ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার ক্ষতিকর দিক কি জানেন?
আপনার এলাকায় কিছু পিচ্চি পোলাপান আপনাকে খুব বিরক্ত করে। তো একদিন রেগেমেগে একটা মেশিনগান নিয়ে তাদের দিকে গুলি ছুড়লেন। সবাই পালিয়ে গেল। আপনি খুব খুশি। আনন্দের চোটে মেশিনগানটা খালি রাস্তায় রেখে আপনি বাসায় চলে আসলেন।
এইখানে কেউ বলতে পারেন, পাগল নাকি? এমনটা কেউ করে?
করে। অধিকাংশ মানুষই এমন করে।
ধরেন আপনার ঠাণ্ডা লাগল। আপনি দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক এনে খেয়ে ফেললেন।
আসলে আপনি কী করলেন? আপনি আপনার দেহে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলোর কাছে অ্যান্টিবায়োটিক নামের মেশিনগান তুলে দিলেন। এখন ব্যাকটেরিয়াগুলো এই অ্যান্টিবায়োটিকটা খুলে দেখবে। এরপর কেমন করে সেটাকে অকেজো করা যায় তা নিয়ে গবেষণা করবে। এবং ব্যাকটেরিয়াগুলো যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না যে তাদের সমস্ত মস্তানি রং সাইড দিয়ে গাড়ি চালানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ – তারা সত্যি সত্যি গবেষণা করে অ্যান্টি-অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে ফেলবে অথবা নিজেদের জন্য এমন একটা বর্ম তৈরি করবে যে আপনার মেশিনগানের গুলি উপেক্ষা করে রোবোকপের মতো আপনার দিকে এগিয়ে আসতে থাকবে।
নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার কী?
আপনার তুলে দেওয়া অস্ত্র নিয়ে ব্যাকটেরিয়ারা শুধু আপনাকেই ঘায়েল করবে না, আপনার এলাকার অন্য মানুষদের করবে। আমি সিনেমা দেখি না অনেকদিন, কিন্তু যখন ব্যাকটেরিয়াল কালচারগুলোর অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স পরীক্ষার রিপোর্ট দেখি – তখন মনে হয় হরর মুভি দেখছি। একেকটা ব্যাকটেরিয়া স্ট্রেইনকে আমরা এত বড় ডাকু বানিয়ে ফেলেছি যে এদের থার্ড জেনারেশন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও আর মারা যাচ্ছে না!
অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারে দায়ী বাংলাদেশের কম-বেশি সবাই। তবে তিন শ্রেণীকে আমি আমলে নিতে চাই।
প্রথমত, রোগী এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন। দেখুন, আল্লাহ মানুষকে রোগ-ব্যাধি দিয়ে পরীক্ষা করেন। রোগ হলে পাপ মাফ হয়। একটু অসুস্থ হলে এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। ডাক্তারের কাছে দৌড়ানো বা ওষুধ খাওয়ার জন্য পাগল হওয়ার কিছু নেই। একটু সবর করুন। ধৈর্য ধরুন। আল্লাহকে ডাকুন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা শরীরকে একটা মেকানিসম দিয়েছেন নিজেকে সুস্থ করার জন্য। এই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে একটু সময় দিন।
এক সপ্তাহ ধরে অসুস্থ? এবার ডাক্তারের কাছে যান। পরামর্শ নিন। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক তো দূরের কথা, প্যারাসিটামল-ও খাবেন না। প্রতিটি ওষুধেরই কিছু না কিছু প্রতিক্রিয়া আছে।
আপনি কী জানেন, ওষুধকে শরীর কখনও আপন করে নেয় না? লিভার বা কিডনির অনেকগুলো কাজের মধ্যে একটা শরীর থেকে ওষুধ বের করে দেওয়া। যারা উল্টা-পাল্টা ওষুধ খান তারা এই দুটো অঙ্গের ওপরে অনেক যুলম করেন।
দ্বিতীয়ত, ওষুধের দোকানদার। দেখুন, ওষুধ আর মুদি-আনাজপাতি এক জিনিস নয়। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি করা একেবারেই অনুচিত। আর সবচেয়ে বড় অনুচিত কাজ ডাক্তারি করা – ক্রেতারা ওষুধ চাইলে ডাক্তারের কাছে যেতে বলুন। কটা টাকা বেশি বিক্রির জন্য বখাটেদের হাতে মেশিনগান তুলে দেওয়া আর যাই হোক হালাল হবে না।
সভ্যতা মানে সমাজের অসভ্যদের নিয়ন্ত্রণ করা। সমাজে কিছু আইন থাকবে, যারা মানবে না তাদের শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে। বাংলাদেশ বেশ কিছুদিন ধরে সভ্যতার এই সংজ্ঞার ওপরে উঠে গিয়েছে। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন এখন রূপকথার মতো লাগে।
এরপরেও যদি প্রশাসন, বিশেষ করে স্বাস্থ্য এবং ঔষধ প্রশাসনে ব্যতিক্রমী কিছু মানুষ থেকে থাকেন তাদেরকে আমি তৃতীয় দলে আনব। অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি থেকে শুরু করে খাওয়া অর্থাৎ, ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানিগুলোর প্রডাকশন, মার্কেটিং, ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন, দোকানে বিক্রি প্রতিটি স্তরে স্পষ্ট আইন এবং সেটার প্রয়োগ থাকা উচিত।
মেঘেদের সাথে কথা বলা শেষ। এবার মানুষদের সাথে কথা।
অ্যান্টিবায়োটিক আল্লাহর একটা রহমত মানব সভ্যতার প্রতি। এটা নিয়ে হেলা-ফেলা এবং স্বেচ্ছাচারের খেসারত দেবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রত্যেকটি কাজ সুচিন্তিত হওয়া উচিত। আমরা কারো হক নষ্ট করছি কিনা সেটা হিসাব করা।
অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে অনাচার জীবজগতের ভারসাম্যতা নষ্ট করে। এটা আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তনের শামিল। এগুলোর প্রতিক্রিয়া খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না বলে যে আল্লাহর সামনে এর হিসাব দেওয়া লাগবে না – এমনটি নয়। আমরা যেন আমাদের প্রতিটি কথা এবং কাজে আল্লাহকে ভয় করি।
আল্লাহ আমাদের যেন অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স জনিত মানবসৃষ্ট মহামারী থেকে আমাদের রক্ষা করেন।