সচেতনতা

মানসিক রোগ ‘মেসিয়া কমপ্লেক্স’

Messiah Complex নামে একটি মানসিক রোগ আছে । এ রোগে ভোগা ব্যক্তি মনে করে, তাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে স্পেশাল একটা মিশন নিয়ে। আর সেই মিশন হল, পৃথিবী থেকে সব মন্দ দূর করে মানুষকে রক্ষা করা। বাংলা সিনেমার পুলিশের শেষ দৃশ্যের ডায়লগের মত, মেসিয়া কমপ্লেক্সের রোগীরা সব সময় আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চায়। অন্য কর্তৃপক্ষের উপরে সে ভরসা করেনা।

Messiah Complex চরম পর্যায়ে পৌছালে অনেকের মধ্যে বিশ্বাস জাগে ঈশ্বর তাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছে Savior হিসেবে।

নেটফ্লিক্স এর টিভি সিরিয়াল The Messiah দেখেছেন কি ? ( সাবধান- আমি সিরিয়ালটার স্পয়লার দিতে যাচ্ছি)।

সিরিয়ালের কাহিনী অনুযায়ী, পায়াম গোলশিরি নামের এক লোক সিরিয়ার যুদ্ধবিদ্ধস্ত এলাকার মাঝে দাড়িয়ে হঠাত করে নিজেকে মেসিয়া / ইমাম মেহেদি/সেভিয়ার হিসেবে দাবি করে। তার বেশ কিছু অনুসারী জুটে যায় । তাদের সহায়তায় সে ইজরাইল, মেক্সিকো, আমেরিকা সহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায় । তার অনুসারী বাড়তে থাকে। কয়েন অদৃশ্য করে দেওয়া, পানির উপর দিয়ে হাটা সহ বেশ কিছু ট্রিক দেখিয়ে জনগনকে চমৎকৃত করতে থাকে সে।

এক পর্যায়ে ডাক্তার এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা তাকে ভালভাবে এনালাইসিস করার সুযোগ পায় । তার অতীত ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, সে একটা সার্কাস পার্টির সাথে ঘুরে বেড়াত। এই কারনে অনেক ম্যাজিক ট্রিক শিখেছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়া অবস্থায় সে মেসিয়া কমপ্লেক্সে আক্রান্ত হয়। নিজেকে সে বিশ্বের সেভিয়ার হিসেবে মনে করছে তখন থেকে।

মেসিয়া কমপ্লেক্স এর মূল লক্ষনগুলার সাথে সিজোফ্রেনিয়া এবং হ্যালুসিনেশনের মিল আছে অনেক। রোগী এমন অনেক জিনিস দেখতে পায়, যা অন্য কেউ দেখে না বা ক্যামেরায় ধরা পড়ে না ( ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন)।

রোগী এমন অনেক গায়েবি আওয়াজ শুনতে পায় ,যা আর কেউ শোনে না বা রেকর্ড করা যায়না ( অডিটরি হ্যালুসিনেশন)।

এছাড়া রয়েছে ট্যাকটাইল হ্যালুসিনেশন । রোগী এমন জিনিস ফিল করে যার অস্তিত্ব নেই।

দীর্ঘদিন এইসকল হ্যালুসিনেশন হতে থাকলে, এবং রোগীর মধ্যে কোনো ভ্রান্ত বিশ্বাস দানা বাধলে যে সিচুয়েশন হয়, সেটাকে বলে সিজোফ্রেনিয়া।

জয়া আহসান আর চঞ্চল চৌধুরীর দেবী সিনেমার নায়িকা, রানুর এই ধরনের সিজোফ্রেনিয়া রোগী ছিল । সে মনে করত, তার শরীরের মধ্যে একটা দেবী ঢুকে বসে আছে। বিভিন্ন সময় সে নুপুরের শব্দ ( অডিটরি হ্যালুসিনেশন) বকুল ফুলের গন্ধ ( অলফ্যাক্টরি হ্যালুসিনেশন), জানালায় অচেনা মানুষ ( ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন) দেখত।

মনোবিদ মিসির আলি তার ভুলটা ভাঙ্গিয়ে দেয়। তাকে জানায়, রানুর শৈশবের খারাপ অভিজ্ঞতার কারনে তার এই মানসিক সমস্যা হচ্ছে। এ কারনে সে ভুলভাল জিনিস দেখছে, ভুল ধারনা নিয়ে বসে আছে।

এই সব ক্ষেত্রে, রোগী অন্ধভাবে কোনো একটা ধারনায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে । তার বিশ্বাসের বিপরীতে কোনো কথাই শুনতে চায়না। এক ধরনের ঘোরের মধ্যে থাকে সব সময়।

কেউ যদি একগুয়েভাবে ‘আমিই মেসিয়া’ ভেবে বসে থাকে,এই ধারনার সপক্ষে বিভিন্ন রকম হ্যালুসিনেশন দেখতে থাকে, এবং এর বিপক্ষে আর কোনো কথা শুনতে চায়না, তখন তাকে মেসিয়া কমপ্লেক্সের রোগী বলা যায়।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময় অনেক মেসিয়া কমপ্লেক্সের রোগী দেখা গেছে। উইকিডিয়ায় নিজেদেরকে যিশুখ্রিস্ট বলে দাবী করা ৪৪ জনের লিস্ট আছে একটা
https://en.m.wikipedia.org/…/List_of_people_claimed_to_be_j…

এছাড়া উইকিতে আরেকটা লিস্ট আছে, যারা নিজেকে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের উত্তরসূরী বলে দাবী করেছে ,

https://en.m.wikipedia.org/…/List_of_people_who_have_been_c…

তাছাড়া একটু গুগল করেই Messiah Complex এ ভুগছেন এবং এর থেকে মুক্তি পেয়েছেন এমন অনেকের লেখা পড়তে পারেন
https://www.salon.com/2013/08/02/i_thought_i_was_a_prophet/

এছাড়া, জেরুজালেম সিনড্রম নামে কাছাকাছি ধরনের আরেকটা মানসিক রোগ আছে। জেরুজালেম,মক্কা, ভ্যাটিকান,বৃন্দাবন বা এইরকম ঐতিহাসিক কোনো ধর্মীয় শহরে লোকজন ভ্রমন করে গেলে তারা এই রোগে আক্রান্ত হন। নিজেদেরকে মেসায়া ভাবা শুরু করেন।

Grandiose delusions নামে আরেক টা মানসিক রোগ আছে । এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে অনেক বড়, ধনী ,শক্তিশালী ভাবে।এ ধরণের লোক নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি,এমন কি ঈশ্বর বলেও দাবী করে থাকে।

২.

যে কোনো ধরনের দাবি ( বৈজ্ঞানিক,রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা যে কোনো ধরনের) কে ৩ ক্যাটাগরীতে ভাগ করা যেতে পারে।

ক্যাটাগরী ওয়ান, মিথ্যা দাবি
ক্যাটাগরি টু, মিস গাইডেড দাবি
ক্যাটাগরি থৃ, সত্য দাবি

একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। করোনা ভাইরাস ঠেকানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন লোক বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করছে। ক্লাস এইটের একটা বাচ্চা তার ক্লাসের বিজ্ঞান বইয়ের জ্ঞান দিয়ে যেমন ওষুধ বানানোর চেষ্টা করছে , আবার তেমনি মাল্টিমিলয়ন ডলারের প্রজেক্ট নিয়ে অনেক বড় বড় কোম্পানি চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেক কোম্পানি, ইভেন অনেক দেশ কিছু না বানিয়েই দাবি করছে, আমরা করোনার ভ্যাক্সিন বানিয়ে ফেলেছি।

এইসকল দেশ, বা প্রতিষ্ঠানকে আপনি ক্যাটাগরি ওয়ান এ ফেলতে পারেন ।

ক্লাস এইটের যে বাচ্চা, যার পৃথিবী অনেক ছোট, যে সামান্য একটু সাফল্য পেয়েই মনে করছে আমি বিরাট বড় আবিষ্কার করে ফেলেছি, তাকে আপনি ক্যাটাগরি টু তে ফেলতে পারেন। এখানে ,তার নিজের কোন দোষ নেই, তাকে সঠিকভাবে গাইড করলে, তাকে বুঝালে একদিন অনেক বড় আবিষ্কার আসবে তার হাত ধরে, আশা করা যায়।

ক্যাটাগরি ৩ এ থাকবে সেই সকল বিজ্ঞানীরা যারা আসলেই চেষ্টা করছেন এবং সাফল্যের কাছাকাছি পৌছে গেছেন।

গো-মূত্র খেলে করোনা সেরে যাবে–এমন কথা কোনো প্রাচীন বিশ্বাসের কারনে কেউ বলতেই পারে। ( ক্যাটাগরি টু, মিসগাইডেড)

কিন্তু তার ভুল শুধরে না দিয়ে কোনো ব্যবসায়ী যখন জেনেশুনে গো-মূত্র ৫০০০ টাকা লিটার দরে বিক্রি করা শুরু করে, তখন সে ক্যাটাগরি ওয়ানের প্রতারক ।

আর কেউ যদি পরীক্ষা করে প্রমান করতে পারে, যে গো-মূত্র খেলে আসলেই করোনা সারবে, তাহলে সেটা ক্যাটাগরি থৃ তে পড়বে ( তবে, এমন কিছু প্রমানিত হয়নি এখন পর্যন্ত)

( বিভিন্ন ক্যাটাগরির করোনার ভ্যাক্সিন বিস্তারিত বুঝতে এই পোস্ট ফলো করুন – https://www.facebook.com/permalink.php?story_fbid=1643467342496275&id=100004990757830)

রাজনৈতিক দাবির ক্ষেত্রেও আপনি এই ৩ ক্যাটাগরীতে ফেলতে পারেন। ”সমাজতন্ত্র কিংবা ইসলামী রাজনীতি কিংবা মুজিববাদই বাংলাদেশের জন্য বেস্ট”– যে এই কথা বলে , সে ৩ ক্যাটাগরীতেই পড়তে পারে। সে মিসগাইডেড হতে পারে, সে জেনেশুনে মিথ্যা দাবি করতে পারে, অথবা তার দাবি প্রমানিত সত্য হতে পারে।

ধর্মীয় কোনো দাবির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যে কোন দাবিকে ৩ টা ক্যাটাগরীর যে কোনো একটায় ফেলে দেওয়া যায়।

কেউ যদি দাবি করে, আমি স্বর্গীয় কোনো মেসেজ পেয়েছি, সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য কোন কোন ক্যাটাগরি হবে সেই দাবিটা ?

সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ এর লালসালু উপন্যাসটা কি পরেছেন ? বা সিনেমাটা ? গল্পের নায়ক, মজিদ এর গ্রাম এ ছিল প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ। একটা ভাল জীবনের সন্ধানে সে নিজের এলাকা ছেড়ে বহুদূরের এক গ্রামে হাজির হল। সেখানে এসে দাবি করল, তোমাদের গ্রাম এ এক পীরের মাজার বানাতে হবে। পীর সাহেব আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে আদেশ দিয়েছেন। তোমরা সুন্দর করে একটা মাজার বানাও। আমাকে মাজারের খাদেম বানাও। রেগুলার মাজারে শিন্নি দিবা, মিলাদ দিবা, তা না হলে পীর সাহেব অভিশাপ দিবেন।

জেনেশুনে মজিদ এখানে মিথ্যা কথা বলছে। তাকে ক্যাটাগরী ওয়ানে ফেলে দেওয়া যায়।

ক্যাটাগরী টু তে পড়বে দি মেসিয়াহ সিরিয়ালের পায়াম গোলশিরির মত মানুষেরা, যারা কোনোভাবে মিসগাইডেড বা ব্রেইনওয়াশড হয়েছে । এরা জেনেশুনে কোনো মিথ্যা বলছে না। এরা যা দাবি করছে, সেটাকে অন্তর থেকে সত্য জেনেই এই দাবিগুলা করছে, কিন্তু তাদের জানায় একটু ঘাটতি থেকে গেছে।

তিন নাম্বার ক্যাটাগরিতে পড়বে সেই সব মহাপুরুষেরা , যারা আসলেই কোনো আধ্যাত্মিক বার্তা পেয়েছেন ।

( বলা বাহুল্য , বর্তমান জমানাতে এমন কাউকে দেখি নাই । সবাই ক্যাটাগরি ওয়ান আর টূ এর মধ্যেই পড়ে। অতীতে হয়তো অনেক ক্যাটাগরি থৃ মহাপুরুষ ছিলেন। তবে সেটা নিয়েও বিতর্ক আছে। কিছু মানুষের কাছে যিনি ক্যাটাগরি থৃ মহাপুরুষ , অন্য অনেকের কাছে হয়তো তিনি ক্যাটাগরি টু বা ওয়ান। )

৩.

সম্প্রতি একজন বাংলাদেশী ইঞ্জিনিয়ার, মুশতাক মুহম্মদ আরমান খান মুন্না, নিজেকে ইমাম মেহেদি হিসেবে দাবি করেছেন । গত ৬ মাস ধরেই অবশ্য তিনি একের পর এক এই ধরনের ভিডিও দিয়ে যাচ্ছিলেন।

এই মুশতাক খান কোন ক্যাটাগরীর দাবী করছেন ? আসুন বোঝার চেষ্টা করি।

১। তিনি কি ক্যাটাগরি ওয়ানের লোক হতে পারেন ? জেনেশুনে মিথ্যা বলছেন ?

হ্যা, হতে পারে। মাস ছয়েক ধরেই তিনি ইউটিউবে একাধিক ভিডিও দিচ্ছেন। করোনা ভাইরাস আসলে তিনি বলেছিলেন, এটা সামান্য সর্দি জ্বর। মুসলমানদের এই করোনা আক্রমন করবে না । ( তার সেই কথা ফলেনি । প্রচুর মুসলমান মারা গিয়েছে করোনায় )।

২৯শে এপ্রিল একটি গ্রহানু পৃথিবীর কাছাকাছি এসেছিল। তিনি ভবিষ্যতবানী করেছিলেন, এই গ্রহানু পৃথিবীর কাছে এসে অনেক জোরে শব্দ তৈরি করবে , যেটা পৃথিবীর সব জায়গা থেকে শোনা যাবে।

( 1998 OR2 নামের এই গ্রহানু পৃথিবী থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকেই চলে গেছে। কোনো ধরনের শব্দ শোনা যায়নি। আসলে, পৃথিবীর বাইরে বায়ুমন্ডল নাই। শব্দ পরিবহনের জন্য বায়ু লাগবে। তাই, এ ধরনের বহির্বিশ্বের শব্দ শোনা একেবারেই অসম্ভব)

এই ভবিষ্যতবানীগুলা একটাও যখন ফলেনি, তখন তিনি ৩ মাস চুপ ছিলেন। নতুন কোনো ভিডিও দেন নি। আজ নতুন ভিডিও রিলিজ করেছেন , এবং তার না মেলা ভবিষ্যতবাণী সম্পর্কে কিছুই বলেন নি।

আগে ,তিনি তার নিজের জন্মভূমি, নেত্রকোণা নিয়ে বেশ মাতামাতি করতেন। নরসিংদীর নিউমেরিকাল ভ্যালুর সাথে মক্কা মদিনার সম্পর্ক খুজে বেড়াচ্ছিলেন । খুব বেশি মিল পাননি। বর্তমানে তিনি আবার বেশি মিল খুজে পেয়ে নিজের কর্মস্থল ‘টংগী’ কে হাইলাইট করছেন ( টঙ্গী তো আসলে কোন জেলা নয়, গাজীপুরের একটা থানা। মদিনা শহরের সাথে সমতুল্য তো হয় না ! )

এছাড়া তিনি নিজে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, লেখাপড়া করেছেন বুয়েট থেকে। ইন্টারনেট এর খুব ভাল ব্যবহার জানেন। বিশ্বের অগাধ জ্ঞানের দুয়ার তার সামনে উন্মুক্ত। ১৯৭৯ সালের কথিত ইমাম মেহেদি ‘আল কাহতানি’ এর ঘটনাও তিনি তার ভিডিওতে বলেছেন। কোনটা আসল হাদিস আর কোনটা জাল হাদিস, সবই তার জানার কথা।

সব কিছু জেনে শুনেও কি তিনি ইমাম মেহেদি হওয়ার এই দাবি করছেন ভাইরাল হওয়ার জন্য? ক্ষমতার জন্য ? নিজে একটা গ্রুপ গঠন করে নেতা হওয়ার জন্য ?

২। এবারে আসুন, তিনি কি ক্যাটাগরি টু এর লোক হতে পারেন ? তিনি কি মেসিয়াহ কমপ্লেক্স বা অন্য কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত ? কোনভাবেই ব্রেইন ওয়াশড হয়েছেন ? মিসগাইডেড হয়ে এই দাবি করছেন ?

তার ভিডিওগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, তিনি সকল ঐশি বাণী পাচ্ছেন স্বপ্নের মাধ্যমে কিংবা কাজের মধ্যে হঠাত করে। ( যেমন- রাতে খিদে লেগেছিল, আমি রান্নাঘরে গিয়ে ফুলকপির তরকারি মুখে দিলাম, তখন মাথার মধ্যে মেসেজ আসল ) স্বপ্নে তিনি যাদেরকে দেখছেন , যাদের সাথে কথা বলছেন , সেটা তার নিজের মুখ থেকেই শুনছি শুধু। তিনি লালসালুর মজিদের মত জেনেশুনে মিথ্যা বলছেন, নাকি এগুলা তার সিজোফ্রেনিক মস্তিষ্কের অংশ , বোঝার কোন উপায় নেই।

আরেকটা ইন্টারেস্টিং কথা জানিয়েছিলেন তিনি। ( ধরে নেই, এই ক্ষেত্রে তিনি সত্য বলছেন) স্বপ্নগুলা তিনি নিজে একা দেখছেন না , তার আশেপাশের কয়েকজন সহযোগীও স্বপ্ন দেখে দেখে তাকে ইমাম মেহেদি বলে ডাকছে। তাকে নের্তৃত্ব দিতে উদ্বুদ্ধ করছে ।

একজন মানসিক রোগী যদি তার নিজের বিশ্বাস আশেপাশের অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেয়, তখন সেটাকে বলে shared delusion , বিশ্বে এমন অনেক শেয়ার্ড ডেলুশনের উদাহরন রয়েছে। বাংলাদেশেই মীরপুরের ডাক্তার রিতা-ইঞ্জিনিয়ার মিতা ( যারা বাড়ির মধ্যে ৫ বছর সেলফ কোয়ারেন্টাইনে ছিল, কখনো বের হয়নি) কিংবা ময়মনসিংহের এ্যাডাম ফ্যামিলি ( বাবার কথা শুনে একসাথে ১১ জন ফ্যামিলি মেম্বর ট্রেন লাইনে সুইসাইড করেছিল ) Shared delusion এর ভাল উদাহরন।

১৯৭৯ সালে ইমাম মেহেদির দল যখন কাবা ঘর দখল করে নিল, সেই ঘটনাতেও দেখা যায় , জোহাইমান আল ওতাইবি নিজে বেশি পরিমানে ব্রেইন ওয়াশড ছিল। সে পরে আল কাহতানিকে ব্রেইন ওয়াশ করে । তাকে বুঝায় যে তুমিই ইমাম মেহেদি, তোমার মধ্যে ক্ষমতা আছে সবাইকে লিড দেওয়ার।

আমাদের দেশি ইমাম মেহেদি, মুশতাক মুহম্মদ আরমান খান কি কখনো কোনো ডাক্তার দেখিয়েছে ? মানসিক ডাক্তার ? খুব সম্ভবত , না। সে কোন শারীরিক সমস্যা হলেও ডাক্তার দেখায় না। তার ভিডিও থেকেই জানা যায়, সে নিজের ইচ্ছামত চিকিৎসা করে। ডায়রিয়া হলে পানি না খেয়ে বসে থাকে। ওরস্যালাইন বা নরমাল পানি , কিছুই খায়না । তার অনুসারীদের ও এইসব চিকিৎসা নিতে উতসাহিত করে।

এছাড়া, জেরুজালেম সিনড্রম এর কিছু লক্ষন ও আছে তার মধ্যে। ২০১৩ সালে প্রথমবার তিনি ওমরাহ করতে আসলেই তার মধ্যে এই ইমাম মেহেদি হওয়ার ফিলিংস আসে। মক্কা ছাড়া অন্য শহরে কিন্তু তার মধ্যে কোনো অনুভূতি জাগেনি।

একজন মানসিক ডাক্তার যদি তাকে ডায়াগনোজ করত, তাহলে নিশ্চিত হওয়া যেত যে সে মেসিয়া কমপ্লেক্স বা এইধরনের কোনো মানসিক রোগে ভুগছে কিনা । তবে ভিডিওতে তার ঘোর লাগা চোখের দৃষ্টি, ধীর লয়ে কথা বলা, আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে উদাসীনতা দেখে তাকে পুরাপুরি সূস্থ বলে মনে হয়না কোনোভাবেই ।

৩। এমন কি হতে পারে , মুশতাক খান ক্যাটাগরি থৃ এর মহাপুরুষ ?

বিশ্বের বিভিন্ন কোনায় মাঝে মাঝেই ইমাম মেহেদি বা এইরকম টাইটেল নিয়ে অনেকে আত্মপ্রকাশ করেন। কেউই তেমন পপুলার হন নি। অনেকের আবার খারাপ পরিনতি হয়েছে। এইতো, গত ইদের সময় পাকিস্তানে একজন ইমাম মেহেদি দাবিদারকে আদালত চত্বরে গুলি করে খুন করেছিল আরেকজন ”এ্যান্টি ইমাম মেহেদি”। তার দাবি ছিল , এই মেহেদি ভুয়া । আমি স্বপ্নে আদেশ পেয়েছি, এই ভুয়া ইমাম কে গুলি করে খুন করতে হবে ।

( সম্ভবত, দুই জনেই মানসিক রোগী ছিলেন। ডাক্তাররাই ভাল বলতে পারবেন) [ নিউজ লিংক- https://www.abc.net.au/…/pakistani-muslim-accused-…/12505756 ]

শুধু বর্তমান সময়ে নয়, অতীতে বিভিন্ন সময়েই ইমাম মেহেদি ,এমনকি নবী দাবিদার অনেকের আবির্ভাব হয়েছিল। [ দেখুন বিশাল লম্বা লিস্ট- https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_Mahdi_claimants]

তবে যারা ইমাম মেহেদি মিথ নিয়ে ব্যবসা করতে চায়, তারা এইসব ইতিহাস হাইলাইট করেনা কখনো। তারা দাবি করে , আমাদের গ্রুপের নেতাই ইমাম , তোমরা আমার দলে জয়েন করো, জিহাদ করো। তারা
কেউ অতীতের ইমাম মেহেদি দাবীদারদের নিয়ে এনালাইসিস করেনা। কেউ কখনোই বলে না, ইমাম মেহেদি সম্ভবত অতীতেই চলে এসেছেন । তোমরা হুদাই লাফাইয়ো না ।

Sacred Games টিভি সিরিয়ালে এইরকম একটা সিচুয়েশন দেখা যায়। ( সাবধান- স্পয়লার এ্যালার্ট) একটা জংগি গ্রুপ গাজওয়াতুল হিন্দ এর জিহাদ করার জন্য এ্যাটম বোমা বানাচ্ছিল । কিছু পুরনো ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী, হিন্দুস্তানে বেশ রক্তক্ষয়ী একটা যুদ্ধ হবে । তারা ২০২০ সালে সেই গাজওয়াতুল হিন্দ ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের বুঝায়, ১২০০ সেঞ্চুরিতে মুহম্মদ বিন ঘুরির ইন্ডিয়া আক্রমনের সময়েই গজওয়াতুল হিন্দ এর ঘটনাগুলো ঘটে গেছে।

বর্তমান সময়েও, ইমাম মেহেদি সম্পর্কে কনফিউশন দূর করতে ইসলামি বিশেষজ্ঞদের এগিয়ে আসা উচিত। ১৯৭৯ সালে আল কাহতানি যখন ক্বাবা ঘর দখল করে নিয়েছিল, তখন সৌদি আরবের ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি প্রথম কয়েকদিন। এ কারনে সৌদি সরকার ইমাম মেহেদির দলের উপর আক্রমন ও করতে দেরি করেছিল। ফলস্বরূপ, পবিত্র কাবা শরীফ জিম্মি ছিল ১৫ দিন।

তো, আপনার কি মনে হয়, এই লোক কোন ক্যাটাগরির লোক ?

৪.

মুশতাক খান ইমাম মেহেদি হোক আর না হোক, তিনি একজন বাংলাদেশী। সৌদি আরবে বসে তিনি যে সব দাবি করছেন, সেগুলা বেশ বিপজ্জনক। সৌদি রাজা এবং রাজপুত্র খুব দ্রুত মারা যাওয়ার ভবিষ্যতবাণী দিচ্ছেন তিনি , যেটা ওদের রাজা শুনতে পেলে হয়তো কল্লা কেটে ফেলবে । ( এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার দ্রুত তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারে)

মুশতাক খান যেভাবে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন ( মহানবী (সা) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছেন , আমি টঙ্গী থেকে মদিনায় হিজরত করেছি, মহানবী (সা) হজ্ব করতে গিয়ে বাধা পেয়েছেন, আমিও তাবলিগের ইজতেমা করতে গিয়ে বাধা পেয়েছি, মহানবীর(সা) মত আমিও ২৫ বছর বয়সে প্রথম বিয়ে করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি) তাতে মুশতাকের উপরেও কেউ ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পাওয়ার জন্য’ আঘাত করে না বসে !!! যেমনটা হয়েছে পাকিস্তানের কোর্টে ওদের লোকাল ইমাম মেহেদির উপর ।

মুশতাক খানের সাথে সাক্ষাত করার জন্য অনেকে আবার বর্ডার পার হয়ে সৌদি যাওয়ার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে ১৭ জন মিসগাইডেড জেহাদি এ্যারেস্টেড হয়েছে [https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1755026.bdnews]

মুশতাক খান কে থামানো না গেলে আরো অনেকে মিসগাইডেড হয়ে চলে যেতে পারে। বছর কয়েক আগে ইসলামিক স্টেটের আবু বকর আল বাগদাদির দাওয়াতে যেভাবে মানুষ সিরিয়া যাচ্ছিল, সেইরকম অবস্থা হতে পারে।

বিশ্বের ইতিহাসে এইরকম অনেক ইমাম মেহেদি বা কাল্ট গুরু পাওয়া যায়, যারা আমজনতাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসে তাদের দলে এবং অনেক ভাইয়োলেন্ট কাজ শুরু করে দেয়। ১৯৭৮ সালে জিম জোন্স ওয়েস্ট ইন্ডিজের জোনস টাউনে ৯১৮ জন অনুসারীকে একসাথে গন আত্মহত্যা করতে উতসাহিত করান। কারন , তার হিসাব অনুযায়ী, ওটাই ছিল মহাপ্রলয়ের মুহুর্ত । যারা ওই সময়ে মারা যাবে, তারা স্বর্গবাসী হবে। [https://en.wikipedia.org/wiki/Jonestown]

১৯৯৭ সালে Marshall Applewhite তার হেভেন্স গেট নামক সংগঠন নিয়ে আরেকটা গন-আত্মহত্যা চালান। এবার অবশ্য ক্ষয় ক্ষতি জোনসটাউনের মত হয়নি। মাত্র ৩৯ জন মারা গিয়েছিলেন। [https://en.wikipedia.org/wiki/Marshall_Applewhite]

জিম জোন্স বা এ্যাপলহোয়াইট একা নন। এই ধরনের সম্প্রদায় অনেক আছে, যারা ‘শিঘ্রই কেয়ামত হবে’ এই হাইপ তুলে বিভিন্ন ধরনের গন্ডগোল বাধায়। এই নেতাদের কে কে ক্যাটাগরি ওয়ান ( মিথ্যাবাদী) আর কে কে ক্যাটাগরি টু ( মিসগাইডেড) , তা বের করা বেশ কঠিন । সাধারনভাবে এদেরকে ডুমস ডে কাল্ট বলা হয় [https://en.wikipedia.org/wiki/Doomsday_cult]

টিভি সিরিয়াল স্যাক্রেড গেমস এর গুরুজি ও এইরকম একটা ডুমস ডে কাল্টের নেতা ছিল। এছাড়া Dangerous persuasions [https://www.imdb.com/title/tt2640962/] কিংবা ক্রাইম প্যাট্রোলেও এইরকম কয়েকটা ইতিহাস নির্ভর কাহিনি আছে । দেখতে পারেন [https://www.youtube.com/watch…]

সব মিলায়ে বেশ হ য ব র ল অবস্থা। মুশতাক খানের ক্ষেত্রে দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। আল্লাহ পাক সবাইকে হেদায়েত দান করুক ।

– Jahirul Islam

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button