দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরীক্ষাকালীন কিছু চিত্র
ক্লাস এইটের কথা। আমাদের বৃত্তি পরীক্ষার সেন্টার কাউনিয়ায় ছিল।আমাদের মাদরাসার পরীক্ষার স্বীকৃতি তখন পযন্ত হয়নি। তাই নিজপাড়া মাদরাসা থেকে আমাদের রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল। সম্ভবত পরীক্ষার্থী আমি আর কামাল ছিলাম কাছাকাছি। পরীক্ষার হলে আমাদের সাথে পরেছিল ধোমেরকুটি ফাজিল মাদরাসার ছাত্রীরা। আমাদের প্রস্তুতি একেবারে খারাপ ছিল না। আমরা প্রশ্ন পেয়েই কোন দিকে না তাকিয়ে আমাদের মত করে লিখতে থাকি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে চাচ্ছিলাম না কোন ধরণের কথা বলি। শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে আমি আমার মত করে পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিলাম। কামাল আর আমার এমন ভাবখানা দেখে পাশের শিক্ষার্থী দুজন আমাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের বিভিন্ন অজুহাত খুঁজছিল। পাশের জন অসহায় ভাব নিয়ে আমাকে ভাইয়া সম্বোধন করে সম্পর্ক তৈরীর চেষ্টা করতে লাগল। এরপর মায়াবী কন্ঠ প্রয়োগে বিভিন্ন কথাদিয়ে আমার সাথে ভাবজমানোর চেষ্টা করল; যেন কতই না কল্যাণকামী। মতলব, আমি যেন পরীক্ষায় সাহায্য করি…. কিন্তু চাওয়া মত সফল হতে পারে নি।
একসময় একজন মৌলভী সাহেব পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে বেশ উচ্চস্বরে আদবের সাথে এক মুমিন অন্য মুমিনকে সাহায্য করা প্রসঙ্গে একাধিক হাদীস আবৃত্তি করলেন- শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে। এর খুতবার মত অনুবাদ করে বুঝাতে লাগলেন পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের পরস্পরে সাহায্য করার কত বহুত ফযীলত! আমার পাশের জনের মুখে হাসি ফুটে উঠল, তার চোখ যেন চকচকিয়ে উঠল আমার খাতা দেখার লোভে। আমার সাথে কথা বলার যেন অকাট্য দলীল পেয়ে গেল। ভাবখানা এমন, ‘এবার তো দেখতে পারি তাইনা! হুজুর কতইনা কল্যাণকামী লোক। তিনি কতই মহৎ, দয়ালু ও পণ্ডিত লোক। তিনি ১৪০০ বছর আগের রাসূল (সা)-এর পরীক্ষার হল কেন্দ্রিক কথাকে সফল ইজহিতহাদের মাধ্যমে আমাদের জন্য পেশ করেছেন।’ …হুজুরের এমন কথা শুনে আমার শরীরের সর্বত্র যেন রাগের ঢেউ খেলে গেল। হুজুর সাহেব বললটা কী? উনি গরুর বাছুরকে ছাগলের ওলানে লাগালো। মনে হচ্ছিল ওনাকে রিমান্ডে নিয়ে হাদীসের ব্যাখ্যাসহ খুঁটি নাটি সব জিজ্ঞেস করি। ওনার ভূলটা ধরিয়ে দেই। কারণ আমাদেরকে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে পরীক্ষার হলে দেখতে ও দেখাতে নিষেধ করা হয়েছে। এটা সন্দেহাতীত চুরি..।
বর্তমান পরীক্ষার সেন্টারগুলোর দশা অত্যন্ত করুণ। পরীক্ষার হল যেন ক্লাস রূম হয়ে গেছে। পরীক্ষার হলেই ক্লাস নেয়ার ভঙ্গিতে বলে দেয়া হচ্ছে, বোর্ডে লিখে দেয়া হচ্ছে, বই সরবরাহ করা হচ্ছে, প্রশ্নের উত্তর সরবরাহ করা হচ্ছে। পরীক্ষার হল চুরি-চামারি, খেয়ানতে ভরে গেছে। কেন্দ্র দখল করে শক্তিমানরা তাদের কলেজের, স্কুলের, মাদরাসার রেজাল্ট ভালো করার জন্য উঠে পরে লেগে গেছে। সরকারী বেতন খেয়ে পেট পুরছে আর প্রাইভেট পড়িয়ে টাকা ইনকাম করছে। ক্লাসের শিক্ষার্থীরা সাবজেক্টগুলোতে অজ্ঞই থেকে যাচ্ছে।
দলের প্রভাব দেখিয়ে ছাত্রলীগ ভাইয়েরা গুণ্ডা, বদমাস, মাদকসেবী, খুনি ও দলীয় ক্যাডারদের এ প্লাস, মাইনাস, অন্তত পাশের ব্যবস্থার করছে। গার্ড দেয়া শিক্ষকরা তো অসহায়- পুলিশরাও। “খুলনা বিএল কলেজে পরীক্ষার হলে ছাত্রলীগ নেতাদের প্রবেশে বাধা দেয়ায় খুলনা মহানগর পুলিশের এক উপ-পরিদর্শককে চড়-থাপ্পড় মারলেন কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক উজ্জল দাস।” “পরীক্ষার হলে শিক্ষকের সঙ্গে অশোভন আচরণের কারণে দুই বছরের জন্য বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাকিম বিল্লাহর সাজা মওকুফ করে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট।” – এমন হাজারো নিউজ দিয়ে পত্রিকা ভরা আছে। নকল ধরার অপরাধে কত শিক্ষককেই না শিক্ষার্থীরা পিটিয়েছে তার ইয়োত্তা নেই।
অভিভাবকরা সন্তানের পরীক্ষার রেজাল দর্শনীয় করতে নিজ হাতে, কাঁধে, পকেটে, ব্যাগে নকল সরবরাহ করছেন। দেখে লেখার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। নানান কৌশলে চুরি করা শিখাচ্ছেন (অনেক ভাল অভিভাবকও আছেন)। এমনকি অভিভাবকরা অভিনব কায়দায় বাঁশের খুঁটির সাথে নকল বেঁধে নিজ সন্তানের কাছে পৌঁছানের দৃশ্যও ক্যামেরাবন্দি করেছেন সাংবাদিকরা। এমন প্রকৃতির অভিভাবকরা আসলে তাদের সন্তানকে কী বানাতে চাচ্ছেন? কেবলমাত্র একজন প্লাসধারী? কত প্লাসধারীরা আজ গার্মেজে চাকরী করছে লেখা-পড়া ছেড়ে দিয়ে। না হয় বিশ্ববিদ্যালয় পযন্ত পৌঁছল- তারপর কী ঝরে পরার আশংকা নেই? এমন কী আপনাকে খুন করারও আশংকা আছে; ঐশীর মত। সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দেয়ার ব্যর্থতা ঘুচতে গিয়ে সন্তানকে নকল করার দীক্ষা দিচ্ছেন। সন্তানের জীবন ধ্বংস করছেন। তার আত্ম-বিশ্বাস হারিয়ে দিচ্ছেন। আপনি সন্তানের নৈতিকতা চাননা, চান প্লাস; যা আপনার সন্তানকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। কখনো অভিভাবকরা এসে শিক্ষকদের বলেন, স্যার আমার ছেলেটার প্লাসের ব্যবস্থা করেন যে কোন উপায়ে। বাড়তি যা সহযোগীতা লাগে দিয়ে দিবো। নিজের সন্তানের জন্য ব্যর্থতার কবর খুরছেন। আর কিছু নয়।
আমরা অনেক শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীকে যোগ্য, দক্ষ করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছি। সরকারের বেতনে খেয়ে বিভিন্ন অজুহাতে ক্লাস করছি না। আমাদের হক আদায় করছি না। হুজুর, নন-হুজুর সবাই (অনেকেই ব্যতিক্রম আছেন)। শিক্ষার্থীদের দেখার কলা-কৌশল শিখাচ্ছি। কেবল বস্তুবাদী চিন্তার বেড়াজারে বন্দি হয়ে আছি। চাই প্লাস । প্লাস চাওয়া একটা বৈধ ব্যাপার। আমাদের সবাই আমাদের আপনজন ও শিক্ষার্থীদের জন্য প্লাস চাই। কিন্তু নৈতিকতার ভিত্তিতেই। দ্বীনী ধ্যান-ধারণাকে পদপিষ্ট করে নয়। একেবারে স্রেফ বস্তুবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার সাথে মিশে গিয়ে নয়। খুশির সাথে যাকাতের টাকা খেয়ে যেমন সত্য বলার বল পাওয়া কঠিন। তেমনি ভেজাল প্লাস দিয়েও মানবতার জন্য কিছু করার আশা করা কঠিন। এমনকি যারা অনেকটা নিশ্চিত প্লাস পাওয়ার যোগ্য তাদেরকেও আমরা এমন দুই নাম্বারী কাজে অংশ নিতে সাহায্য করছি। আমি শুনে ছিলাম উত্তরবেঙ্গের এক বিখ্যাত মাদরাসার সেন্টার দখলের কথা। শিক্ষকরা প্রত্যক্ষভাবে সব কিছু সলভ করে দিতেন এবং দেশে নামকরা রেজাল্ট করতেন। এখন কেমন তা জানি না। যেখানে একটা প্রতিষ্ঠান, একটা সেন্টারের আমানত রক্ষা না করে স্বেচ্ছাচারীতা চালিয়ে যাই সেখানে রাষ্ট্র চালানোর আশা করছি।
দায়িত্বশীল মেজিস্ট্রেটরাও দূর্বল ও শক্তিহীন; বেশির ভাগই। তারা কেন্দ্রে গিয়ে কোন নজীর স্থাপন করতে পারছেন না। অনেকে পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে কিছু উৎকোচও নিচ্ছেন। কেন্দ্রে পৌঁছে খাওয়া-দাওয়া আর ভোজন সাড়তেই হলগুলোতে এলার্ট সংকেত বেঁজে উঠে। তারা সতর্ক হওয়ার পরই তিনি একটা নামকাওয়াস্ত পরিদর্শন সেরে ফেলেন। যারা সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন তারা পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে নকলের বস্তাও উদ্ধার করেছেন।সাতক্ষীরার ঘটনা। সাতক্ষীরা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. জাকির হোসেন ও তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফরিদ হোসেন বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনকালে তালা উপজেলা সদরের তালা আলিয়া মাদরাসা ও শহীদ আলী আহম্মেদ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এক বস্তা নকল উদ্ধার করেন এবং চার পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেন।
সরকারী ফরমান হলো পাঁশ করে দাও। যা-ই লিখুক। গান লিখলেও। বেশি বেশি প্লাস দাও। বিবেকওয়ালা শিক্ষকরা বিরম্বনায় পরছেন। পরীক্ষকরা তাদেরকে চাপ দিচ্ছেন, নাম্বার অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিতে। কাউকে ফেল করালে টাকা কর্তনের হুমকিও দিচ্ছেন। যাতে পাশ ও প্লাস পাওয়াকে সরকারী সফলতা হিসেবে দেখানো যায়। তাই পরীক্ষার হলগুলোও হয়ে উঠেছে অবাধ নকলের কারখানায়। এখানে সরকারী দায় বিশাল। তাদের ঢিল অবস্থান পরবর্তী প্রজন্মকে শক্তিহীন, জ্ঞানহীন ও অদক্ষ করে তুলছে। অনেক শিক্ষার্থীর সৎ থাকতে চাওয়ার পরেও হলের জঘন্য পরিবেশের কারণে পেরে উঠছে না। দায়িত্বরত শিক্ষক তাকে দিয়ে অন্যদের চাহিদা পুরণ করাচ্ছে। চাপ সৃষ্টি করছে। ফলে তার নিজের পরীক্ষাটাই অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এই মুহুর্তে একজন ব্যক্তির নাম স্মরণ পড়ছে। আমরা ছোট থাকাকালে তিনি নাকি শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। সে সময়ে তিনি পরোয়াহীন ও দক্ষভাবে শিক্ষার পরিবেশকে ভেজালমুক্ত করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। এগুলো লোকদের মুখে মুখে প্রচলিত। পরীক্ষার সময় নাকি তিনি দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটতেন। তাঁর কথা অনেকেই সপ্রশংস হয়ে বলেন। তিনি সম্ভবত এহসানুল হক মিলন।
নকলের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাচ্ছে। আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাস জিরোতে নেমে আসছে। তাদের কাছে কারো না দেখে, কারো সাহায্য না নিয়ে, নকল ছাড়া পরীক্ষা দেয়া যেন সপ্নের হয়ে গেছে। এটা তাদের কাছে ধীরে ধীরে অসম্ভব হয়ে উঠছে। সবকিছু পারলেও যেন মনে হয় শব্দটা, তথ্যটা, বাক্যটা ওর কাছে চেক করে নেই। মানসিক দূর্বলতার কারণে সন্দেহ প্রবনতা জাগ্রত হচ্ছে। সব কিছু পারার পরও অনেক সময় কঠিন গার্ড থাকলে তার সাহস ও দৃঢ়তা কমে যেতে থাকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা বা এমন জাতীয় পরীক্ষাগুলোর ক্ষেত্রে সে হতাশায় ভুগতে থাকে। হীনমন্যতার পরিমান বাড়তেই থাকে। আর সে কখনো সাহস করে বলতে পারবে না, এটা আমার খাঁটি সার্টিফিকেট। সার্টফিকেটের বরকতও নষ্ট হয়ে যায়।
পড়ালেখায় চরম অলসতা সৃষ্টি হয়। মনযোগ নষ্ট হয়ে যায়। দেখার তো একটা ব্যবস্থা আছে। তাই হালকা পড়লেই চলবে। এত বেশি পড়ার কী দরকার! এমনও হয়, কারো কাছে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে থাকলে সে ভাবতে থাকে আমার তো সব জানাই আছে? আইটেমগুলো পড়তে বেশি সময় দরকার নেই। এত পড়ার দরকার নেই। পরীক্ষার আগে পড়লেই হবে। অবশেষে অলসতার কারণে সেটাও আর ভালো করে পড়া হয়ে ওঠে না।
সর্বপরি, চুরি ও খেয়ানত করার মধ্য দিয়ে জীবনে একটা অনৈতিক ভীত গড়ে উঠল। অবৈধ রেজাল্ট জীবনের সাথে লেগে গেল। মানহীন একটা সার্টিফিকেট কাঁধে চেপে বসল। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে হেফাজত করুন আর পরিবেশটা বদলিয়ে দিন। আমীন।
– Bazlur Rashid