সচেতনতা

মসজিদ সংস্কারের গুরুত্ব

‘এই ওহিও করা হয়েছে যে, মসজিদগুলো আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করার জন্য। অতএব তোমরা আল্লাহ তায়ালার সাথে আর কাইকে ডেকো না’ (সূরা জিন : ১৮)। মসজিদ সম্পর্কিত পবিত্র কুরআনের বক্তব্য (আয়াত) সূরা বাকারা, সূরা আল-ইমরান, সূরা তাওবা, সূরা জিনসহ অনেক সূরাতে রয়েছে। পৃথিবীর প্রথম মসজিদ সম্পর্কে সূরা আল-ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে ‘নিশ্চয় মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা তো মক্কায় অবস্থিত। উহা বরকতময় এবং বিশ্বজগতের জন্য পথপ্রদর্শক।’ পবিত্র কুরআনের এই বর্ণনা মতে, পৃথিবীর প্রথম মসজিদ হচ্ছে বায়তুল্লাহ বা মসজিদুল হারাম। এরপর দ্বিতীয় মসজিদ হচ্ছে মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মোকাদ্দাস। তৃতীয়টি হচ্ছে মসজিদে কোবা এবং চতুর্থ মসজিদ ‘মসজিদে নববী’। পৃথিবীর প্রথম মসজিদ সম্পর্কে হজরত আবু যর রা: থেকে একটি হাদিস বর্ণিত রয়েছে। যে হাদিসে বলা হয়েছে, রাসূল সা:কে জিজ্ঞেস করা হলোÑ হে রাসূলুল্লাহ সা: পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রথম মসজিদ কোনটি? জবাবে রাসূলে করিম সা: বলেন, আল-মসজিদুল হারাম। অতঃপর জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, আল-মসজিদুল আকসা। এরপর তিনি (আবু যর) জিজ্ঞেস করলেন, এই দুটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার মধ্যে সময়ের ব্যবধান কত দিনের? জবাবে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ৪০ বছরের (মিশকাত)। অর্থাৎ নূহ আ:-এর প্লাবনের পর ইবরাহিম আ: তৈরি করেছিলেন বায়তুল্লাহ বা মসজিদুল হারাম, আর সুলায়মান আ: তৈরি করেছিলেন মসজিদুল আকসা। উভয় মসজিদই তৈরি করেছিলেন সর্বপ্রথম হজরত আদম আ:। আর ইবরাহিম আ: এবং সুলায়মান আ: নূহ নবীর প্লাবনের পর তা সংস্কার করেছিলেন মাত্র।

মসজিদ তৈরির ইতিহাসে হজরত মুহাম্মদ সা: প্রথম মসজিদ তৈরি করেছিলেন মদিনাতে; যার নাম মসজিদে কোবা। এরপর তিনি মদিনার কেন্দ্রস্থলে তৈরি করলেন মসজিদে নববী। আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মদ সা: যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন, তখন তিনি ‘কোবা’ নামক পল্লীতে ১৪ দিন অবস্থান করেন এবং সেখানেই তিনি মসজিদুল কোবা প্রতিষ্ঠিত করেন। এই মসজিদ সম্পর্কে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘প্রথম দিন থেকে যে মসজিদ তাকওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; হে নবী তোমার জন্য সর্বাধিক উপযোগী সেটিই, যেখানে তুমি ইবাদতের জন্য দাঁড়াবে’ (সূরা তাওবা : ১০৮)।

নতুন মসজিদ তৈরির জন্য মসজিদের নামে স্বত্ব করে জমি ক্রয় করতে হয়, কিংবা কোনো মুসলিম যদি মসজিদ নির্মাণের জন্য সম্পত্তি ওয়াকফ করতঃ স্বত্ব ত্যাগ করেন; তবে সেখানে মসজিদ নির্মাণে বাধা নেই। দেখা গেছে, মসজিদে নববী যে স্থানে অবস্থিত; ওই জায়গাটির মালিক ছিল বনু-নাজ্জার গোত্রের সোহেল ও সহল নামে দুই বালক। তাদের অভিভাবক ছিলেন আনসারদের প্রধান ‘আস’আদ ইবনে জোরারা’। আল্লাহর রাসূল সা: এই স্থানে মসজিদ নির্মাণের সঙ্কল্প করেছেন জেনে ইবনে জোরারা জায়গাটি মসজিদ তৈরির জন্য দান করতে চাইলেন। নবী করিম সা: এই প্রস্তাব গ্রহণ না করে নাজ্জার গোত্রের প্রধানদের ডেকে তাদের সামনে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা পুনরায় ব্যক্ত করলেন এবং ওই ভূখণ্ডের উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করে দিতে তাদের অনুরোধ করলেন। অবশেষে জমির উপযুক্ত মূল্য নির্ধারিত হলো এবং রাসূল সা:-এর নির্দেশে হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা: জমির মালিকদের মূল্য পরিশোধ করে দিলেন। অতঃপর সেখানে আল্লাহর নবী মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করলেন। তৈরির সময় মসজিদে নববী ছিল একটি সাধারণ খাঁচার মতো ইটের বেড়া দিয়ে ঘেরা; খুঁটি ছিল খেজুর গাছের কাঠ, আর ছাদ খেজুর গাছের ডালপালা। খায়বার যুদ্ধের পর মসজিদে নববীর আয়তন বৃদ্ধি করা হয়। এরপর মসজিদে নববীর আরো বহু সংস্কার হয়েছে।

যুগে যুগে পৃথিবীর মসজিদগুলো মসজিদে নববীর মতো সংস্কার হয়েছে, তাতে দোষের কিছু নেই। মসজিদে নববীকেও সংস্কার করা হয়েছে, পবিত্র কাবা শরিফেরও সংস্কার হয়েছে। হজরত ওমর রা: যখন খলিফা, তখন মসজিদে নববীর আয়তন আরো বৃদ্ধি করা হয়। হজরত ওসমানের সময় মসজিদে নববীতে পাথর-চুন-সুঁড়কি দিয়ে কাঠামো তৈরি করা হয়; আর শালকাঠে ছাদ করা হয়। মারওয়ান যখন মদিনার গভর্নর তখনো মসজিদে নববী কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে। বাদশা ওয়ালিদের আমলে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ৭০৬ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি সুশোভিত করে চার কোণায় চারটি মিনার স্থাপন করেন। এখন অবধি মসজিদে নববীকে বিভিন্ন ধাপে সংস্কার করা হচ্ছে।

সংস্কার সংস্কৃতিতে একটি মসজিদের আয়তন, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, উচ্চতা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি হতে পারে, হতে পারে টেকসই পদ্ধতির মসজিদ। মসজিদ অঙ্গনে মক্তব-মাদরাসা, পাঠাগার ইত্যাদিরও অনুমোদন ইসলামী দলিলে প্রমাণিত হয়ে আসছে। তবে মসজিদ অঙ্গনে আধুনিক শপিংমল, মার্কেট, বাজার সৃষ্টিতে ওলামারা একমত হতে পারেননি। পুরনো মসজিদ ভেঙে সেই স্থানে বহুতল ভবন করে নিচতলায় শপিংমল, মার্কেট, দোকানপাট ইত্যাদি রাখার ফতুয়া কুরআন-হাদিসে তো পাওয়া যাবেই না, এমন কি এ ব্যাপারে ইসলামী চিন্তাবিদদেরও কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় না। তবুও কোথাও কোথাও নিচতলায় মার্কেট, দোকানপাট রেখে উপর তলায় মসজিদ করতে দেখা যায়। এতে ভুল বোঝাবুঝির কারণে মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টি করে সংঘর্ষও হতে দেখা যায়। অনেকেই নিচতলায় মার্কেট রেখে উপর তলায় মসজিদ ‘ঝুলন্ত পদ্ধতি’র পে দামেস্কের মসজিদ, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, চকবাজার মসজিদের উদাহরণ টেনে থাকেন। এসব মসজিদের বৈধতার বিষয়ে ইজতেহাদ করার অবকাশ রয়েছে।

হাদিস শরিফে এসেছে, পৃথিবীর মধ্যে মর্যাদাপূর্ণ স্থান হচ্ছে মসজিদ। আর সবচেয়ে নিঃকৃষ্ট স্থান বাজার। মসজিদ অঙ্গনে সেই বাজার সৃষ্টির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ থাকতে পারে। ইসলামী চিন্তাবিদরা একমত হতে পেরেছেন যে, কোনো ভূখণ্ড যদি শুধু মসজিদ তৈরির নিমিত্তে ওয়াকফ করা হয়, তাহলে ওয়াকফকৃত সেই স্থানে মসজিদ ছাড়া অন্য কিছু করা বৈধ হবে না। আর যদি ওয়াকফ করা হয় এভাবে যে, এই স্থানটিতে একটি বিল্ডিং করা হলে এর নিচতলা মার্কেট এবং দ্বিতীয় বা তৃতীয় তলা মসজিদের জন্য উৎসর্গ করা হবে। এভাবে মসজিদ তৈরি বৈধ হলেও ওলামাগণ সেটাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। আবার এভাবে জমি খরিদ করা হয় যে, এই জমির ওপর একটি বিল্ডিং তৈরি করা হবে, যার নিচতলা কিংবা উপরতলা মার্কেট হবে এবং বাকি অংশ মসজিদ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকবে। এতে মার্কেট থেকে যে রোজগার হবে, তা দিয়ে মসজিদের ব্যয় সঙ্কুলান হবে; ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন পরিশোধ হবে। এরূপ সিদ্ধান্তে জমি খরিদ করার আগেই মসজিদের ব্যয় নির্বাহের জন্য মার্কেট করার উদ্দেশ্যে আলাদা করে জমি খরিদ করাই শ্রেয়। মনে রাখা যেতে পারে, মসজিদ কোনো ব্যবসায় বা কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠান নয়। মসজিদের ব্যয় নির্বাহ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। এ বিষয়ে মসজিদে দান-খয়রাত করার ওপর উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো স্থানে পূর্ব থেকে মসজিদ ছিল এখন সেই মসজিদ ভেঙে কিছু অংশে মার্কেট দোকানপাট করা আর কিছু অংশে মসজিদ করার সিদ্ধান্তে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। পূর্ব থেকে মসজিদ থাকা বা পুরনো মসজিদ ভেঙে মসজিদ সংস্কারের নামে শপিংমল-দোকানপাট করার বৈধতা কুরআন-হাদিসে আশা করা তো যায়ই না, এতে ওলামাগণও একমত হতে পারেন না। যে বিষয়ে একমত হওয়া যায় না, সেটা স্থগিত রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। এমনটা হলে দোষের নয় যে, মসজিদ চত্বরের বাইরে বা অন্য কোনো খানে মসজিদের নামে জমি খরিদ করা হয়েছে কিংবা দান হিসেবে পাওয়া গেছে, সেসব স্থানে মার্কেট তৈরি করে বৈধ ব্যবসার জন্য ভাড়া দিয়ে ভাড়ার সেই অর্থ দিয়ে মসজিদের ব্যয় নির্বাহ অবৈধ নয়। (সূত্র. আল মুহিতুল বুরহানি ৯/১২৮, ১৩৭; আলবাহরুর রায়কে ৫/২৫১; ফাতাওয়া খানিয়া ৩/২৯৩; রদ্দুল মুহতার ৪/৩৫৮)। হাদিস শরিফে এসেছেÑ রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে একটি মসজিদ নির্মাণ করবে, এর বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য বেহেশতে একটি বাড়ি তৈরি করবেন’ (বুখারি ও মুসলিম)। এই হাদিসটি কি মসজিদ সংস্কারের নামে মসজিদের সাথে মার্কেট তৈরিতে নিরুৎসাহী করে না? মুসলমানরা এত সঙ্কীর্ণ মানসিকতার হলো কেন যে, মসজিদের ব্যয় সঙ্কুলানের জন্য মসজিদ ভেঙে সেখানে মসজিদ ও মর্কেট করতে হবে? বরং তাদের মানসিকতা হওয়া উচিত ছিল, মসজিদের সামনের অঙ্গনকে সম্প্রসারিত করে মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে আর্থিক সহায়তা করা। একটু চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করলে দেখা যাবে; ছোট-বড় অনেক শহরেরই প্রাণকেন্দ্রে বড়-ছোট বহু ঈদগাহ মাঠ রয়েছে। সেখানে বছরে মাত্র দুই দিন নামাজ পড়া হয়ে থাকে। এত বড়-ছোট ঈদগা মাঠ যদি মাত্র দুই দিনের নামাজের জন্য ফেলে রাখা যায়, তাহলে যেখানে দিনে পাঁচবার নামাজ পড়তে হয়, সেই মসজিদে মার্কেট বানানোর চিন্তা মুসলমানদের মাথায় আসে কিভাবে? আর যদি মসজিদ সংস্কারের নামে পুরনো মসজিদ ভেঙে একটা অংশকে মার্কেট বানানোর প্রথা চলমান হতে থাকে, তবে অদূর ভবিষ্যতে ঈদগাহ মাঠগুলোকেও কী সংস্কারের নামে মার্কেট করে উপরের তলায় ঈদের জামাতের ব্যবস্থা হতে থাকবে! এমন হতে থাকলে ঈদগাহ মাঠে নামাজ আদায়ে যে খোলামেলা দৃশ্য ও সৌন্দর্য সেটা অদৃশ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে চিন্তার সীমাবদ্ধতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। মানুষের মধ্যে এরকম চিন্তার সীমাবদ্ধতা থাকলে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে ওঠতে পারে। মুসলিম সমাজব্যবস্থায় মসজিদের যে আবেদন, সে আবেদন নিচতলায় মার্কেট-শপিংমল-দোকানপাট রেখে উপরতলায় মসজিদ তৈরিতে পূরণ হয় না।

লেখক : ড. মোজাফফর হোসেন (গবেষক)

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button