কুরআন

কুরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফযীলত

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ইসলামী আইন-কানূন সংক্রান্ত সকল বিষয়ে পবিত্র কুরআনই চূড়ান্ত দলীল হিসাবে গৃহীত। এতেই মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের সকল অত্যাবশ্যকীয় বিষয় ও ঘটনার বিবরণ রয়েছে। কুরআন আল্লাহর কিতাব। এর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা ইবাদত। এটি মানুষের যাবতীয় কল্যাণের উৎস। তার থেকে দূরে সরে যাওয়ার মাধ্যমেই মানুষ অকল্যাণে নিপতিত হয়। কুরআনের মাধ্যমে বিবিধ কল্যাণের দ্বার উন্মোচিত হয়, যা একজন ব্যক্তিকে ক্রমাগত আরও কিছু অনুসন্ধান করার পথ দেখায়, যাতে সে এর মাধ্যমে উভয় জাহানে সম্মানিত হয়। আর কুরআন তেলাওয়াতকারীর উপর কল্যাণ বর্ষিত হয়। কেননা পবিত্র কুরআন পঠিত কোন সাধারণ বইয়ের মতো নয়। এটি বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহর পবিত্র বাণী। যা তিনি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিকট গোটা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য নাযিল করেছেন। যেন এর মাধ্যমে তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পরিচালিত করেন। তাই নিম্নে পবিত্র কুরআন মাজীদ তেলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফযীলত সমূহ সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাতের প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

কুরআন তেলাওয়াতকারী মুমিন মর্যাদায় শ্রেষ্ঠতম

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিভিন্ন সময় ছাহাবায়ে কেরামকে নানা উদাহরণের মাধ্যমে দ্বীন শিক্ষা দিতেন। যেমনটি তিনি অন্যান্য মুমিনের চাইতে কুরআন তেলাওয়াতকারী মুমিনের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার সময় শিক্ষা দিয়েছিলেন। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে মুমিন কুরআন তেলাওয়াত করে, সে হ’ল উৎরুজ্জা ফলের (কমলালেবুর) ন্যায়। ফলটি সুগন্ধিযুক্ত এবং স্বাদও উত্তম। আর যে মুমিন কুরআন তেলাওয়াত করে না, তার উদাহরণ হ’ল খেজুরের ন্যায়। যার ঘ্রাণ নেই কিন্তু সুস্বাদু। আর যে মুনাফিক কুরআন তেলাওয়াত করে, সে হ’ল রায়হানা (লতানো) ফুলের ন্যায়। যা সুগন্ধিযুক্ত, কিন্তু স্বাদ তিক্ত। যে মুনাফিক কুরআন তেলাওয়াত করে না, সে হ’ল মাকাল (লতানো লেবুজাতীয় তিক্ত) ফলের ন্যায়। যার ঘ্রাণ নেই এবং স্বাদও তিক্ত’।

কুরআন তেলাওয়াতকারীর দুনিয়াবী মর্যাদা

কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তির মর্যাদা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে বৃদ্ধি পায়। নাফে‘ বিন আব্দুল হারিছ (রাঃ) উসফান নামক স্থানে ওমর (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য গেলেন। ওমর (রাঃ) তাকে কর্মকর্তা হিসাবে মক্কায় নিযুক্ত করেছিলেন। অতঃপর তিনি নাফে‘কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি মক্কা ও ত্বায়েফের উপত্যকাবাসীদের জন্য কাকে তোমার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছ? তিনি বললেন, ইবনু আবযাকে। ওমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ ইবনু আবযা? তিনি বললেন, আমাদের আযাদকৃত গোলামদের একজন। ওমর (রাঃ) বললেন, ‘তুমি একজন ক্রীতদাসকে তাদের জন্য তোমার স্থলাভিষিক্ত করেছ?’ নাফে‘ বললেন, ‘তিনি মহান আল্লাহর কিতাবের একজন বিজ্ঞ আলেম, ফারায়েয শাস্ত্রেও অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ বিচারক’। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, তোমাদের নবী (ছাঃ) যথার্থই বলেছেন, ‘এই কিতাবের অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহ অনেক জাতিকে মর্যাদায় উন্নীত করেন এবং কুরআন পরিত্যাগকারীদের অবনত করেন’।

উক্ত হাদীছ থেকে প্রমাণিত হ’ল যে, আল্লাহ প্রেরিত কুরআনের উপর ঈমান ও আমলের বদৌলতে মানুষ উচ্চমর্যাদা লাভ করতে পারে। আর কুরআন বিমুখ হ’লে মানুষ উভয় জগতে হবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত।

প্রতি হরফে দশ নেকী

পৃথিবীর বুকে এমন কোন গ্রন্থ, মহাগ্রন্থ, ধর্মগ্রন্থ অথবা বিশ্বকোষ নেই, যার একটি হরফ বা বর্ণ পাঠ করলে ১০টি নেকী হয়, কেবল কুরআন মাজীদ ব্যতীত। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) থেকে একটি হরফ পাঠ করল তার একটি ছওয়াব হ’ল। আর একটি ছওয়াবের পরিমাণ হয় দশ গুণ। আমি বলছি না যে, আলিফ-লাম-মীম (তিনটি বর্ণ মিলে) একটি হয়ফ। বরং আলিফ একটি হরফ বা বর্ণ, লাম একটি বর্ণ এবং মীম একটি বর্ণ’। উক্ত হাদীছ থেকে প্রমাণিত হ’ল যে, কুরআন মাজীদ তেলাওয়াতের উচ্চ মর্যাদা রয়েছে। যার ফলে কুরআন থেকে একটি বর্ণ তেলাওয়াত করলে মহান আল্লাহ তাকে দশটি ছওয়াব প্রদান করেন।

একটি আয়াত তেলাওয়াতের ফযীলত

প্রতিদিন মসজিদে গিয়ে কুরআনের ১টি বা দু’টি মাত্র আয়াত শিখলে বহু নেকী লাভ হয়। যেমন উক্ববা বিন আমের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কি এমন পসন্দ করে যে, সে প্রতিদিন সকালে মদীনার ‘বুতহান’ কিংবা মক্কার ‘আক্বীক্ব’ নামক স্থানে যাবে এবং সেখান থেকে কোন অন্যায় না করে কিংবা কোন প্রকার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন না করে বড় বড় কুঁজবিশিষ্ট দু’টি উষ্ট্রী নিয়ে আসবে? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! অবশ্যই আমরা তা পসন্দ করি। তিনি বললেন, যে ব্যক্তি সকালে মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কিতাবের দু’টি আয়াত শিখে অথবা তেলাওয়াত করে, যা তার জন্য দু’টি উটনীর চেয়ে উত্তম। আর তিন আয়াত তার জন্য তিনটি উটনীর চেয়ে উত্তম এবং চার আয়াত চারটি উটনীর চেয়ে উত্তম। এমনিভাবে যত আয়াত তেলাওয়াত করবে, সেগুলি তত উটনীর চাইতে উত্তম হবে’। উপরোক্ত হাদীছ থেকে প্রমাণিত হ’ল যে, কুরআন মাজীদের প্রত্যেক আয়াত তেলাওয়াতকারীকে আল্লাহ এভাবে বিশাল প্রতিদান দিবেন।

উল্লেখ্য যে, ‘বুতহান’ নামক স্থানটি মদীনা থেকে সড়কপথে ১৮.৫ কি.মি. দূরবর্তী একটি উপত্যকা। আর ‘আক্বীক্ব’ ত্বায়েফের নিকটবর্তী একটি স্থান। যা ইরাকবাসীদের হজ্জের মীক্বাত; মক্কা থেকে উত্তর দিকে ‘যাতু ‘ইর্ক্ব’-এর সন্নিকটে ‘আক্বীক্ব’ মক্কা থেকে ৮৩.৩ কি.মি. দূরে অবস্থিত।

আসমান ও যমীনে উচ্চসম্মান অর্জন

কুরআন নিঃসন্দেহে ইহকাল ও পরকালের উচ্চসম্মান অর্জনের সোপান। ফলে কুরআন তেলাওয়াতকারীর সুনাম আসমানে ও যমীনে ছড়িয়ে পড়ে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘কুরআন তেলাওয়াতকে তুমি আবশ্যক করে নাও। কেননা এটি তোমার জন্য যমীনে আলোকবর্তিকা ও আসমানে ধনভান্ডার স্বরূপ’।

অতএব যে ব্যক্তি স্বীয় হৃদয়কে কুরআনের দিকে ও আল্লাহর দিকে পরিচালিত করবে, মহান আল্লাহ তাকে ইহকালে ও পরকালে সর্বোচ্চ মর্যাদাবান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। সেকারণ তেলাওয়াতকারীর কর্তৃত্ব ও প্রভাব তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবদিকে বিস্তৃত হয়। সুতরাং কুরআনের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে সে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে এবং তাঁর সৃষ্টির কাছে মহা সম্মানিত হয়।

গাফেলদের তালিকা থেকে মুক্তি

নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াতে ঈমান মযবূত হয়। অন্তরের মরীচা বিদূরিত হয়। এমনকি উদাসীনতার কুহক থেকে মুক্ত হয়ে সোচ্চার ও শক্তিশালী মুমিনে রূপান্তরিত হওয়া যায়। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘…আর যে ব্যক্তি রাতে একশ’টি আয়াত তেলাওয়াত করবে, গাফেলদের তালিকায় তার নাম লেখা হবে না অথবা তার নাম বিনয়ীদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে’।

তেলাওয়াতকারীর পাপ সমূহ নেকীতে পরিবর্তিত হয়

পৃথিবীর বুকে এমন কোন গ্রন্থ নেই, যা পাঠ করলে পাপসমূহ ক্ষমা করা হয় এবং তাদের কৃত পাপসমূহ নেকীতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করলে আল্লাহ তাকে যাবতীয় গোনাহ থেকে মুক্ত করবেন। কেননা আল্লাহকে স্মরণের অন্যতম মাধ্যম হ’ল কুরআন নিয়ে আলোচনা করা। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যখন কোন জনসমষ্টি আল্লাহকে স্মরণের উদ্দেশ্যে একত্রিত হয় অতঃপর পৃথক হয়, তখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা পাপ থেকে ক্ষমাকৃত অবস্থায় দন্ডায়মান হও। কেননা তোমাদের পাপকে পুণ্য দিয়ে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে’।

ঈমানী জ্যোতির বিকিরণ

জুম‘আর দিন সূরা কাহ্ফ তেলাওয়াত করলে এক জুম‘আ থেকে পরবর্তী জুম‘আ পর্যন্ত তার ঈমান শাণিত থাকে এবং এ সময়ের যাবতীয় ফিৎনা থেকে আল্লাহ তাকে হেফাযত করেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুম‘আর দিন সূরা কাহ্ফ তেলাওয়াত করে, তার ঈমানী জ্যোতির বিকিরণ থাকবে এক জুম‘আ থেকে পরবর্তী জুম‘আ পর্যন্ত’।

প্রশান্তি অবতরণ

কুরআনে আছে শান্তির বার্তা। আছে রহমত প্রাপ্তির দিশা। যেমন বারা বিন আযেব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘জনৈক ব্যক্তি সূরা কাহ্ফ তেলাওয়াত করছিল এবং তার পাশে তার ঘোড়া রশি দ্বারা বাঁধা ছিল। এমন সময় একখন্ড মেঘমালা তাকে আচ্ছন্ন করল এবং তার নিকটবর্তী হ’তে লাগল। তখন তার ঘোড়া লাফাতে লাগল। অতঃপর সে ব্যক্তি সকালে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করল। তখন তিনি বললেন, তা ছিল আল্লাহর বিশেষ রহমত ও প্রশান্তি, যা কুরআন তেলাওয়াতের কারণে নেমে এসেছিল’। উল্লেখিত হাদীছ থেকে বুঝা গেল যে, কুরআন তেলাওয়াত করলে আল্লাহর বিশেষ রহমত ও প্রশান্তি নাযিল হয়। ফেরেশতারা কুরআন তেলাওয়াত শোনার জন্য দল বেঁধে দুনিয়ায় নেমে আসেন।

আল্লাহর নৈকট্য অর্জন

প্রত্যেক কর্মী তার কর্মের বিনিময় পেয়ে থাকে। প্রত্যেক অধস্তন দায়িত্বশীল তার দায়িত্বের জন্য ঊর্ধ্বতনের কাছে দো‘আ, পারিতোষিক পেয়ে থাকেন। ঠিক অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ কুরআন তেলাওয়াতকারীদের জন্য তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের নিকট বিশেষভাবে আলোচনা করেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আর যখন কোন জনসমষ্টি আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যকার কোন ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে এবং পরস্পর তা থেকে শিক্ষা অর্জন করে, তখন ফেরেশতারা তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখে, তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল হয়, দয়া ও অনুগ্রহ তাদের আবৃত করে রাখে এবং আল্লাহর নৈকট্যশীল ফেরেশতাদের সাথে তাদের বিষয়ে আলোচনা করেন। যার আমল তাকে পিছিয়ে দেবে বংশমর্যাদা তাকে এগিয়ে দিতে পারবে না’।১০

কুরআনের ধারক জাহান্নামে যাবে না

কুরআনের ধারক-পাঠক জাহান্নামে দগ্ধীভূত হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা কুরআন পাঠ কর। আর বাড়ীতে সংরক্ষিত কুরআন যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। কেননা আল্লাহ ঐ অন্তরকে কখনোই শাস্তি দিবেন না, যা কুরআনের সংরক্ষক’।১১ তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি কুরআনকে ভালবাসে, সে যেন আনন্দিত হয়’।১২

তেলাওয়াতে সিজদার বিনিময়

পবিত্র কুরআনে ১৫টি সিজদার আয়াত আছে। যেগুলো পাঠ করলে সিজদা করতে হয়। এ সিজদার অনেক ফযীলত রয়েছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আদম সন্তান যখন সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করে সিজদায় করে, তখন শয়তান কাঁদতে কাঁদতে দূরে সরে পড়ে এবং বলতে থাকে হায়, দুর্ভাগ্য! অন্য বর্ণনায় রয়েছে হায়, আমার দুর্ভাগ্য! আদম সন্তান সিজদার জন্য আদিষ্ট হ’ল। অতঃপর সে সিজদা করল এবং এর বিনিময়ে সে জান্নাত পেল। আর আমাকে সিজদার আদেশ করা হ’ল, কিন্তু আমি তা অস্বীকার করলাম, ফলে আমার জন্য জাহান্নাম অবধারিত হ’ল’।১৩

সম্মানিত লেখক ফেরেশতাদের মর্যাদা লাভ

দক্ষ তেলাওয়াতকারী ও অদক্ষ তেলাওয়াতকারীর ভিন্ন ভিন্ন ফযীলত হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কুরআনে দক্ষ ব্যক্তি সম্মানিত পুণ্যবান লিপিকার ফেরেশতাদের সঙ্গে থাকবেন। আর যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত করে, কিন্তু আটকে যায় এবং তার জন্য তেলাওয়াত কষ্টকর হয়, তবে তার জন্য দ্বিগুণ নেকী রয়েছে’।১৪

এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, যারা দক্ষতার সাথে কুরআন তেলাওয়াত করতে সক্ষম তারা আমল লিপিবদ্ধকারী সম্মানিত ফেরেশতাদের সাথে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা অর্জন করবেন।

কুরআন শাফা‘আতকারী

পবিত্র কুরআন ক্বিয়ামতের দিন তার তেলাওয়াতকারীর জন্য আল্লাহর নিকট শাফা‘আত করবে। আবু উমামা বাহেলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা কুরআন তেলাওয়াত কর। কেননা ক্বিয়ামতের দিন তেলাওয়াতকারীদের জন্য তা শাফা‘আতকারী হিসাবে আল্লাহর নিকট উপস্থিত হবে। আর তোমরা আলোকোজ্জ্বল দুই সূরা বাক্বারাহ ও আলে ইমরান তেলাওয়াত কর। কেননা এ দু’টি ক্বিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে ছায়া দানকারী মেঘখন্ড সদৃশ ‘গামামা’ কিংবা ‘গায়ায়া’ অথবা ডানা প্রসারকারী পাখীর দু’টি ঝাঁকের ন্যায় একত্রিত হয়ে। তারা তেলাওয়াতকারীদের পক্ষে যুক্তি পেশ করবে। তোমরা সূরা বাক্বারাহ তেলাওয়াত কর। কেননা এটি তেলাওয়াতে বরকত রয়েছে এবং তা বর্জন করা আফসোসের কারণ। আর বাতিলপন্থী অলস লোকেরা এই আমল করতে সক্ষম নয়’।১৫

নাউয়াস বিন সাম‘আন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন কুরআন ও তদনুযায়ী যারা আমল করেছে তাদের উপস্থিত করা হবে। আর সূরা বাক্বারাহ ও আলে ইমরান তার সামনে পেশ করা হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ সূরা দু’টির জন্য তিনটি উদাহরণ পেশ করেছেন, যেগুলি আমি এখনও ভুলিনি। তিনি বলেন, সে দু’টি (১) মেঘখন্ডের ন্যায় (২) দু’টি কালো শামিয়ানার ন্যায়। যার মাঝে আলোকবর্তিকা রয়েছে (৩) সে দু’টি যেন ডানা বিস্তারকারী সারিবদ্ধ পাখীর দু’টি ঝাঁক। যারা তেলাওয়াত কারীদের পক্ষে দৃঢ়ভাবে যুক্তি উপস্থাপন করবে’।১৬

ছিয়াম ও কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন

ছিয়াম ও কুরআন মানুষকে সর্বদা নেকীর কাজে মশগূল রাখে। তাই ছিয়াম ও কুরআন বিশেষভাবে আল্লাহর নিকট ছায়েম ও কুরআন তেলাওয়াতকারীর জন্য ক্বিয়ামতের দিন শাফা‘আত করবে। যেমন আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ছিয়াম ও কুরআন ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট শাফা‘আত করবে। ছিয়াম বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে দিনের বেলায় খানা-পিনা ও প্রবৃত্তি পরায়ণতা হ’তে বিরত রেখেছিলাম। অতএব তার ব্যাপারে তুমি আমার শাফা‘আত কবুল কর। অন্যদিকে কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলা ঘুম থেকে বিরত রেখেছিলাম। অতএব তার ব্যাপারে তুমি আমার শাফা‘আত কবুল কর। রাসূল (ছাঃ) বলেন, অতঃপর তাদের উভয়ের শাফা‘আত কবুল করা হবে’।১৭

জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ

কুরআন মাজীদ তেলাওয়াতকারীর জন্য জান্নাতে সবের্বাচ মর্যাদা রয়েছে। কুরআনের পাঠক আয়াতসমূহ মুখস্থ রাখার সংখ্যা বরাবর জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করবেন। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘কুরআন অধ্যয়নকারীকে বলা হবে, কুরআন তেলাওয়াত কর এবং উপরে উঠতে থাকো। দুনিয়ায় তুমি যেভাবে ধীরে-সুস্থে তেলাওয়াত করতে, সেভাবে তেলাওয়াত করো। কেননা তেলাওয়াতের শেষ আয়াত সংখ্যায় জান্নাতে তোমার বাসস্থান হবে’।১৮

কুরআন মুখস্থ করার মর্যাদা

পবিত্র কুরআন মুখস্থ করা ও সেটা সংরক্ষিত রাখা চূড়ান্ত ধৈর্য ও সর্বোচ্চ স্মৃতিশক্তির কাজ। এই অসাধ্য সাধনকারীদের বিশেষ মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘কুরআনের হাফেয ও তেলাওয়াতকারীগণ সম্মানিত লেখক ফেরেশতাগণের ন্যায় উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। অতি কষ্টসাধ্য হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি সর্বদা তেলাওয়াত করে কুরআনের হিফযকে সংরক্ষিত রাখে, সে দ্বিগুণ নেকী হাছিল করবে’।১৯

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন যখন কবর সমূহ বিদীর্ণ হয়ে সবাই পুনরুত্থিত হবে, তখন কুরআন তার পাঠকের নিকট বিপর্যস্ত এক ব্যক্তির অবয়বে উপস্থিত হয়ে বলবে, ‘তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো? আমিই তোমাকে রজনীতে বিনিদ্র রেখেছি এবং দিবসে পরিশ্রান্ত করেছি। প্রত্যেক ব্যবসায়ী তার ব্যবসায় মুনাফা অর্জন করে। আর তুমিও আজ পরকালের জন্য সম্পাদিত তোমার সকল ব্যবসার পূর্ণ মুনাফা অর্জন করবে। অতঃপর তার ডান হাতে রাজত্ব প্রদান করা হবে এবং বাম হাতে এর স্থায়িত্ব দেওয়া হবে। তার মাথায় সম্মানের রাজমুকুট পরানো হবে। সেই সাথে হাফেযের পিতা-মাতাকে দুই খন্ড পোষাক পরিধান করানো হবে, যা দুনিয়ায় ইতিপূর্বে আর কারো জন্য তৈরী করা হয়নি। তখন তারা উভয়ে বলবে, এ পোষাক আমাদেরকে পরিধান করানো হ’ল কেন? তখন তাদেরকে বলা হবে, তোমাদের সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দেওয়ার প্রতিদান স্বরূপ’।২০

আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্মান

কুরআন মাজীদের প্রকৃত বাহকের মর্যাদা সর্বাধিক। তাই হাফেযে কুরআন ও আলেমের সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করা আবশ্যক। যেমন আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘বয়োজ্যেষ্ঠ মুসলিম ও কুরআনের যথাযথ বাহক, যিনি তাতে সীমালঙ্ঘনকারী ও অবহেলাকারী নন, এমন ব্যক্তিকে সম্মান করা মূলতঃ আল্লাহরই প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত’।২১

পরিশিষ্ট

যথাযথভাবে কুরআন শিক্ষা করা ও সুন্দরভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা মুমিনের জন্য যরূরী। প্রতিদিন কমপক্ষে দুই পৃষ্ঠা ও রামাযানের প্রতিদিন কমপক্ষে এক পারা কুরআন তেলাওয়াত করা কর্তব্য। যা মুখস্থ আছে তা সংরক্ষিত রাখা ও আয়াতগুলির অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করা। মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন- আমীন!


১. বুখারী হা/৫৪২৭; মুসলিম হা/৭৯৭; মিশকাত হা/২১১৪।
২. মুসলিম হা/৮১৭; ইবনু মাজাহ হা/২১৮; মিশকাত হা/২১১৫।
৩. তিরমিযী হা/২৯১০; মিশকাত হা/২১৩৭; ছহীহাহ হা/৩৩২৭।
৪. মুসলিম হা/৮০৩; মিশকাত হা/২১১০।
৫. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৬১; মিশকাত হা/৪৮৬৬; ছহীহুত তারগীব হা/১৪২২, ২২৩৩।
৬. ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১১৪২; বায়হাক্বী শো‘আব হা/২০০২; মিশকাত হা/২১৮৬; ছহীহুত তারগীব হা/৬৪০।
৭. আহমাদ হা/১২৪৭৬; মুসনাদ আবু ইয়া‘লা হা/৪১৪১; ছহীহুত তারগীব হা/১৫০৪।
৮. বায়হাক্বী, আদ-দা‘আওয়াতুল কাবীর হা/৫২৬; হাকেম হা/৩৩৯২; মিশকাত হা/২১৭৫; ছহীহুত তারগীব হা/৭৩৬।
৯. বুখারী হা/৫০১১; মুসলিম হা/৭৯৫; মিশকাত হা/২১১৭।
১০. মুসলিম হা/২৬৯৯; মিশকাত হা/২০৪।
১১. দারেমী হা/৩৩১৯, সনদ ছহীহ; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩০০৭৯।
১২. দারেমী হা/৩৩২৩, সনদ ছহীহ-হোসায়েন সালীম আসাদ।
১৩. মুসলিম হা/৮১; মিশকাত হা/৮৯৫।
১৪. বুখারী হা/৪৯৩৭; মুসলিম হা/৭৯৮; মিশকাত হা/২১১২।
১৫. মুসলিম হা/৮০৪; মিশকাত হা/২১২০।
১৬. মুসলিম হা/৮০৫; মিশকাত হা/২১২১।
১৭. বায়হাক্বী শো‘আব হা/১৯৯৪; মিশকাত হা/১৯৬৩; ছহীহুত তারগীব হা/৯৮৪।
১৮. আবুদাঊদ হা/১৪৬৪; তিরমিযী হা/২৯১৪; মিশকাত হা/২১৩৪; ছহীহাহ হা/২২৪০।
১৯. বুখারী হা/৪৯৩৭; আহমাদ হা/২৪৮৩২।
২০. ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৫৭৬৪; ছহীহাহ হা/২৮২৯।
২১. আবুদাঊদ হা/৪৮৪৩; মিশকাত হা/৪৯৭২; ছহীহুল জামে‘ হা/২১৯৯।

মূল লেখা: ইহসান ইলাহী যহীর

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button