কালো মেয়ে
কালো মেয়ে নিয়ে যত লেখা পড়ি, মনে হয় কেউ অনর্থক স্তুতি গাইছে, কেউ অকারণ সান্তনা দিচ্ছে, অযাচিত সহানুভূতি দেখাচ্ছে।
লেখাগুলো সযত্নে এড়িয়ে যাই সবসময়। এটা লেখালেখির কোনো বিষয় হতে পারে মানতে পারি না একেবারেই। সেদিন একটা ছোট্ট মেয়ে বলল কালো মেয়ে নিয়ে লিখো। বরাবরের মত এড়িয়ে যাব ভেবেও এড়াতে পারলাম না। হয়ত অনেকের সাথে আমার মতের মিল হবে না, তবু ভাবলাম মেয়েটার জন্য লিখি। কালো মেয়ে কেন লেখালেখির বিষয় হতে পারে না, সেটাই না হয় লিখলাম!
শুরুটা কী দিয়ে করা উচিৎ? মনির হোসেনকে দিয়েই শুরু করি। যে সময়টার কথা বলছি, তখন মনির হোসেনের বয়স ছিল ৪-৫ বছর। কার্জনের মাঠে, পুকুর পাড়ে, বারান্দায় ওর অবাধ বিচরণ। কোথা থেকে যেন উদয় হয়ে কোলের উপর বাটি উপুর করে ফুল ঢেলে বলত ‘বিস তাকা দেন’। মনির হোসেন ফুল বেচা শেষে গল্প করতে আসতো। একদিন আমার পাশে বসে বলল “আপনার মত দেকতে আরেকটা আফা আছে। ঐ আফা ধলা।”
অতটুকু বাচ্চা, ঠিক আমার সাথে আমার পিঠাপিঠি বোনের পার্থক্য করে ফেলেছে গায়ের রঙ দিয়ে। স্কুলে ভার্সিটিতে সবাই যেখানে তালগোল পাকিয়ে ফেলত, মাঝেসাঝে বোনের ছয় মাসের মেয়েটাও যখন আমাকে মা ভেবে ভুল করে, সেখানে মনির হোসেন ঠিক পার্থক্য করে নিয়েছে- ঐ আফা ধলা।
গায়ের রঙের ব্যাপারটা আমি মনির হোসেনের মত করেই দেখি। গায়ের রঙ শ্রেফ একটা পার্থক্য সৃষ্টিকারী, আর কিছু না। আল্লাহর সৃষ্টিতে কত বৈচিত্র্য! তিনি কেন সবাইকে এক রঙে রাঙাবেন?
চোখের সামনে ‘আদর্শ গায়ের রঙের’ প্রায় আমার মতই একজনকে দেখেও কখনও মনে হয়নি গায়ের রঙ টা আরেকটু উজ্জ্বল হতে পারতো! আলহামদুলিল্লাহ, এটা আল্লাহর রহমত যে তিনি আমাকে এমন আফসোসের মুখোমুখি করেন নি।
কিন্তু অনেকের আফসোস আছে। এ আফসোস একদিনে তৈরি হয়নি। যখন একের পর এক বিয়ে ভেংগে যেতে থাকে রঙটা একটু ‘ময়লা’ বলে, যখন দিনের পর দিন অবজ্ঞার শিকার হতে হয় এই গায়ের রঙের জন্য, তখন যা আছে তা-ই ভাল ভেবে খুশি থাকাটা খুব কঠিন হয়ে যায়। এই আফসোসের পালে হাওয়া লাগায় কালো মেয়ে নিয়ে লেখালেখি। আমার আপত্তি আছে এসবে।
কিছু লেখা খুব স্থূল। যেমন-
“কালো মেয়েদের মনে ভীষণ মায়া থাকে। তারা স্বামীর সুখে অসুখে পাশে থাকে।”
বলাই বাহুল্য খুব বেশি অস্তিত্ব সংকটে না ভুগলে কালো মেয়েরা এসব স্তুতিবাক্যে স্বস্তি পাবে না।
তবে কিছু লেখায় কালো মেয়েদেরকে সান্তনা দেয়া হয় এভাবে-
কালো হলেও মেয়েটা দ্বীনদার হতে পারে।
কালো হলেও মেয়েটা মন মানসিকতায় উদার হতে পারে।
কালো হলেও একটা মেয়ে বুদ্ধিমতি হতে পারে।
সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা এই “কালো হলেও” তে। আমি যখন বলছি “মেয়েটা কালো হলেও….” তখন স্বীকার করে নিচ্ছি যে কালো হওয়াটা একটা ঘাটতি, একটা খুঁত। এই ঘাটতি পোষাতে এখন মেয়েটাকে দ্বীনদার হতে হবে, উদার হতে হবে, বুদ্ধিমতি হতে হবে…. নিদেনপক্ষে বলার মত কিছু একটা হতে হবে।
ভাই বোনেরা, বুঝে হোক বা না বুঝে হোক কখনো এভাবে বলবেন না। এতে কালো মেয়েদের মনে পাকাপোক্ত ধারণা হয়ে যায় স্রষ্টা তাকে খুঁতো মেয়ে বানিয়ে পাঠিয়েছে। এখন হয় রঙ ফর্সা ক্রীম ডলতে হবে, নয়ত এক্সট্রা অর্ডিনারি হয়ে কালোত্বের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে।
দয়া করে কখনো বলবেন না একটা ফর্সা মেয়ের মনে রঙের জন্য অহংকার থাকতে পারে, নিরহংকারী কালো মেয়ে তার থেকে শ্রেয়। এতে ফর্সা মেয়ের নৈতিক স্খলনে কালো মেয়ে অনর্থক সান্তনা খুঁজে নিতে পারে।
কেউ গায়ের রঙের জন্য অহংকার করছে এটা যেমন খারাপ, কেউ গায়ের রঙের জন্য আফসোস করছে এটাও ভাল কিছু না। বরং একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। যে মেয়েটা কালো রঙ নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগছে, সে হঠাৎ ফর্সা হয়ে গেলে রঙ নিয়ে অহংকারী হয়ে উঠবে এটাই তো স্বাভাবিক!
কালো মেয়ে নিয়ে যদি লিখতেই হয়, তবে তাদের আফসোস দূর হবে এমন কিছু লেখা উচিৎ। তাদের বোঝানো উচিৎ কারো অপছন্দে তার আল্লাহ প্রদত্ত রঙটা অসুন্দর হয়ে যায় না।
কেউ সমুদ্র ভালবাসে, কেউ নদী ভালোবাসে। কেউ বা কী সমুদ্র কী নদী দু’টোতেই সমান মুগ্ধ!
রঙের ব্যাপারটাও তাই। যে তোমায় গায়ের রঙ দেখে ফিরিয়ে দিল, তার রুচিবোধ তোমার সৌন্দর্যের সাথে মেলে না। ব্যস এটুকুই!
হ্যাঁ, শ্রেফ রঙের জন্য ফিরিয়ে দিলে খুব কষ্ট লাগতেই পারে। কিন্তু, তোমার অন্যান্য গুনের সে মূল্যায়ন করেনি এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ধরে নিচ্ছো না কেন?
যার কাছে নিজের পছন্দ-অপছন্দ, রুচিবোধ বিশাল কিছু, সে সারাজীবন তোমার তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে বিশাল সমস্যা খুঁজে পেতে পারে। আল্লাহ কি তোমাকে সেই চুলচেরা বিশ্লেষণ থেকে বাঁচিয়ে দিলেন না?
আল্লাহর দুনিয়াটা প্রশস্ত। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ আছে যার কাছে গায়ের রঙ কোনো বিষয় না।
সেই মানুষটার সাথে দেখা হওয়ার আগে তুমি নিজেকে ভালোবাসতে শেখো। একবার আয়নার সামনে দাড়িয়ে দেখো, তোমার রঙটা বাজে না। তোমার চেহারাটা অসুন্দর না। আল্লাহ নিজে তোমার জন্য এ রঙ পছন্দ করেছেন, কারো স্বীকৃতি অস্বীকৃতিতে কিছু যায় আসে না।
————————–
আফিফা আবেদীন সাওদা
কালো মেয়ে