কুরআন

কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব ও ফযীলত

কুরআন (القرآن) শব্দের অর্থ পঠিত, তেলাওয়াতকৃত। যা সবকিছুকে শামিল করে। আর কুরআনকে ‘কুরআন’ এজন্যই বলা হয় যে, তাতে শুরু-শেষ, আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান, হালাল-হারাম, প্রতিশ্রুতি-ধমক, শিক্ষণীয় ঘটনাবলী, উপদেশ, দুনিয়া ও আখেরাতের সবকিছুর ইঙ্গিত রয়েছে। আর সেইসাথে রয়েছে আয়াতগুলির একে অপরের সাথে অনন্য সমন্বয় ও সুসামঞ্জস্য। নিম্নে কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব আলোকপাত করা হ’ল।-

(ক) কুরআন শিক্ষাগ্রহণকারী ও শিক্ষাদানকারী শ্রেষ্ঠ

সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ রয়েছেন। সকল শ্রেণী ও পেশার লোকদের চাইতে কুরআন শিক্ষাগ্রহণকারী ও শিক্ষাদানকারীগণ সর্বশেষ্ঠ মানুষ হিসাবে পরিগণিত। ওছমান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ- ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে নিজে কুরআন শিখে ও অন্যকে শিখায়’। অন্য বর্ণনায় এসেছে,إِنَّ أَفْضَلَكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে কুরআন শিক্ষা করে ও অন্যকে শিখায়’। অতএব কুরআন নিয়মিত তেলাওয়াত করতে হবে এবং এর সঠিক মর্ম অনুধাবন করে তদনুযায়ী জীবন গঠন করতে হবে।

উহুদ যুদ্ধের শহীদগণের একাধিক ব্যক্তিকে একই কবরে দাফন করা হয়। আর সবের্বাচ্চ কুরআন হিফযকারীকে রাসূল (ছাঃ) আগে কবরে নামানোর নির্দেশ দিলেন। যেমন জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,كَانَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْمَعُ بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ مِنْ قَتْلَى أُحُدٍ فِى ثَوْبٍ وَاحِدٍ، ثُمَّ يَقُولُ : أَيُّهُمْ أَكْثَرُ أَخْذًا لِّلْقُرْآنِ؟ فَإِذَا أُشِيرَ لَهُ إِلَى أَحَدِهِمَا قَدَّمَهُ فِى اللَّحْدِ- ‘নবী করীম (ছাঃ) উহুদ যুদ্ধের শহীদগণের দু’জনকে একই কাপড়ে একত্রিত করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এদের মধ্যে কুরআনে অধিক বিজ্ঞ কে? যখন তাদের কোন একজনের প্রতি ইশারা করা হ’ল, তখন তিনি তাকেই আগে কবরে নামানোর নির্দেশ দিলেন’। অত্র ঘটনায় কুরআনে পারদর্শিতা অর্জনের সম্মান বর্ণিত হয়েছে। যা জীবিত ও মৃত সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য।

(খ) প্রকৃত কুরআনধারীরাই আল্লাহওয়ালা

কুরআন তেলাওয়াত করা এবং তার আয়াতগুলি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা ও সেগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহওয়ালা হওয়া যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, দুনিয়াতে মানুষের মধ্যে কতিপয় আল্লাহওয়ালা রয়েছেন। ছাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তারা আবার কারা? তিনি বলেন,أَهْلُ الْقُرْآنِ هُمْ أَهْلُ اللهِ وَخَاصَّتُهُ- ‘কুরআন ওয়ালারাই প্রকৃত আল্লাহওয়ালা এবং তাঁর নিকটতর’। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালবেসে কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করবে, স্বয়ং আল্লাহ তাকে ভালবাসেন এবং তাকে তাঁর নিকটবর্তী হিসাবে গণ্য করেন।

(গ) বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত শিক্ষার গুরুত্ব

বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা যরূরী। কুরআন তেলাওয়াতের সময় মাখরাজ সমূহ সঠিকভাবে উচ্চারণ না করলে বা তাজবীদের নিয়ম সমূহ পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ না করলে অনেক সময় আয়াতের মর্ম পরিবর্তন হয়ে যায়। যাতে পাপ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব ধীরে-সুস্থে ও বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা যরূরী। যেমন আল্লাহ বলেন, وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلاً- ‘আর কুরআন তেলাওয়াত কর ধীরে ধীরে, সৌন্দর্যমন্ডিত পন্থায়’ (মুযযাম্মিল ৭৩/৪)। তিনি আরও বলেন, وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيلاَ- ‘আর আমরা তোমার উপর পর্যায়ক্রমে সুন্দরভাবে কুরআন নাযিল করেছি’ (ফুরক্বান ২৫/৩২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,حَسِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ، فَإِنَّ الصَّوْتَ الْحَسَنَ يَزِيدُ الْقُرْآنَ حُسْنًا- ‘তোমরা তোমাদের কণ্ঠস্বরের দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্যমন্ডিত কর। কেননা সুমধুর কণ্ঠস্বর কুরআনের সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করে দেয়’।

(ঘ) কুরআনওয়ালাদের সাথে ঈর্ষা

মহাগ্রন্থ কুরআন মাজীদের বক্তব্য প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সুগভীর। একে যথাযথভাবে আয়ত্ত্বকারীগণ মহাপুরুষ। ভালো কাজের আগ্রহ থেকে তাদের প্রতি ঈর্ষা করায় কোন দোষ নেই। তবে কারো প্রতি অন্যায়ভাবে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। কেননা আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِي اثْنَيْنِ : رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ الْقُرْآنَ فَهُوَ يَقُومُ بِهِ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَهُوَ يُنْفِقُ مِنْهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ- ‘কেবল দু’টি বিষয়ে ঈর্ষা করা বৈধ- যাকে আল্লাহ কুরআনের জ্ঞান দান করেছেন, আর সে তা রাত-দিন তেলাওয়াত করে এবং সে ব্যক্তির উপর যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন। অতঃপর তাকে বৈধ পন্থায় ব্যয় করার সক্ষমতা দিয়েছেন’।

(ঙ) কুরআনের পরিপূর্ণ হেফাযত যরূরী

পবিত্র কুরআনের যথার্থ হেফাযত করতে হবে। মুখস্থকৃত সূরা বা আয়াত বারবার তেলাওয়াতের মাধ্যমে কুরআন বিস্মৃতি থেকে দূরে থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,تَعَاهَدُوا هَذَا الْقُرْآنَ، فَوَالَّذِىْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَهُوَ أَشَدُّ تَفَلُّتًا مِّنَ الإِبِلِ فِى عُقُلِهَا- ‘তোমরা কুরআনের যথাযথ হেফাযত ও সংরক্ষণ কর। সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন, অবশ্যই উট তার রশি থেকে যেমন দ্রুত পালিয়ে যায় তার চেয়েও দ্রুত বেগে এ কুরআন চলে যায়’। অর্থাৎ কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি যত্নবান না হ’লে কুরআন স্মৃতি থেকে দ্রুত হারিয়ে যাবে।

(চ) রামাযানে অধিকহারে কুরআন তেলাওয়াত

রামাযান মাসে হেরাগুহায় কুরআন নাযিলের সূচনা হয়। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, প্রতি বছর (রামাযানে) জিব্রীল (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে একবার কুরআন পাঠের পুনরাবৃত্তি করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন সে বছর তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে দু’বার কুরআন পাঠ করেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘জিব্রীল (আঃ) রামাযান শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতি রাতেই রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। তখন নবী করীম (ছাঃ) তাঁকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন’।১০ অতএব রামাযান মাসে অন্তত একবার পূর্ণ কুরআন তেলাওয়াত করে শেষ করা উত্তম।

পরিশিষ্ট

যথাযথভাবে কুরআন শিক্ষা করা ও সুন্দরভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা মুমিনের জন্য যরূরী। প্রতিদিন কমপক্ষে দুই পৃষ্ঠা ও রামাযানের প্রতিদিন কমপক্ষে এক পারা কুরআন তেলাওয়াত করা কর্তব্য। যা মুখস্থ আছে তা সংরক্ষিত রাখা ও আয়াতগুলির অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করা। মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন- আমীন!


১. দারেমী হা/৩৩৭০, সনদ হাসান; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩১৭৩৮।
২. বুখারী হা/৫০২৭; মিশকাত হা/২১০৯।
৩. বুখারী হা/৫০২৮; ইবনু মাজাহ হা/২১১।
৪. বুখারী হা/১৩৪৩; মিশকাত হা/১৬৬৫।
৫. আহমাদ হা/১২৩০১; হাকেম হা/২০৪৬; ছহীহুত তারগীব হা/১৪৩২।
৬. দারেমী হা/৩৫৪৪; আহমাদ হা/১৮৫১৭; আবুদাঊদ হা/১৪৬৮; ইবনু মাজাহ হা/১৩৪২; মিশকাত হা/২১৯৯; ছহীহুল জামে‘ হা/১৩৪৫।
৭. বুখারী হা/৭৩; মুসলিম হা/৮১৬; মিশকাত হা/২০২।
৮. বুখারী হা/৫০৩৩; মুসলিম হা/৭৯১; মিশকাত হা/২১৮৭।
৯. বুখারী হা/৪৯৯৮; মিশকাত হা/২০৯৯।
১০. বুখারী হা/১৯০২; আহমাদ হা/৩৪২৫।

মূল লেখা: ইহসান ইলাহী যহীর

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button