ইমান/আখলাক

জবাবদিহিতার অনুভূতি

মানব জীবনে অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল জবাবদিহিতার অনুভূতির দুর্বলতা। যা দু’প্রকার : মানুষের নিকট জবাবদিহিতা এবং আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতা। মানুষের নিকট জবাবদিহিতার অনুভূতি কমে গেলে বা বিলুপ্ত হ’লে মানুষ যত না বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার চাইতে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার অনুভূতি বিলুপ্ত হ’লে। কেননা ‘আল্লাহর নিকটে যমীন ও আসমানের কোন কিছুই গোপন থাকে না’ (আলে ইমরান ৩/৫)। তিনি মানুষের চোখের চোরা চাহনি এবং তাদের বুকে যা লুকিয়ে থাকে, সবই জানেন (মুমিন ৪০/১৯)। যদি প্রত্যেক মানুষ স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে সজাগ হ’ত ও আখেরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতি তীব্রতর হ’ত, তাহ’লে সমাজের সিংহভাগ অভিযোগ ও সমস্যা বিদূরিত হ’ত।

মানব জাতির মধ্যে মুসলমান হ’ল মানবতার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। কারণ সে যা কিছুই করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য করে এবং আল্লাহর ভয়ে অন্যায় থেকে বিরত থাকে। সে জানে যে, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা সে (ক্বিয়ামতের দিন) দেখতে পাবে’। ‘আর কেউ অণু পরিমাণ মন্দকর্ম করলে তাও সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৭-৮)। আখেরাতে কঠিন শাস্তির ভয়ে সে সদা কম্পবান থাকে। কেননা সে জানে যে, সেদিন ‘যার ওযনের পাল্লা হালকা হবে’, ‘তার ঠিকানা হবে ‘হাভিয়াহ’। ‘তুমি কি জানো তা কি?’ ‘প্রজ্বলিত অগ্নি’ (ক্বারে‘আহ ১০১/৮-১১)। বস্ত্ততঃ ক্বিয়ামতের দিন ওযনের পাল্লা হালকা হওয়ার ভয়েই হযরত ওমর (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে বলতে গেলে ঘুমাতেন না। তিনি বলতেন, যদি আমি রাতে ঘুমাই, তাহ’লে আমি নিজেকে ধ্বংস করলাম। আর যদি দিনে ঘুমাই, তাহ’লে প্রজাদের ধ্বংস করলাম। কেননা আমি তাদের উপর দায়িত্বশীল (মাক্বরীযী, আল-খুত্বাত্ব ১/৩০৮)। উমাইয়া খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (৯৯-১০১ হি.) রাতের বেলা মোটা মোমবাতি জ্বেলে কর্মকর্তাদের ডেকে প্রজাদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হচ্ছিলেন। …এমন সময় একজন বলে উঠল, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনার নিজের অবস্থা ও পরিবারের অবস্থা কেমন? তখন খলীফা ফুঁ দিয়ে বড় মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলেন এবং গোলামকে উচ্চৈঃস্বরে ডেকে বললেন, চেরাগ নিয়ে আসার জন্য। কিছুক্ষণ পরে চেরাগ এল, যা নিবু নিবু আলোয় জ্বলছিল। এবার তিনি বললেন, তুমি এখন যা খুশী আমাকে প্রশ্ন কর। অতঃপর তিনি তার প্রশ্ন সমূহের উত্তর দিলেন। শেষে ঐ ব্যক্তি তাঁকে বড় মোমবাতিটি নিভিয়ে দিয়ে নিবু নিবু চেরাগ আনার কারণ কি জিজ্ঞেস করল। জবাবে খলীফা বললেন, হে আল্লাহর বান্দা! বড় মোমবাতিটি যা আমি নিভিয়ে দিয়েছি, সেটি ছিল আল্লাহর মাল ও মুসলমানদের মাল। তার আলোয় আমি প্রজাদের অবস্থাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলাম। কিন্তু যখনই তুমি আমার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে, তখনই আমি মুসলমানদের মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলাম’ (সীরাহ ওমর বিন আব্দুল আযীয ১৩৭-৩৮ পৃ.)

জবাবদিহিতার অনুভূতি ও দায়িত্বানুভূতির তীব্রতা মুসলিম নেতাদের মধ্যে কেমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর একটি ঘটনা থেকেই বুঝা যায়। একদিন তিনি প্রচন্ড সূর্যতাপে ছাদাক্বার উটের পরিচর্যা করছিলেন। এমন সময় বনু তামীমের নেতা আহনাফ বিন ক্বায়েস ইরাক থেকে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে আসেন। যখন তারা নিকটবর্তী হ’লেন, তখন খলীফা ওমর আহনাফকে ডেকে বললেন, হে আহনাফ! কাপড়-চোপড় ছেড়ে দ্রুত এস এবং এই উট পরিচর্যার ব্যাপারে আমীরুল মুমিনীনকে সাহায্য কর। কেননা এগুলি ছাদাক্বার উট। এর মধ্যে ইয়াতীম-মিসকীন ও বিধবাদের হক রয়েছে। তখন একজন বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনি ছাদাক্বা খাতের কোন একজন গোলামকে এ কাজের নির্দেশ দিলেই তো যথেষ্ট ছিল। জবাবে ওমর (রাঃ) বললেন, আমার চাইতে ও আহনাফের চাইতে বড় গোলাম আর কে আছে? কেননা যে ব্যক্তি মুসলমানদের কোন দায়িত্বে থাকে তার উপরে ঐরূপভাবে দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব, যেভাবে একজন মনিবের প্রতি গোলামের দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব’ (ইবনুল জাওযী, তারীখু ওমর ৮৯ পৃ.)

আববাসীয় খলীফা মুক্তাদী বি আমরিল্লাহ (৪৬৭-৪৮৭ হি.)-এর মন্ত্রী আবু শুজা‘-এর নিকটে জনৈক ব্যক্তি এসে বলল, আমাদের প্রতিবেশী একজন বিধবা আছেন, যার চারটি সন্তান রয়েছে। যারা নগ্ন দেহ ও ক্ষুধার্ত। কথাটি শোনার সাথে সাথে মন্ত্রী একজন লোক দিয়ে খাদ্য, বস্ত্র ও কিছু নগদ অর্থ পাঠিয়ে দিলেন। অতঃপর প্রচন্ড শীতে নিজের দেহের পোষাক খুলে রেখে দিলেন। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমি এই পোষাক পরবো না, যতক্ষণ না এই ব্যক্তি আমার নিকট তাদের খবর নিয়ে আসে’। লোকটি ছুটে চলে গেল এবং দায়িত্ব পালন করে ফিরে এসে বলল যে, তারা খুবই খুশী হয়েছে এবং মন্ত্রীর জন্য দো‘আ করেছে। একথা শোনার পর মন্ত্রী পোষাক পরিধান করলেন’ (আল-বিদায়াহ ১২/১৫০-৫১)। কি বিস্ময়কর কথা! একজন প্রজার দেহে কাপড় নেই শুনে মন্ত্রী নিজের দেহের কাপড় খুলে রেখে দিলেন। আর খবর না আসা পর্যন্ত ঐভাবেই প্রচন্ড শীতে কাঁপতে থাকলেন। এযুগে কি এর কোন তুলনা আছে? এটাই ছিল আল্লাহভীরু মন্ত্রীদের অন্যতম দৃষ্টান্ত। যারা জানতেন যে, ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক মানুষকে যে পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। তা হ’ল এই যে, তার জীবন সে কোন কাজে ব্যয় করেছে? তার যৌবন সে কোন কাজে জীর্ণ করেছে? সে কোন পথে আয় ও ব্যয় করেছে? সে যা ইলম শিখেছে, সে অনুযায়ী আমল করেছে কি-না?’ (তিরমিযী হা/২৪১৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ কোন বান্দাকে যদি প্রজাদের উপরে দায়িত্বশীল নিযুক্ত করেন, অতঃপর সে তাদের উপর খেয়ানতকারী হিসাবে মৃত্যুবরণ করে, তাহ’লে তার উপর আল্লাহ জান্নাতকে হারাম করে দেন’ (বুঃ মুঃ)। কেবল শাসকই নন, বরং যেকোন দায়িত্বশীলের জন্য একই হুকুম।

বয়স, যোগ্যতা ও পদমর্যাদার হিসাবে মানুষের জবাবদিহিতার তারতম্য হয়ে থাকে। সেদিকে লক্ষ্য করেই রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মনে রেখ তোমরা সবাই দায়িত্বশীল। আর তোমরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক তার প্রজাদের উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। ব্যক্তি তার পরিবারের উপরে দায়িত্বশীল। সে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার ও সন্তানদের উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। গোলাম তার মনিবের সম্পদের উপর দায়িত্বশীল। সে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’ (বুঃ মুঃ)। আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন তাদের কৃতকর্ম বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে তাদের যবান এবং তাদের হাত ও পা’ (নূর ২৪/২৪)। এমনকি প্রত্যেকের দেহচর্ম ও ত্বক তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে (হামীম সাজদাহ ৪১/২০-২৩)। অতএব হে মানুষ! অবিচ্ছেদ্য সাক্ষীদের থেকে সাবধান হও। হে দায়িত্বশীলগণ! ক্বিয়ামতের দিন নিজের আমলনামা নিজে পাঠ করার জন্য প্রস্ত্তত হও (বনু ইস্রাঈল ১৭/১৪)। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন!

– ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button