বৃদ্ধাশ্রম : মানবতার কলঙ্কিত কারাগার (১)
বৃদ্ধ ও আশ্রম শব্দ দু’টি মিলে হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম। শব্দগতভাবে অর্থ দাঁড়ায় বৃদ্ধনিবাস বা বৃদ্ধের আশ্রয়স্থল। অন্য অর্থে জীবনের শেষ সময়ের আবাসস্থল, বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে বৃদ্ধাবস্থায় পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনের আশ্রয় ব্যতীত সরকারী-বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় লালিত-পালিত হওয়ার স্থানকে বৃদ্ধাশ্রম বলে। যে যৌবনকাল ছিল চঞ্চলতায় ভরপুর, যে যৌবনকালের কর্মস্পৃহার বদৌলতে গড়ে উঠল এই সৌন্দর্যময় আবাসস্থল, বিস্তার লাভ করল শিক্ষা, উৎকর্ষ সাধিত হ’ল জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়, সে যৌবনের উচ্ছলতা আজ হারিয়ে গেছে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় তারা নিজেরাই আজ অচল, জরাজীর্ণ বার্ধক্যে আক্রান্ত হয়ে চরম অসহায়ত্ব বরণ করে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বৃদ্ধাশ্রম নামীয় কারাগারে স্থান পেয়েছে। একসময় যারা নামী দামী বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও চাকরিজীবী ছিলেন, বর্ণাঢ্য ছিল যাদের জীবন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজ সন্তানদের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তারাই। পরিবার ও সন্তান থেকেও যেন ‘সন্তানহারা ইয়াতীম’ হয়ে জীবন যাপন করছেন।
বৃদ্ধের এমন সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। সাথে সাথে তাদের প্রতি অবহেলার মাত্রা বেড়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যার ফলে সূচিত হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম নামের কলঙ্কজনক অধ্যায়। ছোট বেলায় যে বাবা-মা ছিলেন সন্তানের সবচেয়ে বেশী আপন, যাদের ছাড়া সন্তান কিছুই করতে পারত না, যারা নিজেদের আরাম হারাম করে তাদের মানুষ করেছেন, নিজের সব দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে সন্তানের হাসিমাখা মুখ দেখার জন্য যে মা-বাবা ব্যাকুল থাকতেন, সে না খেলে যিনি থাকতেন অনাহারে, না ঘুমালে থাকতেন নির্ঘুম, অসুস্থ হ’লে ঠায় বসে থাকতেন শিয়রে, যে বাবা-মা তিল তিল করে নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন সন্তানকে মানুষ করার জন্য, যে বাবা নিজের পকেট খরচকে বাঁচিয়ে রাখতেন তার সন্তানের টিউশন ফী অথবা টিফিনের টাকার জন্য, যারা নিজের অসুস্থতার কথা না ভেবে কেবল তার সন্তানদের কথা চিন্তা করে প্রত্যুষেই নেমে পড়তেন রূযীর সন্ধানে, সেই বাবা-মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা অবশেষে যদি হয় বৃদ্ধাশ্রম, তবে মানবতার প্রতি এ এক চরম উপহাস বৈ কি?
বৃদ্ধাশ্রমের ইতিহাস : ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। ঘরছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে ইতিহাসে আলাদা জায়গা দখল করে নিয়েছে শান রাজবংশ। পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধাশ্রমে ছিল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরাম-আয়েশের সব রকম ব্যবস্থা। ছিল খাদ্য ও বিনোদন ব্যবস্থা।[1] কিন্তু এখন বিষয়টি এমন হয়েছে যে, একবার বাবা-মাকে বৃদ্ধনিবাসে পাঠাতে পারলেই যেন সবকিছু থেকে দায়মুক্তি ঘটে। মূলত অসহায় ও গরীব বৃদ্ধদের প্রতি করুণাবোধ থেকেই হয়ত বৃদ্ধাশ্রমের সৃষ্টি। যেখানে বৃদ্ধদের প্রয়োজনীয় সেবা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের সেই ছবি এখন আর নেই।
কয়েক দশক আগেও আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন একটা ছিল না। সময়ের সাথে সাথে এর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ২৮.১০.২০১৮ইং তারিখে প্রকাশিত সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্য মোতাবেক বর্তমান বাংলাদেশের নিবন্ধনকৃত শান্তি নিবাসের (বৃদ্ধাশ্রমের) সংখ্যা ছয়টি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, সারা দেশে প্রতিটি বৃদ্ধাশ্রমে ৫০টি করে মোট ৩০০টি সিট রয়েছে।[2] রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আশ্রিত ব্যক্তিদের নিজস্ব অর্থায়নে চলে একটি আশ্রম ‘বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ’ নামে। এটি একজন পরিচালক ও দু’জন কর্মচারীর সহযোগিতায় চলে। প্রায় ৩০/৪০ জন থাকতে পারে এখানে। চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়ায় কাপ্তাই সড়কের দক্ষিণ পাশে ২০১৪ সালের ১লা মে চালু হয় ‘আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র’। মানবতার উন্নয়নের আশায় কেন্দ্রটি চালু করেন শিল্পপতি শামসুল আলম। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশের অবহেলিত, অসহায় প্রবীণদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বিশিষ্ট শিল্পপতি মুকুল চৌধুরী ১৯৮৭ সালের গোড়ার দিকে ঢাকার উত্তরায় আজমপুরে গড়ে তোলেন ‘বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র’। ১৯৯৪ সালে কেন্দ্রটিকে স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত করা হয় গাযীপুরের মণিপুর বিশিয়া কুড়িবাড়ীতে। ১৯৯৫ সালে ২১শে এপ্রিল শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মাদার তেরেসা কেন্দ্রটির বর্ধিতাংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এখানে প্রবীণদের থাকার জন্য ১টি বিশাল টিনশেড ভবন ও ৩টি পাঁচতলা ভবন রয়েছে। যা বর্তমানে কেন্দ্রীয় প্রবীণ নিবাস হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। কেন্দ্রটি ৭২ বিঘা জমির ওপর নির্মিত হ’লেও বর্তমানে তা সম্প্রসারিত হয়ে ১০০ বিঘায় উন্নীত হয়েছে। মহিলা-পুরুষদের আলাদা ভবনে মোট ১২০০ মানুষ থাকার সুব্যবস্থা রয়েছে এই কেন্দ্রে। বর্তমানে ২ শতাধিক বৃদ্ধ সেখানে অবস্থান করছেন। চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য রয়েছে পাঁচতলা ভবনের চিকিৎসা কেন্দ্র। এখানে ২ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসক, ২ জন নার্স, একজন কম্পাউন্ডার ও ১টি অ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক সেবা প্রদানে নিয়োজিত আছে।[3]
এছাড়াও সারাদেশে নিবন্ধনহীন আরও অনেক বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে কেন এই বৃদ্ধাশ্রম? আসুন! এর জবাব খুঁজি।
কেন এই বৃদ্ধাশ্রম : আমি গত ২৬শে ডিসেম্বর’১৮ ঢাকার অদূরে গাযীপুরের মণিপুরে অবস্থিত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৃদ্ধ পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিদর্শন করে বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধদের অবস্থানের বহুবিধ কারণ লক্ষ্য করলাম। সফরসঙ্গী ছিলেন, ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ গাযীপুর যেলার সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম। কথা বললাম, ম্যানেজার আবু শরীফের সাথে। বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধদের অবস্থানের কারণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য বহুমূখী পরিস্থিতি বুঝতে তিনি সাহায্য করলেন। তিনি বলেন, এখানে অনেকে আসেন সেচ্ছায়, আবার অনেকে আসেন অনিচ্ছায়।
১. স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধদের অবস্থানের কিছু কারণ :
ক) পরিবার জনশূণ্য : অনেকের পরিবারের সকল সদস্য একের পর এক মৃত্যুবরণ করায় পরিবার জনশূণ্য হয়ে পড়েছে। আবার অনেকের সন্তান উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে বিদেশে পড়তে গিয়ে আর স্বদেশে ফিরেনি। তাই অসহায়ত্ব থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়েছেন এমন কিছু বৃদ্ধের সন্ধান মিলে। যেমন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত প্রবীণ নিবাসের বৃদ্ধা মিরা চৌধুর (ছদ্মনাম)। বয়স পঁয়ষট্টি পেরিয়েছে। জন্ম রাজধানীর পুরান ঢাকার মালিটোলায়। ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি.এ ও এম.এ সম্পন্ন করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাঠ চুকিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন খুলনা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষিকা হিসাবে। এরপর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে কাছের প্রিয়বন্ধু জোসেফ চৌধুরীর সঙ্গে। স্বামী ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও)-এর ডিরেক্টর পদে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। জীবন সংসারের আলো যখন উদ্ভাসিত, ঠিক তখনই ছন্দপতন। স্বামীর মৃত্যুই জীবনযুদ্ধেপরাজিত সৈনিকের রূপ দেয় মিরাকে। জীবনের অর্জিত সম্পদ দিয়ে একমাত্র ছেলে অপূর্ব হাসান চৌধুরীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগ থেকে পাশ করার পর যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান উচ্চতর ডিগ্রী নিতে। সমস্ত স্বপ্নসাধের কবর রচনা করে মিরা চৌধুরী আজ ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রমের ৪১৫ নম্বর কক্ষে। পাশে কাউকে না পেয়ে নিজের সম্বল বলতে রাজধানীর বাংলামোটরের দিলু রোডে ছয়তলা একটি বাড়ী বিক্রি করে দেন ২ কোটি টাকায়।
বাড়ী বিক্রির টাকা ব্যয় হয়েছে ছেলের শিক্ষা খরচে। তবে নিজের নামেও কিছু টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে। সেখান থেকেই আশ্রমের খরচ চালানো হয়। ছেলে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রেরই একটি ব্যাংকে চাকুরী নিয়েছেন। বেতনও বেশ ভাল। দেশে ফেরা অনেকটাই অনিশ্চিত। মিরা চৌধুরী স্মৃতিচারণ করে বলছিলেন, ‘ছেলে বাংলাদেশে আসবে এমন আশা দিনে দিনে ক্ষীণ হচ্ছে। আর আসবেই বা কেন? কিসের আশায় আসবে? বাংলাদেশে এসেই বা কি করবে? এ দেশে তো জীবনের নিরাপত্তাও নেই। মিরা বলেছিলেন, ‘আর কয় দিনইবা বাঁচব। এখন আর ছেলেকে বিরক্ত করি না। কষ্টেই তো আমার জীবন গড়া। অসময়ে স্বামীকে হারালাম। বাবা-মা চলে গেছেন অনেক আগে। একমাত্র ভাই, সেও চলে গেল ছয় মাস হয়। আপন বলতে আর তো কেউ নেই। কলকাতায় স্বামীর ঘরের আত্মীয়-স্বজন আছে। কে আর কার খবর রাখে? চাচাতো বোনের মেয়ে মিরপুরে থাকে। ও মাঝে মধ্যে এসে খবর নেয়। আছি তো। আশ্রমেই বেশ আছি। শুরু থেকেই মৃদু ভাষায় কথা বলছিলেন। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলেন না। গলা ধরে এলো। নিমিষেই চোখের কোণ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গালে গড়ালো। বয়সের ভারে কুচকানো গাল। তাতে বেদনার স্পষ্ট ছাপ। চশমা খুলে ওড়নায় চোখের পানি মুছতে মুছতে শোনালেন সংক্ষিপ্ত জীবনকথা।[4]
খ) পরিবারের বোঝা : কিছু পরিবার তাদের বৃদ্ধদের পরিবারের বোঝা মনে করে। তাদের ধারণা সন্তান লালন পালনে ভবিষ্যত রয়েছে। তাদের পিছনে খরচ করলে তারা বড় হয়ে আবার তাদের দেখাশুনার ভার গ্রহণ করবে। অপরদিকে বৃদ্ধরা জরাগ্রস্ত, অসহায়, নিষ্কর্মা দুর্বল হয়ে যাবে। তাদের দ্বারা ভবিষ্যতে কোন উপকার পাওয়া যাবে না। তাদের লালন পালন করে লাভ হবে না। এমন বৃদ্ধদের পেছনে অর্থ ব্যয় করা অনর্থক ভেবে, পরিবারের বোঝা মনে করে, অবহেলা ভরে তাদের সাথে অন্যায় আচরণ করে বলে অনেকে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেন। গাযীপুরের বিশিয়া বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের একাধিক শিক্ষিত সন্তানের মা পঁচাত্তর বছর বয়সোর্ধ ময়মনসিংহের আলিমুন্নেসা তাদের একজন। এক সময় যাদের তরে বুক ভরা ভালোবাসা ছিল, তারা এক বুক ব্যথা ঢেলে আজ তিক্ত করেছে এ অন্তর। স্বপ্নের পরিবর্তে উপহার দিয়েছে চোখ ভরা লোনাপানি।
লক্ষ্মীপুরের আব্দুল হামীদ মোল্লা। মানুষ করার তাকীদে হোমিও ঔষধ বিক্রি করে শিক্ষিত করেছেন তিন ছেলে, তিন মেয়ে এবং মানুষ করেছেন বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীতে কর্মরত ছোট দুই ভাইকেও। বুক ভরা আহাজারী আর চোখ ভরা কান্না নিয়ে দিনাতিপাত করেন বৃদ্ধাশ্রমে। এ দু’জনেরই শিক্ষিত পরিজন দেখার সুযোগ পায় না তাদের। যেন পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা। নিজেদের প্রবোধ দেয় এখানেই ভালো আছি, বেশ আছি।
কুষ্টিয়ার বাজিতপুর গ্রামের এক কৃষকের চার মেয়ে, এক ছেলে। ছেলের বাড়িতে বৃদ্ধ বাবার ঠাঁই হয়নি। মেয়েরা পালা করে তাকে রাখতেন। ব্যাপারটা জামাইদের পসন্দ হ’ত না। সেজ মেয়ের বাড়িতে এক রাতে খাবারের জন্য অনেক্ষণ বসে থেকেও শেষ পর্যন্ত কেউ খাবার না দেওয়ায় ট্রেনে চেপে চলে এলেন ঢাকায়। অবশেষে তিনি স্বেচ্ছায় বেছে নিলেন বৃদ্ধাশ্রম।[5]
গ) পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অভাব : পরিবারের সদস্য একাধিক থাকা সত্ত্বেও তাদের কর্মক্ষম বা উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় স্বেচ্ছায় একশ্রেণীর বৃদ্ধরা মাথাগুজার ঠাঁই করে নিয়েছে বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে। এমনই একজন সিলেটের অধিবাসী মুহাম্মাদ ছবির খাঁন। বৃদ্ধ বয়সে বাবা হয়েছেন এক মেয়ের। এই বয়সে কেউ নেই দেখাশুনা করার মত। তাই স্ত্রী-কন্যা ফেলে রেখে স্বেচ্ছায় ঠাঁই করে নিয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে।
ঘ) পরিবারের সদস্যদের বনিবনার অভাব : সন্তানাদি বা ছেলের বউদের সাথে অমিল। সেকারণ তারা পায় না সদাচরণ, বেঁচে থাকার মত পায় না আহার, পায় না উপযুক্ত পরিধেয় বস্ত্র এবং নানাবিধ রোগের যাতাকলে পিষ্ট হয়েও পায় না চিকিৎসার জন্য পারিবারিক সহযোগিতা। অর্থের অভাবে ব্যক্তিগত চাহিদার সকল অংশ থাকে অপূরণীয়। ফলে কষ্ট-ক্লেশে জর্জরিত হয়ে অনেকেই স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমকে জীবনের শেষ ঠিকানা বানিয়ে নেয়। এমনই একজন চট্টগ্রামের পটিয়া উপযেলার মুখপাড়া এলাকার ৭৭ বছর বয়সী অরুণ ভট্টাচার্য। একমাত্র ছেলের বউয়ের লাথি ঘুষি খেয়ে হাতের আঙ্গুল ভেঙ্গে এখন আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে আছেন।[6]
ঙ) একাকিত্ব ঘোচাতে বৃদ্ধাশ্রমে : অনেকে আবার বাড়িতে সঙ্গ দেওয়ার মত কেউ না থাকায় একাকিত্ব ঘোচাতে স্থান করে নিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। তাছাড়া নিরাপত্তার অভাবেও অনেকে এই পথ বেছে নেন৷ দেখা গেছে রং মিস্ত্রি বা কলের মিস্ত্রি, এমনকি গৃহ পরিচারিকার হাতেও খুন হচ্ছেন তাঁরা৷ তাই নিরাপত্তার অভাবেও অনেকে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানা যায়।
২. অনিচ্ছায় :
ক) পথহারা অসহায় : অনেকে শেষ বয়সে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে অবুঝ বালকের মত ঘুরে বেড়ায় পথে-প্রান্তরে। নেই তার সঠিক পরিচয়। কোন না কোন এক পরিস্থিতিতে তাকে হারিয়েছে পরিবার। ফিরে যেতে পারেনি গন্তব্যে। অবশেষে কারো না কারো মাধ্যমে তার ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে বা বৃদ্ধ পুনর্বাসন কেনেদ্র।
খ) পরিবারের সদস্যদের বনিবনার অভাব : পরিবারের সন্তান দের বা পুত্রবধূদের সাথে অস্বাভাবিক অমিলের কারণে যেমন অনেকেই স্বেচ্ছায় আশ্রয় নিয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে, তেমনি অনেকের ঠাঁই হয়েছে অনিচ্ছায়। যদিও সন্তান চায় স্ব-পরিবারে শান্তিতে বসবাস করতে। কিন্তু পুত্রবধূরা চায় সুখী সংসার নামের ক্ষুদ্র পরিবার গঠন করতে। পুত্র হার মেনে যায় তার স্ত্রীর কাছে। অনেক সময় পিতা-মাতাও বৃদ্ধ বয়সের কারণে অস্বাভাবিক আচরণ করে। ফলে চরম বাদানুবাদের পরিসমাপ্তি ঘটে বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধের ঠাঁই করে দিয়ে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার অবস্থান গড়তে হয় বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে।
গাযীপুরের মণিপুর বিশিয়া বৃদ্ধ পুনর্বাসন কেন্দ্রের ম্যানেজার আবু শরীফ বলেন, অনেকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে এখানে দিয়ে যায় বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে। তিনি বলেন, সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনা তখনই ঘটে যখন নিজের পুত্র বা পুত্রবধূ আশ্রমে রাখার সকল কার্যক্রম শেষ করে ঔষধ আনার নাম করে কৌশলে পালিয়ে যায়। তার হৃদয়ফাটা কান্না আর আহাজারী যেন আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হ’তে থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় পরিবারের সদস্যদের বনিবনার অভাবেই এ কাজ করেছে।
গ) কুড়িয়ে পাওয়া : হৃদয়ের সকল ভালবাসা উজাড় করে দিয়ে যে পিতা-মাতা ভাল সন্তান হিসাবে গড়ে তুলতে তিলতিল করে সর্বস্ব বিকিয়েছে, তারাই আজ বৃদ্ধ বয়সে নিষ্ঠুর নিয়তির শিকার। অপয়া, নির্বোধ, কু-সন্তান তাদের মত সম্মানিত গুরুজনদের সাথে নির্মম আচরণ করে রাস্তার ধারে ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়া, ডাক্তার দেখানোর কথা বলে অচেনা জায়গায় বসিয়ে রেখে চলে যাওয়া বা দূর পাল্লার গাড়ীতে তুলে দিয়ে কৌশলে নেমে যাওয়ার মত ঘৃণ্য দৃষ্টান্তও রয়েছে। ম্যানেজার আবু শরীফ জানান, এমন অসহায়দের কুড়িয়ে এনে জমা করেছেন গাযীপুর বৃদ্ধ পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালক ও কর্মকর্তাবৃন্দ। এমনই দু’একটি ঘটনা নিম্নে উল্লিখিত হ’ল।-
(১) সংসারের বোঝা মনে করে কুমিল্লার দুই কুলাঙ্গার সন্তান মিলে গাড়ীতে করে গৌরনদী উপযেলার টরকী বাস স্ট্যান্ডে পঁচাশি বছর বয়সী বৃদ্ধা মা আরাফাতুন্নেসাকে রাস্তার ধারে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। আট দিন কাটে তার সেখানে। মাঝে মাঝে ছেলেদের নাম ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বৃদ্ধা। স্থানীয়রা নিতে চাইলে বলে তার ছেলেরা তাকে নিতে আসবেই আসবে।[7] সংবাদ পেয়ে নিয়ে আসেন গাযীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের মালিক মুকুল চৌধুরী।
(২) বগুড়ার দুপচাচিয়ার অধিবাসী এক ছেলে ও দুই মেয়ের মা ৫৫ বছর বয়সী শ্যামলীকে সিরাজগঞ্জ রেলস্টেশনে ফেলে রেখে যায় ছেলে-মেয়েরা। অবশেষে স্থানীয় লোকজনের নিকট থেকে রাজধানীর মিরপুরের বৃদ্ধাশ্রম ‘চাইল্ড ওল্ড’ সংস্থা লালন পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে তার।[8]
(৩) ত্রিশ বছর পূর্বে স্বামী হারা ৮৬ বছর বয়সী হুজলা বেগম নড়াইলের লোহাগড়া উপযেলার কুচিয়াবাড়ির অধিবাসী। তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মা হওয়া সত্তেবও তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব কেউ না নিয়ে পুত্র ও পুত্রবধূ মিলে বাঁশবাগানের ভিতর ফেলে রাখে। অবশেষে সমাধান হয় প্রসাশনের মাধ্যমে।[9]
(৪) মাদারীপুরের পৌর শহরের শকুনী লেক পাড়ে ৮০ বছর বয়সের যোবেদা খাতূনকে কুড়িয়ে পায় স্থানীয় সরকারী নাযীমুদ্দীন কলেজের দুই ছাত্র। তার ছেলে ও পুত্রবধূ মিলে রাস্তায় ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়। এই সামান্য পরিচয় দিয়েই জ্ঞান হারান বৃদ্ধা। দুই ছাত্র মিলে সদর হাসপাতালে ভর্তি করান বৃদ্ধাকে।[10] এমন অসহায়দের ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম ছাড়া আর হবেই বা কোথায়? এভাবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকেরই তাদের ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে।
ঘ) অতি উচ্চশিক্ষিত জনের বৃদ্ধ পিতা-মাতা : পরিবারের সকলে অতিশিক্ষিত হয়ে নিজেদেরকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন সর্বক্ষণ। সন্তান বড় করার তাকীদে একাধিক গৃহশিক্ষক, ব্যক্তিগত গাড়ী, নিজস্ব ড্রাইভার, নিজ নিজ চাকুরীতে বা ব্যবসায় নিয়োগ করা হয় একাধিক সহযোগী। কিন্তু এর ফাঁকে বৃদ্ধ, অচল, অসহায় পিতা-মাতার পাশে সামান্য সময় দেয়ার যেন কেউ নেই। বড় বড় আসবাবপত্রের ঠাঁই হ’লেও এই বৃদ্ধের সামান্য জায়গা হয় না মস্তবড় ফ্লাটে। তাদের জন্য যেন বাসাটা খুবই সংকীর্ণ। তখন ইচ্ছায় অনিচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রম ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
(১) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক (অবসর প্রাপ্ত) ড. আব্দুল আউয়াল (৭০) ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। দীর্ঘ ১৭ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন সুনামের সঙ্গে। ২০০৬ সালে অবসর নেন। সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তিন সন্তানের মধ্যে বড় রোজিনা ইয়াসীন আমেরিকা প্রবাসী। এরপর বড় ছেলে উইং কমান্ডার (অব.) ইফতেখার হাসান। ছোট ছেলে রাকিব ইফতেখার হাসান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। জীবনে এত কিছু থাকার পরও আজ তার দু’চোখে অন্ধকার। থাকেন আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসে। প্রথম দিকে ভালই ছিল। আস্তে আস্তে পুত্র ও পুত্রবধূর ঝগড়ার মাধ্যমে বুঝতে পারলেন তিনি এই পরিবারের বোঝা। তাই স্বেচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক তিনি বেছে নেন এই পথ।[11]
(২) টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপযেলার কাঠরা গ্রামের মৃত জরু মিয়ার স্ত্রী ফরীদা বেগম (৮০)। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। নয় বছর ধরে তিনি আশ্রমে আছেন। কিন্তু একদিনের জন্যও তাঁকে দেখতে আসেননি সন্তানরা।[12]
(৩) পাবনার চাটমোহর থানার নেংরী গ্রামের মৃত অরিস্টিন কুরাইয়ের স্ত্রী পরসী কুরাই। পঁচাশি বছর বয়সী এই খ্রীষ্টান মহিলার পাঁচ ছেলে সবাই শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু কেউ তাঁর খোঁজ-খবর রাখেনি। বাড়িতে ফেলে রেখে চলে গেছে সবাই। তার অসহায়াত্ব দেখে এলাকার লোকজন তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেন।[13]
(৪) সত্তর বছর বয়সী জুয়েলী বেগম ২৫ বছর পূর্বে হারান স্বামী আব্দুল মান্নান শেখকে। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকতেন বোনের বাসায়। ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে বিয়ে করিয়েছেন। কান্না জড়িত কন্ঠে জুয়েলী বেগম বলেন, ঢাকার নারিন্দা এলাকায় তাঁর ছেলে একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছিল। সেখানে স্ত্রী ও মাকে নিয়ে একসঙ্গেই বসবাস করতেন। একদিন বেড়ানোর কথা বলে ছেলে ও ছেলের বউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এর কয়েক দিন পর তিনি জানতে পারেন, ছেলে ফ্ল্যাট বিক্রি করে চলে গেছেন। একদিন ঐ ফ্ল্যাটের নতুন মালিক এসে সবকিছু জানতে পারেন। তিনি ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে তাঁকে গাযীপুর সদর উপযেলার মণিপুর বিশিয়া এলাকার বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে রেখে আসেন।[14] অশ্রুসিক্ত নয়ন আর কান্নাজড়িত কণ্ঠে জুয়েলী বেগম বলেন, ‘মাকে একটু জায়গা দিলে ওদের কী এমন অসুবিধা হ’ত! তারপরও আমি তো মা; সব সময় চাই ‘আমার ছেলে ভালো থাকুক, আরও বড় হোক’। শিশুর শৈশবে নিজের সব সুখ বিলিয়ে দিয়ে সন্তানের মঙ্গল নিশ্চিত করতেন এই মায়েরা। সন্তানেরা সেই মায়েদেরই জীবন থেকে মুছে ফেলেছেন। অথচ সন্তানের মঙ্গল কামনায় দিন-রাত প্রার্থনায় রত এখানকার মায়েরা।
(৫) চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপযেলার সুচিয়া গ্রামের বাসিন্দা তেষট্টি বছর বয়সী দুই সন্তানের জননী বাণী চৌধুরী ছিলেন নগরীর বি এন স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষিকা। ছেলেটি চাকুরী পাওয়ার পর বউ, বাচ্চা, শ্যালক, শ্বাশুড়ী নিয়ে থাকেন শহরের বাসায়। মা-ছেলের সম্পর্ক ছেদ হয়েছে পাঁচ বছরের বেশী সময় ধরে। বাণী চৌধুরী দুঃখ করে বলেন, আসবাব পত্রসহ ঘরের সবকিছু রাখার জায়গা হ’লেও বৃদ্ধা মায়ের জন্য জায়গা হয় না ফ্লাটে।[15]
(ঙ) সম্পদ লিখে দিয়ে অথবা সন্তানদের দ্বারা সম্পদ আত্মসাতের পর নিঃস্ব হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে : অনেকে অতি আগ্রহে নিজের সন্তানদের সম্পত্তি লিখে দিয়ে আনন্দ বোধ করেন। অবশেষে সম্পত্তি পেয়ে সন্তান-সন্ততি আলাদা হয়ে যায়। বৃদ্ধ পিতা-মাতা তাদের নিকট হয়ে উঠে উচ্ছিষ্ট। অথবা সন্তানরাই ভিন্ন কৌশলে সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করে দেয় বৃদ্ধ মাতা-পিতাকে। অবশেষে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় অনেকের জীবনে অপেক্ষা করে বৃদ্ধাশ্রমের বিছানা।
(১) কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেটে নিজের ফ্ল্যাট ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক (অব.) ড. এম আব্দুল আউয়ালের। এছাড়া পল্লবীতেও বেশ কিছু জমি ছিল। কিন্তু এসব বড় ছেলে কৌশলে বিক্রি করে টাকা-পয়সা নিজের অ্যাকাউন্টে জমা করেছেন, আক্ষেপ করেই বলেন অধ্যাপক আব্দুল আউয়াল। তিনি বলেন, ওরা আমাকে এত কষ্ট দেয় কেন? আমাকে নিয়ে এত ছলচাতুরি করে কেন? বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠেন তিনি। তিনি বলেন, আমি কি এজন্য এতো কষ্ট করে ওদের মানুষ করেছিলাম? অধ্যাপক আফসোসের সুরে বলেন, ছোট ছেলের পড়ালেখার জন্যও পেনশনের টাকা থেকে ২৬ লাখ টাকা পাঠিয়েছি। সেই ছেলেও আমাকে কোন দিন ফোন করে না। তিনি বলেন, আমার অন্য সন্তানদের চাইতে বড়টা একটু বেশী চতুর। আমার সব টাকা ও-ই বিভিন্ন সময় নিয়েছে। এখনো ওর কাছে ৬০ লাখ টাকা পাই। সেই টাকা দিচ্ছে না। মনের ক্ষোভে বলতে থাকেন, টাকা যদি নাই দেয় তাহ’লে আমার ছেলেকে আমি ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করব।[16]
(২) দেশের অন্যান্য বৃদ্ধাশ্রমগুলোর মতো রাজধানীর আগারগাঁও এ অবস্থিত ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত প্রবীণ নিবাস (বৃদ্ধাশ্রম)। আশ্রমের মালিক সাংবাদিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন আশ্রমের জ্যেষ্ঠ বৃদ্ধের সঙ্গে। ছেলে-মেয়েদের সম্মান হানি ঘটতে পারে তাই গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ করতে তিনি নারাজ। (হায়রে আবেগ! যে সন্তান নেয় না খোঁজ-খবর, ফেলে রাখে বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে, তাদের মান-সম্মান, সম্ভ্রম নষ্ট হওয়ার ভয়ে গোপন রাখে নাম পরিচয়। এর নাম পিতা-মাতা)। যার কথা বলছি (ছদ্মনাম আব্দুর রহীম ছাহেব) তিনি ঢাকার বনানী এলাকাতে নিজের নামে জমি কিনে বাড়ি করেন। এছাড়াও শহরের নামি দামি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন ছেলে-মেয়েদের। সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ইতালী প্রবাসী এক বাংলাদেশী ছেলের সঙ্গে। ছেলেও সরকারী অনেক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হয়েছেন। উচ্চবংশ দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন ছেলেকে। গেল দুই বছর আগে আব্দুর রহীম ছাহেবের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই তাকে এ বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হয়। অনেক অনুরোধের পর জানালেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকার কারণ। বললেন, বনানী এলাকার বাড়িটা ছেলে ও ছেলের বউ জোর করে লিখে নিয়েছে। তিন তলা ভবনের এক তলায় আমরা থাকতাম আর অন্য দু’টি তলা ভাড়া দেওয়া হ’ত। আমি থাকলে তো তারা এত টাকা ভাড়া পাবে না। তাই আমাকে এখানে রেখে গেছে। বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আব্দুর রহীম ছাহেব। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, আমি সব সময় দো‘আ করি আমার সন্তানরা যেন কখনোই বৃদ্ধ না হয়। তাহ’লে তারা এত কষ্ট সহ্য করতে পারবে না। কান্নার কারণে আর কিছুই যেন বলতে পারছিলেন না। হাউমাউ করে কেঁদে জড়িয়ে ধরলেন সাংবাদিককে। কিছুক্ষণ পর নিজের কক্ষের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। এমনিভাবে সম্পদ কেড়ে নিয়ে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে নিঃশ্ব করে দিয়েছে অনেক দুনিয়াদার অবাধ্য সন্তান। যাদের অনেকের স্থান বৃদ্ধাশ্রম, অনেকের হাতে ভিক্ষার ঝুলি।[17]
(চ) পরিবার অবহেলাকারী বড় ভাই : বৃদ্ধ পুনর্বাসন কেন্দ্র মণিপুরের ম্যানেজার বললেন, (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) কুমিল্লার জনৈক ব্যক্তি দীর্ঘ ৩৫ বছর পূর্বে ইরান গমন করেন। বাড়ীতে রেখে যান স্ত্রী-সন্তান ও ছোট ভাই-বোনদের। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস? তিনি বিদেশ যাওয়ার পর প্রচুর টাকা উপার্জন করতে পেরে সেখানে বিয়ে করে এদেশের সকলকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে যান। নিরাশ হয়ে ভাইয়েরা নিজেরা নিজেদের অবস্থান গড়ার প্রচেষ্টায় লেগে যায়। হঠাৎ শরীরে কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসায় বহু অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে উপকার না হওয়ায় দেশে পাঠিয়ে দেন ইরানের কর্মকর্তাগণ। নিঃশ্ব অবস্থায় দেশে ফিরে ভাইদের শরণাপন্ন হন। তখন তারা রাগে, ক্ষোভে ভাইকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাওয়াই উপযুক্ত বলে মনে করে।
বৃদ্ধাশ্রমে অবস্থানরতদের অনুভূতি : বৃদ্ধাশ্রমে আছে অনেক কিছুই, তবু যেন কিছু্ই নেই সেখানে। সবার ভিতরে শুধু হাহাকার পরিবারের সদস্যদের এক নযর দেখার জন্য। কেউ কেউ কাঁদতে কাঁদতে হয়ে গেছে বাক প্রতিবন্ধির মত। আবার কারো মুখে বিলাপ জড়িত কন্ঠে প্রশ্নের আহাজারী, ‘আমার মা নাই? আমার কেউ নাই? গ্রামে কবে নিবা? তোমরা কি নিবা? আমার কেউ নাই, আল্লাহরে আল্লাহ’। তাদের প্রশ্নের কোন উত্তর আমাদের নিকট ছিল না। কোন উপায় ছিল না অশ্রুসিক্ত চোখে ফিরে আসা ছাড়া। আরেক বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলাম, খালা! আপনার বাড়ী কোথায়? দুঃখে, ক্ষোভে, রাগে, গোস্বায় যেন আনমনাভাবে জবাব দিল, ‘এইডাই’। বললাম, আরে না আসল বাড়ী? ‘আসল বাড়ীও এইডাই’। ছল ছল অশ্রুসিক্ত অবস্থায় আচলে মুখ ছাপিয়ে কক্ষের ভিতরে চলে গেলেন। কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে রাযী হ’লেন না তিনি। সকলের ভিতরে যেন একই অনুভূতি, ‘আমরা সন্তান হারা, পরিবার হারা, নিঃশ্ব, অসহায়’।
এক বৃদ্ধা মায়ের মনের অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি উত্তরে বলেন, বাবা শোন ঝড় উঠলে সংকেত দিয়ে জানানো হয় কত বেগে ঝড় বইছে। কিন্তু সন্তানের কথা বা পরিবারের কথা মনে হ’লে ভিতরে যে ঝড় বয়ে যায় তার গতিবেগ হিসাব করে বের করার সাধ্য আমার নেই। তাদের কথা শুনে মনের অজান্তে গন্ড বেয়ে দু’ফোঁটা পানি চলে এল। চোখের ঝাপসা নযরে মিলিয়ে গেল বৃদ্ধাশ্রম। এমন অসহনীয় পরিস্থিতিতে দিনাতিপাত করে বৃদ্ধরা। অনুভূতির এক নমুনা পাওয়া যায় বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত বৃদ্ধাশ্রম থেকে সন্তানদের প্রতি প্রেরিত চিঠি-পত্রেও।
– মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
পরবর্তী অংশ পড়ুন: বৃদ্ধাশ্রম : মানবতার কলঙ্কিত কারাগার (২)
[1]. প্রথম আলো, ১৭ই জানুয়ারী’১৪।
[2]. সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তন ডটকম, ২৮শে অক্টোবর’১৮।
[3]. ভোরের কাগজ ১০ই নভেম্বর’১৪।
[4]. দৈনিক যুগান্তর, ২৫শে সেপ্টেম্বর’১৮, জাগো নিউজ ডটকম, ৭ই মে’১৬।
[5]. প্রথম আলো, ২৮শে জুন’১৯।
[6]. সিটিজিবার্তা ডটকম, ৬ই মে ’১৯।
[7]. দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ই ফেব্রুয়ারী’১৪।
[8]. নতুন সময় টিভি ২৯শে এপ্রিল’১৯।
[9]. নয়াদিগন্ত ২৮শে সেপ্টেম্বর’১৮।
[10]. বাংলাদেশ প্রতিদিন ৭ই নভেম্বর’১৮।
[11]. এটি এন টাইমস ১লা নভেম্বর’১৬।
[12]. প্রথম আলো, ১৪ই মে’১৭।
[13]. প্রথম আলো, ১৪ই মে’১৭।
[14]. প্রথম আলো, ১৪ই মে’১৭।
[15]. সিটিজিবার্তা ২৪শে ডটকম, ৬ই মে’১৯।
[16]. এটি এন টাইমস ১লা নভেম্বর’১৬।
[17]. একুশে টেলিভিশন, ২২শে জানুয়ারী’১৮।