নারী অঙ্গন

মুসলিম নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (৩য় কিস্তি)

পূর্ববর্তী ধাপগুলোতে যা সহযোগিতা করবে, তা হল নিম্নোক্ত প্রশিক্ষণ পদ্ধতিসমূহ:

(ক) শারীরিক শাস্তি ছাড়া অপরাপর শাস্তি প্রদান:

আর এই শাস্তি তখন দেয়া হবে, যখন তার পক্ষ থেকে বার বার সালাত তরক (পরিত্যাগ) করা হবে; যেমন: তাকে নির্ধারিত উপহার দেয়া থেকে বঞ্চিত করা, প্রহারের হুমকি দেয়া এবং তার চাহিদা পূরণের আহ্বানে সাড়া না দেয়া …ইত্যাদি ইত্যাদি।

আর শারীরিক শাস্তি হবে মৃদু শাস্তি, কঠোর নয়; আর এই ধরনের শাস্তি কেবল তখনই কার্যকর করা হবে, যখন তার দশ বছর পূর্ণ হবে এবং তার পক্ষ থেকে বার বার সালাত তরক (পরিত্যাগ) করা হবে; আর এই শাস্তিবিধানের সময় শরীরের স্পর্শকাতর স্থানসমূহ থেকে দূরে থাকতে হবে, যেমন: ঘাড়, পেট ও মাথা।

(খ) পুরুষ ও নারী জাতির জাতিগত বিশেষত্বের তাগিদ দেওয়া:

ছেলে ও মেয়ের প্রত্যেকের জন্য যে একে অপরের থেকে পৃথক বিশেষত্ব বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সে বিষয়ে তাকে অবহিত করা; আর এই অবহিতকরণের কাজ শুরু হবে তাদের বয়স দশম বছর পূর্ণ হওয়ার সময় থেকে তাদের বিছানা আলাদা করার মাধ্যমে। আর এটা একে অপরের নিকটবর্তী হওয়ার ও অশ্লিলতার পথ বন্ধ করার জন্য এবং স্বাতন্ত্রবোধ ও একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের অনুশীলনের জন্যও এই ব্যবস্থা।

(গ) নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচারের উপর ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ:

আর এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত— চারিত্রিক কর্মকাণ্ডের উপর তাদের অনুশীলন এবং তার উপর তাদেরকে অভ্যস্ত করানো। যেমন: আচার-আচরণে এবং কাজে ও কর্মে সত্যবাদিতার নীতি অবলম্বন করা; প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করা।

(ঘ) কর্মকাণ্ডে উৎসাহ দান:

ছোট বয়সে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে যা সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখে, তা হল শিশুদের কর্মকাণ্ডের সাথে সংগতিপূর্ণভাবে উৎসাহদান। তারা ছোট হলেও তাদের উপর এর অনেক প্রভাব রয়েছে।

(ঙ) বন্ধু-বান্ধবকে পর্যবেক্ষণ ও অনুসরণ:

ছোটবেলা থেকেই বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথীর কর্মকাণ্ডের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা এবং এ ব্যাপারটি উপেক্ষা না করা। কারণ, সে তার বন্ধুর কাছ থেকেই কথা বলা, স্বভাব-প্রকৃতি ও কর্মকাণ্ডের অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়। অতএব তাকে এমন বন্ধুর নিকটবর্তী করাবে, যে উত্তম পরিবেশে জীবনযাপন করে এবং এমন সাথীর সঙ্গ থেকে দূরে থাকবে, যে মন্দ পরিবেশে জীবনযাপন করে।

 

চতুর্থত: তাকে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তত্ত্ববধান করা

আর এই বয়সে এসে পিতা-মাতার দায়-দায়িত্ব বেড়ে যায়। এখানে কয়েকটি বিষয়ে মায়ের দায়-দায়িত্ব কেন্দ্রীভূত হয়:

  • দায়িত্ব পালন ও যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রে তার পিতার সাথে সহযোগিতা করা।
  • গৃহে তত্ত্বাবধান। এই তত্ত্বাভধানের অন্তর্ভুক্ত: ভাল ও কল্যাণকর কাজে উৎসাহ প্রদান করা এবং এর ব্যতিক্রম করলে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সাবধান করা।
  • ছেলে অথবা মেয়েকে তার মূল্য ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অনুভূত করা। সে যদি ছেলে হয়, তবে অনুধাবন করাবে যে, সে পুরুষদের কাতারে পৌঁছেছে; তাকে পুরুষত্ব ও তার বৈশিষ্ট্যসমূহের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেবে। আর এই দায়িত্বটি যদি সম্ভব হয় তবে পিতার জন্যই বহন করা জরুরি। আর যদি সে কন্যা হয়, তবে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করাবে। যেমন: তার ভবিষ্যত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অনুশীলন করা, তাকে বিশেষ তত্ত্বাবধান করা, তার যত্ন নেয়া, তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া, তার পড়াশুনা ও অধ্যাবসায়ের দিকে মনোযোগ দেয়া এবং তারা পাঠসমূহ ও পোষক-পরিচ্ছদের বিষয়টি তদারকি করা।
  • মেয়ের কাজে তার সাথে অংশ নেওয়া। এটি শুরু করতে হবে তার সাথে বন্ধুসুলভ ব্যবহারের মাধ্যমে। আর তাকে বোঝাতে হবে যে, সে তার মা হওয়ার সাথে সাথে একজন বান্ধবীও বটে। এতে করে পরবর্তীতে মেয়ে তার কাছ থেকে এমন কোন কিছু গোপন করবে না, যা অনেক সময় তার ক্ষতির কারণ হতে পারে।
  • মেয়েকে ঘর-গৃহস্থালির কাজকর্মের কিছু দায়িত্ব প্রদান করা এবং তাকে সম্পূর্ণরূপে এমনভাবে উপেক্ষা না করা, যাতে কোন দায়-দায়িত্ব বহন না করেই সে সকল জিনিস হাতের কাছে প্রস্তুত অবস্থায় পেয়ে যায়।
  • সকল সম্পাদিত কাজের ব্যাপারে পিতাকে অবহিত করা এবং বিশেষ করে এই স্তরের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে তাকে অংশগ্রহণ করানো, আর ছেলে হউক অথবা মেয়ে হউক সন্তানদের কোন বিষয়ই তার নিকট গোপন না করা।

এসব দায়িত্ব ও কর্তব্যের গভীরতাই জোর দিয়ে থাকে যে, মা হলেন শিশুর পরিচর্যাকারিনী, লালনপালনকারিনী, তত্ত্বাবধায়ক, শিক্ষিকা, পরিচালিকা ও সম্পাদিকা। তিনি হলেন একাধারে জ্ঞানীদের জননী, কীর্তিমানদের লালনপালনকারিনী ও শিক্ষিকা, শ্রমিক ও কৃষকের প্রশিক্ষক, বীর পুরুষ তৈরির কারিগর এবং মহৎ গুণাবলি রোপণকারিনী। এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যবস্থাপনা মোটেই সহজ কাজ নয়—যেমনটি অনেক মায়েরা ভাবেন— বরং তিনি হলেন পৃথিবীর বুকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এর কারণ হল, মহৎ ব্যক্তি, আলেম-জ্ঞানী, মুজাহিদ (আল্লাহর পথে জিহাদকারী),

দা‘ঈ (আল্লাহর পথে আহ্বানকারী) এবং সৎকর্মশীলদের কারও আবির্ভাব হত না, যদি না তার পিছনে প্রশিক্ষক জ্ঞানী মায়েরা না থাকতেন।

(গ) আদর্শ কন্যা হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য:

কন্যা হচ্ছে সেই মূলেরই শাখা। আল্লাহ সুবহানহু ওয়া তা‘আলা মহান অনুগ্রহের মাধ্যমে তাকে বিশেষিত করেছেন, যার কারণে সে ছেলের থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের হতে পারে, যদি তাকে যথাযথভাবে যেমনটি আল্লাহ সুবহানহু ওয়া তা‘আলা শরী‘আতের বিধান হিসেবে অর্পণ করেছেন সেভাবে লালনপালন করা যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ حَتَّى تَبْلُغَا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَنَا وَهُوَ ». وَضَمَّ أَصَابِعَهُ. (أخرجه مسلم)

“যে ব্যক্তি দু’টি কন্যাকে প্রাপ্তবয়স্কা হওয়া পর্যন্ত লালনপালন করে, কিয়ামতের দিন সে হাজির হবে এমতাবস্থায় যে, আমি এবং সে এভাবে থাকব—” বলে তিনি তাঁর আঙুলসমূহকে একত্রিত করে দেখালেন।- (ইমাম মুসলিম র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন)[1]

কন্যা দুর্বলতা ও শান্ত-শিষ্টতার কারণে তার পিতা-মাতার অন্তর বিশেষভাবে দখল করে থাকে।

আর যেমনিভাবে কন্যার জন্য পিতা-মাতার উপর অধিকার স্বীকৃত আছে, যা পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাসমূহের মধ্যে ইঙ্গিত করা হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে কন্যাও এই দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে মুক্ত নয়। কন্যা হিসেবে নারীর অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ নিম্নরূপ:

–          ব্যক্তিগত দায়িত্বের প্রতি গুরুত্বারোপ করা, যেমন: শিক্ষালাভ ও শিক্ষা দান। একজন নারী তার মা ও ভাল শিক্ষিকাদের সহযোগিতা নিয়ে নিজের জন্য শিক্ষা সংক্রান্ত একটি পরিপূর্ণ সিলেবাস/প্রোগ্রাম গ্রহণ করবে, যা শরয়ী জ্ঞান, আরবি, শিষ্টাচারিতা, তাফসীর, হাদিস, সাহিত্য, সাধারণ জ্ঞান ও নারী বিষয়ক জ্ঞান ইত্যাদিসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করবে, যার বিবরণ নারীর নিজের প্রতি শিক্ষাবিষয়ক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রসঙ্গে পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে।

–          আল্লাহ ত‘আলার বাণীর অনুসরণে পিতা-মাতার আনুগত্য করা এবং এই ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنًاۚ﴾ [ سُورَةُ الإِسۡرَاءِ: 23 ]

“তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে।”  (সূরা আল-ইসরা: ২৩)

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল, অধিকাংশ কন্যাদেরকে দেখা যায় তারা এই আনুগত্যের ব্যাপারে উদাসীন। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পিতামাতার চাইতে বান্ধবীদের অনুসরণ করে এবং তাদেরকে অগ্রধিকার দেয়। এটা ছেলে-মেয়ে উভয়েরই বড় ধরনের অন্যায়। এই ক্ষতি ভবিষ্যতে তাদের কাছেই ফিরে আসবে। কেননা, নিঃসন্দেহে পিতা-মাতার আনুগত্য এমন এক ঋণ, যা শীঘ্রই ফেরত আসবে।

–          মায়ের বিভিন্ন কর্তব্যে সাধ্যমত সহযোগিতা করা। উদাহরণস্বরূপ:

  • রান্নবান্না, ধোয়া-মোছা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব পালন করা; পুরাপুরিভাবে কাজের মহিলা-নির্ভর না হওয়া। কারণ, এই নির্ভরতা মেয়েকে এক অদক্ষ বা অকর্মায় পরিণত করবে, ফলে সেই মেয়ে ভবিষ্যতে তার ঘর-গৃহস্থালির কাজকর্ম ও দায়িত্ব পালনে অসমর্থ্য হবে।
  • ছোট ভাই ও বোনদের লালনপালন এবং নৈতিকতা ও উন্নত চারিত্রিক শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে তার মাকে সার্বিক সহযোগিতা করা (আমরা মায়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রসঙ্গে এর বিস্তারিত আলোচনা করেছি)।
  • পূর্বে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্বে মায়ের প্রতিনিধিত্ব করা।
  • মা মুর্খ হলে তাকে শিক্ষা দেওয়া। বিশেষ করে এমন বিষয়গুলো শিখিয়ে দেওয়া, যাতে তার দীন পালন করতে পারে। যেমন: সালাত এবং সালাতের মধ্যে পঠিত কুরআন ও যিকির-আযকারের প্রশিক্ষণ দেয়া; অবসর সময়ে তার নিকট এমন কিছু শিক্ষণীয় বিষয় পাঠ করবে, যা তার উপকারে আসবে। আর এই ব্যাপারে অনেকেই অমনোযোগী ও উদাসীন। নারীদের অনেকের ব্যাপারে এমন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, তারা (উদাহরণস্বরূপ) সূরা ফাতিহাই পাঠ করতে জানে না অথচ তার কন্যা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা উচ্চ-মাধ্যমিক ছাত্রী। সেখানে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের দায়-দায়িত্ব কন্যাদের উপরই বর্তায়।

 

নিম্নোক্ত বিষয়গুলো থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা:

–          এমন কাজে সময় অতিবাহিত করা, যাতে কোন উপকার নেই: যেমন: বিভিন্ন প্রকার মিডিয়া অনুসরণ করা এবং অপরাপর এমন সব যোগযাযোগের মাধ্যমের পেছনে আত্মনিয়োগ করা, যার কোনো প্রয়োজন নেই। এতে বহু সময় অন্যায়-অপরাধে, খেল-তামাশায় ও অনর্থক কাজে নষ্ট হয়। অথচ মানুষকে তার সময়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে। সময়ই তার বয়স ও জীবন, আর তা জগতের সবচেয়ে দামী জিনিস। যখন তা এসব মিডিয়া ও যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যয় করবে, তখন তা হবে তার দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য খারাপ পরিণতি ও ক্ষতির কারণ। অথচ অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের ব্যাপার হল, অধিকাংশ মেয়ের সময়গুলো বরাদ্দ থাকে এসব মিডিয়া, খারাপ বান্ধবীদের সাথে আড্ডা, মার্কেট এবং টেলিফোনে— যার ফলে নষ্ট হচ্ছে বহু কাজ, ধ্বংস হচ্ছে সময় এবং হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতা।

–          খারাপ বান্ধবী সকল, যারা জ্বলন্ত আগুনের মত যখন তার মধ্যে কোন কিছু পতিত হবে, তখন তা তাকে জ্বালিয়ে দেবে। এই যুগে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগযাযোগের মাধ্যম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে; তাই প্রত্যেকটি মেয়ে যেন এসব খারাপ বান্ধবী থেকে সাবধানতা অবলম্বন করে। তাদের চিহ্ন হল তারা অন্যদের জন্য খারাপ জিনিস ও উপায়-উপকরণ আমদানি করে; তারা দুষ্কর্ম ও বিশৃঙ্খলাকে পছন্দ করে ও করায়, তাতে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং সৎকর্ম ও কল্যাণজনক বিষয় থেকে নিষেধ করে।

–          কাফির ও ফাসিকগণ কর্তৃক আমদানি করা ফ্যাশনের অনুসরণ করা: যেমন আমরা পূর্বেই জেনেছি যে, ইসলামের শত্রুগণ অত্যন্ত আগ্রহী, বরং তারা সচেষ্ট— যাতে মুসলিম মেয়েরা বিশৃঙ্খল হতে পারে। তাদের অন্যতম উপকরণ হচ্ছে, তাদের বিভিন্ন ফ্যাশন— যা তারা মুসলিমগণের কন্যাদের মাঝে ছড়িয়ে থাকে। তাই মুসলিম কন্যার জন্য গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে না দেয়া আবশ্যক।

–          অপ্রয়োজনে মার্কেটে বের হওয়া:  এটি একটি ভয়ানক সমস্যা, যা এই শেষ যামানায় শুষ্ক লাতাপাতায় আগুন ছড়ানোর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক মুসলিম কন্যারা বিভিন্ন মার্কেটে-বাজারে (অপ্রয়োজনে) ঘুরে বেড়ায়— যার ফলে তাদেরকে অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। এসব বিপদসমূহের অন্যতম হল শয়তানের শিকার হওয়া; কারণ, বাজার শয়তানেরই অবস্থান কেন্দ্র এবং সবচেয়ে নিকৃষ্টতম জায়গা হল বাজারসমূহ। যখন মেয়েরা কোন প্রয়োজনের কারণে বাধ্য হবে বাজারে যেতে, তখনই শুধু তার অভিভাবককে সাথে নিয়ে তার প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে বাজারে বের হবে, অতঃপর প্রয়োজন শেষে তার ঘরে ফিরে আসবে। আর এই বের হওয়াটা অনুপ্রেরণা দেয় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বার-বার ঘর থেকে বের হতে। সুতরাং প্রত্যেক মেয়ের উচিত সে যেন তার প্রয়োজনকে হিসাব করে নেয় এবং এই বের হওয়াটা যাতে বেশি না করে, কারণ তা হচ্ছে সকল অনিষ্টের দরজা। নারী যখন তার ঘর থেকে বের হয়, তখন শয়তান তার দিকে উঁকি দেয়। এটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত  [2]। কত মুসলিম নারী যে এই বেপরোয়া বের হওয়ার কারণে দুষ্টচক্রের রশিতে আবদ্ধ হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। সুতরাং ময়েদেরকে খুবই সতর্ক থাকা উচিত।

–          বিনোদন কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে বের হওয়া: এটি খারাপ হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, এটি খেল-তামাশার স্থল, সময় নষ্টকারী এবং অন্যায় ও অপরাধের কারণ। [3]

–          অপ্রয়োজনে ফোন ব্যবহার করা: ফোনের উভয়দিকেই ধার আছে। মূলত এটি প্রয়োজনেই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় হল, টেলিফোনের ক্ষেত্রে  মেয়েদের অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। সে যখন ফোন রিসিভার তার কানে নেয়, তখন অনেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে তা ছাড়ে না। কত দুঃখজনক ও ধ্বংসাত্মক! বর্তমানে তা হয়ে গেছে ধ্বংসের দরজা— যার মাধ্যমে লম্পটরা মুসলিম মেয়েদের পিছনে লেগে তাদেরক নষ্ট করে। সুতরাং এই পথ থেকে সাবধান! সাবধান!!

 

(ঘ) আদর্শ বোন হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য:

বোন হল তার ভাইয়ের নিকট সকল আত্মীয়ের মধ্যে সবচেয়ে নিকটতম ও ঘনিষ্ঠ; আর তাদের উভয়ের জন্য যৌথ হক বা অধিকার রয়েছে। বরং তার (বোনের) দায়-দায়িত্ব আরও ব্যাপক। তা পালন করতে হয় ঘরের মধ্যে, যেখানে সে জীবনযাপন করে। কন্যা হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে যা বলা হয়েছে, ছোট ও বড় ভাই-বোনদের সাথে বোনের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে পরিপূর্ণভাবে তাই বলা হয়।

এসব দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলোর পাশাপাশি নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বৃদ্ধি করা য়ায়:

–          তার চেয়ে বয়সে বড় ভাই ও বোনদের সম্মান ও মর্যাদা দেয়া। কারণ, বড় বোন হলেন মায়ের মর্যাদায় এবং বড় ভাই হলেন পিতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। তাদের জন্য আত্মীয়তার সম্পর্কজনিত অধিকার রয়েছে; আর তার উপর কর্তব্য হল সহযোগিতার মুখাপেক্ষী হলে তাদেরকে সহযোগিতা করা। যেমন: তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা করা, বিপদ-মুসিবতের সময় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে সহযোগিতা করা এবং তাদের পড়াশুনা ও জ্ঞানের ব্যাপারে তাদেরকে সহযোগিতা করা।

–          বাড়ির মধ্যে সকল প্রকার কল্যাণ ছড়িয়ে দেয়া— পাঠের মাধ্যমে, শুনানোর মাধ্যমে, দাওয়াতের মাধ্যমে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকর্মে নিষেধ করার মাধ্যমে ইত্যাদি।

–          প্রথম নারীর পরে ঘরের রান্নাবান্না, ধোয়া-মুছা ইত্যাদির মত কাজকর্মের সে অন্যতম খুঁটি।

–          ঘরের মধ্যে প্রয়োজন হলে কাউকে উপদেশ ও দিকনির্দেশনা দেয়া।

তৃতীয় ক্ষেত্র: সমাজ ও জাতি কেন্দ্রিক একজন নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিধি সমাজ ও পুরো জাতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর সে কর্তব্য হচ্ছে, তাদের মাঝে আল্লাহর দিকে আহ্বান, সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজে নিষেধ, কল্যাণ কামনা ও সংস্কার করার মত কাজের আঞ্জাম দেয়া।

আর এখানে আমি সাধারণভাবে এই দাওয়াতের গুরুত্ব, তার আবশ্যকতা ও ফলাফল, অতঃপর বিশেষকরে নারীর সাথে সংশ্লিষ্ট শরী‘আতের কিছু দলীল-প্রমাণাদি উল্লেখ করছি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَمَنۡ أَحۡسَنُ قَوۡلٗا مِّمَّن دَعَآ إِلَى ٱللَّهِ وَعَمِلَ صَٰلِحٗا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ٣٣ وَلَا تَسۡتَوِي ٱلۡحَسَنَةُ وَلَا ٱلسَّيِّئَةُۚ ٱدۡفَعۡ بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُ فَإِذَا ٱلَّذِي بَيۡنَكَ وَبَيۡنَهُۥ عَدَٰوَةٞ كَأَنَّهُۥ وَلِيٌّ حَمِيمٞ ٣٤  ﴾ [ سُورَةُ فُصِّلَتۡ: 33 – 34 ]

 

“কথায় কে উত্তম ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা, যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহ্বান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, ‘আমি তো অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত।’ ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত।” – ( সূরা ফুসসিলাত: ৩৩ – ৩৪ )

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٠٤﴾ [ سُورَةُ آلِ عِمۡرَانَ: 104 ]

“তোমাদের মধ্যে এমন এক দল থাকা উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজের নিষেধ করবে; এরাই সফলকাম।” – ( সূরা আলে ইমরান: ১০৪ )।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ١٢٥  ﴾ [ سُورَةُ النَّحۡلِ: 125 ]

 

“তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়। তোমার প্রতিপালক সেই ব্যক্তি সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত, যে ব্যক্তি তাঁর পথ ছেড়ে বিপথগামী হয় এবং কারা সৎপথে আছে, তাও তিনি সবিশেষ অবহিত।” – (সূরা আন-নাহল: ১২৫)।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿فَلَوۡلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرۡقَةٖ مِّنۡهُمۡ طَآئِفَةٞ لِّيَتَفَقَّهُواْ فِي ٱلدِّينِ وَلِيُنذِرُواْ قَوۡمَهُمۡ إِذَا رَجَعُوٓاْ إِلَيۡهِمۡ لَعَلَّهُمۡ يَحۡذَرُونَ ١٢٢ ﴾ [سُورَةُ التَّوۡبَةِ: 122 ]

 

“তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হয় না কেন, যাতে তারা দীন সম্বন্ধে জ্ঞান অনুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে; আশা করা যায় তারা সতর্ক হবে।” – ( সূরা আত-তাওবা: ১২২ )।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ قُلۡ هَٰذِهِۦ سَبِيلِيٓ أَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا۠ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِيۖ وَسُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ وَمَآ أَنَا۠ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ١٠٨ ﴾ [ سُورَةُ يُوسُفَ: 108 ]

“বল, এটাই আমার পথ; আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি আহ্বান করি সজ্ঞানে— আমি এবং আমার অনুসারীগণও। আল্লাহ মহিমান্বিত এবং যারা আল্লাহর শরীক করে আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।” – (সূরা ইউসূফ: ১০৮ )।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ يَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ ﴾ [ سُورَةُ التَّوۡبَةِ: 71 ]

“মুমিন নর ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু, তারা সৎকাজের নির্দেশ দেয় এবং অসৎকাজের নিষেধ করে।” – (সূরা আত-তাওবা: ৭১ )।


[1] মুসলিম, অধ্যায়: সদ্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও আচার-ব্যবহার (البر والصلة والآدب), পরিচ্ছেদ: কন্যাদের প্রতি সদ্ব্যবহারের ফযিলত(ِ باب فَضْلِ الإِحْسَانِ إِلَى الْبَنَاتِ), বাব নং- ৪৬, হাদিস নং- ৬৮৬৪

[2] আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

«المرأة عورة فإذا خرجت استشرفها الشيطان»

(নারী হল গোপন বস্তু, সে যখন বের হয়, তখন শয়তান তার দিকে উঁকি দেয়) 

ইমাম তিরমিযী, অধ্যায়: দুগ্ধপান (كتاب الرضاع), পরিচ্ছেদ: শয়তান কর্তৃক নারীর দিকে উঁকি দেয়া যখন সে বের হয় ( باب استشراف الشيطان المرأة إذا خرجت), বাব নং- ১৮, হাদিস নং- ১১৭৩; ইমাম তিরমিযী বলেন: এই হাদিসটি হাসান, গরীব।

[3] পাঠক ও পাঠিকা আবার মনে করবেন না যে, শরীয়ত নিয়ন্ত্রিত বৈধ আমোদ-প্রমোদ ও সুস্থ বিনোদন নিষিদ্ধ। বরং এখানে সেসব উদ্দেশ্য, যেগুলো মুসলিম সমাজের অধিকাংশ স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে— যেগুলোর সর্বনিম্ন পর্যায় হলো পুরুষ ও নারীদের মেলামেশা। কিন্তু যখন বিনোদন শরীয়ত সম্মত পন্থায় নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে তা বৈধ; বরং জীবনের কোন কোন স্তরে তা কাম্যও বটে। – দ্রষ্টব্য: ডক্টর আবদুল্লাহ আস-সাদহান রচিত কিতাবুত তারফীহ (كتاب الترفيه)। গ্রন্থটিতে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য রয়েছে, আল্লাহ তাকে তাওফীক দিন।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button