হিজাব আমার স্বাধীনতা
আমরা যে পথে ভ্রমণ করছি, আমাদের এই পথ অনেক পরীক্ষায় পরিপূর্ণ, অনেক লোভনীয়ও বলা যায়। কিন্তু যদি একটু শান্তভাবে সুস্থির হয়ে ধৈর্য্যের সাথে এই পথের মুখোমুখি হতে পারি; একসাথে অনেকগুলো দুয়ার খুলে যাবে আমাদের সামনে, এতকিছু পাব যা দুহাত ভরে নিলেও শেষ হবে না কোনোদিন।
শুরুতে এটা কঠিন হতে পারে, সত্যিই আমাদের বেগ পেতে হতে পারে, এই পথে চলতে, নিজেকে সামলে রেখে লড়তে; নিজের লোভকে সংবরণ করে পথের লুকানো বিপদের মোকাবেলা করা একটু কষ্টকর নয় কি ? যখন তা লুকানো অবস্থায়, সাথে সাথে তা লোভনীয়ও । একটা সাপের মতো হতে পারে এই পথের লুকানো বিপদগুলো, এই সাপ আমাদেরকে চারদিক থেকে পেঁচিয়ে ধরে উপরে উঠতে থাকে, আমাদের শ্বাসরোধ করে আসে, তবু আমরা অনুমতি দেই নিজেকে সঁপে দেই, এমনকি আমাকে অন্ধ করে দেয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের চোখ খুলে যায় তখন, যখন সত্যিই আর দেখা যায় না কিছুই। আমিও হারিয়ে যাই অন্য সবার কাছ থেকে, দলছুট হয়ে পড়ি। সাপটি আমাকে ক্ষুধার্ত অজগরের মতন পেঁচিয়ে ধরে, আমার দম বন্ধ করে আসে, আমি শ্বাস নিতে পারি না। আমি দেখতে পারি না। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি, এত হতাশ লাগে, এত লজ্জিত মনে হয় নিজেকে। আমি জানিনা, কখন চোখ ভিজে আসে, ঘোলা হয়ে আসে আমার পৃথিবী। আমি আর্তনাদ করে উঠি। কিন্তু আমি কি ছেড়ে দেই ? আমি কি নিজেকে সাপের মুখে ঠেলে দেই ? আমি কি নিজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অন্যের উপর দিয়ে দেই ? যখন আমি জানি আমাকে ভেসে থাকতে হলে সাঁতরে তীরে পৌঁছুতেই হবে, বেঁচে থাকতে হলে ভেসে থাকতেই হবে, আমি কি চাইনা আমার নিজের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে সাঁতরে চলি, যতক্ষণ না আমার মাসল শক্ত হয়ে আসে, জমে যাই আমি। তবু তো আকঁড়ে ধরেছিলাম ভেসে থাকা খড়কুটো; জ্ঞান হারিয়ে অজানা দ্বীপে নিজেকে আবিষ্কারের আগের শেষ স্মৃতি এটাই ছিল। ডুবে যাবার আগেও শেষ পর্যন্ত ভেসেছিলাম। আসলে সিদ্ধান্তটা আমারই ছিল; ঠিক কোন মুহুর্তে আমি সিদ্ধান্ত নেব আর সাঁতার কাটব না ! নাকি শেষ পর্যন্ত আশা আর ভয়ের মাঝে টিকে থেকে লড়ে যাব ? আমি লড়ছিলাম শেষ পর্যন্ত।
‘আল্লাহু আকবার’
�
আমি চাই, এবং আমি যার কাছে চাই তিনি আমাকে ভালোবাসেন। সরীসৃপগুলো এটাকে খুব ভয় পায়, ওদের লকলকে জিভকে আমি আমার তিলাওয়াতের ছন্দ-সুরে দুভাগ করে চিরে দিই। ওরা আমাকে ভয় পায়, যখন আমি আমার মাথা মাটিতে ঠেকাই, আমার দৃপ্ত কপালে ধুলো মেখে আমি শুধু একজনকেই সন্তুষ্ট করার সংগ্রাম করে যাই । যাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসা যায়, চিরন্তন, একজনই তিনি, পরম দয়াময়।
�
এই কামনার কালসাপগুলো কোন গল্পকথা নয়, আমাদের চারপাশেই এরা থাকে, এদের বইতে এদের দেখি, এদের উপন্যাসে এদের দেখি, টিভিতে এরা আছে, অর্থহীন কথাবার্তায় গল্পগানে বন্ধুবেশে এরা লুকায়িত। এরা আমাকে এতটা ‘বড়’ প্রলোভন দেখাতে পারে, যা আমি জানি আমি কখনোই করব না। আবার এত ‘ছোট’ হতে পারে এদের প্রলোভন যা আমার হিজাবের থেকে একটি চুল হলেও বের করে আনে। ‘সামান্য’ একচির হলেও এরা চেষ্টা চালিয়েই যায়; সরীসৃপ। কিন্তু যখনই আমি সিদ্ধান্ত নেই, আমি ওদের পাতা ফাঁদে ধরা দেব কি দেবনা- ঐ একটি সেকেন্ডের মাঝেই আমার ঈমানের পরীক্ষা নেয়া; হয়ে গেছে।
�
আমরা কি জানি , আমাদের নিজের মাঝেই লুকায়িত সেই সরীসৃপকে, যার তুচ্ছতার কারণে অবহেলা করি, যা আমাকে ধোঁকা দেয়, এই প্রলোভন, কামনার কালসাপ। “শত্রুকে দুর্বল মনে করা” এটাই ছিল প্রথম ভুল যা আমাকে দুর্বল করে তাকে সবল করে দিল। হায় ! যদি শুরুতে শুরু হত এই লড়াই । এই সব হিসহিসে সরীসৃপ, আমার গা বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করছে, আমার ভয়ংকর দুঃস্বপ্নগুলো এভাবেই ভেঙ্গে যেত। আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে আছে, আমি চিৎকার করতে চাচ্ছি, কিন্তু পারছি না। আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, সব থেকে অসহায় মনে হয় এটাই ছিল। আমি কিছুই করতে পারছিলাম না, অথচ আমি নিজেকে এভাবে বিলিয়ে দিতে চাইনি; তারা অবাক হয়ে তাকাত আমার দিকে, আশ্চর্যও হত। আমিও তাদের দলেই ছিলাম, হিসহিসে সরীসৃপগুলোর খসখসে খোলসের সাথে; যখন পুরো ছবিটা একসাথে দেখার সুযোগ হল তার আগে কিছুই বুঝিনি, একটু বড় ভিউ পেতে হলে নিজেকে উপরে উঠাতেই হয়। উপর থেকে যিনি আমাকে দেখছেন, সেখান থেকেই নিজেকে দেখব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। এটাই ছিল যাত্রার শুরু। শুরুতে যা ছোট, সামান্য আর তুচ্ছ বলে হেলাফেলা করতাম সেগুলোকে আমার সাথে নিয়ে চলা শুরু করলাম; জমানো শুরু করলাম, ছোটোবেলার স্ট্যাম্প কালেক্টিং এর মত। মুত্তাকী হবার পথে স্মারক হিসেবে শুরুর স্মরণিকাগুলো সামান্যই; অন্তত আজ যেখান থেকে দেখি নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে। গোড়ালিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম অন্য পথ ধরে চলব বলে, যাদের তাকওয়া আছে, যারা তাদের পবিত্রতা রক্ষা করছে তাদের সাথে।
“নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন” (৩-৭৬)
মুত্তাকীদের মাঝে নিজেকে খুঁজে পাবার এই লড়াই হতে পারে কঠিন ও কঠোর, দীর্ঘ ও দৈনিক। কিন্তু সত্য হল এই লড়াই আমৃত্যু, কখনো শেষ হবার নয়। আমরা চাই টানেলের শেষে পৌঁছানো আলোকে আলোকিত হাসিমুখ দেখতে, অনেকগুলো আলোকিত মানুষের ছবি, আনন্দিত, আমাদের ভাইয়েরা বোনেরা সবাই বিজয়ীর বেশে। হাস্যোজ্জ্বল। তাই যখন নিজেকে অসহায় হিসেবে পাই, দেখি কামনার কালসাপ, দুনিয়ার ধোঁকা, লালসা । অথচ আশা,হতাশা আর বিশ্বাসের এই দোলাচলে মুক্তি পাওয়া আশ্চর্যরকম সহজ ! সমস্যা যত জটিল হয়, সমধান ততোধিক সরল হয়। আত্মসমর্পণ। আত্মসমর্পণ করা নিজেকে, আল্লাহর কাছে। আমাদের স্রষ্টা আমাদের সাথেই আছেন। একটু যদি বুঝতে পারতাম, সমস্যা সমাধানে অপারগ হয়ে নয়, একেবারে শুরু থেকেই। আল্লাহ আমাদের কাছেই আছেন। হতে পারে অনেক কঠিন, কিন্তু দিনশেষে এটাই সবচেয়ে সঠিক সমাধান। হিজাব ; কঠিন হতে পারে। কিন্তু পথের শেষে এর মূল্য হয় অমূল্য, এই মূল্য কষ্ট করে অর্জন করে নেয়ারই যোগ্য।
ভুল এমনটাও হতে পারে, একবার শুরু করার পর আবার ছেড়ে দেয়ার মত। স্ক্যারি ! সামনে তাকিয়ে যখন দেখি, আমি কিছুই জানিনা, জীবনের পথে-প্রান্তরে দিগন্ত কোথায় আমি জানি না; কিন্তু নিশ্চিত জানি ওরা আমার পরীক্ষা নেবেই, এই পথ আমিই বেছে নিয়েছি, লড়ে যাবার পথ। মাড়ির দাঁত দিতে কামড়ে ধরেছি আমার বিশ্বাস। কপালের ঘাম মুছে ফেলার সময় এখন, ভেবেছি ,দেখেছি, বুঝেছি। এবং আমার প্রথম পদক্ষেপে বিক্ষিপ্ত হয়েছে ধূলিময় পথ।
সবভুলে আনমনা হয়ে যখন পিছন ফিরে তাকাই, কতটা পথ পাড়ি দিয়ে এলাম। এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে তনুমন ভরে উঠে। আমার লড়াইয়ের গৌরবগাঁথা মেখে আছে ঐ ফেলে আসা হারানো দীর্ঘ পথ। আশৈশব, আজ এর মূল্য সূচিত হবে , প্রাপ্তির খাতায় দাগ পড়বে, পুরোনো দিনের হারানো লড়াই, সব থেকে দামী ছিল ঐ প্রথম দিনটাই।
‘ফার্স্ট স্টেপ ইজ দ্য হার্ডেস্ট’ ।
উঠে দাঁড়াও, ক্ষমা চাও, অন্ধকার যতই হোক না কেন, ধূলো ঝেড়ে মাথা উঁচু করে তাকাও, একেবারে টানেলের শেষদিকে। আলো এসে ছুঁয়ে যাবে তোমার হাসিমুখ। অন্ধকার যতই গাঢ় হোক না কেন। হারবে না লড়বে ; সিদ্ধান্তটা শেষ পর্যন্ত তোমারই।