আবহাওয়া দূষণ রোধে সবুজ উদ্ভিদ
বিদ্যমান উন্নয়ন ধরন (উৎপাদন, আহরণ, প্রবৃদ্ধি, ভোগ) দিয়ে বিশ্ব এক মহাবিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর থেকে রক্ষা পেতে গেলে উন্নয়নের ধারার মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ কার্বন-নিঃসরণমুখী উন্নয়ন করে না। চীন নিজ দেশে এখন উন্নয়নের ধরনে কয়লাকেন্দ্রিকতা কমাচ্ছে, কিন্তু বাড়াচ্ছে আফ্রিকায়। ভারত তার প্রতিবেশী দেশসমূহে এবং আফ্রিকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বেশী উৎসাহী। উদ্দেশ্য, নিজ দেশে কার্বন-নিঃসরণের মাত্রা কমানো। কিন্তু বিশ্ব, সমুদ্র, নদী, বায়ুমন্ডল সব তো অভিন্ন। যেখানেই ক্ষতি হোক না কেন তা সবার কাছেই গিয়ে পৌঁছাবে। আমাদের পৃথিবীটা এক দিনে উষ্ণ হয়নি। এর পেছনে তেল, কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারের উচ্চমাত্রা শুধু নয়, মুনাফাকেন্দ্রিক উৎপাদন ও ভোগের নির্বিচার বৃদ্ধিও যুক্ত। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উপাদান হ’ল সমরাস্ত্র খাতের ভয়ংকর বিকাশ। মানুষ ও পরিবেশকে ভয়াবহভাবে খুন করার যাবতীয় আয়োজন হয় এই খাতের প্রয়োজনে; নিত্য নতুন গবেষণা, বিনিয়োগ এবং উত্তেজনা-সংঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে। প্যারিস ঘোষণায় জলবায়ু বিপর্যস্ত দেশগুলোকে ১০ হাযার কোটি ডলার অর্থ যোগান দেওয়ার একটা অনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আছে। এই সঙ্গে এই অঙ্কটাও মাথায় রাখা দরকার যে, বিশ্বে প্রতিবছর সমরাস্ত্র খাতে খরচ হয় এর ১০ গুণ বা ১০ লাখ কোটি ডলারেরও অধিক অর্থ। যার প্রতিটি টাকা মানুষ ও পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
প্রকৃতি সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও, গড়ে প্রতি মিনিটে পৃথিবীর বুক থেকে ২১ হেক্টর বনভূমি আমরা উজাড় করছি; ৩৫,০০০ টন পেট্রোলিয়াম পোড়াচ্ছি; ১২,০০০ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশিয়ে দিচ্ছি; ৫০,০০০ টন উর্বর পরিমৃত্তিকা বাতাস অথবা পানিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। বিশ্বে প্রতি ঘণ্টায় ৬৮৫ হেক্টর ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে, ৫৫ জন মানুষ কীটপতঙ্গ নাশক দ্রব্যাদিজাত বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে; ৬০ জন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। জৈব পরিবেশের বিনষ্টের কারণে আগামী ২০২০ সাল নাগাদ প্রতি ২০ মিনিটে ১টি করে প্রাণী পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। এছাড়াও প্রতিদিন ২৫,০০০ মানুষ পানির অভাবে মারা যায়, ৩৬০টি পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র থেকে ১০ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়, উত্তর গোলার্ধে এসিড বৃষ্টির কারণে ২,৫০,০০০ টন সালফিউরিক এসিড নির্গত হয়, প্রায় ১৪০টি প্রাণী প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটছে, প্রায় ১,৪০,০০০ নতুন যানবাহন পথে নামছে, অশোধিত ১২,০০০ ব্যারেল খনিজ তেল মহাসাগরের পানিতে মিশছে এবং এসবই মানুষের ভোগের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।
প্রকৃতি হচ্ছে বিনাশযোগ্য অসংখ্য উপাদানের সমষ্টি। প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা আছে। কিন্তু তা মানুষের আগ্রাসী ভূমিকার কারণেই নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনে আরও অবনতি হয়েছে। পাশাপাশি যুদ্ধ, সহিংসতা, দখল ও গণহত্যায় বিশ্বের মানবিক পরিবেশ আরও অবনতির শিকার হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, বেড়েছে বঞ্চনা আর অনিশ্চয়তাও। সেজন্য দুনিয়াজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন এখন সন্ত্রাসীর মতোই বড় একটি বিপদ।
বাংলাদেশের সীমিত জমি, তারপরও রেন্ট-সিকারদের আওতায় যাচ্ছে বন-জঙ্গল, পাহাড়, জলাভূমি, বিল-খাল এমনকি নদী। খোদ রাজধানীতে বুড়িগঙ্গা, পাশে তুরাগ, বালু নদীর একই দৃশ্য। জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট কারণে নদী ও তার পরিবেশ বিপন্ন হ’লে বাংলাদেশের অস্তিত্বও বিপন্ন হবে। নদী হারানোর সর্বনাশ ১/২ বছরে, ১/২ দশকে বোঝা যায় না। অথচ এই নদীর পরিবেশ বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যতের অস্তিত্বের অবলম্বন। এগুলো কেবল নদী নয়, আমাদের সবার, দেশ ও মানুষের প্রাণ। প্রাকৃতিক সম্পদ হিসাবে পৃথিবীর প্রতিটি উদ্ভিদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশিক মূল্য রয়েছে। যেমন একটি পরিপক্ক উদ্ভিদ প্রায় ৩১,৫০০ ডলার মূল্যের অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে; প্রায় ৬২,২০০ ডলার মূল্যের বায়ু দূষণ রোধ করতে পারে; প্রায় ৩৭,৫০০ ডলার মূল্যের পানিকে বিভিন্ন প্রকারের দূষণ হ’তে রক্ষা করতে করে এবং ৩১,৫০০ ডলার মূল্যের ভূমি দূষণ রোধ করতে পারে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচী বা ইউএনইপি থেকে বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়নের জন্যে একটি শহরের মোট ২৫% উন্মুক্ত ভূমি থাকা প্রয়োজন। সাধারণত এই উন্মুক্ত ভূমি বলতে সবুজ এবং জলজ ভূমির একটা সহাবস্থানকে বোঝায়। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১.৭৪% আসে সবুজ বনজসম্পদ হ’তে। একটি সবুজ উদ্ভিদ- তার পরিচয় ব্যতিরেকেই উগান্ডাতে যে ভূমিকা পালন করছে- কাতারেও সেই একই ভূমিকা রাখছে। যেমন মানুষের খাদ্য হওয়া, পশু পাখির আশ্রয়স্থল; বায়ু, পানি, শব্দ এবং মাটি দূষণ রোধ এবং সর্বোপরি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। এজন্য উদ্ভিদ বপনের কোন বিকল্প নেই ।
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের দীর্ঘ ঘোষণা প্রকাশ করা হয়েছে যে, আমরা এমন এক বিশ্ব কল্পনা করি, যেখানে প্রতিটি দেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভোগ করবে এবং সবার জন্য শোভন কাজের নিশ্চয়তা থাকবে। এমন এক বিশ্ব, যেখানে ভোগ ও উৎপাদনের ধরন এবং সব প্রাকৃতিক সম্পদ বাতাস থেকে জমি, নদী, ভূগর্ভস্থ পানি থেকে সাগর মহাসাগর ব্যবহারের ধরন হবে টেকসই। আমরা এমন এক বিশ্ব কল্পনা করি, যেখানে গণতন্ত্র, সুশাসন ও আইনের শাসনের সঙ্গে সঙ্গে টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ রক্ষা হবে, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র ও ক্ষুধার নিরসন ঘটবে। এমন এক বিশ্ব, যেখানে উন্নয়ন ও প্রযুক্তির ব্যবহার হবে জলবায়ু সংবেদনশীল, যেখানে জীববৈচিত্র গুরুত্ব পাবে। এমন এক বিশ্ব, যেখানে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাঁচবে এবং যেখানে বন্য প্রাণী ও অন্যান্য জীবিত প্রজাতি রক্ষা পাবে। প্রকৃতপক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি হ’তে দেশের বিপর্যয় কমাতে বাতাস, পানি, মাটি ও খাদ্যের অর্থনীতির সাথে পরিবেশ নিরাপত্তার সমন্বয় করতে হবে।