বিদআত ও কুসংস্কার

বিদ‘আতে হাসানার উদাহরণ : একটি পর্যালোচনা (১)

বিদ‘আতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে অনেকে এমন কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত বিষয়কে বিদ‘আতে হাসানাহর উদাহরণ হিসাবে পেশ করে, যেন প্রমাণিত হয় যে, সকল মুসলমান সর্বান্তকরণে বিদ‘আতে হাসানাহকে গ্রহণ করে নিয়েছে। এমনকি এগুলো বর্তমান সমাজের এমনই অবিচ্ছেদ্য অংশ যে, এগুলো ব্যতীত সমাজ চলতে পারে না। সুতরাং সকলেই বিদ‘আতে হাসানাহকে মেনে নিতে বাধ্য। অথচ যে সকল বিষয়কে বিদ‘আতে হাসানাহর উদাহরণ হিসাবে পেশ করা হয়ে থাকে, সেগুলো আদৌ বিদ‘আতে হাসানাহ নয়, বরং সুন্নাত। যেমন কুরআন মাজীদ সংকলন, কুরআনে হারকাত ও নুকতা সংযুক্তকরণ, কুরআন অনুবাদ, হাদীছ সংকলন, জামা‘আত সহকারে তারাবীহর ছালাত আদায়, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, পাকা মসজিদ নির্মাণ, নাহুশাস্ত্র রচনা করা, ইসলামী গ্রন্থ প্রণয়ন করা ইত্যাদি।[1] বস্ত্তত এগুলোর কোনটিই বিদ‘আত নয়। মূলতঃ এগুলোকে বিদ‘আতে হাসানাহ প্রমাণ করে এরই ছিদ্রপথে আসল বিদ‘আতগুলোকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে এরা তৎপর। যেমন মীলাদ, ক্বিয়াম, ঈদে মীলাদুন্নবী, শবে মিরাজ, শবে বরাত পালন, জায়নামাযের দো‘আ পড়া, স্বশব্দে নিয়ত পড়া ইত্যাদি। আলোচ্য নিবন্ধে কথিত বিদ‘আতে হাসানাহগুলো পর্যালোচনা হ’ল।-

ক. কুরআন সংকলন : বিদ‘আতে হাসানার উদাহরণে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়ে থাকে তাহ’ল কুরআন সংকলন।[2] এটাই সমাজে বিদ‘আত প্রতিষ্ঠিত করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। কারণ কুরআন ইসলামী শারী‘আতের মূল উৎস। সুতরাং কুরআন সংকলনকে বিদ‘আতে হাসানাহ প্রমাণ করতে পারলেই কেল্লাহ ফতেহ। ভাবখানা এই যে, গ্রন্থাবদ্ধ যে কুরআন মুসলিম উম্মাহ পড়ছে এবং এ থেকে শরী‘আতের বিধান চয়ন করছে সেটিই যদি বিদ‘আতে হাসানাহ হয়, তাহ’লে বিদ‘আতে হাসানার ছদ্মাবরণে শারী‘আতে প্রবিষ্ট মীলাদ-ক্বিয়াম, শবেবরাত, চিল্লা, চল্লিশাসহ সকল বিদ‘আত জায়েয হয়ে যাবে। এজন্যই হয়ত বিদ‘আতে হাসানার উদাহরণে সর্বপ্রথম কুরআন সংকলনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়ে থাকে। তাই বিষয়টি পর্যালোচনার দাবী রাখে।

পর্যালোচনা : কুরআন মাজীদ সংকলন বিদ‘আতে হাসানাহ বা সাইয়্যিয়াহ কোনটিই নয়। কুরআন গ্রন্থাবদ্ধ করণের ইঙ্গিত স্বয়ং মহান আল্লাহ দিয়েছেন। কারণ লাওহে মাহফূযে সংরক্ষিত কুরআন গ্রন্ধাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। আল্লাহ বলেন,إِنَّهُ لَقُرْآنٌ كَرِيْمٌ، فِيْ كِتَابٍ مَكْنُوْنٍ-  ‘নিশ্চয়ই এটি সম্মানিত কুরআন। যা ছিল সুরক্ষিত কিতাবে’ (আল-ওয়াক্বিয়া ৫৬/৭৭-৭৮)। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ বলেন, لاَ يَمَسُّهُ إِلاَّ الْمُطَهَّرُوْنَ ‘পবিত্রগণ ব্যতীত কেউ একে স্পর্শ করেনি’ (আল-ওয়াক্বিয়া ৫৬/৭৯)। উপরোক্ত আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, লাওহে মাহফূযে সংরক্ষিত কুরআন গ্রন্থাবদ্ধ থাকলে এ পৃথিবীর কুরআন গ্রন্থাবদ্ধকরণ বিদ‘আত নয়।

কুরআনের বহু আয়াতে কুরআনকে ‘কিতাব’ বলা হয়েছে। যেমন-ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ  ‘এটা সেই কিতাব যাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই’ (বাকারাহ ২/২)। অন্যত্র তিনি বলেন,مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ،  ‘আমি এ কিতাবে কোন কিছুই অলিখিত রাখিনি’ (আন‘আম ৬/৩৮)। এছাড়া আরোও অনেক আয়াতে কুরআনকে ‘কিতাব’ বলা বলা হয়েছে।[3] উল্লিখিত আয়াত সমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরআন গ্রন্থাকারে সংকলনের নির্দেশ পরোক্ষভাবে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় কুরআন অবতীর্ণের ধারা অব্যাহত ছিল বিধায় তাঁর যামানায় কুরআন গ্রন্থাবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। তবে কুরআন লিপিবদ্ধ করণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় অব্যাহত ছিল। সুতরাং তা বিদ‘আত নয়।[4]

কুরআন মাজীদ লিখে রাখার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কয়েকজন ছাহাবীকে নিযুক্ত করেছিলেন যাদেরকে ‘কাতিবে অহী’ বা অহী লেখক বলা হয়। যায়েদ বিন ছাবিত (রাঃ) ছিলেন তাঁদের মধ্য অগ্রগণ্য।[5] সে সময় মক্কায় ও মদীনায় ১৫ জন ছাহাবী অহী লেখার দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁদের কেউ অনুপস্থিত থাকলে অন্যেরা লিখতেন’।[6]

যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাঃ)-কে অহী লেখার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। বারা ইবনু আযিব (রাঃ) বলেন,لَمَّا نَزَلَتْ (لاَ يَسْتَوِى الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُجَاهِدُونَ فِى سَبِيلِ اللهِ) قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم ادْعُ لِى زَيْدًا وَلْيَجِئْ بِاللَّوْحِ وَالدَّوَاةِ وَالْكَتِفِ أَوِ الْكَتِفِ وَالدَّوَاةِ، ثُمَّ قَالَ اكْتُبْ- ‘যখন لاَ يَسْتَوِى الْقَاعِدُوْنَ…  আয়াতটি অবতীর্ণ হল তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, যায়েদকে আমার কাছে ডেকে আন এবং তাকে বল সে যেন কাষ্ঠখন্ড, দোয়াত ও কাঁধের হাড় (রাবী বলেন, অথবা তিনি বলেছেন, কাঁধের হাড় এবং দোয়াত) নিয়ে আসে। এরপর তিনি বললেন, লিখ’।[7]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চারজন ছাহাবীকে কুরআন মাজীদ সংগ্রহ বা সংকলন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন,سَأَلْتُ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ رضى الله عنه مَنْ جَمَعَ الْقُرْآنَ عَلَى عَهْدِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ أَرْبَعَةٌ كُلُّهُمْ مِنَ الأَنْصَارِ أُبَىُّ بْنُ كَعْبٍ وَمُعَاذُ بْنُ جَبَلٍ، وَزَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ، وَأَبُو زَيْدٍ- ‘আমি আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, নবী করীম (ছাঃ)-এর সময় কোন কোন ব্যক্তি কুরআন সংগ্রহ করেছেন? তিনি বললেন, চারজন এবং তাঁরা চারজনই ছিলেন আনছারী ছাহাবী। তাঁরা হ’লেন, উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ), মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ), যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাঃ) ও আবূ যায়েদ (রাঃ)।[8]

উল্লিখিত হাদীছসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পবিত্র কুরআন লিখে সংরক্ষণের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বয়ং নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাঁর যুগ থেকেই কুরআনের আয়াতসমূহ একত্রিতকরণ ও সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছিল। শেষোক্ত হাদীছে جَمَعَ الْقُرْآنَ বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ ‘কুরআন একত্রিত করা’ বা ‘সংকলন করা’। যার পূর্ণতা লাভ করেছে আবূ বকর (রাঃ) ও ওছমান (রাঃ)-এর যামানায়। সুতরাং কুরআন মাজীদ গ্রন্থাবদ্ধ করা বিদ‘আতে হাসানাহ এমন দাবী অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশে কুরআন মাজীদ লিখে সংরক্ষণের কাজ শুরু হওয়া সত্ত্বেও তা বিদ‘আতে হাসানাহ হয় কিভাবে?

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় কুরআনের সূরা সমূহ পৃথকভাবে লিখে সংরক্ষণ করা হ’লেও গ্রন্থাবদ্ধ ছিল না। বরং পরবর্তীতে গ্রন্থাবদ্ধ হয়েছে। সেকারণ কুরআন গ্রন্থাবদ্ধ করা বিদ‘আতে হাসানাহ। এমন দাবীও সঠিক নয়। কেননা যে হাদীছে বলা হয়েছে, ‘দ্বীনের মধ্যে উদ্ভাবিত প্রত্যেক নতুন কাজ বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা’, ঐ হাদীছেই বলা হয়েছে,فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، ‘তোমাদের উপরে আবশ্যক হ’ল আমার সুন্নাত ও হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা। আর তোমরা একে মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে’।[9]

উল্লিখিত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, খুলাফায়ে রাশেদার আমল বিদ‘আত নয়, বরং সুন্নাত। আর কুরআন গ্রন্থাবদ্ধ করার কাজ প্রথম খলীফা আবূ বকর ছিদ্দীক (রাঃ) ও তৃতীয় খলীফা ওছমান বিন আফফান (রাঃ) করেছেন।[10] সুতরাং তা বিদ‘আতে হাসানাহ নয়; বরং সুন্নাত।

খ. কুরআন মাজীদে নুকতা ও হরকত সংযুক্তকরণ এবং নাহুশাস্ত্র প্রণয়ন :

বিদ‘আতকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কেউ কেউ কুরআন মাজীদে নুকতা ও হরকত সংযুক্তকরণ এবং নাহুশাস্ত্র প্রণয়নকে বিদ‘আতে হাসানাহ বলে দাবী করে থাকে। এগুলো আদৌ বিদ‘আতে হাসানাহ নয়। কেননা এতে কুরআন মাজীদের মৌলিকত্ব, অর্থ, পঠন-পাঠন ও ছওয়াব লাভ কোনটিরই তারতম্য ঘটেনি।

পাঠকদের সুবিধার্থে এ মহৎ কাজগুলো করা হয়েছে মাত্র। কুরআন মাজীদে নুকতা ও হরকত সংযুক্ত করায় এমন হয়নি যে, আগে কুরআন মাজীদ যেভাবে পড়া হ’ত, এখন নুকতা ও হরকত সংযোজনের কারণে অন্যভাবে পড়া হচ্ছে। কিংবা আগে এক হরফ পাঠে দশ নেকী হ’ত, এখন এগার নেকী হচ্ছে। বিধায় এটা বিদ‘আত বা বিদ‘আতে হাসানাহ নয়।

আরো উল্লেখ্য যে, কুরআনে নুকতা ও হরকত সংযোজন ও নাহুশাস্ত্র প্রণয়নে চতুর্থ খলীফা আলী বিন আবু তালিব (রাঃ)-এর অবদান রয়েছে। বর্ণিত আছে, একদা জনৈক ব্যক্তি কুরআন মাজীদের সূরা তওবার তৃতীয় আয়াত পাঠ করার সময় أَنَّ اللهَ بَرِيءٌ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ وَرَسُوْلُهُ ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুশরিকদের থেকে দায়িত্বমুক্ত’ (তওবা ৯/৩) আয়াতে رَسُوْلُهُ-এর স্থলে ভুলক্রমে رَسُوْلِهِ পাঠ করল। এতে অর্থের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটল। অর্থাৎ তখন এর অর্থ হ’ল- ‘আল্লাহ মুশরিক ও তাঁর রাসূল থেকে দায়িত্বমুক্ত’ (নাঊযুবিল্লাহ)।

এতদশ্রবণে আবুল আসওয়াদ আদ-দুয়াইলী (রহঃ) আলী (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, এভাবে চলতে থাকলে আস্তে আস্তে কুরআন বিকৃত হয়ে যাবে। সুতরাং আমাকে অনুমতি দিলে আমি নির্ভুলভাবে কুরআন পাঠের জন্য আরবী ব্যাকরণ প্রণয়ন করতে পারি। আলী (রাঃ) তাঁকে অনুমতি দিলে আবুল আসওয়াদ আদ-দুয়াইলী (রহঃ) নাহুশাস্ত্র প্রণয়ন করেন এবং কুরআন মাজীদে নুকতা ও হরকত প্রদান করেন।[11]

সুতরাং খুলাফায়ে রাশেদার অনুমোদিত কর্মকান্ড বিদ‘আত নয়, বরং সুন্নাত। কারণ রাসূলুললাহ (ছাঃ) তাঁর ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে মাড়ির দাঁতের সাহায্যে শক্ত করে আঁকড়ে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।[12]

গ. কুরআন মাজীদের অনুবাদ : 

কুরআন মাজীদের অনুবাদ করা বিদ‘আতে হাসানাহ নয়। বরং এটা প্রত্যেক ভাষাভাষীদের জন্য কুরআন মাজীদ সহজভাবে অনুধাবনের জন্য ভাষান্তর। এ বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহর দিকনির্দেশনা রয়েছে। তিন বলেন,وَلَوْ جَعَلْنَاهُ قُرْآنًا أَعْجَمِيًّا لَقَالُوا لَوْلَا فُصِّلَتْ آيَاتُهُ أَأَعْجَمِيٌّ وَعَرَبِيٌّ ‘যদি আমরা আজমী কুরআন নাযিল করতাম, তাহ’লে ওরা বলত, যদি এই আয়াতগুলি (আমাদের ভাষায়) বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হ’ত। কি আশ্চর্য! কুরআন হ’ল আজমী অথচ রাসূল হ’লেন আরবী’! (হা-মীম সাজদা-৪৪)

অন্যত্র তিনি বলেন,وَلَوْ نَزَّلْنَاهُ عَلَى بَعْضِ الْأَعْجَمِيْنَ، فَقَرَأَهُ عَلَيْهِمْ مَا كَانُوْا بِهِ مُؤْمِنِيْنَ- ‘যদি আমরা এটা কোন অনারবের প্রতি নাযিল করতাম এবং সে ওটা তাদের নিকট পাঠ করত, তবুও তারা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করত না’ (শো‘আরা ২৬/১৯৮-১৯৯)। তিনি আরো বলেন,وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُوْلٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ  ‘আমরা স্বজাতির ভাষাভাষী ব্যতীত কোন রাসূলকে পাঠাইনি, যাতে তারা তাদের কাছে (আমার দ্বীন) ব্যাখ্যা করে দিতে পারে’  (ইবরাহীম ১৪/৪)

অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন,فَإِنَّمَا يَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِكَ لِتُبَشِّرَ بِهِ الْمُتَّقِيْنَ وَتُنْذِرَ بِهِ قَوْمًا لُدًّا ‘আমরা তো কুরআনকে তোমার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি তা দ্বারা মুত্তাক্বীদের সুসংবাদ দিতে পার এবং কলহপরায়ণ সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পার’ (মারিয়াম ১৯/৯৭)

উল্লিখিত আয়াতসমূহ দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক রাসূলকে স্বজাতির ভাষায় কিতাবসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে কিতাব বুঝতে ও তাদের জাতিকে বুঝাতে সহজ হয়। ফলে একেক কিতাব একেক ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। সকল আসমানী কিতাব আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়নি। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল মানুষের কাছে আসমানী কিতাবকে সহজবোধ্য করা। আমাদের নবী বিশ্বনবী (আম্বিয়া ২১/১০৭)। কুরআন বিশ্ববাসীর হেদায়াতের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে (তাকবীর ৮১/২৭)। কুরআন অবতরণের স্থান যেহেতু আরব। সেহেতু কুরআনকে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, অন্য ভাষায় এর অনুবাদ করা যাবে না। বরং প্রত্যেক জাতির ভাষায় কুরআন মাজীদ অনুবাদ করার ফলে কুরআন অবতীর্ণের উদ্দেশ্য পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ، ‘আর আমরা কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব কোন উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি? (ক্বামার ৫৪/২২)। অন্যত্র তিনি বলেন,أَفَلاَ يَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوْبٍ أَقْفَالُهَا- ‘তারা কি কুরআন সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করে না, নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ’? (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)

আল্লাহ আরোও বলেন,كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوْا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ، ‘এটি এক বরকতমন্ডিত কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে লোকেরা এর আয়াত সমূহ অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৯)

উপরোক্ত আয়াতগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরআন শুধু তেলাওয়াতের জন্য নাযিল হয়নি। বরং আল্লাহ কুরআন সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করতে এবং তা অনুধাবন করতে ও তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে বলেছেন। আর এসবের জন্য তা প্রত্যেক ভাষায় অনুবাদ হওয়া আবশ্যক। কোন গ্রন্থ অনূদিত হ’লে এর উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় না বরং উদ্দেশ্য পূর্ণতা লাভ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে সে দেশের স্থানীয় ভাষায় কুরআন অনুবাদ করে ইসলামের বাণী মানুষকে বুঝিয়েছেন। সুতরাং কুরআন অনুবাদের বিষয়ে মহান আল্লাহ, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের নির্দেশনা রয়েছে। বিধায় কুরআন অনুবাদ করা বিদ‘আত নয়।

ঘ. হাদীছ সংকলন :

বিদ‘আতে হাসানার অন্যতম উদাহরণ হ’ল হাদীছ সংকলন। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে হাদীছ সংকলিত হয়নি। অনুরূপভাবে খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ও ছাহাবীদের যুগেও হয়নি। ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) সর্বপ্রথম হাদীছ সংগ্রহ ও সংকলনের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।[13] গ্রন্থাকারে সর্বপ্রথম হাদীছ সংকলন হ’ল ইমাম মাকহুল শামী (রহঃ) (মৃত: ১১৬হিঃ)-এর ‘কিতাবুস সুনান’।[14] মতান্তরে ইমাম মালেক বিন আনাস (রহঃ)-এর ‘মুওয়াত্ত্বা’ গ্রন্থ।[15]

পর্যালোচনা : হাদীছ সংকলন বিদ‘আত নয়। কারণ এর পূর্ব দৃষ্টান্ত রয়েছে। বিদ‘আতের সংজ্ঞায় ইবনু হাজার  আসক্বালানী (রহঃ) বলেন,وَالْبِدْعَةُ أَصْلُهَا مَا أُحْدِثَ عَلَى غَيْرِ مِثَالٍ سَابِقٍ ‘পূর্ব নমুনা ব্যতীত কিছু আবিষ্কার করাকে বিদ‘আত বলে’।[16] ইবনু হাজার আসক্বালানী ও ইবনু রজব (রহঃ) আরোও লিখেছেন,المُحْدَثَةٍ الْمُرَادُ بِهَا مَا أُحْدِثَ وَلَيْسَ لَهُ أَصْلٌ فِي الشَّرْعِ وَيُسَمَّى فِي عُرْفِ الشَّرْعِ بِدْعَةً وَمَا كَانَ لَهُ أَصْلٌ يَدُلُّ عَلَيْهِ الشَّرْعُ فَلَيْسَ بِبِدْعَةٍ- ‘মুহদাছা দ্বারা এমন নতুন কাজ উদ্দেশ্য, শরী‘আতে যার কোন ভিত্তি নেই। শরী‘আতের পরিভাষায় তাকেই বিদ‘আত বলা হয়। আর শরী‘আতে যার ভিত্তি রয়েছে তা বিদ‘আত নয়’।[17]

হাদীছ লিখে সংরক্ষণ করার বহু দৃষ্টান্ত ইসলামী শরী‘আতে রয়েছে। বিধায় হাদীছ লেখা ও সংকলন করা বিদ‘আত নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বয়ং হাদীছ লিখার নির্দেশ দিয়েছেন। ছাহাবায়ে কেরাম হাদীছ লিখে সংরক্ষণ করেছেন। কোন কোন ছাহাবী ছহীফা তথা ছোট পুস্তিকাকারেও হাদীছ সংকলন করেছিলেন।

প্রখ্যাত ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আছ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ সমূহ লিপিবদ্ধ করতেন। তিনি বলেন, আমি নিয়মিত হাদীছ লিখতাম। কুরায়েশরা আমাকে নিষেধ করে বলে যে, তুমি সব কথা লিখ না। কেননা রাসূল (ছাঃ) একজন মানুষ। তিনি ক্রোধ ও খুশীর সময় কথা বলেন। তখন আমি লেখা বন্ধ করি এবং রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে উক্ত বিষয়টি উত্থাপন করি। তখন রাসূল (ছাঃ) বলেন, اُكْتُبْ فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ مَا يَخْرُجُ مِنْهُ إِلاَّ حَقٌّ، ‘তুমি লেখ। যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর ক্বসম করে বলছি, আমার থেকে হক্ব ব্যতীত কিছুই বের হয় না’।[18]

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, মক্কা বিজয়কালে খুযা‘আহ গোত্র লায়স গোত্রের জনৈক ব্যক্তিকে হত্যা করল। এ হত্যা ছিল তাদের এক নিহত ব্যক্তির প্রতিশোধ। এরই পেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রক্তপণ, ক্বিছাছ, মক্কার মর্যাদা, সেখানকার গাছকাটা ও কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুর বিধান সম্পর্কে ভাষণ দিলেন। তখন ইয়ামানবাসী জনৈক ব্যক্তি বলল,اُكْتُبْ لِىْ يَا رَسُوْلَ اللهِ ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এ কথাগুলো আমাকে লিখে দিন’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, اُكْتُبُوْا لأَبِىْ فُلاَنٍ ‘তোমরা অমুকের পিতাকে এটি লিখে দাও’।[19] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, اُكْتُبُوْا لأَبِىْ شَاهٍ ‘তোমরা আবু শাহকে লিখে দাও’।[20]

আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, هذا دليل صريح على جواز كتابة الحديث ‘এটি হাদীছ লিখা জায়েয সম্পর্কে সুস্পষ্ট দলীল’।[21]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্তিম শয্যায় শায়িত অবস্থায় উম্মতের জন্য তার শেষ অছিয়ত লিখে দিতে চেয়েছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অসুখ বেড়ে গেল, তখন তিনি বললেন,اُئْتُونِى بِكِتَابٍ أَكْتُبُ لَكُمْ كِتَابًا لاَ تَضَِلُّوْا بَعْدَهُ ‘আমার নিকট লেখার জন্য কিছু নিয়ে এসো, আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু বিষয় লিখে দিব, যাতে পরবর্তীতে তোমরা পথভ্রষ্ট না হও’।[22]

রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস, পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজ, মিসরের রাজা মুক্বাউক্বিস, ইয়ামামার শাসক হাওযাহ বিন আলী, বালক্বার শাসক হারেছ বিন আবু শিমর আল-গাসসানী, বাহরাইনের শাসক মুনযির বিন সাওয়া, হাবশার বাদশাহ নাজজাশী, ইয়ামানের শাসক ও হিমইয়ারী শাসকদের নিকট রাসূল (ছাঃ) পত্র মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন।[23] যেগুলো হাদীছ হিসাবে বিভিন্ন কিতাবে উল্লিখিত হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,قَيِّدُوْا الْعِلْمَ بِالْكِتَابِ ‘তোমরা লিখে ইলমকে আবদ্ধ (সংরক্ষণ) কর’।[24]

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,مَا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم أَحَدٌ أَكْثَرَ حَدِيْثًا مِنِّيْ إِلا عَبْدُ اللهِ بْنُ عَمْرٍو، فَإِنَّهُ كَانَ يَكْتُبُ- ‘রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের মধ্যে আমার চাইতে অধিক হাদীছ বর্ণনাকারী কাউকে পাইনি আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ব্যতীত। কেননা তিনি হাদীছ লিখতেন’।[25]

আলী (রাঃ)-এর নিকটও একটি ‘ছহীফা’ ছিল। আলী (রাঃ) বলেন, مَا عِنْدَنَا شَىْءٌ إِلاَّ كِتَابُ اللهِ، وَهَذِهِ الصَّحِيْفَةُ ‘আমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব ও এই ছহীফা ব্যতীত আর কিছুই নেই’।[26]

আবু তুফাইল বলেন,

سُئِلَ عَلِىٌّ أَخَصَّكُمْ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِشَىْءٍ فَقَالَ مَا خَصَّنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِشَىْءٍ لَمْ يَعُمَّ بِهِ النَّاسَ كَافَّةً إِلاَّ مَا كَانَ فِى قِرَابِ سَيْفِى هَذَا قَالَ فَأَخْرَجَ صَحِيفَةً مَكْتُوبٌ فِيهَا لَعَنَ اللهُ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ اللهِ وَلَعَنَ اللهُ مَنْ سَرَقَ مَنَارَ الأَرْضِ وَلَعَنَ اللهُ مَنْ لَعَنَ وَالِدَهُ وَلَعَنَ اللهُ مَنْ آوَى مُحْدِثًا-

‘আলী (রাঃ)-কে প্রশ্ন করা হ’ল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কি আপনাদের নিকট বিশেষভাবে কিছু বলে গেছেন? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সর্বসাধারণের কাছে প্রকাশ করেননি এমন কোন ব্যাপারে আমাদেরকে বিশেষভাবে কিছু বলে যাননি। তবে একমাত্র আমার তলোয়ারের এ খাপটিতে যা আছে তা ব্যতীত। রাবী বলেন, তারপর তিনি তার তরবারির খাপ থেকে একটি ছহীফাহ্ (লিখিত কাগজ) বের করলেন, যাতে লেখা ছিল- ‘আল্লাহ অভিসম্পাত করেন ঐ ব্যক্তিকে, যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে যবেহ করে। আল্লাহ অভিসম্পাত করেন ঐ লোককে, যে যমীনের সীমানা চিহ্নসমূহ চুরি করে। আল্লাহ অভিসম্পাত করেন ঐ ব্যক্তিকে যে তার পিতাকে অভিসম্পাত করে। আল্লাহ অভিসম্পাত করেন ঐ ব্যক্তিকে, যে কোন বিদ‘আতীকে আশ্রয় দেয়’।[27]

মুগীরা ইবনু শু‘বাহ (রাঃ) মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর নিকট হাদীছ লিখে পাঠিয়েছিলেন-

أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَقُولُ فِىْ دُبُرِ كُلِّ صَلاَةٍ مَكْتُوْبَةٍ : لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ، اللَّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلاَ مُعْطِىَ لِمَا مَنَعْتَ، وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ.

‘মুগীরাহ ইবনু শু‘বাহ (রাঃ)-এর কাতিব ওয়াররাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, মুগীরাহ ইবনু শু‘বাহ (রাঃ) আমাকে দিয়ে মু‘আবিয়াহ (রাঃ)-কে একখানা পত্র লিখালেন যে, নাবী (ছাঃ) প্রত্যেক ফরয ছালাতের পর বলতেন, এক আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, সার্বভৌমত্ব একমাত্র তাঁরই, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য, তিনি সবকিছুর উপরই ক্ষমতাশীল। হে আল্লাহ! আপনি যা প্রদান করতে চান তা রোধ করার কেউ নেই, আর আপনি যা রোধ করেন তা প্রদান করার কেউ নেই। আপনার নিকট (সৎকাজ ভিন্ন) কোন সম্পদশালীর সম্পদ উপকারে আসে না’।[28]

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় হাদীছ না লিখলেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর তিনি হাদীছ লিখে সংরক্ষণ করেছিলেন। বৃদ্ধাবস্থায় একটি ঘটনায় এমনই প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রখ্যাত তাবেঈ হাসান বিন আমর আল-জামরী (রহঃ) বলেন, আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর নিকট আমি একটি হাদীছ বর্ণনা করলাম। কিন্তু তিনি তা অস্বীকার করলেন। আমি বললাম, এটা আমি আপনার নিকট থেকেই শুনেছি। তখন তিনি বললেন, এটা যদি আমার নিকট থেকেই শুনে থাক তাহ’লে তা আমার কিতাবে লেখা রয়েছে। এ কথা বলে তিনি আমার হাত ধরে তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন এবং আমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ লেখা অনেকগুলো খাতা দেখালেন, তাতে ঐ হাদীছটিও পাওয়া গেল। অতঃপর তিনি বললেন, আমি কি তোমাকে বলিনি যে, যদি ওটা আমিই বলে থাকি তাহ’লে তা আমার খাতায় লেখা রয়েছে’?[29]

ইবনু আব্দিল বার্র (রহঃ) বলেন, আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগে হাদীছ লিখতেন না, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি হাদীছ লিখে সংরক্ষণ করেছিলেন।[30]

আবু হুরায়রা (রাঃ) তাঁর ছাত্রদেরকে হাদীছ লিখে সংরক্ষণ করার জন্য অনুমতি দিতেন। তাবেঈ বিদ্বান বাশীর ইবনু নাহীক বলেন,كُنْتُ أَكْتُبُ مَا أَسْمَعُ مِنْ أَبِى هُرَيْرَةَ، فَلَمَّا أَرَدْتُ أَنْ أُفَارِقَهَ أَتَيْتُهُ بِكِتَابِهِ فَقَرَأْتُهُ عَلَيْهِ وَقُلْتُ لَهُ : هَذَا مَا سَمِعْتُ مِنْكَ؟ قَالَ : نَعَمْ. ‘আমি আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে যে সকল হাদীছ শুনতাম তা লিখে নিতাম। যখন আমি তাঁর থেকে বিদায় গ্রহণ করতে ইচ্ছে করতাম তখন সে সকল লেখা তাঁর নিকট উপস্থিত করতাম। অতঃপর আমি তা তাঁকে পড়ে শুনাতাম এবং বলতাম, এটা আমি আপনার নিকট থেকে শুনেছি। তখন তিনি বলতেন, হ্যাঁ, ঠিক আছে’।[31]

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) তাঁর সন্তানদেরকে হাদীছ লিখে রাখার জন্য তাকীদ দিয়েছেন। তাঁর পৌত্র ছুমামা বিন আব্দুল্লাহ বলেন,أَنَّ أَنَساً كَانَ يَقُوْلُ لِبَنِيهِ : يَا بَنِىَّ قَيِّدُوْا هَذَا الْعِلْمَ بِالْكِتَابِ. ‘আনাস (রাঃ) তাঁর সন্তানদের বলতেন, হে আমার সন্তানগণ! এই ইলম তথা হাদীছকে তোমরা লিপিবদ্ধ করে রাখ’।[32]

তাবেঈ সালমান ইবনু ক্বায়েস ইয়াস্কুরী (রহঃ) হযরত জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে শ্রুত হাদীছসমূহ লিখে নিয়েছিলেন। যা ‘ছহীফায়ে জাবির’ নামে খ্যাত।

ইমাম শা‘বী সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ)-এর স্মরণ শক্তির তা‘রীফ করে বলেন,قريء عليه صحيفة جابر مرة واحدة فحفظها ‘তাঁর নিকট ছহীফায়ে জাবির একবার মাত্র পড়া হ’লে তিনি মুখস্থ করে ফেললেন।[33]

উল্লিখিত হাদীছ ও আছারসমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, হাদীছ সংকলন বিদ‘আত নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ হাদীছ লিখার নির্দেশ দিয়েছেন, হাদীছ লিখে ইয়ামানবাসীর জন্য প্রেরণ করেছেন, তাঁর অন্তিম শয্যায়ও হাদীছ লিখে দিতে চেয়েছিলেন, হাদীছ লিখে সংরক্ষণের জন্য অনুমতি দিয়েছেন, ছাহাবীগণ হাদীছের ছহীফা লিখেছেন। সুতরাং হাদীছ সংকলনকে বিদ‘আতে হাসানাহ বলে প্রচার করা চরম মিথ্যাচার, প্রতারণা ও নিজেদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস মাত্র।

(চলবে)

– ক্বামারুয্যামান বিন আব্দুল বারী
মুহাদ্দিছ, বেলটিয়া কামিল মাদরাসা, জামালপুর।


[1]. মুহাম্মাদ জাফরুল্লাহ, বিদ‘আত: একটি পর্যালোচনা (প্রবন্ধ), ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা জুলাই-সেপ্টেম্বর/২০১১, পৃঃ ৯৩-৯৪। 

[2]. বিদ‘আত : একটি পর্যালোচনা, পৃঃ ৯৩।

[3]. বাক্বারাহ ২/১৭৬; আলে ইমরান ৩/৭; নিসা ৪/৪, ১১৩; আন‘আম ৬/১১৪; আ‘রাফ ৭/১৯৬; মুমিন ৪০/২; সাজদা ৩২/২; আম্বিয়া ২১/১০; কাহফ ১৮/১; যুমার ৩৯/৪১; শূরা ৪২/১৭; নাহল১৬/১৬।

[4]. মু’জামু মাক্বায়িসুল লুগাহ ১/২০৩; ফাতহুল বারী ১৩/২৫৩। 

[5]. বুখারী হা/৪৬৭৯, ৪৯৮৬, ‘তাফসীর ও কুরআন মাজীদের ফযীলত’ অধ্যায়। 

[6]. ফাতহুল বারী হা/৪৯৯০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য, ৯/২২ পৃঃ। 

[7]. বুখারী হা/৪৯৯০ ‘কুরআন মাজীদের ফযীলত’ অধ্যায়। 

[8]. বুখারী হা/৫০০৩ ও ৫০০৪, ‘কুরআনের ফযীলত’ অধ্যায়; মুসলিম হা/২৪৬৫; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৭১৩০।  

[9]. আবূদাঊদ হা/৪৬০৭; তিরমিযী হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৪২; মিশকাত হা/১৬৫, সনদ ছহীহ।

[10]বুখারী হা/৪৯৮৬ ও ৪৯৮৭, ‘কুরআনের ফযীলত’ অধ্যায়। 

[11]. তাযকিরাতুল হুফফায ১/৬০ পৃঃ। 

[12]. আবূদাঊদ হা/৪৬০৭; তিরমিযী হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৪২ সনদ ছহীহ। 

[13]. বুখারী, তা‘লীক হা/১০০। 

[14]. ইবনে নাদীম, কিতাবুল ফিহরিস্ত, পৃঃ ৩১৫। 

[15]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফৎহুলবারী ১/৬ পৃঃ। 

[16]. ফাতহুল বারী ১৩/২৫৩ পৃঃ; অনুরূপ কথা বলেছেন, ইবনু ফারেস, মাক্বায়িসুল লুগাহ ১/২০৩; আল-মুনজিদ, পৃঃ ২৯। 

[17]. ফাতহুল বারী ১৩/২৫৩ পৃঃ; জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/২৫২ পৃঃ। 

[18]. আহমাদ হা/৬৫১০; আবূদাঊদ হা/৩৬৪৬; ছহীহাহ হা/১৫৩২।

[19]. বুখারী, ‘ইলম’ অধ্যায়, হা/১১২। 

[20]. বুখারী হা/২৪৩৪, ৬৮৮০‘পড়ে থাকা বসুত উঠিয়ে নেয়া’ অধ্যায়; মুসলিম হা/১৩৫৫; আবূদাঊদ হা/২০১৭; তিরমিযী হা/২৬৬৭। 

[21]. তুহফাতুল আহওয়াযী, ৭/৭৯ পৃঃ। 

[22]. বুখারী হা/১১৪, ৩০৫৩, ৩১৬৮, ৪৪৩১, ৪৪৩২, ৫৬৬৯, ৭৩৬৬। 

[23]. বুখারী হা/৭, ৪৪২৪; মুসলিম হা/১৭৭৩। 

[24]. দারেমী হা/৪৯৭; ছহীহাহ হা/২০২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৪৩৪। 

[25]. বুখারী হা/১১৩ ‘ইলম’ অধ্যায়। 

[26]. বুখারী হা/১৮৭০; ‘মদীনার ফযীলত’ অধ্যায়; মুসলিম হা/১৩৭০।  

[27]. মুসলিম হা/১৯৭৮, ‘কুরবানী’ অধ্যায়, ‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারোর নামে যবেহ হারাম’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ আদাবুল মুফরাদ হা/১৩। 

[28]. বুখারী ‘আযান’ অধ্যায় ‘ছালাতের পর যিকির’ অনুচ্ছেদ হা/৮৪৪। 

[29]. জামি‘ বায়ানিল ইলম, পৃঃ ৬৪; ফাৎহুল বারী ১/২৫২। 

[30]. ফাৎহুল বারী ১/২৫২। 

[31]. দারেমী ১/১২৭ পৃঃ; আল-মুআল্লামী, আনওয়ারুল কাশিফা, পৃঃ ৪২, বর্ণনাটি নির্ভরযোগ্য। 

[32]. দারেমী ১/১২৬ পৃঃ; নাছিরুদ্দীন আলবানী, আল-ইলমু লিআবী খায়ছামা, পৃঃ ১২০; মাওকূফ হিসাবে হাদীছটি ছহীহ। 

[33]. শামসুদ্দীন আয-যাহাবী (রহঃ), ‘তাযকিরাতুল হুফফায (বৈরূত: দারুল মা‘রিফাহ) ১/১০৪ পৃঃ; তাদবীনে হাদীছ পৃঃ ৬৮।

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button