সংবাদ

ইসরায়েল পশ্চিম তীরের অধিকৃত জায়গাকে স্থায়ীভাবে দখল করে নিতে যাচ্ছে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি সহজ কিন্তু শক্তিশালী নীতি আঁকড়ে আছে। সেটি হলো: কোনো দেশই, সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন তার প্রতিবেশী দেশের জমি দখল করতে পারবে না। ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনা ফকল্যান্ড দ্বীপ দখল করার পর যুক্তরাজ্য সেখানে নিজের ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে যে সেনা অভিযান চালিয়েছিল, বিশ্বের খুব কম দেশই তার বিরোধিতা করেছিল।

১৯৯০ সালে ইরাক তার প্রতিবেশী কুয়েত দখল করার পর কুয়েত থেকে ইরাকিদের বের করে দিতে জাতিসংঘ সামরিক অভিযান অনুমোদন দিয়েছিল। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার পর জাতিসংঘ রাশিয়ার ওপর বড় ধরনের অবরোধ আরোপ করেছিল যা এখনো বিদ্যমান। কোনো দেশ পাশের দেশের জমি কেড়ে নেবে এটি বিশ্ব সম্প্রদায় কখনোই মেনে নেবে না— এই আদর্শের ওপর ভর করে গত ৫৩ বছর ফিলিস্তিনিরা আশায় বুক বেঁধে ছিল।

১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ নম্বর রেজুলেশনে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি রূপরেখা ঠিক করা হয় এবং সেই রেজুলেশনেও বলা হয় ‘যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এক দেশ আরেক দেশের ভূখণ্ড কেড়ে নিতে পারবে না।’ ইসরায়েল ফিলিস্তিনির ভূখণ্ড ঘেরাও করে রাখলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এত দিন তারা সেটিকে নিজেদের জমি বলে দাবি করেনি। ফিলিস্তিনও এই আশায় এত দিন চুপ করে ছিল যে একদিন না একদিন আন্তর্জাতিক আইন মেনে অধিকৃত ভূখণ্ড ফিলিস্তিনের কাছে ইসরায়েল ফিরিয়ে দেবে।

ফকল্যান্ডবাসী, কুয়েতবাসী কিংবা ইউক্রেনীয়রা হানাদার শক্তির সঙ্গে কোনো রকম সমঝোতা করেনি। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা প্রথম থেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। সেই আস্থার প্রতিদানে ফিলিস্তিনকে অবমাননাই পেতে হয়েছে। ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকে সমান পরিমাণ ও সমান মান সম্পন্ন জমি বিনিময়ের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তাকেও ইসরায়েলের নীতি নির্ধারকেরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে। এবং এখন ইসরায়েল পশ্চিম তীরের অধিকৃত জায়গাকে স্থায়ীভাবে দখল করে নিতে যাচ্ছে।

গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প ও তাঁর ইহুদি জামাতা জ্যারেড কুশনার একটি ‘শান্তি পরিকল্পনা’ প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে ফিলিস্তিনের কাউকে রাখা হয়নি। এক তরফাভাবে পশ্চিম তীরের জমি ইসরায়েলের হাতে তুলে দেওয়ার এই ‘শান্তি পরিকল্পনা’ ইসরায়েল ‘গ্রহণ করে’ দ্রুত সেটি বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্য দিয়ে জর্ডান উপত্যকাসহ পশ্চিম তীরের ৩০ শতাংশ ভূখণ্ড ইসরায়েল নিয়ে নিচ্ছে। ট্রাম্পের আগে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলের অধিকৃত জায়গাকে স্থায়ীভাবে মানচিত্রভুক্ত করার বিষয়টি অনুমোদন দেননি। কিন্তু তিনি সেটিকে অবৈধ মনে করেন না। এমনকি তিনি ইসরায়েলে মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে আনতেও কুণ্ঠা বোধ করেননি। এখন ট্রাম্পের আশীর্বাদ ধন্য নেতানিয়াহু সরকার ফিলিস্তিন, জর্ডান কিংবা মিসরের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে পশ্চিম তীর দখল করে নিচ্ছে।

২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিড সম্মেলনে তৎকালীন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতকে সমান পরিমাণ জমি বিনিময়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি তা মেনেও নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব থেকেও সরে গেছে ইসরায়েল। সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, পশ্চিম তীরের যে জায়গা ইসরায়েল দখল করেছে তার একটা অংশ তাকে স্থায়ীভাবে দিতে হবে এবং সমপরিমাণ জায়গা ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে দেবে যা দিয়ে গাজা ও পশ্চিম তীরের মধ্যে একটা করিডর করা যেতে পারে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের বিষয়াদি নজরদারির করার কর্তৃপক্ষ কারতেত (যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, জাতিসংঘ ও রাশিয়া)-এর কাছে এ বছরই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গাজা ও পশ্চিম তীরের মধ্যে করিডর করার মতো এক খণ্ড জায়গা চেয়েছিলেন। তার সেই আবেদন নিয়ে ইসরায়েলের নীতি নির্ধারকেরা রীতিমতো তাচ্ছিল্য করেছেন।

কারতেতের বাইরে কোনো সমাধান হতে পারে কিনা সেই আশায় ফিলিস্তিন রাশিয়ার শরণাপন্ন হয়েছিল। রাশিয়া এ বিষয়ে মস্কোয় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জাপানকে নিয়ে সম্মেলনও করেছে। সেখানে ইসরায়েলকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তারা আসেনি। ফলে পুরো শান্তি আলোচনা ভেস্তে গেছে। এখন ইসরায়েলের এই নতুন আগ্রাসন দীর্ঘ মেয়াদে সেখানে রক্তক্ষয়ী লড়াই জিইয়ে রাখল।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
দাউদ কাত্তাব ফিলিস্তিনি লেখক ও প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button