নারী অঙ্গন

মুসলিম নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (১ম কিস্তি)

নারী এবং তার দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা কেন?

প্রথমত:

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাকে পুরুষের স্বভাব-প্রকৃতি থেকে ভিন্ন বিশেষ স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন; আর সে থেকেই তিনি তাকে এমন কতগুলো বিধিবিধানের সাথে বিশেষিত করেছেন, যেগুলো ঐ বিশেষ স্বভাব-প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ হায়েয (ঋতুস্রাব), নিফাস, উভয় অবস্থা থেকে পবিত্রতা অর্জন, দুধ পান করানো এবং সালাত (নামায), সিয়াম (রোযা), হজ প্রভৃতি ধরনের ইবাদতের কিছু কিছু বিধানের সাথে যা সংশ্লিষ্ট। সুতরাং পুরুষ ও নারী গবেষকদের উপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হল, তারা এ বিষয়ের প্রতি সংশ্লিষ্ট করে তাদের আলোচনা নির্দিষ্ট করবেন।

দ্বিতীয়ত:

একজন নারীর উপর কিছু আবশ্যকীয় দায়িত্ব ও মহান আমানত রয়েছে, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তার উপর ন্যস্ত করেছেন। সে সাধারণভাবে আকিদা-বিশ্বাস, পবিত্রতা অর্জন, সালাত (নামায), সিয়াম (রোযা) প্রভৃতির মত শরী‘আতের সকল বিধিবিধানের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত। আর তার জন্য আরও কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে, একাধারে সে লালন-পালনকারিনী, মাতা ও স্ত্রী হওয়ার কারণে তাকে সেগুলোর সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত করা হয়েছে; সুতরাং প্রত্যেক অবস্থায় তার উপর আবশ্যক হল সে ঐ নিয়ম-কানুনসমূহ যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে। অতএব তাকে নিয়ে মোটামুটিভাবে ও বিস্তারিতভাবে আলোচনা হওয়া আবশ্যক; আরও আবশ্যক সুস্পষ্টভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা, যাতে মুসলিম নারী তার মধ্য দিয়ে ঐসব দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানতে পারে।

তৃতীয়ত:

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যব্যাপী ইসলামের শত্রুগণের পক্ষ থেকে বিগত যুগে মুসলিম নারীরা ঐ নগ্ন হামলার শিকার হয়েছে এবং মুসলিম সন্তানদের কেউ কেউ সেই প্রয়াসকে গলধঃকরণ করেছে; ফলে তারা ঐ কলমসমূহ যা লিখেছে, তা-ই আওড়াতে থাকে এবং ঐ আওয়াজসমূহের প্রতিধ্বনি-ই করতে থাকে, যাতে নারী তার আপন গৃহ থেকে বেরিয়ে যায়, সে পুরুষের সাথে অবাধে মেলামেশা করতে পারে এবং তাকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে এবং তার শিশু সন্তানদের যত্ন নেয়ার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে পারে। ঐ আওয়াজসমূহ মুসলিম নারীকে নিয়ে চিৎকার করে বলে: “তুমি যে অবস্থানে রয়েছো, তা ভেঙ্গে চুরমার করে দাও; তোমার চতুর্পাশে বিস্তৃত পর্দাসমূহ ছিঁড়ে ফেল; আমাদের দিকে বের হয়ে আস, যাতে তুমি আলো দেখতে পাও, যে আলো থেকে তুমি আড়ালে ছিলে যুগ যুগ ধরে; পুরুষের কর্তৃত্ব থেকে স্বাধীনতা অর্জন কর; মর্যাদার শর্তসমূহ থেকে মুক্তি লাভ কর; তোমার পর্দা খুলে ফেলে দিয়ে বের হয়ে আস; ঘর থেকে বের হয়ে আসার মাধ্যমে তোমার অস্তিত্ব ও কণ্ঠস্বরের প্রমাণ দাও; জীবনের প্রতিটি লোভনীয় বস্তু থেকে তোমার অংশটুকু গ্রহণ করার মাধ্যমে তুমি নিজেকে উপভোগ কর; তোমার স্বাধীন রুচি ব্যতীত অন্য কিছু যাতে তোমাকে শাসন না করে এবং বই পুস্তকের প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় তোমার যাদুকরী কোমলতা ছাপিয়ে, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা ও রূপ-সৌন্দর্য প্রদর্শনীর মাধ্যমে তুমি ব্যবসা চালিয়ে যাও!”

আরব তরুনী! তুমি কি দারিদ্রতা চাও, অথচ সৌন্দর্য একটি বড় গচ্ছিত সম্পদ

তুমি কি পবিত্রতা চাও, অথচ এ যুগ হচ্ছে উপভোগের যুগ!

আগে অবশ্য মান-মর্যাদা রক্ষার যুগ ছিল, এখন সেটা তো শেষ হয়ে গেছে,

এ যুগ তো নতুন অনেক কিছু করেছে, সুতরাং তুমি চমৎকার কিছু কর!  [১]

 এই নগ্ন হামলা এর বিরুদ্ধে দাবি করে জোটবদ্ধ পরিশ্রম বা চেষ্টা-সাধনা, যাতে মুসলিম নারী তার বিরুদ্ধে প্রণীত পরিকল্পনাকে পরিপূর্ণ মনোযোগের সাথে বুঝতে পারে; অতঃপর সে পর্যবেক্ষণ করবে এবং তার পথ সে সচেতন দৃষ্টিতে গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।

চতুর্থত:

আর তা তৃতীয়টির সাথে সংশ্লিষ্ট; উপরোল্লেখিত নগ্ন হামলার সাথে সাথে নারী বিষয় নিয়ে অনেক ফেতনা-ফাসাদ ও বিশৃঙ্খলার উদ্ভব সাধন করা হয়েছে। যেগুলো ইসলামী শরী‘আতের ব্যাপারে সচেতন মুসলিম নারীদের কারও কারও মধ্যেও দেখা যায়। বস্তুত এ ফেতনা ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে এমন কিছু লোক হাঁকডাক দিচ্ছে, যারা চায় নিজেকে প্রকাশ করতে; আরও চায় তার জন্য এমন একটি রায় বা মত হবে, যা তার সাথে সম্বন্ধযুক্ত হবে। অবশেষে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নারীর অনেক ব্যাপার নিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে দু’ভাগে মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর বিষয়টি শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না। ফলে আমরা দৈনিক সংবাদপত্রগুলো এবং ম্যাগাজিনসমূহে বিখ্যাত ও অখ্যাত ব্যক্তিবর্গের হাতে লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ অধ্যয়ন করি— কারণ, তারা দাবি করে যে, শরী‘আত কারও একান্ত বিষয় নয়, সবাই এতে মত প্রকাশ করার অধিকার রাখে। [২]

তারা চিকিৎসা, প্রকৌশল ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কোন কথা বলতে রাজি নয়; কারণ, তারা সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয়; কিন্তু তারা মূর্খতা ও অজ্ঞতা সত্ত্বেও আল্লাহর শরী‘আতের মধ্যে নাক গলানোটাকে গ্রহণ করেছে; আল্লাহ তুমি পবিত্র! এটা কত বড় অপবাদ!!

এটা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের উপর গুরু দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় যে, সত্য বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও গবেষণা চালিয়ে যাবেন, যতটুকু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাদেরকে বর্ণনা, দলিল-প্রমাণ ও জ্ঞানবুদ্ধির শক্তি থেকে দান করেছেন।

পঞ্চমত:

মুসলিম নারী পরবর্তী যুগসমূহে কাফির ও মুনাফিকদের মধ্য থেকে প্রত্যেক হাঁকডাককারী ও হাঁকডাককারিনীর বাহন ও ফটক হিসেবে গৃহীত হয়েছে, যাতে তারা এই দীনের অস্তিত্বকে ধ্বংস করে দিতে পারে; কারণ, তারা জানে যে, নারী যখন তার ঘর থেকে বের হয়ে যাবে, তার শিশুসন্তানদেরকে মুরব্বী ও কাজের মহিলার নিকট রেখে যাবে, পুরুষদের ময়দানসমূহে অনুপ্রবেশ করবে ও তাদের সাথে মেলামেশা করবে, তাদের কাপড় পরিধান করবে, তার চেহারা ও শরীরের কোন কোন অংশ উন্মোচিত করবে, শিল্পকারখানার ধোঁয়ায় নিজেকে কলুষিত করবে এবং খরিদ্দার ও পর্যবেক্ষকদের জন্য তার দেহের বাহ্যিক দিকটিকে সুসজ্জিত করবে, আর এভাবে সে পুরুষের সাথে তার কর্মক্ষত্রে প্রতিযোগিতা করবে এবং তার প্রকৃত ময়দানকে সে উপেক্ষা করবে; তখনই সে বিকৃতির প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করবে এবং সঠিক পথ থেকে দূরে সরে যাবে; আর এভাবেই তারা নারীকে নষ্ট-ভ্রষ্ট করে দিবে এবং শিশু ও তার লালন-পালন ও আদব-কায়দার প্রশিক্ষণের ব্যাপারে অবহেলা করবে; আর তার পুরুষের অধিকারের দিকে মনোযোগ দিবে না; আর তা থেকেই পুরো সমাজে বিশৃঙ্খলা পুনঃপ্রবর্তিত হবে।

আমি এখানে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই না, কিন্তা এটা বিজ্ঞজনদের উপর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণকে বাধ্যতামূলক করে দেয়; কেননা প্রয়োজনের সময় থেকে আলোচনা বিলম্বিত করা বৈধ নয়।

ষষ্ঠত:

দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন দিকে নারীর উদারতার বিষয়ে যা লক্ষ্য করা যায়, সেটি মোটেই সহজ ব্যাপার নয়, চাই তার আচার-আচরণগত দিক হউক, অথবা তার কাজকর্মের দিক হউক, অথবা পুরুষদের সাথে তার মেলামেশার ব্যাপারে বা তাদের সাথে নির্জনে সময় কাটানোর ব্যাপারে হউক, অথবা তাদের সাথে কোনো প্রকার বাধ্য-বাধকতা ছাড়া অবাধ কথা-বার্তা বলার ব্যাপারে হউক, অথবা তার সাজসজ্জা, পোষাক-পরিচ্ছদ, পর্দা ও শরী‘আতের সীমা থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শনের ব্যাপারে হউক, অনুরূপভাবে তার নিজ গৃহে তার কাজকর্ম ও ঘর থেকে বেশি বেশি বাইরে গমন করা এবং প্রাচ্য অথবা পাশ্চাত্য থেকে আগত বিভিন্ন ফ্যাশান ও শ্লোগানে প্রভাবিত হওয়ার ক্ষেত্র্রে নমনীয়তার ব্যাপারে হউক; আমি বলব: এই উদারতা ও শৈথিল্য থেকে যা দেখা যাচ্ছে, তা অত্যন্ত যত্নসহকারে দাবি করে মুসলিম নারী বিপর্যয়ে পতিত হওয়ার পূর্বেই তাকে উদ্দেশ্য করে  আবশ্যকীয় দায়িত্ব পালন করা, যেমনিভাবে অনেক দেশে বিপর্যয়ে পতিত হয়েছে তার বোন ও মুসলিম নারীসমাজ; সুতরাং সে এমন হয়ে গেছে যে, আপনি আকার-আকৃতি ও বেশভূশায় তার মাঝে ও কাফির নারীর মাঝে কোন পার্থক্য করতে পারবেন না। 

সপ্তমত:

আজকের মুসলিম নারীর সাথে কয়েকটি প্রবণতার দ্বন্দ্ব চলছে, এগুলোকে মোটামুটি নিম্নলিখিতভাবে উল্লেখ করা যায়:

–          প্রাচীন সামাজিক প্রবণতা: নির্দিষ্ট প্রকৃতির লোক এবং প্রত্যেক প্রাচীন বিশ্বাস আঁকড়ে ধরার প্রতি আহ্বানকারী ব্যক্তি; এগুলোর মধ্যে কোনটি শরী‘আত স্বীকৃত আর কোনটি শরী‘আত স্বীকৃত নয়, সে দিকে কোন প্রকার দৃষ্টি দেয়া ছাড়াই শুধুমাত্র প্রথার অনুসরণ ও অনুকরণের মাঝে সীমাবদ্ধ।

–          প্রত্যাখ্যানকারী প্রবণতা: আর তা এমন এক প্রবণতা, যা প্রতিটি প্রচীন বিষয়কেই প্রত্যাখ্যান করে; আর নারীকে অতীতের আড়াল ও শরী‘আতের শিক্ষাসমূহ থেকে বের হয়ে আসার জন্য আহ্বান করে এবং তাকে ছোট হউক, বা বড় হউক, আকৃতিগত হউক, বা বিষয়বস্তুগত হউক প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাফির নারীর অনুসরণের জন্য ডাকে।

–          মাঝামাঝি প্রবণতা: আর তা এমন এক প্রবণতা, যার প্রতি জাতির চিন্তাবিদগণ ও শরী‘আতের অনুসারী ব্যক্তিবর্গ আহ্বান করে এবং বলে: “হে নারী! তুমি বিবেক দিয়ে অনুধাবন কর। কেননা, তুমি মুসলিম নারী, তুমি জান যে, তোমার প্রতিপালকের নির্দেশ গ্রহণ করার মধ্যেই তোমার কল্যাণ; আর তিনিই সে সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানেন, যা তোমাকে উপকৃত করবে। আল্লাহ তা‘আলা তোমার জন্য অনেক নির্দেশনা অবতীর্ণ করেছেন, তুমি সেগুলো গ্রহণ কর, কারণ তাতে তোমার মুক্তি নিহিত রয়েছে। আর এমন প্রত্যেকটি বিষয়, যেদিকে তারা তোমাকে পরিচালিত করে, চাই তা প্রাচীন প্রথা হউক, অথবা আধুনিক ষড়যন্ত্র হউক, তোমার উচিত হল, তুমি এগুলোকে এই পরিমাপক দ্বারা ওজন করে নেবে, অতঃপর তুমি গ্রহণ করবে অথবা প্রত্যাখ্যান করবে।” [৩]

 

মুসলিম সমাজে অনেক নারী সে যে সমাজে বসবাস করে, সেই সমাজের প্রবাহের শক্তি বিবেচনায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছে এবং নারীগণ এসব আওয়াজের ধাক্কাধাক্কির ফলে অনেক দলে পৃথক হয়ে গিয়েছে। ফলে মুসলিম নারীর সামনে বহু পথের উদ্ভব হলো, প্রত্যেকেই নারীর স্বার্থ ও কল্যাণ চিন্তা করার কথা বলে, তার অধিকার দাবি করে এবং তাকে নিয়ে কান্নাকাটি করে ও কান্নার ভান করে। তাই অনেক নারীর নিকটই মিথ্যার সাথে সত্যের মিশ্রণ হয়ে গেছে এবং দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সিদ্ধান্তহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

একদিকে কারও উপর কাফির ও ফাসিকদেরর আওয়াজ ও চেঁচামেচি প্রভাব বিস্তার করেছে এবং এই গোষ্ঠীর কলমের লেখালেখিতে প্রতারিত হয়ে ভ্রষ্ট এই ধারায় চলে গেছে। ফলে সে শরী‘আতের সীমালঙ্ঘন করে পর্দা খুলে ফেলেছে, পুরুষদের সাথে মেলা-মেশায় গিয়েছে এবং শিল্পকলা, অভিনয়, গান ও নৃত্যের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

আরেকদিকে কেউ কেউ আছে এক পা এগুলে দু‘পা পেছায়; সে দ্বিধাগ্রস্ত— একবার সে বস্তুবাদী চিন্তা করে, আরেকবার সে তার স্বভাবধর্ম ও স্রষ্টার শিক্ষাসমূহের দিকে ফিরে আসে।

অন্যদিকে আছেন রক্ষণশীল বুদ্ধিমান নারী, যিনি তার প্রতিপালকের শিক্ষা ও দর্শনসমূহ সংরক্ষণ করেন এবং ঈমান ও তুষ্টতা সহকারে সেই শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করেন। তিনি এই দীনকে শক্তভাবে বহন ও আঁকড়ে ধরেছেন এবং বিজাতীয় বিনষ্ট বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর তিনি তার প্রতিপালকের দিকে অন্যদেরকে মাথা উঁচু করে দৃঢ়তার সাথে আহ্বান করেন এবং তার ব্যক্তিত্ব, পর্দা ও পবিত্রতা রক্ষা করে চলেন। তার স্বামীর অধিকার বাস্তবায়নকারিনী হিসেবে এবং তার শিশুসন্তানদের লালনপালনকারিনী হিসেবে এই জীবনে তিনি তার প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেন।

এই প্রতিটি অবস্থাই আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে অন্ধকার দূর করার জন্য, যা মুসলিম নারীর বিষয়ে এই যুগ বা সময়কে প্রভাবিত করেছে; যাতে করে প্রত্যেক সত্যানুসন্ধানী মুক্তিকামী পুরুষ অথবা নারীর জন্য পথ স্পষ্ট হয় এবং তার মাইলফলকগুলো পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হয়ে উঠে।

অষ্টমত:

মুসলিম সমাজ তথা মুসলিম জাতির পরিপূর্ণতার জন্য এমন রক্ষণশীল আদর্শ নারীর প্রয়োজন, যে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানে এবং তার উপর অর্পিত আমানতকে অনুধাবন করে; যে নিজের পথ দেখতে পায় এবং তার নিজের অধিকার ও অন্যের অধিকার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে।

–          আমাদের প্রয়োজন এমন মুসলিম মুমিন নারীর, যার রয়েছে তার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অগাধ বিশ্বাস; সুতরাং তিনি তাঁকে প্রতিপালক, স্রষ্টা ও মাবুদ বা উপাস্য বলে বিশ্বাস করেন; আরও বিশ্বাস করেন তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমষ্টি ও রাসূলগণের প্রতি; আর পরকালের প্রতি এবং তাকদীরের ভাল ও মন্দের প্রতি। অতঃপর  এই ঈমান অনুযায়ী তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন তার এই জীবনের চিন্তাভাবনাগুলোকে; জগত, জীবন ও মানুষ সম্পর্কে।

–          আমাদের প্রয়োজন এমন সচেতন নারীর, যিনি তার প্রতিপালকের শরী‘আত তথা বিধিবিধানকে সংরক্ষণ করেন, অনুধাবন করেন তাঁর আদেশসমূহকে; অতঃপর সে অনুযায়ী কাজ করেন। আর অনুধাবন করেন তাঁর নিষেধসমূহকে, অতঃপর সেগুলো থেকে দূরে থাকেন। তার নিজের অধিকার এবং তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে সম্যক জানেন, অতঃপর এর মাধ্যমে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন।

–          আর আমাদের প্রয়োজন এমন সচেতন নারীর, যিনি তার প্রকৃত দায়িত্বের বিষয়গুলো এবং তার গৃহরাজ্যের বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেন; অতঃপর এই ছোট্ট রাজ্যের অধিকার সংরক্ষণ করেন, যে রাজ্য পুরুষদের প্রস্তুত করে এবং শিশু-কিশোরদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসায় ও তাঁর দীনের সেবায় গঠন করে তোলে।

–          আর আমাদের প্রয়োজন এমন নারীর, যার বাহ্যিক দিক তার অভ্যন্তর সম্পর্কে বলে দেয়। কারণ, তিনি প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের দ্বারা প্রভাবিত নন, প্রভাবিত নন কোনো প্রবণতা বা ফ্যাশন দ্বারা; যিনি প্রত্যেক ধ্বনি বা চীৎকারের অনুসরণ করেন না। তিনি তার বাহ্যিক ক্ষেত্রে মডেল বা আদর্শ, যেমনিভাবে অভ্যন্তরীণ দিকেও আদর্শ। তার শরীর সংরক্ষিত; আর তার হৃদয় ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ এবং তার পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতার দিকটি সুস্পষ্ট; আর তার পোষাক-পরিচ্ছদ ও অন্তরের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় অবস্থাই পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র। তিনি ঈমান এনেছেন, শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং আমল করেছেন।

–          আর আমাদের প্রয়োজন এমন আদর্শ আল্লাহ্‌র পথে আহ্বানকারী নারীর, যিনি তার কথার পূর্বে কাজের দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার দিকে আহ্বান করেন; তিনি মানুষের জন্য ভাল ও কল্যাণকে পছন্দ করেন, যেমনিভাবে তা তিনি নিজের জন্য পছন্দ করেন; তিনি একে উপদেশ দেন, ওকে নির্দেশনা প্রদান করেন আর আরেকজনের অন্যায় কাজের সমালোচনা করেন; তিনি লালন-পালন করেন, গঠন করেন, ভুলত্রুটি সংশোধন করেন, সমস্যা সমাধান করেন, তার সম্পদ দ্বারা দান-সাদকা করেন, তার সাধ্যানুসারে কর্মতৎপরতা পরিচালনা করেন, দাওয়াতী কাজ নিয়েই তিনি জীবনযাপন করেন, কি দাঁড়ানো অবস্থায়, কি তার বাসায় ঘুমন্ত অবস্থায়, কি তার কাজের মধ্যে— এক কথায় যে কোন স্থানে, যে অবস্থায়ই থাকেন।

–          আর আমাদের প্রয়োজন এমন নারীর, যিনি তার শত্রুদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সচেতন থাকেন, অতঃপর তাদের ফাঁদে পা দিয়ে তাদের আনুগত হওয়া থেকে, তাদের আহ্বানসমূহে সাড়া দেওয়া থেকে এবং তাদের জীবন-পদ্ধতি অনুসরণ থেকে সতর্ক থাকেন। তিনি সদা-সতর্কতা অবলম্বন করেন এবং ঐসব ভ্রান্ত প্রচার-প্রপাগান্ডা থেকে সতর্ক করেন, যেগুলো নারীকে তাদের প্রপাগান্ডার বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছে— যার বিবরণ পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে।

এই প্রয়োজনীয়তাই বিজ্ঞজন ও বিশেষ ব্যক্তিবর্গকে তাদের বক্তব্য-বিবৃতি ও লেখনীর মাধ্যমে তাদের চেষ্টা-সাধনা শুরু করতে বাধ্য করে। যাতে তারা মুসলিম নারী ও তার অভিভাবকের দৃষ্টি খুলে দেন ‌এবং স্মরণ করিয়ে দেন তার কাঁধের উপর অর্পিত আমানতের কথা।

নবমত:

পুরুষের উপর প্রভাব সৃষ্টির ক্ষেত্রে নারীর বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। তিনি যদি মা হন, তবে তার জন্য নির্দেশ দেয়া ও নিষেধ করার বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আর তার (পুরুষের) উপর আবশ্যক হল তার আনুগত্য করা এবং সৎকাজের ব্যাপারে করা তার আদেশসমূহের বাস্তবায়ন করা।

আর সে যদি স্ত্রী হয়, তবে তার অধিকার আছে স্বামীকে আল্লাহ্‌র আনুগত্যের ব্যাপার উৎসাহিত ও প্রলুব্ধ করার এবং অন্যায় ও অবাধ্যতার ব্যাপারে সতর্ক করার। আর স্বামীর ক্ষেত্রে স্ত্রীর ভূমিকাকে গণ্ডমূর্খ ছাড়া অন্য কেউ অস্বীকার করে না। আর অনুরূপভাবে তার প্রভাব বিদ্যমান যদি সে বোন, কন্যা বা নিকটাত্মীয়ও হয়।

আর এই জন্য নারীর উপর আবশ্যক হল, সে এই মহান ভূমিকা অনুধাবন করবে, যাতে তার দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করতে পারে।

 

দশমত:

একজন নারী একজন পুরুষের চেয়ে নারী, নারীসমাজ ও নারীদের মাঝে প্রচলিত প্রবণতা সম্পর্কে বেশি ওয়াকিফহাল। তেমনিভাবে সে তাদের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়গুলো সম্পর্কে বেশি অবগত। সে-ই পুরুষের চেয়ে ক্ষমতাবান এই পথে চলতে।

পটভূমি হিসেবে উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রত্যেকটিই নারী প্রসঙ্গে এবং নারীর দায়িত্ব, অধিকার, জবাবদিহিতা ও এই সামগ্রিক সীমারেখা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে; যার মাধ্যমে একজন নারী তার ভূমিকা সুন্দরভাবে পালন এবং তার দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে আদায় করতে পারে।

নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং এগুলোর প্রকৃতি ও আদায়ের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে এ কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের সঠিক দীনের সর্বজনস্বীকৃত ও নিশ্চিত বিধান হচ্ছে: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পুরুষ ও নারীর মধ্যে দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ إِنَّا عَرَضۡنَا ٱلۡأَمَانَةَ عَلَى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَٱلۡجِبَالِ فَأَبَيۡنَ أَن يَحۡمِلۡنَهَا وأَشۡفَقۡنَ مِنۡهَا وَحَمَلَهَا ٱلۡإِنسَٰنُۖ إِنَّهُۥ كَانَ ظَلُومٗا جَهُولٗا ٧٢ ﴾ [ سورة الأحزاب: 72 ]               

“আমি তো আসমান, জমিন ও পর্বতমালার প্রতি এই আমানত পেশ করেছিলাম, তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তাতে শঙ্কিত হল, কিন্তু মানুষ তা বহন করল। সে তো অতিশয় যালিম, অতিশয় অজ্ঞ।” – ( সূরা আল-আহযাব: ৭২ )

ইবনু আব্বাস, মুজাহিদ, সা‘ঈদ ইবন জুবায়ের রা. প্রমুখ বলেন: আমানত হল ফরযসমূহ। 

আর কাতাদা র. বলেন: আমানত হল দীন, ফরযসমূহ এবং শরী‘আতের সীমারেখা বা দণ্ডবিধিসমূহ।

আর উবাই ইবন কা‘ব রা. বলেন: আমানতের মধ্যে অন্যতম হল নারীকে তার লজ্জাস্থানের ব্যাপারে আমানত রাখা হয়েছে।

আর ইবনু কাছীর র. বলেন: এসব কথার মধ্যে কেনো বিরোধ নেই। বরং এগুলো একই কথা প্রমাণ করছে যে, সেই আমানতটি হচ্ছে তাকলীফ তথা (শরী‘আতের বিধিবিধানের) দায়িত্ব-প্রদান। [7]

আর এই কথাও সর্বস্বীকৃত যে, মুসলিম নারী তার দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করলে সেও পুরুষের মতই প্রতিদান পাবে। আল্লাহ তা‘আলা কর্মসমূহের প্রতিদানের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:

فَٱسۡتَجَابَ لَهُمۡ رَبُّهُمۡ أَنِّي لَآ أُضِيعُ عَمَلَ عَٰمِلٖ مِّنكُم مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰۖ بَعۡضُكُم مِّنۢ بَعۡضٖۖ فَٱلَّذِينَ هَاجَرُواْ وَأُخۡرِجُواْ مِن دِيَٰرِهِمۡ وَأُوذُواْ فِي سَبِيلِي وَقَٰتَلُواْ وَقُتِلُواْ لَأُكَفِّرَنَّ عَنۡهُمۡ سَيِّ‍َٔاتِهِمۡ وَلَأُدۡخِلَنَّهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ ثَوَابٗا مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِۚ وَٱللَّهُ عِندَهُۥ حُسۡنُ ٱلثَّوَابِ ١٩٥ ﴾ [ سورة آل عمران: 195 ]                             

“অতঃপর তাদের প্রতিপালক তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বলেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে কর্মনিষ্ঠ কোন নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না; তোমরা একে অপরের অংশ। সুতরাং যারা হিজরত করেছে, নিজ গৃহ থেকে উৎখাত হয়েছে, আমার পথে নির্যাতিত হয়েছে এবং যুদ্ধ করেছে ও নিহত হয়েছে, আমি তাদের পাপ কাজগুলো অবশ্যই দূরীভূত করব এবং অবশ্যই তাদেরকে দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার; আর উত্তম পুরস্কার আল্লাহরই নিকট। – ( সূরা আলে ইমরান: ১৯৫ )

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ وَمَن يَعۡمَلۡ مِنَ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَأُوْلَٰٓئِكَ يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ وَلَا يُظۡلَمُونَ نَقِيرٗا ١٢٤﴾ [سورة النساء: 124 ]

 “মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎ কাজ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও যুলুম করা হবে না।” – ( সূরা আন-নিসা: ১২৪ )

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٩٧ ﴾ [ سورة النحل: 97]                                                                                                              

“মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, তাকে আমি নিশ্চয়ই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব। (সূরা আন-নাহল: ৯৭)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ مَنۡ عَمِلَ سَيِّئَةٗ فَلَا يُجۡزَىٰٓ إِلَّا مِثۡلَهَاۖ وَمَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَأُوْلَٰٓئِكَ يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ يُرۡزَقُونَ فِيهَا بِغَيۡرِ حِسَابٖ ٤٠﴾ [ سورة غافر: 40 ]                                                                                         

“কেউ মন্দ কর্ম করলে সে কেবল তার কর্মের অনুরূপ শাস্তি পাবে এবং পুরুষ কিংবা নারীর মধ্যে যারা মুমিন হয়ে সৎকাজ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, সেথায় তাদেরকে দেয়া হবে অপরিমিত জীবনোপকরণ। – ( সূরা গাফের: ৪০ )

সুতরাং দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং প্রতিদানের ক্ষেত্রে তারা উভয়ে সমান।

আর এই বাস্তবতাটিও আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীর মধ্যেও বিদ্যমান; তিনি বলেন:

إِنَّ ٱلۡمُسۡلِمِينَ وَٱلۡمُسۡلِمَٰتِ وَٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ وَٱلۡقَٰنِتِينَ وَٱلۡقَٰنِتَٰتِ وَٱلصَّٰدِقِينَ وَٱلصَّٰدِقَٰتِ وَٱلصَّٰبِرِينَ وَٱلصَّٰبِرَٰتِ وَٱلۡخَٰشِعِينَ وَٱلۡخَٰشِعَٰتِ وَٱلۡمُتَصَدِّقِينَ وَٱلۡمُتَصَدِّقَٰتِ وَٱلصَّٰٓئِمِينَ وَٱلصَّٰٓئِمَٰتِ وَٱلۡحَٰفِظِينَ فُرُوجَهُمۡ وَٱلۡحَٰفِظَٰتِ وَٱلذَّٰكِرِينَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا وَٱلذَّٰكِرَٰتِ أَعَدَّ ٱللَّهُ لَهُم مَّغۡفِرَةٗ وَأَجۡرًا عَظِيمٗا ٣٥﴾ [ سورة الأحزاب: 35 ]   

“অবশ্যই আত্মসমর্পনকারী পুরুষ ও আত্মসমর্পনকারী নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, সাওম পালনকারী পুরুষ ও সাওম পালনকারী নারী, যৌন অঙ্গ হিফাজতকারী পুরুষ ও যৌন অঙ্গ হিফাজতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী— এদের জন্য আল্লাহ ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান রেখেছেন।” – (সূরা আল-আহযাব: ৩৫)

দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং প্রতিদানের ক্ষেত্রে সে পুরুষের মতই— এটি নিশ্চিত ও সর্বস্বীকৃত বাস্তবতা।

এর উপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি যে, মুসলিম নারীর উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তাতে পুরুষ ব্যক্তিও অংশীদার। আর তা হচ্ছে: আমানত, দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা।

নারীর উপর আবশ্যক হল এই দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করা। সে তা উপলব্ধি করবে পূর্ণ অনুভূতিসহকারে, সে তা জেনে ও বুঝে উপলব্ধি করবে, সে তা প্রতিষ্ঠিত করে ও কাজে পরিণত করার মাধ্যমে স্মরণ রাখবে এবং সে অন্য নারীদের মাঝে তা প্রচার ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার হেফাজত করবে। এ ব্যাপারটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংক্ষেপে বিভিন্ন হাদিসের মধ্যে উল্লেখ করেছেন; তন্মধ্যে আমরা নিম্নে কিছু উল্লেখ করছি:

– রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« لا تزول قدما عبد يوم القيامة حتى يسئل عن عمره فيم أفناه وعن علمه فيم فعل وعن ماله من أين اكتسبه وفيم أنفقه وعن جسمه فيم أبلا » ( أخرجه الترمذي وقال هذا حديث حسن صحيح )

“কিয়ামতের দিন বান্দার দু‘পা একটুও নড়বে না যতক্ষণ না জিজ্ঞেস করা হবে তার জীবনকাল সম্পর্কে: সে তা কোন পথে অতিবাহিত করেছে; জিজ্ঞেস করা হবে তার জ্ঞান সম্পর্কে, সে জ্ঞান অনুযায়ী কী কাজ করেছে; জিজ্ঞেস করা হবে তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, সে তা কোথা থেকে উপার্জন করেছে এবং কোন খাতে ব্যয় করেছে এবং জিজ্ঞেস করা হবে তার শরীর সম্পর্কে, কোথায় সে তা ক্ষয় করেছে।” – (ইমাম তিরমিযী হাদিসটি বর্ণনা করেন এবং বলেন: এই হাদিসটি হাসান সহীহ) [5]

– রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«إذا صلت المرأة خمسها وصامت شهرها وحفظت فرجها وأطاعت زوجها قيل لها: ادخلي الجنة من أي أبواب الجنة شئت» (أخرجه أحمد).

“যখন নারী তার পাঁচ ওয়াক্তের সালাত আদায় করবে; তার (রমযান) মাসের সাওম পালন করবে; তার লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে এবং তার স্বামীর আনুগত্য করবে, তখন তাকে বলা হবে: তুমি জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা কর, সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবশে কর।” (ইমাম আহমদ হাদিসখানা বর্ণনা করেন) [6]

– রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

«كلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته الإمام راع ومسؤول عن رعيته والرجل راع في أهله وهو مسؤول عن رعيته والمرأة راعية في بيت زوجها ومسؤولة عن رعيتها والخادم راع في مال سيده ومسؤول عن رعيته . قال وحسبت أن قد قال:  والرجل راع في مال أبيه ومسؤول عن رعيته وكلكم راع ومسؤول عن رعيته» (أخرجه البخاري … عن عبد الله بن عمر ).

“তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল (রক্ষণাবেক্ষণকারী), আর তোমাদের প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ইমাম বা শাসক হলেন দায়িত্বশীল, আর তাকে তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর পুরুষ তার পরিবার ও সংসারের জন্য দায়িত্বশীল, আর তাকে তার পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণ ও দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর নারী তার স্বামীর ঘর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, আর তাকে তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর খাদেম (সেবক) তার মনিবের ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, আর তাকে তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি ধারণা করি যে, তিনি (রাসূল) আরও বলেছেন: পুরুষ ব্যক্তি তার পিতার ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, আর তাকে তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর তোমাদের সকলেই দায়িত্বশীল, আর তোমাদের সকলকেই তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” – (ইমাম বুখারী র. হাদিসটি আবদুল্লাহ ইবন ওমর রা. থেকে বর্ণনা করেন )  [7]

এছাড়াও এ-ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর আরও অনেক বক্তব্য রয়েছে।

এসব দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে আগামী পর্বে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

মুসলিম নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিমণ্ডল

মুসলিম নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিমণ্ডল কয়েকটি ক্ষেত্র বা পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা হল:

প্রথম ক্ষেত্র: তার নিজের ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্য

তার নিজের ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়টি নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে:

প্রথমত: তার প্রতিপালকের প্রতি তার ঈমান তথা বিশ্বাস প্রসঙ্গে: আর এটা হল সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং আবশ্যকীয় কর্তব্যকাজ। কেননা পূর্বে উল্লেখিত আয়াতসমূহের [8] মধ্যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা উত্তম প্রতিদান প্রাপ্তির সাথে তাঁর প্রতি ঈমানের শর্তারোপ করেছেন; তিনি  বলেন:

﴿ وَمَن يَعۡمَلۡ مِنَ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَأُوْلَٰٓئِكَ يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ وَلَا يُظۡلَمُونَ نَقِيرٗا ١٢٤﴾ [سورة النساء: 124]                                                                                                                                    

“মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎ কাজ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও যুলুম করা হবে না।”  ( সূরা আন-নিসা: ১২৪ )

তাছাড়া এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ আরও অনেক আয়াত রয়েছে।

এই ঈমানের অনুসরণকারীকে ঈমানের ছয়টি রুকন মেনে চলতে হবে—

(ক) আল্লাহর প্রতি ঈমান: এর মানে আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদের তিনটি অংশের প্রতিই বিশ্বাস স্থাপন করা। যথা:

 – আল্লাহ তা‘আলার কাজের ক্ষেত্রে তাঁর একত্ববাদ। একজন মুসলিম নারী ঈমান আনবে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা হলেন সকল কিছুর মালিক, পরিচালনাকারী, সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা। তিনি বলেন:

﴿ ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ ٣ مَٰلِكِ يَوۡمِ ٱلدِّينِ ٤ ﴾ [ سورة الفاتحة: 2 – 4 ]

“সকল প্রশংসা সৃষ্টিজগতের রব আল্লাহরই; যিনি দয়াময়, পরম দয়ালু; কর্মফল দিবসের মালিক।” (সূরা আল-ফাতিহা: ২ – ৪)

তাছাড়া আরও অনেক আয়াত রয়েছে। আর এটাই হল রব হিসেবে আল্লাহর একত্ববাদ (তাওহীদ আর-রুবূবিয়াহ)

বান্দাদের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে তাঁর একত্ববাদ। একজন মুসলিম নারী ঈমান আনবে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা হলেন একচ্ছত্র মা‘বুদ তথা ইবাদতের উপযুক্ত এবং সে সকল প্রকার ইবাদত তাঁকে উদ্দেশ্য করেই করবে। তাই সে সালাত আদায় করবে আল্লাহর জন্য, পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতা অর্জন করবে আল্লাহর জন্য; সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ডাকবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে না; আর সে আল্লাহর কারণেই পিতা-মাতার আনুগত্য করবে; পর্দা করবে আল্লাহ্‌র আনুগত্য করে; আর আল্লাহর নিকট যা আছে, তা পাওয়ার আশায়ই স্বামীর আনুগত্য করবে … এভাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴾ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦  ﴿ سورة الذاريات: 56 

“আমি সৃষ্টি করেছি জিন এবং মানুষকে এইজন্য যে, তারা শুধু আমারই ইবাদত করবে।”  (সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬)

আর এটাই হল ইলাহ হিসেবে তাঁর একত্ববাদ (তাওহীদ আল-উলূহিয়াহ), অথবা ইবাদতের ক্ষেত্রে তাঁর একত্ববাদ (তাওহীদ আল-‘ইবাদাহ্)

তাঁর নামসমূহ ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে তাঁর একত্ববাদ। মুসলিম নারী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার জন্য সাব্যস্ত করবে সকল সুন্দর নামসমূহ এবং মহৎ গুণাবলী। আর তা করতে হবে যেকোনো প্রকার অপব্যাখ্যা, তার ধরন-প্রকৃতি খোঁজা, সৃষ্টির গুণাবলীর সাথে সেগুলোর সাদৃশ্যস্থাপন অথবা এগুলোকে অর্থশূন্য করা ছাড়াই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [ سورة الشورى: 11 ]

“কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।”  (সূরা আশ-শুরা: ১১)

মুসলিম নারী এসব সুন্দর নামসমূহ এবং মহৎ গুণাবলীর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে। সে স্বীকৃতি দেবে যে, আল্লাহ হলেন দয়াময়, পরম দয়ালু; তাই সে তাঁর নিকট রহমত কামনা করবে। তিনি হলেন রিযিকদাতা, পরম শক্তির অধিকারী; তাই সে তাঁর নিকট রিযিকের জন্য আবেদন করবে। তিনি হলেন রোগ নিরাময়কারী ও যথেষ্ট, সুতরাং সে তাঁর নিকট রোগ থেকে মুক্তির জন্য আবেদন করবে। আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল, পরম ক্ষমাপরায়ণ; তাই সে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। তিনি হলেন মার্জনাকারী ও দানশীল; তাই সে তাঁর নিকটই মাফ চাইবে … ইত্যাদি।

(খ) ফেরেশতার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা: সুতরাং মুসলিম নারী বিশ্বাস স্থাপন করবে যে, আল্লাহ তা‘আলার অনেক ফেরেশতা রয়েছে, যারা রাতদিন অক্লান্তভাবে তাঁর দাসত্ব করে; আর তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক আছে যারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে; আর তাদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, যার নাম ও গুরুত্ব আমাদের নিকট স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে; যেমন: জিবরাঈল আ. যিনি ওহীর দায়িত্বপ্রাপ্ত; ইস্রাফিল আ. যিনি সিঙায় ফুঁ দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত; আর সেখানে পাহাড়-পর্বত, বাতাস এবং বান্দাদের হিসাব-নিকাশ ও তাদের কর্মতৎপরতা লিপিবদ্ধ করার জন্য আরও অনেক ফেরেশতা রয়েছে; এমনকি প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে দু’জন করে ফেরেশতা রয়েছে, যারা ঐ ব্যক্তি থেকে প্রকাশিত প্রতিটি কথা ও কাজ লিপিবদ্ধ করে; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ إِذۡ يَتَلَقَّى ٱلۡمُتَلَقِّيَانِ عَنِ ٱلۡيَمِينِ وَعَنِ ٱلشِّمَالِ قَعِيدٞ ١٧ مَّا يَلۡفِظُ مِن قَوۡلٍ إِلَّا لَدَيۡهِ رَقِيبٌ عَتِيدٞ ١٨﴾ [ سُورَةُ قٓ: 17-18]

“স্মরণ রাখ, দুই সাক্ষাৎ গ্রহণকারী ফেরেশতা তার ডানে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে; মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে।”  ( সূরা ক্বাফ: ১৭ – ১৮ )

(গ) রাসূলদের উপর নাযিলকৃত আল্লাহ তা‘আলার কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা: আল-কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে তার উল্লেখ রয়েছে; তন্মধ্যে আমাদের জন্য চারটি কিতাবের নাম স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে: তাওরাত, যা মূসা ‘আলাইহিস সালামের উপর অবতীর্ণ হয়েছে; ইঞ্জিল, যা ঈসা ‘আলাইহিস সালামের উপর অবতীর্ণ হয়েছে; যাবুর, যা দাউদ ‘আলাইহিস সালামকে দেয়া হয়েছে এবং আল-কুরআন, যা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ হয়েছে। আর আল-কুরআনুল কারীম হল সর্বশেষ কিতাব, যার মাধ্যমে কিতাব অবতীর্ণের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং যা বাকি সকল কিতাবের বিধানকে রহিত করে দিয়েছে; আর তার (কুরআনের) মধ্যে যা এসেছে, তা ব্যতীত অন্য কোন কিতাবের বিধান অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা বৈধ নয়।

(ঘ) মানুষের জন্য আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রেরিত রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা: তারা মানুষকে সুসংবাদ দেয়, সতর্ক করে এবং তাদের প্রতিপালকের ইবাদত করার আবশ্যকতার কথা তাদের নিকট প্রচার করে। আর ঐসব রাসূলদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, আমাদের জন্য যাদের নাম আলোচিত হয়েছে; আর তাদের মধ্যে এমন অনেক রয়েছেন, যাদের নাম আলোচিত হয় নি; সুতরাং মুসলিম নারী তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে, যাদের নাম বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সামগ্রিকভাবে তাদের প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করবে, যাদের নাম উল্লেখ করা হয় নি। আর তাদের মধ্যে প্রথম হলেন নূহ ‘আলাইহিস সালাম এবং সর্বশেষ হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যার মাধ্যমে নবুওয়ত ও রিসালাতের ধারার সমাপ্তি ঘটে এবং তিনি তাদের মধ্যে সর্বশেষ, তাঁর পরে আর কোন নবী আসবে না; তাঁকে সকল মানুষ ও জিনের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে; আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে শরী‘আত প্রবর্তন করেছেন, সে অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত না হলে তা বৈধ হবে না।

(ঙ) আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা: মানুষের এই জীবনের পরিসমাপ্তির সূচনা হয় কতগুলো ভূমিকা বা উপাদানের মাধ্যমে; আর তা হল তার মৃত্যু ও পরবর্তী জীবনে স্থানান্তরের মাধ্যমে; আর কবরের ফিতনা (পরীক্ষা), তার নিয়ামত ও শাস্তির মাধ্যমে; আর কিয়ামতের ছোট ও বড় শর্ত বা নিদর্শনের মাধ্যমে; অতঃপর পুনরুত্থান বা পুনরায় জীবিত করা, হাশর (সমাবেশ), হিসাব, প্রতিদান ও সিরাত (পুলসিরাত) এবং সব শেষে জান্নাত ও জাহান্নামে মাধ্যমে।

এই হল মুসলিম নারীর আকিদা বা বিশ্বাস, যার উপর ভিত্তি করে তার নিজের জীবনকে গড়ে তোলা এবং সে ব্যাপারে জবাবদিহির অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকা আবশ্যক

অতঃপর এই ঈমান বা বিশ্বাস আরও কতগুলো আবশ্যকীয় বিষয়কে অনুসরণ করে; যেমন: আল্লাহ তা‘আলার ভালবাসা, তাঁর প্রতি একনিষ্ঠতা; তাঁর নিকট প্রত্যাশা করা, তাঁকে ভয় করা; আর সে এগুলো জেনে রাখবে এবং তার উপর ধৈর্যধারণ করবে; আর সে এই আকিদা-বিশ্বাস পরিপন্থী কর্মকাণ্ডসমূহ এবং ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ থেকে সতর্ক থাকবে; আর এগুলোর শীর্ষে রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করা, কুফরী করা, নিফাকী করা এবং আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর দীন ও তিনি যে শরী‘আত প্রবর্তন করেছেন, তার সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা; অথবা যে কোন প্রকারের ইবাদত আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারও উদ্দেশ্যে করা; অথবা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের বিধান আল্লাহ তা‘আলার বিধানের সমান বা তার চেয়ে উত্তম বলে বিশ্বাস করা এবং এই বিশ্বাস করা যে, মানবতা এমনিতেই সৌভাগ্যবান হবে, যেমনিভাবে সে আল্লাহ তা‘আলার বিধানের মধ্যে সৌভাগ্যবান হয়; অথবা এই বিশ্বাস করা যে, যুগ-যামানা আল্লাহ তা‘আলার বিধান নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এবং তা পবিত্র উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ হিসেবে অবিশিষ্ট রয়েছে; এই জীবনে তার উপর আমলের প্রয়োজন নেই; অথবা জাদুকর ও জ্যোতিষীর কর্মকাণ্ডে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং ঈমান বিনষ্টকারী জাদুকর, ভেল্কিবাজ ও ভণ্ড-প্রতারকদের অনুসরণ করা।

সুতরাং মুমিন নারীর আবশ্যকীয় কর্তব্য হল, সে এই ধরনের ভয়াবহ শিরকে নিপতিত হওয়া থেকে সতর্ক থাকবে; অতএব সে ঈমান গ্রহণের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং আরও দায়িত্বপ্রাপ্ত ঈমান বিনষ্ট করে, এমন বিষয় থেকে সতর্ক থাকার ব্যাপারে।

দ্বিতীয়ত: তার নিজের ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ থেকে অন্যতম হল জ্ঞান অর্জন:

আর এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল শরী‘আতের জ্ঞান, যার দ্বারা তার দীন প্রতিষ্ঠিত হবে। কারণ, এই দীন জ্ঞান ব্যতীত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না; আর তা হল আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে জ্ঞান এবং তাঁর দীন ও শরী‘আত সম্পর্কিত জ্ঞান। আর এই জ্ঞান দুইভাগে বিভক্ত:

(ক) ফরযে আইন: এই প্রকারের জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ ও নারীর উপর ফরযে আইন তথা আবশ্যকীয় কর্তব্য; আর তা এমন জ্ঞান, যার দ্বারা দীনের জরুরি বিষয়গুলো জানা ও বুঝা যায়; অথবা অন্যভাবে বলা যায়: এটা এমন জ্ঞান, যা ব্যতীত দীন প্রতিষ্ঠিত হয় না; যেমন: সামগ্রিকভাবে আল্লাহর প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন সম্পর্কিত বিধানসমূহ, পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিধানসমূহ, সালাত (নামায) সম্পর্কিত বিধানসমূহ; সুতরাং মুসলিম নারী শিক্ষা লাভ করবে সে কিভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে? কিভাবে সে সালাত (নামায) আদায় করবে? কিভাবে সাওম (রোযা) পালন করবে? কিভাবে সে তার স্বামীর হক আদায় করবে? আর কিভাবে সে তার সন্তানদেরকে লালনপালন করবে? এবং এমন প্রত্যেক জ্ঞান, যা তার উপর বাধ্যতামূলক।

(খ) আরেক প্রকার জ্ঞান অর্জন করা ফরযে কিফায়া: আর তা এমন জ্ঞান, যা কিছুসংখ্যক ব্যক্তি অর্জন করলে বাকিরা অপরাধমুক্ত হয়ে যায়; আর মুসলিম নারীর জন্য এই প্রকার জ্ঞান অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং সেই জ্ঞান অর্জন করে পরিতৃপ্তি লাভ করাটা উত্তম বলে বিবেচিত হবে। কুরআন ও সুন্নাহ এই জ্ঞান অর্জনের প্রশংসায়, তার ফযিলত বা মর্যাদা বর্ণনায় এবং এ প্রকার জ্ঞান ও জ্ঞানীদের গুরুত্ব বর্ণনায় অনেক বক্তব্য নিয়ে এসেছে; আরও বক্তব্য নিয়ে এসেছে অন্যদের উপর তাদের উচ্চমর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনায়; কারণ, তারা হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তরসুরী।

ইবনু আবদিল বার আল-আন্দালুসী র. বলেন:

“আলেমগণ এই ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, ইলম বা জ্ঞানের মধ্যে এক প্রকার এমন রয়েছে, যা প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে ফরযে আইন; আরেক প্রকার হল ফরযে কিফায়া … অবশেষে তিনি বলেন: এর থেকে যতটুকু সকলের উপর আবশ্যক তা হচ্ছে যে সকল বস্তু তার উপর ফরয করা হয়েছে, যা না জেনে থাকার সুযোগ নেই সে ফরযটুকু জানা।”   

মুসলিম নারীকে ইসলাম যে সম্মান দান করেছে, তন্মধ্যে অন্যতম হল: ইসলাম নারীর জন্য শিক্ষা গ্রহণ করা ও শিক্ষা প্রদান করার মর্যাদা পুরুষের মর্যাদার মত করে সমানভাবে নির্ধারণ করেছে এবং নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের জন্য কোন বিশেষ মর্যাদা নির্দিষ্ট করে নি। শিক্ষা এবং শিক্ষা গ্রহণের ফযিলত বা মর্যাদা বর্ণনায় বর্ণিত সকল আয়াত ও হাদিস পুরুষ ও নারীকে সমানভাবে মর্যাদাবান বলে অবহিত করে; যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ يَرۡفَعِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡ وَٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ دَرَجَٰتٖۚ﴾ [ سُورَةُ المجادلة: 11 ]

“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন।”  (সূরা আল-মুজাদালা: ১১)

তিনি আরও বলেন:

﴿ قُلۡ هَلۡ يَسۡتَوِي ٱلَّذِينَ يَعۡلَمُونَ وَٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَۗ ﴾ [سُورَةُ الزُّمَرِ: 9]

“বল, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান?” ( সূরা আয-যুমার: ৯ )

 তিনি আরও বলেন:

﴿ وَقُل رَّبِّ زِدۡنِي عِلۡمٗا ١١٤ ﴾ [ سُورَةُ طه: 114 ]

“বল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ কর।”  ( সূরা ত্বা-হা: ১১৪ )

অনুরূপ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:

« مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَطْلُبُ فِيهِ عِلْمًا سَلَكَ اللَّهُ بِهِ طَرِيقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِى السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِى الأَرْضِ وَالْحِيتَانُ فِى جَوْفِ الْمَاءِ وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلاَ دِرْهَمًا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ ». ( أخرجه أبو داود و الترمذي و ابن ماجه ).

“যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করার জন্য কোন পথ অবলম্বন করে, এর উসিলায় আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতের পথসমূহ থেকে একটি পথে পরিচালিত করেন। নিশ্চয়ই ইলম (জ্ঞান) অন্বেষণকারীর সন্তুষ্টির জন্য ফেরেশতাগণ তাদের পাখাসমূহ বিছিয়ে দেন। আর আলেমের জন্য আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সকলেই ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি গভীর পানির মাছও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। সুতরাং একজন আবেদের (ইবাদতকারীর) উপর আলেমের মর্যাদা তেমনি, যেমন পূর্ণিমার রাতে সকল তারকার উপর চাঁদের মর্যাদা। নিশ্চয়ই আলেমগণ নবগণের ওয়ারিস (উত্তরাধিকারী)। আর নবীগণ কোন দিনার এবং দিরহামের উত্তরাধিকারী রেখে যাননি; বরং তাঁরা শুধুমাত্র ইলমকে উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করল, সে পরিপূর্ণ অংশ (উত্তরাধিকার) গ্রহণ করল।” – ( ইমাম আবূ দাউদ, তিরমিযী ও ইবন মাজাহ হাদিসখানা বর্ণনা করেন )। [9]

এগুলো ছাড়াও কুরআন ও সুন্নাহর আরও অনেক বক্তব্য রয়েছে, যার প্রতিটি বক্তব্যই সমানভাবে পুরুষ ও নারীকে অন্তর্ভুক্ত করে; আর অনুরূপভাবে প্রথম প্রজন্মের নারীগণ জ্ঞান অর্জনের এই নীতি অবলম্বন করেছেন; মুমিন জননী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা জ্ঞান অন্বেষণকারিনী এবং সে ক্ষেত্রে প্রতিযোগী নারীদের জন্য নিজেকে অত্যন্ত চৌকস ব্যক্তি হিসেবে দৃষ্টান্ত পেশ করেন; এমনকি তিনি অধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমের মধ্যে অন্যতমা ছিলেন এবং অনেক মাসআলার ক্ষেত্রে তিনি তাদের তথ্যসূত্র বা আশ্রয়স্থল হিসেবে বিদ্যমান ছিলেন। আর তিনি সাহাবীদের কারও কারও দেয়া বিধিবিধানের ভুল সংশোধন করে দিতেন।

আর তিনি ছাড়াও আরও অনেক মহিলা সাহাবী জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্র গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।[10]

আর অধ্যাপক ডক্টর আবদুর রহমান আয-যুনাইদী নারীর শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পর্যালোচনা করেছেন; আর তা আলোচিত হয়েছে ‘নারীর সাংস্কৃতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য’ (مسئولية المرأة الثقافية)  শিরোনামের একটি পুস্তিকায়; সেখানে তিনি প্রথমে কতগুলো চ্যালেঞ্জের চিত্র তুলে ধরেছেন, মুসলিম নারী এই যুগে যেগুলোর মুখোমুখি হয়; আর তা হল:

প্রথম চিত্র: ইসলামী ধ্যানধারণার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকা; অন্যভাবে বলা যায়: তার ইসলামী আকিদা-বিশ্বাসকে বিশৃঙ্খলামুক্ত না করা; ফলে তার ইলাহ অথবা জীবন অথবা সৃষ্টি সম্পর্কিত বিশ্বাস ও ধ্যানধারণা থাকে বিকৃত; ফলে সে দুর্বল আকিদা-বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে।

দ্বিতীয় চিত্র: পুরুষের সাথে নারীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার সামাজিক অবস্থান। অর্থাৎ কোন কোন পুরুষ কর্তৃক তার পরিবারের সাথে বিদ্যমান নেতিবাচক অবস্থান। আর এটাকেই মুসলিম নারী তার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করে, পরিবারে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারটি সে সার্বিকভাবে বিবেচনা করতে সক্ষম হয় না। যেখানে পরিবারে নারীর সাথে পুরুষের সম্পর্ক শক্তিশালী হওয়ার কথা, সেখানে পুরুষ লোকটি সে সম্পর্কে ছেদ ঘটায় এবং সেটাকে পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয় না।

তৃতীয় চিত্র: চিন্তাগত অস্থিরতা, যা নিয়ে এই যুগ উত্তাল হয়ে আছে; যেমন আমদানিকৃত সংস্কৃতি, যা মুসলিম নারীর উপর সংকট সৃষ্টি করে এবং তাকে নিক্ষেপ করে ধ্বংস, অপ্রিয় ও ঘৃণ্য চরিত্রের পথে; এমনকি শিল্প, নৃত্য ইত্যাদি হয়ে যায় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার পাওয়ার মত বস্তুর অন্তর্ভুক্ত, যাকে আজকের নারীসমাজ গুরুত্ব দিয়ে থাকে; আর এটা বিপজ্জনক ও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।

চতুর্থ চিত্র: তথ্যপ্রযুক্তি বা মিডিয়া; আর কোন সন্দেহ নেই যে, এটাও একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ, কারণ এতে ভাল ও মন্দ সবই একসাথে রয়েছে। যার দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে এমন সংস্কৃতি, যা দীনের বিরুদ্ধে লড়াই করে, মুসলিম নারীর ব্যক্তিত্বের উপর আক্রমন করে, শিশুদেরকে তাদের ব্যক্তিত্ব নষ্ট করার প্রশিক্ষণ দেয় এবং তাদের স্বভাব-প্রকৃতিকে সত্য পথ থেকে ভিন্নমুখী করে দেয়। আর মুসলিম নারী এই দূষিত পরিবেশের মধ্যে জীবনযাপন করে, যার কারণে এই জীবনে তার নির্মল জীবনধারা কলুষিত হয়।

পঞ্চম চিত্র: আর আমি এখানে পঞ্চম চিত্রটি বৃদ্ধি করেছি; আর তা হল: নৈতিক বিপর্যয়, যা কোন কোন মুসলিম সমাজের গভীরে গিয়ে পৌঁছেছে এবং তা মুসলিম নারীসমাজের উপর নগ্নভাবে আক্রমন করেছে ও তার জন্য সমাজটিকে বাস্তবতার বিপরীতরূপে চিত্রিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ শিল্পকলা একাডেমিগুলোতে যেসব অনৈতিক বিষয়াদি ও কর্মকাণ্ড পরিবেশিত হয় এবং তাতে দীনের কিছু কিছু শিক্ষা ও দর্শনকে যেভাবে সেকেলে ও পশ্চাৎপদতা দ্বারা চিত্রিত করা হয়, তাতে এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা জাতির অনুসরণ করে ব্যাপক অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে; যাতে বলা হয় বিয়ে-সাদী হল বন্দী করা বা আটকিয়ে রাখা; আর তার সমাধান হল ভোগবিলাসে মত্ত থাকা এবং এরূপ আরও অনেক শ্লোগান।

ষষ্ঠ চিত্র: নারী জাতির বিশ্বায়ন; আর তা হল পশ্চিমা নাস্তিকগণ আহ্বান করে যে, আদর্শ নারী হল পশ্চিমা নারী, যে অধিকারের ব্যাপারে পুরুষের সমান; শিল্প-কারখানায় পুরুষের মত শ্রমিক, সৌন্দর্য প্রদর্শনকারিনী ইত্যাদি।

আর এই চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো প্রকাশ হতে শুরু করে তাদের ঐসব সম্মেলনে, যেগুলোতে তারা লোকদের আহ্বান করে, আর জাতিসংঘ যেগুলোর তত্ত্বাবধান করে এবং তার মূলনীতিমালা বাস্তবায়নের আহ্বান জানায়; যেমন শ্রমজীবি নারীকেই একমাত্র গ্রহণযোগ্য বিবেচ্য নারী হিসেবে তাদের মূল্যায়ন, হোম মেকার বা গৃহিনীদেরকে বিভিন্নভাবে পশ্চাদপদ বলে অবমূল্যায়ন করে। আর এর মধ্যে আরও রয়েছে, কতগুলো পরিবর্তিত পরিভাষার অনুপ্রবেশ; যেমন: নারী ও পুরুষের বৈষম্য দূর করার তাৎপর্য ব্যাখ্যার জন্য তারা “ المساواة(সমতা) শব্দের ব্যবহার; আর যৌনস্বাধীনতা ও নৈতিকতা বর্জনের জন্য “التنمية(প্রগতি) শব্দের ব্যবহার।

কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ সত্বেও আশার আলো তাদের মধ্যে তাদের মধ্যে থাকবে যারা তাদের দীনকে উপলব্ধি করেছে এবং তাদের শত্রুদের পাতানো পরিকল্পনার ফাঁদ সম্পর্কে সচেতন থেকেছে, তাদের ব্যাপারে আশার আলো সুস্পষ্টভাবে আলোকিত হয়ে আছে যা মনকে করে আনন্দিত এবং তাকে আস্থা, বিশ্বাস ও প্রশান্তিতে ভরে দেয়।

[চলবে]


[1] দ্রষ্টব্য: সাকাফাতুল মুসলিমা (ثقافة المسلمة), পৃ. ১৭

[2] এই উক্তিটি বর্তমানে খুব বেশি ধ্বনিত হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে যে ব্যক্তি বিশেষজ্ঞ না হওয়া সত্ত্বেও শরী‘আত সম্পর্কে কথা বলতে ইচ্ছা পোষণ করে সে এই গণ্ডিতে অনুপ্রবেশের সুযোগ পায় এবং যেকোনো কিছু  দলিল থাকুক বা না থাকুক নিজের মর্জিমতো হারাম করতে কিংবা হালাল করতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা কোন প্রকার নিয়মনীতি বা বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করেই যুক্তি দেখায়: ‘এটা আমার মত, আর ওটা তোমার মত’; ‘এটা আমার বুঝ, আর এটা তোমার বুঝ’।

[3] দ্রষ্টব্য: সাকাফাতুল মুসলিমা (ثقافة المسلمة), পৃ. ১৭ – ১৮

[4] তাফসীরু ইবনে কাছীর, ৬/ ৪৮৮ – ৪৮৯

[5] তিরমিযী, অধ্যায়: কিয়ামতের বিবরণ প্রসঙ্গে (صفة القيامة والرقائق والورع), পরিচ্ছেদ: কিয়ামত প্রসঙ্গে (باب في القيامة), বাব নং- ২, হাদিস নং- ২৪১৭

[6] আহমদ, মুসানাদ, অধ্যায়: মুসনাদুল ‘আশরাতিল মুবাশশিরীনা বিল জান্নাহ (مسند العشرة المبشرين بالجنة), পরিচ্ছেদ: আবদুর রহমান ইবন ‘আউফ রা. বর্ণিত হাদিস (حديث عبد الرحمن بن عوف الزهري رضي الله عنه), হাদিস নং- ১৬৬১।

[7] বুখারী, কিতাবুল জুম‘আ (كتاب الجمعة), পরিচ্ছেদ: গ্রাম ও শহরে জুম‘আ প্রসঙ্গে (باب الجمعة في القرى و المدن), বাব নং- ১০, হাদিস নং- ৮৫৩

[8] দেখুন, পূর্ববর্তী পোস্ট

[9] আবূ দাউদ, ইলম অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ইলম অনুসন্ধানে উৎসাহদান প্রসঙ্গে (باب الحث على طلب العلم ), বাব নং- ১, হাদিস নং- ৩৬৪৩; তিরমিযী, ইলম অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ইবাদতের উপর জ্ঞানের মর্যাদা প্রসঙ্গে (باب فضل الفقه على العبادة), বাব নং- ২০, হাদিস নং- ২৬৮২; ইবনু মাজাহ, কিতাবের ভূমিকা (افتتاح الكتاب في الإيمان و فضائل الصحابة و العلم), পরিচ্ছেদ: ইলম অনুসন্ধানে উৎসাহদান প্রসঙ্গে (باب فضل العلماء و الحث على طلب العلم ), বাব নং- ১৭, হাদিস নং- ২২৩

[10] দ্রষ্টব্য: লেখক কর্তৃক সম্পাদিত ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে করা নারীদের প্রশ্নসমূহ’ (أسئلة النساء لرسول الله صلى الله عليه و سلم); তাতে অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে; আর অচিরেই আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় তা প্রকাশিত হবে।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button