অন্তর কঠিন হওয়ার কারণ ও প্রতিকার
মুহাম্মাদ আবদুল ওয়াদূদ
মানুষ কেবল দেহসর্বস্ব জীব নয়। সুন্দর দৈহিক অবয়বের সাথে মহান আল্লাহ মানুষকে সুন্দর একটি ক্বলব বা অন্তর দিয়েছেন। যার মাধ্যমে মানুষ চিন্তা করে জীবনের ভাল-মন্দ বেছে নেয়। মানুষের অন্তরের চিন্তা-ভাবনার উপরই নির্ভর করে তার অন্যান্য অঙ্গের ভাল কাজ বা মন্দ কাজ সম্পাদন করা। এই ক্বলব বা অন্তরেই মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস বা আক্বীদার অবস্থান। আর আল্লাহ বান্দার অন্তরই দেখেন।[1] এই ক্বলব বা অন্তর হ’ল পরিকল্পনাকারী এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি বাস্তবায়নকারী। অন্তর ভাল থাকলে, মানুষের কাজও ভাল হবে।[2] অন্তর বা মন খারাপ থাকলে, কাজে মনোযোগ থাকে না। কাজ হয় অগোছালো, অসুন্দর। শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ন্যায় এই অন্তরেরও রোগ-ব্যাধি হয়ে থাকে। শরীরের অন্যান্য রোগের কথা মানুষ জানলেও অন্তরের রোগ সম্পর্কে অনেকেই অজ্ঞ। ফলে অধিকাংশ মানুষের অন্তর সুস্থ না থাকার কারণে পাপ কাজ করেই যাচ্ছে। আল্লাহর আযাবের কথা শুনেও কর্ণপাত করছে না। অন্তর কঠিন হওয়া অন্তরের একটি অন্যতম রোগ। অন্তর কঠিন হ’লে মানুষ আল্লাহর আযাব ও জাহান্নামের শাস্তির কথা শুনে বিগলিত হয় না। আল্লাহ বনী ইসরাঈলদের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, ثُمَّ قَسَتْ قُلُوْبُكُم مِّن بَعْدِ ذَلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً ‘অতঃপর এ ঘটনার পরে তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। তা পাথরের মত অথবা তদপেক্ষাও কঠিন’ (বাক্বারা ২/৭৪)। অন্য আয়াতে তিনি বলেন, وَلَـكِنْ قَسَتْ قُلُوْبُهُمْ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ- ‘বস্ত্ততঃ তাদের অন্তর কঠোর হয়ে গেল এবং শয়তান তাদের কাছে সুশোভিত করে দেখাল, যে কাজ তারা করছিল’ (আন‘আম ৬/৪৩)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, فَوَيْلٌ لِّلْقَاسِيَةِ قُلُوْبُهُم مِّن ذِكْرِ اللهِ- ‘যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণের ব্যাপারে কঠোর, তাদের জন্য দুর্ভোগ। তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে রয়েছে’ (যুমার ৩৯/২২)। আল্লাহ আরো বলেন, فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوْبُهُمْ ‘তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে। অতএব তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে’ (হাদীদ ৫৭/১৬)।
অন্তর কঠিন হওয়ার আলামত :
(১) আল্লাহর আনুগত্য ও ভালকাজে অলসতা : মানুষের অন্তর কঠিন হ’লে ইবাদতে অলসতা চলে আসবে। ছালাত পড়বে কিন্তু অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকবে না। ছালাতে নফল ও সুন্নাত আদায়ের পরিমাণ কমে যাবে। মুনাফিকদের চরিত্র প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَلاَ يَأْتُوْنَ الصَّلاَةَ إِلاَّ وَهُمْ كُسَالَى وَلاَ يُنْفِقُوْنَ إِلاَّ وَهُمْ كَارِهُوْنَ ‘তারা ছালাতে আসে অলসতার সাথে আর ব্যয় করে সংকুচিত মনে’ (তওবা ৯/৫৪)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَإِذَا قَامُوْا إِلَى الصَّلاَةِ قَامُوْا كُسَالَى- ‘যখন তারা ছালাতে দাঁড়ায় তখন তারা অলসভাবে দাঁড়ায়’ (নিসা ৪/১৪২)।
(২) আল্লাহর আয়াত ও উপদেশ শুনে অন্তর প্রভাবিত না হওয়া : অন্তর কঠিন হ’লে মানুষ কুরআনের আয়াত শুনে বিশেষ করে আযাবের আয়াতগুলি শুনে ভীত হয় না; বরং কুরআন পড়া ও শোনাকে নিজের কাছে ভারী মনে হয়। আল্লাহ বলেন, فَذَكِّرْ بِالْقُرْآنِ مَن يَخَافُ وَعِيْدِ ‘অতএব যে আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে কুরআনের মাধ্যমে উপদেশ দান করুন’ (ক্বাফ ৫০/৪৫)। অন্যত্র আল্লাহ মুমিনদের প্রশংসা করে বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَاناً وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ- ‘যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় আল্লাহর আয়াত, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরওয়ারদেগারের প্রতি ভরসা করে’ (আনফাল ৮/ ২)।
(৩) দুনিয়াতে আল্লাহর আযাব-গযব ও মানুষের মৃত্যু দেখে অন্তর ভীত না হওয়া : মানুষ সাধারণত আযাব-গযব ও নিকটজনের মৃত্যু দেখলে ভীত হয়। কিন্তু কেউ যদি ভীত না হয়, ভাল আমল না করে, খারাপ আমল ছেড়ে না দেয়, তাহ’লে বুঝতে হবে তার অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। আল্লাহ বলেন, أَوَلاَ يَرَوْنَ أَنَّهُمْ يُفْتَنُوْنَ فِيْ كُلِّ عَامٍ مَّرَّةً أَوْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ لاَ يَتُوْبُوْنَ وَلاَ هُمْ يَذَّكَّرُوْنَ ‘তারা কি লক্ষ্য করে না, প্রতিবছর তারা দু’একবার বিপর্যস্ত হচ্ছে, অথচ তারা এরপরও তওবা করে না কিংবা উপদেশ গ্রহণ করে না’ (তওবা ৯/১২৬)।
(৪) দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা বৃদ্ধি পাওয়া ও আখেরাতকে ভুলে যাওয়া : মুমিনদের আসল বাসস্থান হ’ল জান্নাত। দুনিয়া হ’ল আখেরাতের শস্যক্ষেত্র। যদি কেউ আখেরাতের কথা ভুলে দুনিয়া অর্জনের পিছনে লেগে থাকে, তাহ’লে বুঝতে হবে তার অন্তর কঠিন হয়ে গেছে।
(৫) আল্লাহকে সম্মান করা কমে যাওয়া : আল্লাহকে সম্মান না করার অর্থ হ’ল আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে মান্য না করা। সুতরাং কেউ আল্লাহর আদেশকে মান্য না করে নিষেধগুলিতে ডুবে থাকলে বুঝতে হবে লোকটির অন্তর কঠিন হয়ে গেছে।
অন্তর কঠিন হওয়ার কারণ :
অন্তর কঠিন হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। নিম্নে সেগুলি আলোচনা করা হ’ল।-
(১) অন্তরকে দুনিয়ার কাজে ব্যস্ত রেখে আখেরাতকে ভুলিয়ে রাখা : এটা হচ্ছে অন্তর কঠিন হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। যদি দুনিয়ার ভালবাসা আখেরাতের ভালবাসার চেয়ে প্রাধান্য পায়, তাহ’লে ধীরে ধীরে অন্তর কঠিন হ’তে আরম্ভ করে। ফলে ঈমান কমে যায়, সৎ কাজকে ভারী মনে হয়, দুনিয়াকে ভালবাসা আরম্ভ করে এবং আখেরাতকে ভুলে যেতে থাকে। জনৈক সৎ বান্দা বলেছেন,
ما من عبد إلا وله عينان في وجهه يبصر بهما أمر الدنيا، وعينان في قلبه يبصر بهما أمر الآخرة، فإذا أرد الله بعبد خيراً فتح عينيه اللتين في قلبه، فأبصر بهما ما وعد الله بالغيب، وإذا أراد به غير ذلك تركه على ما فيه، ثم قرأ-
‘প্রত্যেক বান্দারই দু’টি চোখ রয়েছে। এক চোখ দিয়ে সে দুনিয়ার বিষয় দেখে। আর অন্তরে যে চোখ আছে তা দিয়ে সে আখেরাতের বিষয় দেখে। আল্লাহ যদি কোন বান্দার কল্যাণ চান, তাহ’লে তার অন্তরে যে চোখ আছে তা খুলে দেন। ফলে আল্লাহ অদৃশ্যের যে ওয়াদা করেছেন সে সেগুলি দেখতে থাকে। আর আল্লাহ যদি অন্য কিছু ইচ্ছা করেন, তাহ’লে তার অবস্থায় তাকে ছেড়ে দেন। তারপর এ আয়াতটি পাঠ করেন, ‘তাদের অন্তর কি তালাবদ্ধ করা হয়েছে’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)।
(২) অলসতা : এটা একটা সংক্রামক ব্যাধি। অন্তর এ রোগে আক্রান্ত হ’লে শরীরের সব অঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়ে। শরীরের সব অঙ্গ কর্মক্ষমতা হারায়। আল্লাহ বলেন, أُوْلَـئِكَ الَّذِيْنَ طَبَعَ اللهُ عَلَى قُلُوْبِهِمْ وَسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ وَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْغَافِلُوْنَ- ‘তারা হ’ল সে সমস্ত লোক যাদের অন্তর, শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির উপর আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন’ (নাহল ১৬/১০৮)। আল্লাহ মানুষকে যে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়েছেন, মানুষের উচিত সেগুলি সঠিকভাবে কাজে লাগনো। অন্যথা সেই গাফেলদের জন্য আল্লাহ আযাবের ব্যবস্থা রেখেছেন। আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيْراً مِّنَ الْجِنِّ وَالإِنْسِ لَهُمْ قُلُوْبٌ لاَّ يَفْقَهُوْنَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لاَّ يُبْصِرُوْنَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لاَّ يَسْمَعُوْنَ بِهَا أُوْلَـئِكَ كَالأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُوْلَـئِكَ هُمُ الْغَافِلُوْنَ-
‘আমি বহু জিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় রয়েছে, কিন্তু তারা তদ্বারা উপলব্ধি করে না। তাদের চক্ষু রয়েছে কিন্তু তারা তদ্বারা দেখে না। তাদের কর্ণ রয়েছে, কিন্তু তদ্বারা তারা শোনে না। তারাই হ’ল পশুর ন্যায় বরং তা অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত। তারাই হ’লো গাফিল বা অমনোযোগী’ (আ‘রাফ ৭/১৭৯)।
(৩) খারাপ বন্ধুদেরকে ভালবাসা ও তাদের সাথে উঠা-বসা করা : কথায় আছে ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। মানুষ যার সাথে চলাফেরা করে তার আচার-আচরণ অন্য জনের উপরও প্রভাব বিস্তার করে। রাসূল (ছঃ) বলেছেন,
مَثَلُ الْجَلِيسِ الصَّالِحِ وَالْجَلِيسِ السَّوْءِ كَمَثَلِ صَاحِبِ الْمِسْكِ، وَكِيرِ الْحَدَّادِ، لاَ يَعْدَمُكَ مِنْ صَاحِبِ الْمِسْكِ إِمَّا تَشْتَرِيهِ، أَوْ تَجِدُ رِيْحَهُ، وَكِيْرُ الْحَدَّادِ يُحْرِقُ بَدَنَكَ أَوْ ثَوْبَكَ أَوْ تَجِدُ مِنْهُ رِيحًا خَبِيثَةً.
‘সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ আতর বিক্রেতা ও কর্মকারের হাপরের ন্যায়। আতর বিক্রেতার থেকে শূন্য হাতে ফিরে আসবে না। হয় তুমি আতর খরিদ করবে, না হয় তার সুঘ্রাণ পাবে। আর কর্মকারের হাপর হয় তোমার ঘর অথবা তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে, না হয় তুমি তার দুর্গন্ধ পাবে’।[3]
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একজন লোক নবী (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা সে ব্যক্তি সম্পর্কে কি বলব, যে কোন সম্প্রদায়কে ভালবাসে অথচ তাদের সাথে সাক্ষাত হয়নি? রাসূল (ছাঃ) বললেন, المرء مع من احب ‘মানুষ তার সাথেই থাকবে সে যাকে ভালবাসে’।[4] অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
لَمَّا وَقَعَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ فِى الْمَعَاصِى نَهَتْهُمْ عُلَمَاؤُهُمْ فَلَمْ يَنْتَهُوا فَجَالَسُوهُمْ فِى مَجَالِسِهِمْ وَوَاكَلُوهُمْ وَشَارَبُوهُمْ فَضَرَبَ اللَّهُ قُلُوبَ بَعْضِهِمْ بِبَعْضٍ وَلَعَنَهُمْ عَلَى لِسَانِ دَاوُدَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ
‘বনু ইসরাঈলরা যখন পাপাচারে লিপ্ত হ’ল, তখন তাদের আলেম দরবেশগণ প্রথমদিকে এইসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করত। কিন্তু লোকেরা বিরত না হওয়ায় পরে তারা দুষ্টমতি সমাজ নেতা ও বড়লোকদের সাথে উঠা-বসা ও খানাপিনা করত। ফলে আল্লাহ তাদের পরস্পরের অন্তরকে পাপাচারে কুলষিত করে দেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদের উপর লা‘নত করেন’।[5]
(৪) অধিক হারে গুনাহ ও খারাপ কাজ করা : অধিক হারে পাপ বান্দার অন্তরকে কঠিন করে তোলে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا أَخْطَأَ خَطِيئَةً نُكِتَتْ فِى قَلْبِهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ فَإِذَا هُوَ نَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ وَتَابَ سُقِلَ قَلْبُهُ وَإِنْ عَادَ زِيدَ فِيهَا حَتَّى تَعْلُوَ قَلْبَهُ وَهُوَ الرَّانُ الَّذِى ذَكَرَ اللهُ (كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ)
‘যখন বান্দা কোন পাপ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। যখন সে তওবা করে, তখন সেটা তুলে নেওয়া হয়। আর ইস্তেগফারের মাধ্যমে অন্তরকে পরিষ্কার করা হয়। আর যদি পাপ বাড়তেই থাকে, তাহ’লে দাগও বাড়তে থাকে। আর এটাই হ’ল মরিচা। যেমন আল্লাহ বলেন, না এটা সত্য নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের মনের উপর মরিচারূপে জমে গেছে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/১৪) আহমাদ, তিরমিযী।
(৫) মৃত্যুর কষ্ট ও আখেরাতের আযাব ভুলে যাওয়া : মৃত্যু ও আখেরাতের চিন্তা মানুষের অন্তরকে নরম রাখে। কেউ মৃত্যুর কথা ও আখেরাতে জবাবদিহিতার কথা ভুলে গেলে তার অন্তর কঠিন হয়ে যায়।
অন্তর কঠিন হওয়ার প্রতিকার :
(১) আল্লাহ তা‘আলাকে চেনা : অন্তর কঠিন হওয়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার প্রথম ও প্রধান উপায় হ’ল আল্লাহর রহমত, ক্ষমা, শাস্তি ও মর্যাদা জানার মাধ্যমে অন্তর নরম করার চেষ্টা করা এবং আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণের জন্য ছুটে আসা। আল্লাহ বলেন,غَافِرِ الذَّنبِ وَقَابِلِ التَّوْبِ شَدِيْدِ الْعِقَابِ ذِي الطَّوْلِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ إِلَيْهِ الْمَصِيْرُ- ‘পাপ ক্ষমাকারী, তওবা কবুলকারী, কঠোর শাস্তিদাতা ও সামর্থ্যবান। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাঁরই দিকে হবে প্রত্যাবর্তন’ (গাফির ৪০/ ৩)।
(২) কুরআন তিলাওয়াত করা : কুরআন তিলাওয়াত করা ও এর অর্থ বুঝে আমল করার মাধ্যমে অন্তর নরম হয়। আল্লাহ বলেন, الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَالصَّابِرِيْنَ عَلَى مَا أَصَابَهُمْ ‘(বিনয়ী হ’ল তারা) যাদের অন্তর আল্লাহর নাম স্মরণ করা হ’লে ভীত হয় এবং যারা তাদের বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করে’ (হজ্জ্ব ২২/৩৫)। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রহঃ) কুরআন দ্বারা কঠিন অন্তরের কিভাবে চিকিৎসা করতে হবে তা অতি সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন এভাবে- ‘এটির দু’টি পথ রয়েছে- এক- আপনার অন্তরকে দুনিয়া থেকে স্থানান্তর করে আখেরাতের দেশে নিয়ে যাবেন। দুই- অতঃপর কুরআনের অর্থ বুঝবেন এবং কেন নাযিল হয়েছে সেটা বুঝার চেষ্টা করবেন এবং প্রত্যেক আয়াত হ’তে আপনার জন্য প্রয়োজনীয় অংশ গ্রহণ করে তা আপনার অন্তরের ব্যধির উপর প্রয়োগ করবেন। তা যদি আপনার অসুস্থ অন্তরের উপর প্রয়োগ করেন, তাহ’লে আল্লাহর ইচ্ছায় আরোগ্য লাভ করবেন’।[6]
(৩) অন্তরকে পরকালীন চেতনায় উজ্জীবিত করা : অন্তরকে বুঝাতে হবে যে, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের পরে রয়েছে স্থায়ী, অনাদি, অনন্ত আখিরাতের জীবন। সে জীবনের তুলনায় এ নশ্বর জীবন নিতান্তই তুচ্ছ ও নগণ্য। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
والله مَا مَثَلُ الدُّنْيَا فِى الآخِرَةِ إِلاَّ مَثَلُ مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ إِصْبَعَهُ فِى الْيَمِّ فَلْيَنْظُرْ بِمَ يَرْجِعُ.
‘আল্লাহর কসম! আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার উদাহরণ হ’ল যেমন তোমাদের কেউ মহাসাগরের মধ্যে নিজের একটি অঙ্গুলি ডুবিয়ে দেয়, এরপর সে লক্ষ্য করে দেখুক তা কি (পরিমাণ পানি) নিয়ে আসল’।[7]
জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি কানকাটা মৃত বকরীর বাচ্চার নিকট দিয়ে অতিক্রমকালে বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে একে এক দিরহামের বিনিময়ে ক্রয় করতে পসন্দ করবে’? ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা তো একে কোন কিছুর বিনিময়েই ক্রয় করতে পসন্দ করব না। তখন তিনি বললেন, فَوَاللهِ لَلدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللهِ مِنْ هَذَا عَلَيْكُمْ ‘আল্লাহর কসম! এটা তোমাদের কাছে যতটুকু নিকৃষ্ট, আল্লাহর কাছে দুনিয়া এর চেয়েও অধিক নিকৃষ্ট’।[8]
(৪) মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী অবস্থার কথা চিন্তা করা : দুনিয়ার জীবনের পর সবাইকে মরতে হবে এবং দুনিয়ার জীবনের হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে। এ চিন্তা ও বিশ্বাসই মানুষর অন্তর নরম করতে পারে। মরণের পর কবরে যেতে হবে, মুনকার-নাকীরের প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, হাশরের ময়দানে আমলনামা নিয়ে উঠতে হবে, আমল ভাল হ’লে জান্নাত, না হয় জাহান্নাম। একথা চিন্তা ও বিশ্বাসের মাধ্যমেই অন্তর নরম হয়। পক্ষান্তরে সে যদি পরকালের জবাবদিহিতার কথা ভুলে যায়, তাহ’লে তার অন্তর দুনিয়ার মায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে কঠিন হয়ে যায়।
(৫) কবর যিয়ারত করা ও তাদের অবস্থা চিন্তা করা : কোন মানুষ যদি কবরের কাছে গিয়ে এই চিন্তা করে যে, এই কবরে যে আছে সে একদিন দুনিয়াতে ছিল, আমার মত খাওয়া-দাওয়া করত, চলাফেরা করত। আজকে সে কবরে চলে গেছে, তার দেহ মাটি হয়ে গেছে, তার সম্পদ তার ছেলে-মেয়েরা ভাগ করে নিয়েছে। আমাকেও একদিন তার মত কবরে যেতে হবে। তাহ’লে অন্তর নরম হবে। রাসূল (ছঃ) বলেছেন, كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ أَلاَ فَزُوْرُوْهَا، فَإِنَّهَا تَرِقُ الْقَلْبَ . ‘আমি প্রথমে তেমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন তোমরা কবর যিয়ারত কর। কেননা এটা অন্তরকে নরম করে’।[9]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করেছিলেন। অতঃপর তিনি কেঁদেছেন এবং আশেপাশে যারা ছিল তাদের কাঁদিয়েছেন। অতঃপর বললেন, আমি আল্লাহর কাছে আমার মায়ের জন্য ক্ষমা চাওয়ার অনুমতি চেয়েছি, কিন্তু আমাকে অনুমতি দেয়া হয়নি। আমি আল্লাহর কাছে তাঁর কবর জিয়ারত করার অনুমতি চেয়েছি। অতঃপর আমাকে অনুমতি দিয়েছেন। অতএব তোমরা কবর যিয়ারত কর। কেননা এটা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়’।[10]
(৬) আল্লাহর নির্দশনাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা : আল্লাহ কুরআনে আযাব-গযবের অনেক আয়াত নাযিল করেছেন। বিভিন্ন জাতি অবাধ্য হওয়ার কারণে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়ার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। চিন্তাশীল মানুষ যদি এগুলি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন তাহ’লে তার অন্তর নরম হবে। আল্লাহ বলেন,
كِتَاباً مُّتَشَابِهاً مَّثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُوْدُ الَّذِيْنَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِيْنُ جُلُوْدُهُمْ وَقُلُوْبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللهِ ذَلِكَ هُدَى اللهِ يَهْدِيْ بِهِ مَنْ يَشَاءُ وَمَن يُضْلِلْ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ-
‘আল্লাহ উত্তমবাণী তথা কিতাব নাযিল করেছেন, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ, পুনঃ পুনঃ পঠিত। এতে তাদের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে চামড়ার উপর, যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে, এরপর তাদের চামড়া ও অন্তর আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়। এটাই আল্লাহর পথনির্দেশের মাধ্যম। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ যাকে গোমরাহ করেন তার কোন পথ প্রদর্শক নেই’ (যুমার ৩৯/২৩)।
(৭) বেশী বেশী আল্লাহর যিকর করা ও গুনাহ মাফ চাওয়া : অন্তরের কঠিনতা যিকর ব্যতীত দূর হয় না। প্রত্যেকের উচিৎ অন্তরের কঠিনতা দূর করার জন্য আল্লাহর যিকর করা। একজন লোক হাসান (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, يا أبا سعيد، أشكو إليك قسوة قلبي، قال: أذبه بالذكر. ‘হে আবু সাঈদ! আপনার নিকট অন্তর কঠিন হওয়ার অভিযোগ করছি, তিনি বললেন, তুমি (অন্তরের কঠিনতা থেকে বাঁচতে) যিকর করবে। ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রহঃ) বলেছেন, صدأ القلب بأمرين: بالغفلة والذنب، وخلاؤه بشيئن: بالاستغفار والذكر. ‘দু’টি জিনিস অন্তরকে বন্ধ করে দেয়- অলসতা ও গুনাহ, এবং দুটি জিনিস এটাকে শূন্যতা করে- ক্ষমাপ্রার্থনা ও যিকির।
(৮) সৎ লোকদের সঙ্গী হওয়া ও তাদের থেকে উপদেশ গ্রহণ করা : সৎ লোকদের সাথে থাকা, তাদের সাথে চলাফেরা করা ও তাদের থেকে উপদেশ নেওয়ার মাধ্যমে মানুষের অন্তর নরম থাকে। আল্লাহ বলেন,
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيْدُوْنَ وَجْهَهُ وَلاَ تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيْدُ زِيْنَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلاَ تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَن ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطاً.
‘আপনি নিজেকে তাদের সৎসঙ্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহবান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, সে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না’ (কাহফ ১৮/২৮)।
জাফর বিন সুলায়মান বলতেন, كنت إذا وجدت من قلبي قسوة غدوت فنظرة إلي وجه محمد بن واسع ‘যখনই আমি আমার অন্তরের মধ্যে কঠিনতা লক্ষ্য করেছি, তখনই আমি মুহাম্মাদ বিন ওয়াছে‘-এর চেহারার দিকে লক্ষ্য করেছি’।
(৯) আত্মসমালোচনা করা : মানুষ যদি নিজে নিজের দিকে না তাকায়, তাহ’লে সে তার অন্তরের রোগের অবস্থা জানতে পারে না। তাই মানুষের উচিত তার প্রতিদিনের কার্যকলাপের দিকে নিজেই লক্ষ্য রাখা এবং ভাল কাজ অব্যাহত রাখা ও মন্দা কাজ ত্যাগ করা।
১০. দো‘আ করা : দো‘আ প্রত্যেক মুমিনের প্রধান হাতিয়ার এবং অন্তরের কঠিনতা থেকে পরিত্রাণকারী। অন্তরের চিকিৎসার জন্য নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়া যায়, যা রাসূল (ছাঃ) করতেন, اللَّهُمَّ مُصَرِّفَ الْقُلُوْبِ صَرِّفْ قُلُوْبَنَا عَلَى طَاعَتِكَ.
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা মুছার্রিফাল কুলূব ছাররিফ কুলূবানা ‘আলা তা‘আতিক’। অর্থ: ‘হে হৃদয় সমূহকে পরিবর্তনকারী! আমাদের হৃদয়গুলিকে আপনার আনুগত্যের দিকে ঘুরিয়ে দিন’।[11] অন্য হাদীছে এসেছে, يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِىْ عَلَى دِيْنِكَ. ‘হে অন্তরের পরিবর্তনকারী! আপনি আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর স্থির রাখুন’।[12]
পরিশেষে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে অন্তরের কঠিনতা থেকে রক্ষা করে সুস্থ অন্তর নিয়ে তাঁর দরবারে উপস্থিত হওয়ার তাওফীক্ব দান করেন- আমীন।
[1]. মুসলিম, মিশকাত তাহক্কীক আলবানী, ’রিক্কাক’ অধ্যায়, ‘লোক দেখানো ও নাম কুড়ানো’ অনুচ্ছেদ হা/৫৩১৪, রিয়াযুছ ছালেহীন হা/৭।
[2]. বুখারী হা/৫২, মুমলিম, রিয়াযুছ ছালেহীন হা/৫৮৮।
[3]. বুখারী হা/২১০১, মিশকাত হা/৫০১০ তাহক্বীক আলবানী ‘আদব’ অধ্যায় ‘আল্লাহর জন্য ভালবাসা’ অনুচ্ছেদ।
[4]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫০০৮ তাহক্বীক : আলবানী ‘আদব’ অধ্যায় ‘আল্লাহর জন্য ভালবাসা’ অনুচ্ছেদ; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১৯,৩৭০,৩৬৮।
[5]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১৪৮।
[6]. মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, ঈমানী দুর্বলতা, (ঢাকা: আল-ফুরকান প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ-২০০৪), অনু: মুহাম্মদ শামাউন আলী, পৃঃ ৩৬।
[7]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৫৬; তাহক্বীক : আলবানী, ‘কিতাবুর রিক্বাক্ব; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/৪৬৩।
[8]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৫৭ তাহক্বীক: আলবানী ‘কিতাবুর রিক্বাক্ব’।
[9]. হাকেম, হা/১৩৯৩; আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[10]. আলবানী, আহকামুল জানায়িয, মাসআলা নং ১১৯।
[11]. মুসলিম, রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১৪৭০, মিশকাত হা/৮৯।
[12]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১০২।