শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার উপায়
সমাজে সর্বত্র অশান্তি বিরাজ করছে। মানুষের জান-মাল ও ইযযতের নিরাপত্তা নেই। দু’বছরের বাচ্চা থেকে শতবর্ষী অন্ধ বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষিতা হচ্ছে। ইয়াবা সর্বত্র হাতের নাগালে এসে যাচ্ছে। তুচ্ছ কারণে মানুষ খুন হচ্ছে। প্রকাশ্যে দিনমানে শত শত লোকের সামনে মানুষকে কুপিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে। কিশোর অপরাধ কল্পনাতীত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বড়-ছোট ভেদাভেদ নেই। মানীর মান নেই। মা-বোন জ্ঞান নেই। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এমন সব নোংরা ঘটনা ঘটছে অহরহ। ফলাফল এই দাঁড়িয়েছে যে, সমাজে সর্বত্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। কৃষক মূল্য না পেয়ে ধান পুড়িয়ে দিচ্ছে। খামারী দুধ মাটিতে ঢেলে দিচ্ছে। সন্তানের দুধ কিনতে না পারায় বয়স্ক অভাবী পিতা দোকান থেকে দুধের প্যাকেট চুরি করছে। ঈদের জামা কেনার আব্দার পূরণ করতে না পেরে ক্ষুধায় তাড়িত পিতা ৫ ও ৭ বছরের দুই কন্যা সন্তানকে বাযারে নিয়ে টয়লেটে ঢুকিয়ে গলা টিপে হত্যা করছে। দুই কোটির উপরে শিক্ষিত বেকার যুবক হতাশায় ভুগছে। স্বাধীন দেশে এগুলি কেউ ভাবতেও পারেনি। অথচ এটাই বাস্তব। এর ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে এই যে, তরুণ শ্রেণী স্বপ্ন দেখতে ভয় পাচ্ছে। অথচ তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদেরকে স্বপ্ন দেখাতেই হবে। তাদেরকে সাহসী করতেই হবে।
প্রসিদ্ধ আছে যে, ওমর ফারূক খলীফা (১৩-২৩ হি.) হওয়ার পর জনগণকে ডেকে বললেন, আমি যদি তোমাদেরকে আল্লাহর পথে না চালাই, তাহ’লে তোমরা কি করবে? একবার দু’বার তিনবারের পর একজন যুবক উঠে দাঁড়িয়ে তরবারি উঁচিয়ে বলল, এই তরবারি আপনাকে সোজা করবে। ওমর (রাঃ) শুকরিয়া আদায় করে বললেন, ঐ জাতি কখনো পথভ্রষ্ট হবে না, যে জাতির মধ্যে এমন সৎসাহসী তরুণ রয়েছে’। ওমর (রাঃ) একদিন খুৎবায় বললেন, বিয়ের সময় নারীদের অধিক মোহর দেওয়া যাবে না। মসজিদে উপস্থিত একজন মহিলা কুরআনের আয়াত (নিসা ২০) পড়ে বলে উঠল, হে খলীফা! আল্লাহ আমাদের যে অধিকার দিয়েছেন, আপনি তা ছিনিয়ে নিতে পারেন না। ওমর (রাঃ) তার আদেশ প্রত্যাহার করলেন ও অল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন’। রাষ্ট্রপ্রধানের সামনে এরূপ বাক স্বাধীনতা কল্পনাতীত। জাহেলী আরবের স্বেচ্ছাচারী সমাজ এমনি করে নিয়ন্ত্রিত সমাজে পরিণত হয় স্রেফ আল্লাহ ও আখেরাতে জবাবদিহিতার ভয়ে। আজও তা সম্ভব, যদি প্রশাসন ও সমাজনেতারা উপরোক্ত নীতির অনুসারী হন।
শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার উপায় হল ২টি : অনুশাসন ও সুশাসন। এর মধ্যে অনুশাসন বা উপদেশ হল মূল। যার মাধ্যমে মানুষের আক্বীদা পরিবর্তন হয়। আর তার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন হয়। লক্ষাধিক নবী-রাসূল প্রধানতঃ এ কাজটিই করে গেছেন। যদিও আল্লাহর বিশেষ রহমতে ইউসুফ, দাঊদ, সুলায়মান ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন।
সুশাসনের ভিত্তি হল ৪টি : দ্বীন, ন্যায়বিচার, পরামর্শ গ্রহণ ও সমৃদ্ধ কোষাগার। এগুলির মধ্যে প্রথম ও প্রধান ভিত্তি হল দ্বীন। দ্বীন না থাকলে বাকীগুলি অর্থহীন। দ্বীনদার সমাজে মনুষ্যত্ব নিরাপদ থাকে। বেদ্বীন সমাজে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়। আর প্রশাসন দ্বীনদার হ’লে তার প্রভাবে সমাজ দ্রুত পরিবর্তিত হয় (হজ্জ ৪১)। দ্বীন হল সমাজের দেওয়াল স্বরূপ। দ্বীন থাকলে সমাজ আপনা থেকেই নিরাপদ ও সুশৃংঙ্খল থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন বললেন, আল্লাহ অবশ্যই ইসলামী শাসনকে পূর্ণতা দান করবেন। তখন অবস্থা এমন শান্তিময় হবে যে, ইরাকের হীরা নগরীর একজন গৃহবধূ নিজ বাহনে সওয়ার হয়ে একাকী কা‘বাগৃহ তাওয়াফ করবে ও একাকী ফিরে আসবে, অথচ সে কাউকে ভয় পাবে না আল্লাহ ব্যতীত’ (বুঃ মিশকাত হা/৫৮৫৮)। এই নিরাপদ সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল খুলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলে। পরবর্তীকালেও তা কমবেশী অব্যাহত ছিল।
২য় ভিত্তি হল ন্যায়বিচার : এটিই প্রকৃত শান্তির দুয়ার ও সমাজের রক্ষা কবচ। এটা না থাকলে সমাজ নিরাপত্তাহীন হবে। শান্তি-শৃংখলা বিনষ্ট হবে। আল্লাহ স্বীয় নবী দাঊদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে দাঊদ! আমরা তোমাকে পৃথিবীতে শাসক নিযুক্ত করেছি। অতএব তুমি লোকদের মধ্যে ন্যায়বিচার কর। আর তুমি প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। কারণ তারা বিচার দিবসকে ভুলে যায়’ (ছোয়াদ ২৬)। উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালেক ইবনু মারওয়ান (৬৫-৮৬ হি.) তার পুত্রদের বলেন, তোমরা প্রত্যেকেই এই শাসন ক্ষমতার যোগ্যতা রাখ। … মনে রেখ, ন্যায়বিচার হল কঠোর শাসনের বহিঃপ্রকাশ, কঠোর শাস্তি প্রয়োগ নয়’। অতএব গুম, খুন, অপহরণ, ক্রস ফায়ার, বন্দুক যুদ্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করে সমাজে কখনো সুশাসন ফিরে আসবে না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ব্যতীত। একবার জনৈক কর্মকর্তা তার শহরের চারপাশে প্রাচীর দেওয়ার অনুমতি চেয়ে খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীযের (৯৯-১০১ হি.) নিকট পত্র পাঠান। জবাবে খলীফা তাকে লেখেন, তুমি তোমার নগরীকে ন্যায়বিচার দ্বারা প্রাচীর দাও এবং এর রাস্তাগুলিকে যুলুম থেকে পরিচ্ছন্ন কর’ (হিলইয়াতুল আউলিয়া ৫/৩০৫)। একবার বাদশাহ ইস্কান্দার একটি ভারতীয় প্রতিনিধি দলকে প্রশ্ন করেন, তোমাদের দেশে পুলিশের সংখ্যা কম কেন? তারা বলল, আমাদের পরস্পরের হক বুঝে দেওয়ার কারণে এবং আমাদের শাসকদের ন্যায়বিচার ও আমাদের সাথে তাদের সুন্দর আচরণের কারণে’ (মুহাযারাতুল আবরার ১/২৮৮ পৃ.)।
ন্যায়বিচারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল দল ও স্বজনপ্রীতি। এ থেকে নিষেধ করে আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সত্য সাক্ষ্য দানে অবিচল থাক এবং কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার কর, যা আল্লাহভীতির অধিকতর নিকটবর্তী’ (মায়েদাহ ৮)। ইবনু ওমর বলেন, আমার পিতা ওমর যখন লোকদের কোন বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করতেন, তখন নিজের পরিবারের সবাইকে জমা করে বলতেন, আমি লোকদের অমুক অমুক কাজে নিষেধ করেছি। তারা তোমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে এমনভাবে, যেভাবে পাখি গোশতের দিকে তাকিয়ে থাকে। যদি তোমরা ঐ কাজ কর, তাহ’লে তারা তা করবে। আর যদি বিরত থাক, তাহ’লে তারা বিরত থাকবে। আল্লাহর কসম! তোমাদের কেউ যদি আমার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, তাহ’লে আমি তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেব (মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক)। একবার এক মুসলিম ও ইহূদী তাঁর দরবারে বিচার প্রার্থী হল। তিনি রায় দিলেন ইহূদীর পক্ষে। এতে ইহূদী খুশী হয়ে বলে উঠল, আল্লাহর কসম! আপনি ন্যায়বিচার করেছেন। তখন ওমর তাকে বেত্রাঘাত করে বললেন, কিভাবে তুমি বুঝলে? ইহূদী বলল, আল্লাহর কসম! আমরা তওরাতে পেয়েছি যে, যখন কোন ন্যায়বিচারক ন্যায়বিচার করেন, তখন তার ডাইনে ও বামে দু’জন ফেরেশতা থাকেন, যারা তাকে সঠিক পথের দিশা দেন ও ন্যায়বিচারে সাহস যোগান। কিন্তু যখনই তিনি ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করেন, তখনই তারা তাকে ছেড়ে চলে যান’ (মালেক, মিশকাত হা/৩৭৪২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন সাত শ্রেণীর ব্যক্তিকে আল্লাহ ছায়া দিবেন। তাদের প্রথম ব্যক্তি হ’লেন ন্যায়বিচারক নেতা বা শাসক… (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৭০১)। তিনি বলেন, যদি কেউ এক বিঘত পরিমাণ যুলুম করে, তার গর্দানে ক্বিয়ামতের দিন সাত তবক যমীনের বেড়ী পরানো হবে’ (বুখারী হা/৩১৯৫)। তিনি আরও বলেন, ন্যায়বিচারকগণ আল্লাহর ডান পার্শ্বে নূরের আসন সমূহে বসবেন। আর আল্লাহর দুই হাতই ডান হাত। যারা তাদের প্রশাসনে, পরিবারে ও অধীনস্তদের মধ্যে ন্যায়বিচার করেন’ (মুঃ মিশকাত হা/৩৬৯০)। আল্লাহ বলেন, ‘আর আমরা তাদের উপর বিধিবদ্ধ করেছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং যখম সমূহের বদলে যখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সেটি তার জন্য কাফফারা হয়ে যায়। বস্ত্ততঃ যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা করে না, তারা যালেম’ (মায়েদাহ ৪৫)।
একবার জনৈক ইহূদী একজন মুসলিম মহিলার মাথা থেঁতলে দেয়। বিচারে রাসূল (ছাঃ) ঐ ইহূদীর মাথা থেঁতলে দেওয়ার আদেশ দেন এবং তা প্রতিপালিত হয় (বুঃ মিশকাত হা/৩৪৫৯)। একবার রাসূল (ছাঃ)-এর গোলাম ও প্রিয়তম ছাহাবী আনাস বিন মালেক (রাঃ)-এর চাচাতো বোন অন্য এক মহিলার দাঁত ভেঙ্গে দেয়। বিনিময়ে রাসূল (ছাঃ) তার দাঁত ভেঙ্গে দিতে বলেন। এতে আনাস (রাঃ)-এর চাচা বলে ওঠেন, আল্লাহর কসম! মহিলার দাঁত ভাঙ্গা হবেনা। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, এটা আল্লাহর নির্দেশ। তখন তারা রাযী হল এবং ‘দিয়াত’ বা রক্তমূল্য দিয়ে খুশী করলে বাদীনী তার দাবী উঠিয়ে নিলেন। ফলে তার দন্ড মওকূফ হল’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৩৪৬০)। একবার মক্কার সম্ভ্রান্ত বংশ বনু মাখযূমের জনৈকা মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়ল। তখন সবাই তাকে বাঁচাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। অবশেষে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রিয় নাতি উসামা বিন যায়েদকে গিয়ে তারা ধরলেন যাতে উসামা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে গিয়ে সুফারিশ করে। এ খবর জানতে পেয়ে রাসূল (ছাঃ) সবাইকে ডেকে ভাষণ দিয়ে বললেন, তোমাদের পূর্বেকার উম্মত (ইহূদী-নাছারা) অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে একারণে যে, যখন তাদের কোন সম্ভ্রান্ত লোক অপরাধ করত, তখন তাকে শাস্তি দিত না। কিন্তু কোন দুর্বল লোক অপরাধ করলে তার উপর দন্ড প্রয়োগ করত। মনে রেখ, মুহাম্মাদ কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করে, আমি তার হাত কেটে দেব’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৩৬১০)। তিনি বলেন, যদি কেউ দুনিয়াতে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে শাস্তি প্রাপ্ত হয়, তাহ’লে আখেরাতে এটি তার জন্য কাফফারা হবে’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/১৮)। এ কারণেই ব্যভিচারী পুরুষ মা‘এয আসলামী ও ব্যভিচারী গামেদী নারী স্বেচ্ছায় এসে মৃত্যুদন্ডের মত কঠোর শাস্তি গ্রহণ করেছিল জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচার আশায় (মুঃ মিশকাত হা/৩৫৬২)। অতএব দুনিয়াতে পাপমুক্ত হয়ে পরকালীন জীবনে প্রবেশ করাই হল বিচক্ষণ মুমিনের কর্তব্য (ইবনু মাজাহ হা/৪২৫৯)। নইলে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মানুষকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও আল্লাহকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। তাঁর বিচারে কোন যুলুম থাকবে না। সেদিন প্রত্যেক পাওনাদার তার হক পুরোপুরি বুঝে পাবে (বাক্বারাহ ২৮১)।
মনে রাখা আবশ্যক যে, দায়িত্বশীলের গুণাবলী ৫টি : (১) দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে আখেরাত কামনা করা (২) দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা (৩) দায়িত্বকে আল্লাহর অনুগ্রহ হিসাবে গণ্য করা এবং তার যথাযথ শুকরিয়া আদায় করা (৪) আল্লাহর অনুগ্রহ পেয়ে বিনয়ী হওয়া এবং উদ্ধত না হওয়া (৫) কর্মস্থলে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। যারা মুখে বলবে আমরা শান্তিপ্রিয় এবং সংশোধনকামী’ (ক্বাছাছ ৭৭-৭৮ ও বাক্বারাহ ১১-১২ আয়াতের শিক্ষণীয়)।
দায়িত্বশীলগণ যদি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করেন, তাদের পরিণতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ যখন তার কোন বান্দাকে লোকদের উপরে দায়িত্বশীল নিযুক্ত করেন, অতঃপর সে তার দায়িত্ব পালনে খেয়ানতকারী হিসাবে মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দেন (মুসলিম হা/১৪২)। অতএব যিনি যে পর্যায়ের দায়িত্বশীল, তাকে স্ব স্ব দায়িত্বের কৈফিয়ত আল্লাহর কাছে দিতে হবে। সেদিন এক অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলেও তা দেখা হবে এবং এক অণু পরিমাণ অন্যায় করলেও তা দেখা হবে (যিলযাল ৭-৮)।
৩য় ভিত্তি হল : পরামর্শ করা। এজন্য নির্ধারিত ব্যক্তিগণ ছাড়াও সমাজের অন্যান্য জ্ঞানী-গুণীদের নিকট থেকেও পরামর্শ নিতে হবে। এজন্য বলা হয়ে থাকে, ‘জ্ঞানের কথা জ্ঞানীর জন্য কুড়ানো মানিক সদৃশ’। আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, ‘তুমি তাদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ কর। অতঃপর যখন সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর’ (আলে ইমরান ১৫৯)।
৪র্থ ভিত্তি হল : রাজকোষ সমৃদ্ধ হওয়া। এজন্য দু’টি পথ রয়েছে। এক- হারাম আয়ের উৎস সমূহ বন্ধ করা এবং দুই- হালাল আয়ের উৎস সমূহ খুলে দেওয়া। এজন্য শর্ত হল দেশে ঈমান ও তাক্বওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা (আ‘রাফ ৯৬)। তাহ’লে কেবল সরকারী রাজকোষ নয়, জনগণের মধ্যে ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে। সরকারী প্রশাসন ও আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলি দুর্নীতিমুক্ত হ’লে বাকী সেক্টরগুলি আপনা থেকেই ঠিক হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ইয়াছরিবে হিজরত করে এলেন, তখন মাপ ও ওযনে কম দেওয়ার জন্য তারা প্রসিদ্ধ ছিল। অতঃপর যখন তারা মুসলমান হল এবং সূরা মুত্বাফফেফীন নাযিল হল, তখন মদীনাবাসীরা এই পাপ থেকে মুক্ত হল। মদ হারামের আয়াত নাযিল হ’লে তারা নিজেরা মদের ভান্ড গুলি রাস্তায় ঢেলে দিল ও মদ থেকে চিরতরে তওবা করল। ইসলাম আসার পর আরব জাতির মধ্যে সে সময়ে প্রচলিত ৩০-এর অধিক ব্যবসাকে হারাম করা হল, যা অত্যাচার মূলক ছিল। বর্তমান যুগের ভ্যাটসহ নানা ধরনের অত্যাচার মূলক আয়ের উৎস ও সূদী অর্থনীতি বন্ধ করা গেলে এবং যাকাত ও ইসলামী অর্থনীতি পূর্ণভাবে অনুসরণ করা গেলে, সাথে সাথে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে ইসলামী বিচার ব্যবস্থা চালু হ’লে দেশ অতি দ্রুত সুখী ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ।
বাংলাদেশ সর্বদা সমৃদ্ধ দেশ। বিগত দিনে বিদেশীরা সর্বদা এদিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছে এবং আজও তাকিয়ে আছে। তাই তাদের মাধ্যমে দেশে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের চাইতে বড় প্রয়োজন হল ভূগর্ভের ও ভূপৃষ্ঠের পানি দূষণমুক্ত করা এবং ঢাকা সহ দেশের নগরীগুলিকে বায়ু দূষণ হ’তে রক্ষা করা। নইলে দূষিত পানি ও দূষিত বায়ু সেবনে সত্ত্বর মানবতার ধ্বংস নেমে আসবে। অতএব বিদেশ নির্ভর না হয়ে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়ে একনিষ্ঠভাবে দেশের ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠের সম্পদ সমূহ কাজে লাগানোর মধ্যেই আল্লাহর রহমত অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহ বলেন, ‘জনপদের অধিবাসীরা যদি বিশ্বাস স্থাপন করত ও আল্লাহভীরু হ’ত, তাহ’লে আমরা তাদের উপর আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দুয়ারসমূহ খুলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যারোপ করল। ফলে তাদের কৃতকর্মের দরুণ আমরা তাদেরকে পাকড়াও করলাম’ (আ‘রাফ ৯৬)। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!
– ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব