সচেতনতা

জোরে বলেন ঠিক কি-না!

শীতকালে আমাদের দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের একটা ধুম পড়ে যায়। বিয়ে, গায়ে হলুদ, পিকনিক, শিক্ষাভ্রমন ইত্যাদি। আর এই অনুষ্ঠানগুলোর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ গান-বাজনা, ডিজে পার্টি। আর এতে যে মাইক লাগানো হয় তার শব্দ শুধু উপস্থিত আগ্রহী মানুষ নয়, বরং এর বাইরেও অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ সময়ে এই মাইকগুলো বা সাউন্ডবক্সগুলোতে কথা স্পষ্ট বোঝা যায় না, বরং চিৎকার শুনতে পাওয়া যায়।

শব্দ দূষণ যে শুধু বিয়ের অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ, কনসার্ট কিংবা পিকনিক থেকেই হয় তা নয়, ওয়াজ-মাহফিলের ক্ষেত্রেও দেখা যায় লাউডস্পিকারে কিংবা মাইকের ভলিউম বাড়িয়ে যতদূর শব্দ পৌছানো যায় তার একটা প্রবনতা থাকে। চেষ্টাটা এমন যে মানুষকে বাধ্য করা হবে ‘ভালো কথা’ শোনানোর জন্য। অথচ এই কথাগুলো শোনার মতো অবস্থা না থাকায় অনেকে আগ্রহী হবার বদলে ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে যান। কারণ, কাউকে জোর করে কিছু শোনানো যায় না। এই মাইকের শব্দ দূষণে অসুস্থ মানুষ, শিশু, ঘরে বসে ইবাদাতকারী – সবারই অসুবিধা হয়। সর্বোপরি প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়া হয়। তাদের দৈহিক এবং মানসিক ক্ষতি করা হয়। লাউড স্পিকার ও মাইকের মাধ্যমে শব্দ দূষণের মাত্রা ১১০ ডেসিবল ছাড়িয়ে যায়।

অতিরিক্ত শব্দ উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, মাথা ধরা, বদহজম, পেপটিক আলসার এবং অনিদ্রার কারণ ঘটায়। যে কোনও স্থানে আধাঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে মাইকে ১০০ মাত্রার শব্দ দূষণের মধ্যে কাউকে থাকতে হলে তাকে সাময়িক বধিরতার শিকার হতে হবে।

দীর্ঘদিন উচ্চ শব্দের মধ্যে কাজ করলে যে কেউ বধির হয়ে যেতে পারে। যে কোনও ধরনের শব্দ দূষণ সন্তানসম্ভবা মায়ের জন্য গুরুতর ক্ষতির কারণ। পরীক্ষায় দেখা গেছে লস এঞ্জেল্স, হিথরো এবং ওসাকার মতো বড় বিমানবন্দরের নিকটবর্তী বসবাসকারী গর্ভবতী মায়েরা অন্য জায়গার চাইতে বেশি সংখ্যক পঙ্গু, প্রতিবন্ধী ও অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেয়।

একদিন মাসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুনলেন কিছু মানুষ বেশ জোরে জোরে কুরআন পড়ছে। তিনি পর্দা সরিয়ে লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা তোমাদের রবের সাথে নিভৃতে কথা বলছ। সুতরাং, তোমরা অন্যকে কষ্ট দিও না। একজনের স্বরের ওপরে অন্যজন গলা চড়িয়ো না; সেটা কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রেই হোক আর সলাতে হোক। [আবু দাউদ, ১৩৩২]

লক্ষ্যণীয়, যে কাজটি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো কাজের একটি সেই কুরআন পড়াও যদি অন্য মানুষের অসুবিধা এবং বিরক্তির কারণ হয় তবে তা নিষিদ্ধ।

১৯৯৭ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবল এবং রাতে ৪০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবল ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবল ও রাতে ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবল ও রাতে ৭০ ডেসিবলের মধ্যে শব্দের মাত্রা থাকা বাঞ্ছনীয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬ এর ২৫, ২৭, ২৮ ধারামতে শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে অর্থদন্ড ও কারাদন্ড উভয়েরই বিধান রয়েছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে এ আইনগুলোর প্রয়োগ নেই।

উম্মুল মু’মিনীন আইশা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা মসজিদে নববীর আশপাশে কোন বাড়ির দেয়ালে পেরেক বা এ জাতীয় কিছু পোতার সময় আওয়াজ ঘরে পৌঁছালে কাউকে দিয়ে বলে পাঠাতেন যে, এভাবে পেরেক পোতার আওয়াজ দ্বারা যেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট না দেয়।

এমনকি একদিন আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নিজের ঘরের কপাট বানাচ্ছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল মদীনার বাইরে গিয়ে কপাট তৈরি করতে যাতে এই আওয়াজ যেন মসজিদে নববীতে না আসে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যেন কষ্ট না হয়।

আবূ মূসা আল আশ্‘আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক সফরে আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। লোকেরা তখন উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর বলছিল। (তাকবীর শুনে) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে লোকেরা! তোমরা তোমাদের নাফসের উপর রহম করো। কেননা তোমরা তাকবীরের মাধ্যমে কোন বধিরকে বা কোন অনুপস্থিত সত্তাকে ডাকছ না, তোমরা ডাকছ এমন সত্তাকে যিনি তোমাদের সব কথা শুনেন ও দেখেন। [বুখারী ৪২০৫, মুসলিম ২৭০৪]

আমরা সবাই যদি সচেতন হই – মাইক, লাউডস্পিকার এবং হর্ন ব্যবহারে সতর্ক হই তবে সেটা মানুষের জন্য যেমন ইহসান হবে, তেমনি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণেরও নিকটবর্তী হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বোঝার তাওফিক দিন।

– সরোবর

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button