কুরআন

সুন্দর কুরআন পাঠের মূলমন্ত্র

সুন্দর সুরেলা কণ্ঠ ছাড়া মনকাড়া কুরআন তেলাওয়াত সম্ভব কী?

আসলে সুন্দর কণ্ঠ সুন্দর কুরআন পাঠের একমাত্র উপকরণ নয়। বরং সুন্দর কুরআন পাঠের মূল ২টি উপকরণ হল:

১) কুরআন পাঠের বিশুদ্ধতা

২) পঠিত অংশের সাথে পাঠকারীর অন্তরের সংযোগ

এর ওপর যদি কণ্ঠ সুন্দর হয়, তবে তা সোনায় সোহাগা। সেটি আল্লাহ তাআলার অপার এক অনুগ্রহ, যা তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা দান করেন।

সুতরাং আমাদের সবারই কণ্ঠস্বর অপূর্ব না হলেও আমাদের পক্ষে সুন্দর কুরআন তেলাওয়াত সম্ভব।

সুন্দর তেলাওয়াতের জন্য প্রথমেই কুরআনের হরফগুলোকে এর উচ্চারণের স্থান (মাখরাজ) ও বৈশিষ্ট্যগুলো (সিফাত) রক্ষা করে যথাযথভাবে উচ্চারণ করা শিখতে হয়। এই শিক্ষা দুটি ধাপে সম্পন্ন হয়:

প্রথম ধাপ : এ সংক্রান্ত তাত্ত্বিক জ্ঞান ‘তাজউইদ’ শাস্ত্র আয়ত্ত করা।

দ্বিতীয় ধাপ: একজন সুযোগ্য শিক্ষকের সান্নিধ্যে বারবার তেলাওয়াতের মাধ্যমে ‘তাজউইদ’ শাস্ত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগ শেখা।

উল্লিখিত প্রথম ধাপটি খু্ব কঠিন নয়। অল্প কয়েকটি ক্লাসেই ‘তাজউইদ’ শাস্ত্রের প্রয়োজনীয় মৌলিক জ্ঞান অর্জিত হতে পারে। তবে দ্বিতীয় ধাপটির জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। কেউ শিক্ষকের সান্নিধ্যে যত বেশি চর্চা করবে, তার তেলাওয়াতের বিশুদ্ধতা ততই বাড়বে।

লক্ষণীয় যে কুরআন তেলাওয়াতের বিশুদ্ধতা সুরের তুলনায় অগ্রগণ্য। এজন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্বারীদের অনেকেরই তেলাওয়াত বাড়তি সুরবিহীন, অথচ তাঁরা ক্বারীদের শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত।

বরং এ কথা বললে অতিরঞ্জন হয় না যে অনেক ক্ষেত্রে একজন ক্বারী তেলাওয়াতের বিশুদ্ধতার প্রতি সতর্কতার কারণে সুর বর্জন করে স্বাভাবিক সাবলীল তেলাওয়াত করে থাকেন।

অপরপক্ষে কেউ কেউ সুরকে প্রাধান্য দেয়ার কারণে তেলাওয়াতে অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল ডেকে এনে গুনাহগার হচ্ছেন!

তাজউইদ শাস্ত্রের মুহাক্কিক পণ্ডিত ইমাম ইবনুল জাযারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন:

“ … যেভাবে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল ঠিক সেভাবে তাজউইদ সহকারে বিশুদ্ধভাবে কুরআন পাঠকের ক্ষেত্রে এটাই আল্লাহর রীতি যে তার তেলাওয়াত শ্রবণে কর্ণ পরিতৃপ্ত হয় , তা পাঠের সময় অন্তর বিনম্র হয় – তা মনকে কেড়ে নেয়া ও অন্তরকে মোহাচ্ছন্ন করার উপক্রম হয়। এটি আল্লাহ প্রদত্ত রহস্যময় বৈশিষ্ট্যের একটি , যা তিনি বান্দাদের মধ্যে যাকে চান ন্যস্ত করেন।

আর আমরা শিক্ষকদের মধ্যে এমন কাউকে পেয়েছি যার না ছিল সুরেলা কন্ঠস্বর , না ছিল সুর–জ্ঞান , কিন্তু তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ তেলাওয়াতকারী ও শব্দের যথাযথ উচ্চারণকারী , ফলে যখন তিনি কুরআন পাঠ করতেন তা শ্রোতাকে বিমোহিত করত , মনকে সম্মোহিত করত , মানুষ তার চারদিকে ভিড় করত , তার পাঠ শুনতে সমবেত হত – বিশিষ্টজন ও জনসাধারণ, এবং গোটা মানবজাতির মধ্য হতে আরবী জানা ও না জানা লোকেরা এতে অংশ নিত – অপরপক্ষে তারা তাজউইদ ও বিশুদ্ধতা থেকে সরে আসার কারণে পরিত্যাগ করত মাকামাত ও আলহান ( ছন্দ ও সুরবিদ্যা) সম্পর্কে অবহিত সুন্দর কণ্ঠের অধিকারীদেরকে।” [আন নাশর , ১/ ২১২–২১৩]

সুতরাং তেলাওয়াতের সুর নয়, বরং বিশুদ্ধতা রক্ষা করাই প্রথম কাম্য বিষয় – যা শ্রোতাদের অন্তরে তেলাওয়াতের কাঙ্ক্ষিত প্রভাব সৃষ্টির মূলমন্ত্র।

এজন্য আল্লাহর রাসূল থেকে সাহাবীগণ হয়ে প্রাপ্ত কুরআন তেলাওয়াতের অবিচ্ছিন্ন বর্ণনাধারা বা সনদ অনুযায়ী যারা তেলাওয়াত শিক্ষা দেন এবং পরবর্তীতে প্রবিষ্ট যাবতীয় নবোদ্ভাবন যেমন সঙ্গীতের সুরের তালে কুরআন পাঠ এবং মাদ্দ ও গুন্নাহর মধ্যে ঢেউ সৃষ্টি করা জাতীয় বিষয় থেকে মুক্ত রেখে সহজ সাবলীলভাবে কুরআন পাঠ করেন ও পড়ান – তারাই কুরআনের যোগ্যতম শিক্ষক।

আরবী হরফগুলোর বিশুদ্ধতা রক্ষা করে নিয়মমাফিক কুরআন পাঠ যদি সুন্দর কুরআন পাঠের রহস্যের অর্ধেক হয়, তবে এর বাকি অর্ধেক নিহিত রয়েছে পাঠকারী কর্তৃক পঠিত অংশের অর্থ উপলব্ধির মাঝে। আসুন দেখা যাক স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন পাঠের সৌন্দর্য হিসেবে কোন বিষয়টিকে চিহ্নিত করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

ﺇِﻥَّ ﻣِﻦْ ﺃَﺣْﺴَﻦِ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﺻَﻮْﺗًﺎ ﺑِﺎﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﺇِﺫَﺍ ﺳَﻤِﻌْﺘُﻤُﻮﻩُ ﻳَﻘْﺮَﺃُ ﺣَﺴِﺒْﺘُﻤُﻮﻩُ ﻳَﺨْﺸَﻰ ﺍﻟﻠَّﻪَ

আল –কুরআন পাঠে সর্বোত্তম সুরের অধিকারী ঐ ব্যক্তি যাকে পাঠ করতে শুনলে তোমাদের মনে হয় সে আল্লাহকে ভয় করছে। [ইবনু মাজাহ ( ১৩৩৯)]

সুতরাং আল –কুরআন পাঠে সুন্দরতম কণ্ঠ ঐ ব্যক্তির ,

যে আল–কুরআনের অর্থ অনুধাবন করে আল্লাহর প্রতি ভয় –ভীতি ভালবাসা সহকারে অন্তর থেকে তা পাঠ করে।

যার অন্তরে কুরআনের পঠিত অংশের অর্থের জ্ঞান নেই , আর জীবনে কুরআনের আমল নেই – তার কুরআন পাঠে প্রকৃত আল্লাহ –ভীতি ফুটে উঠবে না – তার কণ্ঠস্বর যতই সুন্দর হোক না কেন।

এজন্য আমরা যারা চাই আমাদের তেলাওয়াত সুন্দর হোক, তাদের উচিৎ কুরআন পাঠের বিশুদ্ধতার দিকে মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি এর অর্থ অনুধাবন এবং এর বিধান অনুযায়ী আমলের প্রতি যত্নবান হওয়া।

এই সবকিছুর পর যদি কারও কণ্ঠস্বর সুন্দর হয়, তবে তা কুরআনের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলবে , তাতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

ﺯَﻳِّﻨُﻮﺍ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥَ ﺑِﺄَﺻْﻮَﺍﺗِﻜُﻢْ، ﻓَﺈِﻥَّ ﺍﻟﺼَّﻮْﺕَ ﺍﻟْﺤَﺴَﻦَ ﻳَﺰِﻳﺪُ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥَ ﺣُﺴْﻨًﺎ

তোমরা তোমাদের কণ্ঠের দ্বারা আল কুরআনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত কর , কেননা নিশ্চয়ই সুন্দর কণ্ঠ আল –কুরআনের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয়। [হাকিম ( ২১২৫) প্রমুখ]

 

– মুহাম্মাদ নাসিল শাহরুখ

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button