ১৯ মাইল দূর থেকে পরিষ্কার দেখা যাবে ঘড়িটি, সংকেত পাওয়া যাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের।

রয়াল মক্কা ক্লক টাওয়ারের উপর বসেছে এই ঘড়ি। নাম ‘মক্কা ঘড়ি’। লন্ডনের ঘড়ির নাম বিগবেন। টেমস নদীতে ভাসে বিগবেন টাওয়ার। ইস্তাম্বুলে সেবাহির মলে যে ঘড়িটি আছে, আয়তনের দিক থেকে সেটি বিগবেনের চেয়েও বড়, এতদিন চ্যাম্পিয়ন ছিল। ৩৬ মিটার চওড়া ডায়াল। কিন্তু মক্কা ঘড়ির ডায়ামিটার ১৩০ ফুট । চারটি মুখ এ ঘড়ির। অর্থাৎ চারদিক থেকে দেখা যাবে সময়। পবিত্র কা’বা শরিফের দক্ষিণ গেটের কাছাকাছি সাতটি বিশাল টাওয়ারের ‘আবরাজ আল-বাইত’ কমপ্লেঙ্রে মাঝখানে এই রয়াল মক্কা ক্লক টাওয়ার। স্থানীয় পত্রপত্রিকার মতে, ঘড়িটির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। সৌদি বার্তা সংস্থা এসপিএ জানিয়েছে, এর উচ্চতা ৬০১ মিটার বা ১৯৮৩ ফুট। বিশ্বের দ্বিতীয় সুউচ্চ টাওয়ার। দুবাইয়ের ‘বুর্জ খলিফা’ টাওয়ারের পরে এটি। বুর্জ খলিফার উচ্চতা ৮২৮ মিটার বা ২৭১৭ ফুট। তৃতীয় উচ্চতার টাওয়ার হচ্ছে তাইওয়ানের ‘তাইপে ১০১’। উচ্চতা ৫০৯ মিটার বা ১৬৭০ ফুট। চতুর্মুখী ঘড়িটির একটি মুখে লাগানো হয়েছে ৯ কোটি ৮০ লাখ পিস গ্লাস মোজাইক। প্রতিটি মুখে আরবিতে লেখা আছে ‘আল্লাহু আকবার’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ মহান’ শব্দগুচ্ছ যা হাজারো রঙিন বিজলিবাতির আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। প্রায় ১৯ মাইল দূর থেকেও পড়া যাবে আল্লাহর নাম। আল্লাহর নামের উপরের দিকে স্থাপন করা হয়েছে সোনা দিয়ে মোড়ানো ৭৫ ফুট ডায়ামিটারের একটি বাঁকা চাঁদ। বিশেষ বিশেষ দিবস উপলক্ষে এই চাঁদ থেকে আকাশে বিচ্ছুরিত হবে প্রায় ১৬টি উজ্জ্বল আলোকরশ্মি, যা আকাশের ১০ কিলোমিটার উঁচুতে (সোয়া ছয় মাইল) ছড়িয়ে যাবে। প্রায় ২০ লাখ লেড বাতি আল্লাহর নামকে প্রোজ্জ্বল করে রাখবে রাতভর। ঘড়ির মাথায় বসানো হয়েছে প্রায় ২১ হাজার সাদা ও সবুজ বাতি যা ৩০ কিলোমিটার অর্থাৎ প্রায় ১৯ মাইল দূর পর্যন্ত নামাজের সংকেত দেবে। যাই হোক, আবরাজ আল-বাইত নামের এই ‘মক্কা ঘড়ি’ কমপ্লেঙ্ পৃথিবীর আরেক অত্যাশ্চর্যরূপেই অভিভূত হচ্ছে। বিশেষ বিশেষ রাতে এটি অলৌকিক স্থাপত্যে মহিমান্বিত হয়ে উঠবে।

সাত টাওয়ারবিশিষ্ট আবরাজ আল-বাইত কমপ্লেঙ্রে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ওসামা বিন লাদেনের বাবার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বিন লাদেন গ্রুপ। এপি ও এএফপি বলেছে, সৌদি সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি তহবিল থেকে এর ব্যয় সংকুলান হয়েছে। সাত টাওয়ারের উপরে আছে এক বিশাল মঞ্চ। ছয়টি টাওয়ারের প্রতিটি ৪২ থেকে ৪৮ তলাবিশিষ্ট। আর মাঝখানের ঘড়ি টাওয়ারটি অন্যদের চেয়ে দ্বিগুণ তলাবিশিষ্ট। কমপ্লেঙ্ েতিন হাজার হোটেল কক্ষ ও ফ্ল্যাট রয়েছে। এতে আছে পাঁচতলা শপিং সেন্টার, বিশাল বিশাল মসজিদ ও কনফারেন্স হল, ১৫ লাখ বর্গমিটার ফ্লোর স্পেস। কমপ্লেঙ্ েআছে তিনটি বিশ্বমানের হোটেল- ফায়ারমন্ট, র‌্যাফেলস ও সুইস হোটেল। আছে কয়েক শ লাঙ্ারি অ্যাপার্টমেন্ট; যেখান থেকে সরাসরি দেখা যাবে পবিত্র কা’বা শরিফ। এই কমপ্লেঙ্রে পেছনে সৌদি সরকারের আরেকটি উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। তা হচ্ছে, ক্যাপাসিটির বাইরে প্রতিবছর যে অতিরিক্ত ৭০ লাখ হজযাত্রী মক্কায় আসেন, তাদের জন্য আরামদায়ক অবস্থানের সুযোগ সৃষ্টি। কমপ্লেঙ্রে স্থপতি দার আল হান্দাশের মতে, হজের সময় এই কমপ্লেঙ্ ে৬৫ হাজার হজব্রত পালনকারীর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কমপ্লেঙ্রে ডিজাইন করেছেন জার্মান ও সুইস প্রকৌশলীরা। সৌদি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, প্রকল্পে মোট ব্যয় হচ্ছে ৮০ কোটি মার্কিন ডলার।

শেষ করি ঘড়ির কথা দিয়ে। ‘মক্কা ঘড়ি’র ডায়ামিটার লন্ডনের বিগবেনের চেয়ে ছয় গুণ বড় এবং এর ফ্রেমটি তৈরি করেছেন অত্যন্ত সুদক্ষ ২৫০ জন মুসলিম ওয়েল্ডিং কর্মী। ঘড়ির বুকে চিহ্নিত হয়েছে খেজুর গাছ ও সবুজ ক্রস তরবারির সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় প্রতীক। ঘড়ির নিচেই রয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ ডেক যেখান থেকে দেখা যাবে গোটা মক্কা নগরী। এলিভেটর দর্শনার্থীদের নিয়ে যাবে সেই বিশাল পর্যবেক্ষণ ডেক বা ব্যালকনিতে যেখানে রয়েছে চারতলাবিশিষ্ট মহাকাশ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং ইসলামি জাদুঘর। কমপ্লেঙ্টি জনসাধারণের জন্য কবে নাগাদ খুলে দেওয়া হবে তা এখনো জানায়নি কোনো সংস্থা। তবে এসপিএ জানিয়েছে, মক্কা ঘড়ি রমজানের প্রথম রাতে তিন মাসের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে।

উৎস: বাংলাদেশ প্রতিদিন।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button