সচেতনতা

সন্তানের ছোট ছোট ভুলগুলো থেকে আজই শিক্ষাগ্রহণ করুন

প্রত্যেক বাবা-মায়েরই নিশ্চয়ই এরকম কিছু অভিজ্ঞতা আছে।

একদিন হঠাৎ দেখলেন, আপনার সন্তান মিথ্যে কথা বলছে। একেবারে তুচ্ছ কোনো কারণে বা কারণ ছাড়াই ও মিথ্যে বলা শিখে গেছে। কিংবা আপনি বুঝতে পারছেন, আপনার সন্তানের নামাজের দিকে কোনো মনোযোগ নেই। ঠেলে ঠেলেও তাকে ওমুখো করা যাচ্ছে না। কুরআন পড়া কিংবা হুজুরের কাছে যাওয়ার কথা উঠলেই তার পেটে ব্যথা করছে। অথবা কোনো এক রাতে অসময়ে ঘুম ভাঙায় পানি খেতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন, আপনার সন্তান যা দেখে, যা করে তা আপনি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেন নি।

ইশ, কী আফসোস তাইনা? নিজের শরীর থেকে জন্ম নেয়া প্রাণগুলো এমন করতে পারে? ভাবতেও পারেন নি কখনও। নিজের সন্তানকে সবচেয়ে সুন্দর, সফল আর ভালো একজন মানুষ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। এমনটা করতে পারে, আপনি আশা করেন নি।

বাচ্চাদেরকে ঠিক করার জন্য আমরা অনেক সময় শক্ত হই। হ্যাঁ, কখনও কখনও শক্ত হওয়াই লাগে। কিন্তু এই পর্যায়ে আসার আগেও আরো অনেকগুলো ধাপ আমরা বাবা-মায়েরা পার করে এসেছি।

সেই দিনগুলো যখন আমরা অযথাই মিথ্যে বলেছিলাম। তেমন কোনো কারণ ছাড়াই নামাজে হেলাফেলা করছিলাম৷ কুরআনটা তো আমাদের আলমারির ওপরের তাকের জন্যই বরাদ্দ হয়ে গিয়েছিল। আর টিভি, গান, নাটক-সিনেমা? ওগুলো কি ছাড়া যায়? ওসব দেখা বাদ দিতে যাব কোন দুঃখে? নাহ, অতটা কট্টোর হওয়ার কিছু নেই।

বাচ্চারা শুধু দৈহিক বা ব্যক্তিত্বের দিক থেকেই বাবা-মায়ের সাদৃশ্য পায় না। তার চরিত্রে আয়নার মতো বাবা-মায়ের চরিত্রের একটা প্রতিফলন দেখা যায়। আপনি-আমি আজ যা-যা করছি, একদিন সে আচরণগুলোই আরো বড় হয়ে আমাদের সামনে ফিরে আসবে৷

সেদিন কেউ কেউ হয়তো বুঝতেও পারবে না, ভুলের সূত্রপাতটা ঠিক কোথা থেকে হলো৷ যারা আরেকটু বুদ্ধিমান তারা বুঝতে পারবে, ভুলটা অনেক আগেই হয়েছে। আর এ ভুলের শুরু হয়েছে আমাদের থেকে। কিন্তু এই উপলব্ধিতে খুব একটা কাজ হবে না। শিক্ষা আর শাসনের রশিটা যে বহু আগেই হাত থেকে ছুটে গেছে, সেই ছোট্টবেলার ঘুড়িটাকে ধরে ফেলার আর কোনো উপায় নেই।

তাহলে আমাদের করণীয় কী? কী করে নিজেদের সন্তানকে নিরাপদ রাখব? তার চরিত্র সুন্দর হবে, সে সবার আদর্শ হবে, মিথ্যেবাদী হবে না, বাজে লোক হবে না, আল্লাহর কাজ করতে গড়িমসি করবে না– এগুলো নিশ্চিত করব কীভাবে?

উত্তর হলো, আল্লাহর ভয়। তাক্বওয়া। সন্তানদেরকে তাক্বওয়া শেখানোর মাধ্যমে। আর সেটা কীভাবে? নিজেরা তাক্বওয়ার চর্চা করে।

আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আমরা নিজেরাও আল্লাহর দাস হতে চাই না আর সন্তানদেরকেও আল্লাহর দাস বানানোর চিন্তা করি না। এই জীবনের খ্যাতি, সফলতা, টাকা-পয়সা আর প্রশংসার পিছে লেজকাটা গাধার মতো ছুটতে থাকি৷ টুকটাক কিছু দুনিয়া কামিয়ে ফেলি হয়তো, কয়েক হালি সার্টিফিকেট, কিছু প্রোমোশন, আর দুই-একটা অ্যাওয়ার্ড পেয়ে যাই ঠিকই; কিন্তু আল্লাহর চোখে আমাদের কোনো সম্মান থাকে না।

অনেক স্যুটেড-বুটেড লোকজন আছে, যাদের দেখলে আপনি ভক্তিভরে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু আপনি জানেনও না যে, সামনে দাঁড়ানো মারাত্মক সফল ছেলেটা কোনো মেয়ের গায়ে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আপনি দেখছেন মোটা অংকের চাকরি করা ভীষণ সফল মেয়েটাকে, কিন্তু আপনি বুঝতেও পারেন নি, বিয়ের আগেই মেয়েটার পেটে অবৈধ বাচ্চা এসেছিল। হ্যাঁ, এই মানুষগুলো আমাদের আশেপাশেই মিশে আছে। জাগতিক মাপকাঠিতে ভীষণরকম সফল, কিন্তু ভালো মানুষের দৃষ্টান্ত নয় মোটেও।

আপনি হয়তো ভাবছেন — না, না, আমার ছেলেমেয়েরা এমন হতেই পারে না। ওরা এরকম না। আরেকটু অন্যভাবে বলি তাহলে, আপনার মেয়েটাও তো মিথ্যে বলে। ছেলেটা বাজে ভিডিও দেখে নিজের যৌনখায়েশ মেটায়। নামাজ-রোজা-কুরআনে তাদের কোনো খেয়ালই নেই। আল্লাহর ভয় বলেই যার মনে কিছু নেই, সে গোপনে আরও কত কি করে, ভেবে দেখেছেন? আচ্ছা, আপনি কি এমন সন্তানই চেয়েছিলেন? তবু হয়ত আপনি নিজেকে স্বান্ত্বনা দিচ্ছেন, ভাবছেন, এ আর এমন কি! এগুলো তো ছোটখাট ভুল – সবাই করে। হয়তো এসব আপনার জন্যে কিছুই না। কিন্তু আল্লাহর চোখে অনেক বিশাল কিছু! যে সন্তানকে এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপনাদের এত আয়োজন, সেই সন্তানই আখিরাতের দৌড়ে ভীষণ পিছিয়ে পড়েছে। সেই দীর্ঘ লাইন অপেক্ষা করার পর গন্তব্যটা জান্নাত হবে কিনা – তার কোনো নিশ্চয়তাই আপনি দিতে পারেন নি, বরং জাহান্নাম নিশ্চিত করার মতো হাজারো উপকরণ দিয়ে দিয়েছেন অনায়াসে।

সন্তান দেয়ার মাধ্যমেও আল্লাহ তা’আলা মানুষকে একটা সুযোগ দেন। নিজেকে শুধরাবার সুযোগ। বাচ্চাদের সামনে নিজেকে আরও ভালো একজন মুসলিম হিসেবে উপস্থাপন করার সুযোগ। বাচ্চারা বাবা-মা কে দেখে শিখবে। তাই বাবা-মায়েরাও নিজেদেরকে শুধরে নেবে। সন্তানের সামনে একজন আদর্শ মানুষ হবার ইচ্ছে থেকে তারা নিজেদেরকে প্রতিনিয়ত একটু একটু করে উন্নত করার চেষ্টা করবে। নিজের ভুলগুলোর ছাপ সন্তানের মধ্যে দেখতে পাওয়ামাত্র সতর্ক হয়ে যাবে। আরো চেষ্টা করবে। হ্যাঁ, নিখুঁত হয়ে যেতে কেউই পারবে না। কিন্তু চেষ্টাটা বড় নিখুঁত হবে। বড় আন্তরিক হবে, একেবারে মন থেকে।

যে বাবা-মায়ের মনে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর ভয় থাকে, সে প্রতিনিয়ত নিজের ভুলগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করে। প্রতিনিয়ত আল্লাহর খুশিমতো চলার চেষ্টা করে। আর যে বান্দা সর্বদা আল্লাহর খুশিমতো চলার চেষ্টা করছে, তারচেয়ে ভালো আর উত্তম মানুষ আর কে হতে পারে? এমন বাবা-মায়ের ছায়া যে সন্তানের ওপর পড়ে, তার আচরণ কত সুন্দর হওয়ার কথা।

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে তাওফিক দিক, যেন রামাদান আসার আগেই আমরা এমন নিয়ত করে ফেলি যে নিজেদেরকে আল্লাহর ওয়াস্তে বদলে নেব। আল্লাহ যা হালাল করেছেন, সেটাই শুধু করব। যা হারাম করেছেন, তা কষ্ট হলেও ছেড়ে দেব। খারাপ কাজে লেগে থাকব না। গুনাহর রাস্তায় প্রশংসা খুঁজব না।

এখনও সুযোগ আছে।

নিজেদেরকে বদলাবার। সন্তানদেরকে উত্তমরূপে গড়ে তোলার। আল্লাহওয়ালা বান্দা হিসেবে গড়ে তোলার।

মা-বাবাদের বলছি, নিজের সন্তানদেরকে দেখুন। আপনি সেখানে নিজের ছায়া দেখতে পাবেন। সন্তানের ছোট ছোট ভুলগুলো থেকে আজই শিক্ষাগ্রহণ করুন। আজ যে কাজ সহজেই বদলানো যাবে, কাল সেটাই ভুলের পাহাড়ে পরিণত হবে। ওদের সামনে নিজেকে একজন আদর্শ আল্লাহর বান্দা হিসেবে উপস্থাপন করুন। চেষ্টায় লেগে থাকুন। আল্লাহ অবশ্যই এর বিনিময় দিবেন।

– Anika Tuba

মন্তব্য করুন

Back to top button