আপনার চিন্তাধারা আপনার অজান্তেই আল্লাহ্র শত্রুদের খুশি করছে না তো?
বহুবিবাহ ইস্যুতে ফেসবুক উত্তপ্ত। যেহেতু কথা বলতে পয়সা লাগে না, সবাই নিজের নিজের মূল্যবান মন্তব্যটি করে যাচ্ছেন। হাদীসের বক্তব্য নেই, সালাফদের কওল নেই, উলামাদের ব্যাখ্যা নেই, আছে অনেকগুলো “যদি, কিন্তু, অতএব” সহকারে যুক্তিপ্রয়োগ করে মনমতো ইসলাম প্রচার। এর ফাঁকতালে কিছু ভালো লেখাও যে নেই তা নয়।
এই হট টপিকে আমি না লিখে কীভাবে পারি? নাহ, লিখতে হচ্ছে। তবে এই ইস্যুতে বলার মতো প্রায় সবকথাই কেউ না কেউ বলে ফেলেছেন। চর্বিত চর্বণ করে যেহেতু লাভ নেই, আমি বরং ব্যাপারটাকে অন্য আলোকে দেখার চেষ্টা করি। যে ব্যাপারটা নিয়ে খুব সম্ভবত কেউ লিখছেন না।
সেটা হলো র্যান্ড। র্যান্ডের নাম শুনে অনেকে হয়তো নড়েচড়ে বসেছেন। আমেরিকান গ্লোবাল পলিসি থিঙ্কট্যাঙ্ক RAND Corporation এর মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক বিষয়ক পরামর্শ তৈরীর জন্য ২০০৩ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত রিপোর্ট Civil Democratic Islam এর কথা হয়তো অনেকেই জানেন । এই রিপোর্টে বিশ্লেষক শেরিল বেনার্ড বিশ্বের মুসলিমদের মোটাদাগে চারটি এবং অধিকতর সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে আটটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। এই শ্রেণীগুলোর চিন্তাধারার পার্থক্য বোঝানোর জন্য মুসলিম বিশ্বে কতগুলো কনটেম্পরারি ইস্যুতে শ্রেণীগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিগত প্রভেদ তারা তুলে ধরেছে।
সেগুলো কোন কোন ইস্যু?
গণতন্ত্র, হিজাব, জিহাদ, সংখ্যালঘু অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, নারী অধিকার, ইসলামী রাষ্ট্র, বহুবিবাহ ইত্যাদি।
মনে হচ্ছে না- বহুবিবাহ! সিরিয়াসলি!! এত এত জিনিস থাকতে র্যান্ডও পড়লো বহুবিবাহ নিয়ে!!!
অনেকে বলেন, সমাজে এত এত সুন্নাহ বাকি থাকতে কিছু লোক বহুবিবাহ নিয়ে আলাপ করে কেন। এদের আসলে র্যান্ডের কাছে প্রশ্ন করা উচিত, সালাত, সিয়াম, হাজ্জ, যাকাতের মতো ইসলামের একেবারে বুনিয়াদি সব বিধান বাদ দিয়ে হিজাব, জিহাদ, গণতন্ত্র দিয়ে তারা মুসলিমদের যাচাই করবে কেন।
কেন করবে, তারা বোঝে, বুঝি না আমরা। ইসলামের যতগুলো বিধান আছে সেগুলোর মধ্যে কিছু বিধানকে দুনিয়ার প্রায় সব মুসলিম কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে মানার পক্ষে। আর কতগুলো বিধান আছে যেগুলো এসে গেলে অনেকেই কুরআন সুন্নাহকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের যুক্তি, বিবেক ব্যবহার করে যুগ-সময়ের দোহাই দেয়। নিজের মতো মডার্নাইজ করার চেষ্টা করে। পার্থক্যগুলো তখনই তৈরী হয়।
যেমন আপনি কোনও মুসলিমকে দেখবেন না বলবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সময়ে সালাত পাঁচ ওয়াক্ত প্রয়োজন ছিল, এখন সময় বদলেছে, তিন ওয়াক্ত পড়লেই হয়। কিংবা আল্লাহ্র রাসূলের যুগে সাওম ছিল সূর্যাস্ত পর্যন্ত, এখন অত দীর্ঘক্ষণ না রাখলেও চলে। কেউ বলবে না।
কিন্তু দুনিয়াতে অজস্র মুসলিম আছে যারা বলবে জিহাদ জিনিসটা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে ধর্মীয় ও পলিটিক্যাল কারণে দরকার ছিল, এখন এর দরকার নেই।
এজন্য মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য তুলে ধরতে র্যান্ড মানদণ্ড হিসেবে এমন কতগুলো বিষয়গুলোকে সামনে এনেছে, যা নিয়ে খোদ মুসলিমরাই শতধাবিভক্ত, এবং একটা বড় অংশই এগুলো নিয়ে ডিফেন্সিভ মেন্টালিটিতে বাস করে। এমনই একটা বিষয় হলো বহুবিবাহ।
র্যান্ডের রিপোর্টে বহুবিবাহের ব্যাপারে মুসলিমদের ভাগগুলোর অবস্থান আমি সংক্ষিপ্তরূপে উল্লেখ করছি। আটটা শ্রেণী বলতে গেলে লেখাটা অনেক বড় হয়ে যাবে বিধায় আমি মূল চারটার কথা উল্লেখ করছি।
প্রথম শ্রেণীটি হচ্ছে, ফান্ডামেন্টালিস্ট তথা মৌলবাদী। এরা হচ্ছে সেসব মুসলিম যারা কুরআন-সুন্নাহর হুবহু অনুসরণকে মানবমুক্তির একমাত্র পথ মনে করে। এরা ইসলামকে সমাজের সবক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে চায় এবং ইসলামের বিধানগুলোর মধ্যে কোনওরকম পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন নিয়ে আসার পক্ষপাতী নয়।
এদের ব্যাপারে র্যান্ডের মূল্যায়ন: মৌলবাদীরা মুসলিম বিশ্বে আমেরিকার প্রধান বাধা। এরা পশ্চিমা গণতন্ত্র এবং মূল্যবোধের ঘোর বিরোধী। আমেরিকাকে তারা শত্রুজ্ঞান করে। এদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলাটাই আমেরিকার জন্য কার্যকর স্ট্র্যাটেজি হবে।
র্যান্ডের রিপোর্টমতে, বহুবিবাহের ব্যাপারে মৌলবাদীদের অবস্থান: এরা বহুবিবাহকে একটা ভালো প্র্যাক্টিস মনে করে। এরা বিশ্বাস করে পশ্চিমা নৈতিকতা ব্যাভিচার, পরকীয়াসহ নানা অনাচারের জনক। এর বিপরীতে বহুবিবাহ অনেক কল্যাণকর একটি বিধান।
দ্বিতীয় শ্রেণীটি হচ্ছে, ট্রেডিশনালিস্ট। এই শ্রেণীতে আছে মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ নরমপন্থী আলেম এবং সংস্কারপন্থী ইসলামিস্ট। তারা ইসলামকে মেনে চলতে চায় তবে মৌলবাদীদের মতো কঠোরভাবে নয়।
এদের ব্যাপারে র্যান্ডের মূল্যায়ন: ট্রেডিশনালিস্টরা আমেরিকার জন্য সরাসরি হুমকিস্বরূপ না। এদের মধ্যে আধুনিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটানো সম্ভব। এদেরকে যেকোনমূল্যে মৌলবাদীদের সাথে একত্রিত হওয়া রোধ করতে হবে। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে এদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
র্যান্ডের রিপোর্টমতে, বহুবিবাহের ব্যাপারে ট্রেডিশনালিস্টদের অবস্থান: এরা মনে করে বহুবিবাহ জায়েয, তবে অনেক শর্ত আছে। আর বহুবিবাহ জায়েয হলেও একবিবাহই উত্তম। ট্রেডিশনালিস্টদের মধ্যে যারা সংস্কারপন্থী তারা মনে করে রাষ্ট্রীয় আইন যদি অনুমোদন না করে তবে বহুবিবাহ বৈধ নয়।
তৃতীয় শ্রেণীটি হচ্ছে, মডার্নিস্ট। নামটা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এরা ইসলামের আধুনিকায়নে বিশ্বাসী। ইসলামের অনেক বিধানের সরাসরি ইমপ্লিমেন্টেশানকে তারা বর্তমান সময়ে ইম্প্র্যাক্টিক্যাল মনে করে। কুরআন সুন্নাহর পরিবর্তে যুক্তি-বিবেক খাটিয়ে ইসলামের বিভিন্ন বিধানকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। এরা ইসলামের বিভিন্ন ইস্যুতে ক্ল্যাসিক্যাল উলামাদের চেয়ে ভিন্নতর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে। এরা মনে করে, মডার্নিজমের প্র্যাক্টিস ইসলামকে বরং শক্তিশালীই করবে।
এদের ব্যাপারে র্যান্ডের মূল্যায়ন: মডার্নিস্টরা মুসলিম বিশ্বে আমেরিকার সবচেয়ে মিত্রভাবাপন্ন। পশ্চিমা নৈতিকতা ও ধ্যানধারণার প্রসারে এরাই আমেরিকার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তাই এদেরকে বেশি বেশি প্যাট্রনাইজ করা প্রয়োজন। ক্লাসিক্যাল উলামাদের বক্তব্যের পাশাপাশি মডার্নিস্টদের ব্যাখ্যাকেও মুসলিমদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে।
র্যান্ডের রিপোর্টমতে, বহুবিবাহের ব্যাপারে মডার্নিস্টদের অবস্থান: মডার্নিস্টরা বহুবিবাহকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সময়ের জন্য প্রযোজ্য প্রথা মনে করে, যার উপযোগিতা বর্তমান যুগে নেই।
চতুর্থ শ্রেণীটি হচ্ছে, সেক্যুলার সম্প্রদায়। মুসলিম বিশ্বে যারা সেক্যুলার ধ্যানধারণা লালন করে, রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পৃথকীকরণের নীতিতে বিশ্বাসী, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ইসলামের হস্তক্ষেপের বিরোধী, তারাই এ শ্রেণীটির প্রতিনিধিত্ব করে।
এদের ব্যাপারে র্যান্ডের মূল্যায়ন: পশ্চিমা সেক্যুলার গণতন্ত্রের সাথে এদের মতাদর্শের গভীর সম্পর্ক আছে। সে হিসেবে আদর্শিকভাবে এরা মডার্নিস্টদের থেকেও আমেরিকার বড় মিত্র হবার কথা ছিল। কিন্তু অন্যান্য পার্সপেক্টিভে তাদের সাথে আমেরিকার কিছু বিরোধ রয়েছে। যেমন এদের বামপন্থী নীতি, আমেরিকাবিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি। তা সত্ত্বেও, মৌলবাদীদের মোকাবিলায় সেক্যুলাররা একটা বড় শক্তি।
র্যান্ডের রিপোর্টমতে, বহুবিবাহের ব্যাপারে সেক্যুলারদের অবস্থান: এরা বহুবিবাহকে অনুমোদন করে না।
—
শেষ কথা: বহুবিবাহের মতো একটা টপিক নিয়ে ফেসবুকে আলোচনা কতটা যৌক্তিক, কিংবা আলোচনা হলে কী অ্যাপ্রোচে হওয়া উচিত- তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু যে ব্যাপারটিতে বিতর্ক নেই তা হচ্ছে, আপনি বহুবিবাহের ব্যাপারে অনেকরকম কাল্পনিক শর্ত আরোপ করুন, বহুবিবাহকে এলিয়েনেট করুন, একে নেগেটিভভাবে উপস্থাপন করুন- আমেরিকান পলিসি মেকাররা আপনার কাছে এটাই প্রত্যাশা করে। কারণ আপনার অ্যাপ্রোচ মডার্নিজমের যত কাছাকাছি যাবে তত আপনি আমেরিকার জন্য সুবিধাজনক। কে না জানে, একুশ শতকে যুদ্ধ আর কেবল অস্ত্রে সীমাবদ্ধ নেই, মস্তিষ্কের লড়াইয়েও ছড়িয়ে পড়েছে। এ যুগে অন্যের ভূমি দখলের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো অন্যের ব্রেইনকে দখল করা, চিন্তাভাবনাকে কন্ট্রোল করা।
আপনার চিন্তাধারা আপনার অজান্তেই আল্লাহ্র শত্রুদের খুশি করছে কি না, ভেবে দেখার সময় বোধহয় এসে গেছে।
– MuHammad Jubaer
চমৎকার তথ্যপূর্ণ লিখা। মহান আল্লাহ উত্তম বিনিময় দিক। মুসলিম উম্মাহকে এক হওয়ার শক্তি দিক।