মহামারী থেকে আত্মরক্ষায় বিদ‘আতী আমলের পরিণতি
ছাহাবী-তাবেঈদের যুগে অনেকবার মহামারী দেখা দিয়েছে। যেমন ১৮ হিজরীতে ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ‘ত্বাঊনে আমওয়াস’ নামে এক মহামারী ছড়িয়ে পড়লে পঁচিশ হাযার মানুষ মারা যায়। যাদের মধ্যে ছাহাবী আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ ও মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) অন্যতম। ৬৯ হিজরীতে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ)-এর শাসনামলে ছড়িয়ে পড়া জারিফ মহামারীতে মাত্র তিনদিনে বছরা নগরীর দু’লক্ষ দশ হাযার মানুষ মারা যায় (নববী, শরহ মুসলিম ১/১০৬)।
মহামারীর প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য যুগে যুগে মানুষ বহু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এমনকি অনেকসময় বিদ‘আতী আমলে লিপ্ত হ’তেও দেখা গেছে। তবে তা যে উল্টো ফলই বয়ে আনে, নিম্নোক্ত ঘটনায় তা স্পষ্টভাবে বুঝা যায়।
ঘটনাটি ৮৩৩ হিজরীর। মিসরে এসময় ভয়াবহ মহামারী দেখা দেয়। এতে মানুষের সাথে সাথে সামুদ্রিক প্রাণী, বনের পশু-পাখির মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। নীল নদে অসংখ্য কুমির ও মাছ মৃত অবস্থায় ভেসে থাকতে দেখা যায়। বন-জঙ্গলে মৃত বাঘ, হরিণ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পুরো মিসর জুড়ে জীবন বিনাশী এই মহামারী ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। এই মহামারী ছহীহ বুখারীর প্রখ্যাত ব্যাখ্যাকার হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এতে তাঁর তিন কন্যা মারা যায়। তাদের শোকে সেসময় তিনি ‘বাযলুল মাঊন ফী ফাযলিত-ত্বাঊন’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
যাইহোক ৮৩৩ হিজরী, জুমাদাল উলার প্রথম দিন বৃহস্পতিবার। এদিন কায়রোতে ঘোষণা দেওয়া হয় যে, প্রত্যেকে যেন তিনদিন ছিয়াম পালন করে এবং নিজ নিজ পাপ পরিত্যাগ করে তওবা করে। আর যালেমরা যেন যুলুম বন্ধ করে।
৪দিন পর রবিবার সবাইকে কায়রোর বাইরে মরুভূমিতে একত্রিত করা হয়। যেখানে বিচারপতি ছালেহ বালকীনী লোকদেরকে উদ্দেশ্যে নছীহত করেন। লোকেরা সেখানে বিনয় প্রদর্শন করে এবং চিৎকার করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে দো‘আ-দরূদ পাঠ করে। তারপর তারা ফিরে যায়। কিন্তু পরেরদিন দেখা যায়, মৃতের স্যংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। কেবল ইসকান্দারিয়ায় প্রতিদিন একশত মানুষ মারা যাচ্ছিল। কায়রো ও আশ-পাশের মহল্লাগুলোতে প্রতিদিন দুই সহস্রাধিক মানুষের জানাযা পড়তে হচ্ছিল। এই ভাইরাসের ভয়াবহতা দেখে চল্লিশজনের একটি দল নৌকাযোগে নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু গন্তব্যস্থানে পৌঁছার পূর্বে তাদের সকলেই মারা যায়। সে সময়ে কোন ব্যক্তি সকালে অসুস্থ হ’লে সন্ধ্যার আগেই সে মারা যাচ্ছিল। ভয়াবহতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মানুষ কাফনের কাপড়ের অভাবে তা চুরি করছিল। চারিদিকে গণকবর দেওয়া শুরু হয়েছিল।
এরই প্রেক্ষিতে ১৫ই জুমাদাল আখেরা শুক্রবার সাইয়েদ শিহাবুদ্দীন আহমাদ নামে তদানীন্তন জনৈক গভর্ণর মিসর সুলতানের নির্দেশে খুঁজে খুঁজে সাইয়েদ বংশের ৪০ জন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে সমবেত করেন। যাদের প্রত্যেকের নাম মুহাম্মাদ। তাদের প্রত্যেকের হাতে পাঁচ হাযার দিরহাম তুলে দিয়ে জামে‘ আযহারের মসজিদে বসে কুরআন তেলাওয়াত করতে বলা হয়। ফলে তারা জুম‘আর ছালাতের পর থেকে একযোগে তেলাওয়াত শুরু করেন।
এদিকে কতিপয় অনারব ব্যক্তি পরামর্শ দিলেন যে, সমবেতকণ্ঠে মুনাজাত করলে এবং আযান দিলে মহামারী উঠে যাবে। কারণ তাদের দেশে এমন মহামারী ঘটলে এরূপ সম্মিলিত আমল করা হ’লে ভাইরাস উঠে যায়। তাদের পরামর্শে গোটা নগরীর জনগণকে জামে‘ আযহারের মসজিদে সমবেত করা হয়। এরপর শুরু হয় সর্বস্তরের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জামা‘আতবদ্ধ মুনাজাত।
তারপর ঐ ৪০ জন সাইয়েদ মসজিদের ছাদে উঠে সমবেত কণ্ঠে আযান দিলেন। অতঃপর সকলে স্ব স্ব গৃহে ফিরে গেল। কিন্তু পরদিন দেখা গেল মহামারী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থেকে শুরু করে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি গভর্নর শিহাবুদ্দীন আহমাদও এতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, ‘তাদের সেই সম্মিলিত আমলের পর মহামারীর প্রাদুর্ভাব পূর্বের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছিল’। এই ভয়াবহতার পরে সুলতানের হুঁশ ফেরে। তিনি আলেমগণের নিকট ফৎওয়া জানতে চান যে, মহামারীর জন্য সম্মিলিত মুনাজাত করবে, নাকি ছালাতে কুনূতে নাযেলা পড়বে? তখন তারা পরামর্শ দেন যে, মহামারী থেকে বাঁচার পথ হ’ল, আল্লাহর নিকটে তওবা করা, বিনীতভাবে দো‘আ করা, যুলুম পরিত্যাগ করা, সৎকাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা (বিস্তারিত দ্রঃ ইবনু হাজার, ইনবাউল গুমুর বিআবাইল ঊমুর ৮/২০০-২০৪; জামালুদ্দীন ইউসুফ আতাবেগী, আন-নুজূমুয যাহেরা ফী মূলুকে মিসর ওয়াল ক্বাহেরা, ৪/১৪২-১৪৫)।
শিক্ষা : (১) যেকোন মহামারীকে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য সতর্কবার্তা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে এবং নিজ নিজ আমলকে সংশোধন করে নিতে হবে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন, মহামারীর মধ্যে মুসলমানদের আমল সংশোধনের সুযোগ রয়েছে (মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/৩৮৬৯; ছহীহুত তারগীব হা/১৪০৮)। (২) সর্বাবস্থায় বিদ‘আতী আমল থেকে দূরে থাকতে হবে। (৩) স্মরণ রাখতে হবে যে, রাসূল (ছাঃ) মহামারীকে কাফেরদের জন্য আযাব হিসাবে গণ্য করলেও মুমিনদের জন্য ‘রহমত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন (বুখারী হা/৩৪৭৪; মিশকাত হা/১৫৪৭)। আর তিনি এতে মৃত্যুবরণ কারীকে শহীদ গণ্য করেছেন (মুসলিম হা/১৯১৬)। অতএব এথেকে বাঁচার জন্য সম্ভবপর চিকিৎসা গ্রহণের পাশাপাশি আল্লাহর উপরে দৃঢ় ভরসা রাখতে হবে।
সংকলন: মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
উৎস: মাসিক আত-তাহরীক
Lovely site. Alhamdulliallah. Jazakallah Khair.
অকেন সুন্দর একটি সাইট পেলাম । আলহামদুলিল্লাহ