মানুষের পাপ গোপন রাখার গুরুত্ব
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
“যারা পছন্দ করে যে,ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার লাভ করুক,নিঃসন্দেহে ইহাকাল ও পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আল্লাহ্ জানেন,তোমরা জানো না”। [সূরা আন-নূর; ২৪:১৯]
প্রিয় নবী (সা) আমাদের প্রয়োজনীয় সবকিছুই শিক্ষা দিয়েছেন যার একটি হল অন্যের পাপ গোপন রাখা। আমাদের মাঝে কেউ যদি এমন কোন খারাপ কাজ করে বসে যা কিনা আল্লাহ্র আদেশ বিরুদ্ধ বা নৈতিক চরিত্র বিরুদ্ধ কিংবা অন্যের জন্য মর্যাদাহানিকর, সেক্ষেত্রে তার উচিৎ তা গোপন রাখা এবং কৃতকর্মের জন্য একান্ত নিভৃতে আল্লাহ্র কাছে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করা। প্রিয় নবী (সা) বলেছেন,
“আমার সমগ্র উম্মাহ্ নিরাপদ, কেবল তারা ব্যতীত যারা কিনা তাদের পাপ নিয়ে দম্ভ করে বেড়ায়। তাদের কেউ যখন কোন কুকর্ম করে রাতে ঘুমাতে যায় এবং আল্লাহ্ তার পাপ গোপন রাখেন, সকালে ঘুম থেকে উঠার পর সে বলতে থাকে, “এই শোন, আমি না কাল রাতে এই এই (কুকর্ম) করেছি”। সে যখন ঘুমাতে যাই, আল্লাহ্ তার পাপ গোপন রাখেন, আর সকালে ঘুম থেকে উঠেই আল্লাহ্ যা গোপন রেখেছিলেন তা সে লোকজনের কাছে প্রকাশ করে বেড়ায়”।
[সহীহ আল বুখারী]
জায়িদ ইবনে আসলাম থেকে বর্ণিত,
“আল্লাহ্র রাসূল (সা) এর সময়ে এক লোক যখন স্বীকার করল যে, সে ব্যভিচার করেছে, তখন আল্লাহ্র রাসূল (সা) একটি চাবুক চাইলেন। যখন তাকে একটি ছেঁড়া/পুরানো চাবুক দেওয়া হল তিনি বললেন, “এটার চেয়ে ভাল নেই?” তখন একটি নতুন চাবুক আনা হলে তিনি বললেন, “এটার চাইতে একটু পুরাতন দেখে নিয়ে আস”। এরপর এমন একটা চাবুক আনা হল যেটা ছিল (ব্যবহারের ফলে) একটু পুরানো/নরম। তখন তিনি ওটা দিয়ে ওই ব্যক্তিকে একশো দোর্রা মারার নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি বললেন, “হে লোকেরা! তোমরা আল্লাহ্র সীমা অতিক্রম করোনা। কেউ এই ধরনের ঘৃণিত কোন অপরাধ (যেমন ব্যভিচার) করে বসলে, সে যেন তা গোপন রাখে, কারন কেউ যদি তা প্রকাশ করে বসে, তবে আমরা তার ব্যাপারে বর্ণিত শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আল্লাহ্র কিতাবের বিধান কার্যকর করব”। [মুসনাদ আহমদ]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত, “একজন লোক রাসূল (সা) এর নিকট আসেলেন এবং বললেন:
“হে আল্লাহ্র রাসূল! আমি মদিনার থেকে দূরবর্তী এক স্থানে এক মহিলার সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছি। সুতরাং, আমাকে আমার প্রাপ্য শাস্তি দেন’। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) তখন বললেন: ‘আল্লাহ্ তো তোমার পাপ গোপন রেখেছিল, তবে কেন তুমি তা গোপন রাখলেনা?’” [সহীহ্ মুসলিম]
একইভাবে, যদি কেউ অন্যের পাপের কথা জেনে থাকে তবে তার উচিৎ তা গোপন রাখা। রাসূল (সা) বলেন:
“যে ব্যক্তি দুনিয়ায় একজন মুসলমানের একটা কষ্ট দূর করবে, হাশরের দিন আল্লাহ্ও তার একটা কষ্ট দূর করে দিবেন; যে একজন ঋণগ্রস্তকে ঋণমুক্ত করবে, আল্লাহ্ তার দুনিয়া আর আখিরাত দুটোই সহজ করে দিবেন; আর যে ব্যক্তি একজন মুসলিমের দোষ গোপন রাখবে, দুনিয়া আর আখিরাত দুই জায়গাতেই আল্লাহ্ তার দোষ গোপন রাখবেন।” [ সহীহ্ মুসলিম]
আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত,
“রাসূল (সা) একবার মীম্বরে দাড়িয়ে উচ্চস্বরে বললেন, “হে লোকেরা, যারা কিনা ইসলামকে শুধুমাত্র মুখে গ্রহন করেছ কিন্তু অন্তরে ঈমান আননি এখনো, তোমরা মুসলমানদের অনিষ্ট করা থেকে বিরত থাক, বিরত থাক তাদের ঠাট্টা করা থেকে, আর বিরত থাক তাদের ভুলত্রুটি বলে বেড়ানো থেকে, কারন যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের দোষ অন্বেষণ করে বেড়ায় আল্লাহ্ও তার দোষ অন্বেষণ করবেন এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিবেন, এমনকি যদি নিভৃতে কোন এক গৃহকোণেও সংঘটিত হয়ে থাকে পাপটি।” [সহীহ্ আল জামী]
ইমাম আন-নাওয়াবী (রঃ) লিখেছেন, ‘এই হাদিস থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, শুধুমাত্র মুনাফিক আর দুর্বল ঈমানের লোকেরাই মানুষের দোষ খুঁজে বেড়ায় এবং তা প্রকাশ করে বেড়ায়… “
লজ্জা আর অপমানের ভয় অনেকসময় মানুষকে অনেক খারাপ কাজ করা থেকে বিরত রাখে। হতে পারে এই ভয়টাই একদিন তাকে আল্লাহ্র দিকে নিয়ে যাবে, যখন সে তার ভুল বুঝতে পারবে এবং তার কৃত অপরাধের জন্য আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু যখন তার অপরাধ জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেওয়া হয় তখন সেই ভয়টা আর তার মাঝে কাজ করে না । সে তখন ভাবতে থাকে, ‘কি হবে আর ভাল থেকে, ক্ষতি যা হবার তা তো হয়েই গেছে, লোকজন তো জেনেই গেছে ইতোমধ্যে’, তখন সে প্রাকাশ্যে পাপ কাজে লিপ্ত হতে থাকবে।
তাছাড়া বারবার পাপের কথা বলতে থাকলে মানুষের অন্তর থেকে পাপের ভয় দূর হয়ে যায়। তখন পাপকে আর পাপ বলে মনেই হয়না। যে পাপের কথা বলে বেড়াতে লজ্জাবোধ করেনা, একই পাপে লিপ্ত হওয়া তার জন্য অসম্ভব কিছু নয়। আর এভাবেই সমাজে পাপ ছড়িয়ে পড়তে থাকে!
তাই এক মুসলমান অন্য কোন মুসলমানকে পাপ করতে দেখলে তার উচিত তা গোপন রাখা। সেই পাপ প্রকাশ করে দিয়ে লোকজনকে পাপের দিকে ঠেলে দেওয়া তার পক্ষে সমীচীন নয়। আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে শুধুমাত্র গুনাহগারদেরকেই সতর্ক করেননি, যারা গুনাহের কথা বলে বেড়ায় তাদেরকেও সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেনঃ
“যারা পছন্দ করে যে,ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার লাভ করুক, নিঃসন্দেহে ইহাকাল ও পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আল্লাহ্ জানেন,তোমরা জানো না”। [সূরা আন-নূর; ২৪:১৯]
সূরা আন-নিসা এর মধ্যে আল্লাহ্ বলেনঃ
“আল্লাহ্ কোন মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। তবে কারো প্রতি জুলুম হয়ে থাকলে সে কথা আলাদা। আল্লাহ্ শ্রবণকারী,বিজ্ঞ”।
[সূরা আন নিসা, ৪:১৪৮]
ইবনে আব্বাস (রা) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন,
“আল্লাহ্ পছন্দ করেন না যে, আমরা একে অন্যের বিরুদ্ধে বদ্দোয়া বা মন্দ বিষয় প্রকাশ করি, যদি না আমাদের উপর অন্যায় করা হয়। তবে যদি কারো উপর জূলূম করা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে এই ব্যাপারে আল্লাহ্র অনুমতি রয়েছে। তারপরও এই ব্যপারে ধৈর্য ধারন করাই উত্তম।”
[তফসীর ইবনে কাসীর]
সমাজে আজ এতো ব্যাপকভাবে পাপ ছড়িয়ে পড়ার কারন হল আমরা রাসূল (সা) এর দেওয়া শিক্ষার কথা ভুলে গেছি যার শিক্ষা ছিল নিজের আর অন্যের মন্দ বিষয় প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার। আজ সে কারনেই মানুষের অন্তর থেকে গুনাহের ভয় উড়ে গেছে- হোক সেটা ছোট গুনাহ্ বা বড় গুনাহ্। আরো ভয়ঙ্কর হল, মানুষ আজকাল তাদের নিজের পাপের কথা গর্বভরে প্রচার করতে পছন্দ করে! একবারও কি ভেবে দেখেছি কোথায় চলে গেছি আমরা!!
আজকাল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির নামে সমাজে কতভাবে যে পাপ ছড়িয়ে পড়ছে তার কোন ইয়াত্তা নেই। ইন্টারনেট, বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা এবং রেডিও-টেলিভিশনের প্রোগ্রামগুলোতে খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, ব্যভিচার, দুর্নীতি, বাটপারি আর মারামারি ছাড়া ভাল কোন খবরই পাওয়া যায়না আজকাল। মিডিয়া-যার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে সবচাইতে বড় ভুমিকা রাখার কথা ছিল-তাই আজ সমাজে অন্যায়কে দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুমিকা পালন করছে। কয়েকবছর আগেও আমরা যেসব অপরাধের কথা কল্পনা করতে পারতাম না, সেগুলোই আজ মিডিয়ার কল্যাণে নিত্যনৈমিত্তিক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে! তাই মুসলিম ভাইদের প্রতি অনুরোধ, আসুন, মুসলিম উম্মাহকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় এমন সকল পথ পরিহার করে চলি আমরা; বিরত থাকি নিজের বা অপরের দোষ প্রচার করা থেকে; পানাহ্ চাই আল্লাহ্র কাছে, আল্লাহ্ যেন আমাদের সকলকে এমন ঘৃণিত অপরাধ থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন।
ধৈর্যসহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। জাযাকাল্লাহু খাইরান!
References: Lecture by Allama Ehsan Ilahi Zaheer (rahimahullah), Qawaaid wa-Fawaaid min al-Arabeen an-Nawawi by Shaikh Nathim Sultan, Tafseer Ibn Katheer, and others.
অনুবাদঃ মুনিমুল হক
সম্পাদনাঃ আবদ্ আল-আহাদ এবং শাবাব শাহরিয়ার খান
প্রকাশনায়ঃ কুরআনের আলো ওয়েবসাইট