সচেতনতা

জন্মদিনে যোগদান আর নয়!

দরজায় কে যেন কড়া নাড়লো। এগিয়ে গেল সুমির শাশুড়ি। উপরের তলার ভাড়াটিয়া রিনা। তার মেয়েটার জন্মদিন। তেমন বড় কোন আয়োজন নয়, অল্প আয়ের মানুষ, মেয়ের বান্ধবী, আর অল্পকিছু প্রতিবেশীর বাচ্চাদের নিয়ে একসাথে কেক কাটা হবে। বাড়িওয়ালার নাতিদুটোকে ও যেতে বলতে এসেছে।

১০ বছর হল মেয়েটার, কাছেই একটা স্কুলে পড়ে। বাবা মাকে এসে বলেছে, তার জন্মদিন পালন করা না হলে সে নাকি এবার পরীক্ষা দেবেনা। মেয়ের হুমকিতে নাকি নিজেদের ইচ্ছায় তাদেরকে জন্মদিন পালন করতে হবে। সুমি শুনতে পাচ্ছে তাদের কথাবার্তা। দেখছে আশেপাশে তার ছেলেরা আছে কিনা, বাচ্চারা শুনতে না পেলেই ভালো। সে আর কিছুতেই বাচ্চাদের এসব প্রোগামে যেতে দিবেনা।

কয়েক বছর আগের কথা। বড় বাচ্চাটার বয়স ২ /৩ হবে। আত্মীয়দের অনুরোধে, শাশুড়ির জোড়াজুড়িতে এসব অনুষ্ঠানে যেতে বাধ্য হয়েছে। ফলে বাচ্চাটার মাথায় ব্যাপারটা স্লো পয়জনিংর মত ঢুকে গিয়েছে। বছর বছর কাজিনদের বার্থডেতে যাচ্ছে, কেক কাটা দেখছে, গিফটের ছড়াছড়ি, লোক দেখানো বাড়াবাড়ি। কিন্তু তার বার্থডে যখন পালন হয়না, সেটা বাচ্চাটা একদিন জিজ্ঞাসা করে ফেলে। “আমার বার্থডে কবে হবে মা?” সুমি আর জবাব দিতে পারেনা।

বাচ্চাটার মন ছোট হয়ে যায়। ওর কাজিন, স্কুল, পাড়ার বন্ধুদের সবারই হয় ওর কেন হয়না? ছোট্ট মনে প্রশ্ন টা বার বার কড়া নাড়ে। সুমি বুঝতে পারে কিন্তু কি করবে? ভুলতো তার নিজেরো। অন্যের অনুরোধে ঢেঁকি গিলে এখন হজম করা কঠিন হয়ে গেছে।

যদিও আগে থেকে বুঝতে পারেনি, বাচ্চা এমন প্রশ্ন করবে, ওর মনে সংশয় তৈরি হবে। আমাদের বাচ্চাদের কি আর করিনি? এত্ত গোড়ামীর কি আছে? সমাজে চলতে হলে একটু আধটু এসব করতে হয় বৈকি! এসব কথায় নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা আসলেই ঠিক ছিলনা। বুঝতে পারছে ভালোভাবেই। দেরী হলেও সে প্রতিজ্ঞা করে আর না। বাচ্চাদের সাথে এই দুমুখো নীতি চলবে না।

ছোট বাচ্চাটার বেলায় সচেতন হয়ে যায়। যে যাই বলুক, এবার আর একই ভুল করতে চায়না সে। রিলেটিভরা মুখ কালো করে, প্রতিবেশীরা কথা বন্ধ করে দেয়, বন্ধুবান্ধব কমে আসে। কিন্তু এবার আর সেই একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি হয়না। ছোট বাচ্চাটা জানেই না, বার্থডে কি জিনিশ!

বছরের এই মাসটা আসলেই সুমির মনটা কেমন হয়ে যায়, সেই পুরানো দিনগুলো মনে হয়। প্রথম বার মা হওয়া যেকোন মেয়ের জীবনে বিশেষ ঘটনা। বড় ছেলেটার বয়স ৭ পুরা হল। এই মাসেই ওর আরো কয়েক কাজিনের জন্মদিন। বেশিরভাগই খুব হইহুল্লোড় করে পালন করে। সুমিও ব্যতিক্রম ছিলনা, ছোটবেলার জন্মদিনের ছবিগুলো দেখে এখনো নস্টালজিক হয়ে পড়ে। সেই সময়টা অন্যরকম ছিল। সবাই মিলে একসাথে খাওয়া, মজা করা, ছবি তোলা। তবে লোক দেখানোর ব্যাপারটা এতটা ছিলনা।

ওর ছেলেটা জানেনা ওর জন্মদিন কবে। বছরের আর সব সাধারণ দিনের মত এটা খুব সাধারণ একটা দিন। বাচ্চাদের মগজে এই চিন্তা ঢুকিয়ে দিতে না পারলে পরে আফসোস করে লাভ নেই।

সেদিন এক মায়ের কাছে শুনলাম, তার ৩ বছরের বাচ্চা নাকি বলেছে তার বার্থডে করতে হবে। কেক লাগবে, অমুক অমুককে ইনভাইট করতে হবে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাচ্চা কি করে এসব জানলো? যদি আপনি বাচ্চাকে না শেখান ও এসব শিখবে কি করে?

বার্থডে পার্টি কি জিনিশ, সেখানে সবাই মিলে কেক কেটে হাততালি দিলে গান গাইতে হয়, গিফট দিতে হয়। এসব কোন বাচ্চা জন্ম থেকে শিখে আসেনা। হয় দেখে শেখে অথবা বাবা মায়েরা নিজেরাই শেখান।

কয়েক বছর আগের কথা। এক জন্মদিনের প্রোগ্রামে গিয়েছি। দুই বছরের বাচ্চার জন্মদিন পালন করা হচ্ছে ঢাকার নামকরা ফাইভ স্টার হোটেলে, একটার পর একটা আয়োজন। জমকালো পোশাক, বাহারি ডেকোরেশন, বিশাল কেক, ফটোগ্রাফারদের ক্লিকক্লিক, কয়েক দফা খাওয়াদাওয়া, গেইম সো, গেস্টদের গিফট, আরো জানি কিসব!

মনে হচ্ছিল টাকা রাখার জায়গা পাচ্ছেনা। এসব জায়গায় গেলে মন কেমন হয়ে যায়! নাহ, নিজেদের কিছু কম আছে এটা ভেবে না, আমরা কি শিখেছি আর বাচ্চাদের কি শেখাচ্ছি? যে বাচ্চা এই বয়সে এতটা বিলাসিতায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে, সে বড় হয়ে অর্থকে মুল্যায়ন করবে, সেটা ভাবা বোকামি।

এরচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার নিজের বাচ্চার চোখের ভাষা; যে বোঝাতে চায় কিন্তু পারেনা, তার জন্যেও তার বাবা মা এমন অয়োজন করবে। ছোট বাচ্চার এত চাকচিক্য ভালো লাগাটাই স্বাভাবিক। এরপর এমন প্রোগ্রাম এড়িয়ে গিয়েছি বিভিন্ন অজুহাতে। এমনকি বান্ধবীর বাচ্চার জন্মদিনেও না।

জন্মদিন পালন একরকম পয়সা খরচ করে পাপ কেনার অপর নাম। ছোট্ট বাচ্চা যে জন্মদিনের কিছু বোঝেনা, তাকে ব্যাবহার করে, কেন্দ্র করে এই পাপের আসর বসাচ্ছি। ছোট কাল থেকে অপচয়, শো-ওফ শেখাচ্ছি। কারন জন্মদিন শুধু কেক কাটা আর খাওয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই, শুধু বাচ্চাদের প্রোগ্রাম নেই। সেখানে বড়রা সেজেগুজে পোজ দিয়ে ছবি তোলেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে আপ্লোড করেন। যিনি পালন করছেন, তিনি পাপ কামাচ্ছেন। যারা অংশ নিচ্ছেন তাদেরকেও সুযোগ করে দিচ্ছেন।

যারা এসব পালন করা নিয়ে স্ট্রাগল করছেন, করতে চাননা, যেতে চাননা; বাধ্য হয়ে করছেন, তারা ভেবে দেখুন বাচ্চাদের উপর এর প্রভাব। যেকোন শিশুর জন্য অতি আকর্ষণীয় এসব প্রোগ্রাম। আপনি যদি তাকে এসব দেখিয়ে অভ্যস্ত করেন, সে এসব পেতে চাইবে, তাকে দোষারোপ করা যাবেনা। আপনাকে, নিজেকে কঠোর হতে হবে এসব না মানার ব্যাপারে, কারন এসব পালন না করাই একজন মুসলিমের দায়িত্ব। ইসলামে জন্মদিন বলে কিছু নেই। নিজেরা মানলেই তো বাচ্চারা শিখবে এবং মানবে।

————————

জন্মদিনে যোগদান আর নয়!

ফাহমিদা হুসনে জাহান

#রৌদ্রময়ী_প্যারেন্টিং

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button