সমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

মুসলিম উম্মাহর পদস্খলনের কারণ (১) : বাড়াবাড়ি, অজ্ঞতা, বিদআত

মুসলিম উম্মাহ আজ সোজা-সরল পথ পরিহার করে বাঁকা পথে চলছে। ফলে তারা বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হ্রাস পেয়েছে। শৌর্য-বীর্য হারিয়ে বাতিলের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। বাতিলরা তাদের উপর কর্তৃত্ব করছে। পরস্পরের মযবূত ঈমানী বন্ধুত্বের স্থান দখল করেছে শত্রুতা। এ সবকিছুর মূলে রয়েছে মুসলিম উম্মাহর পদস্খলন তথা কুরআন ও সুন্নাহর পথ থেকে সরে যাওয়া। আলোচ্য নিবন্ধে মুসলিম উম্মাহর পদস্খলনের কয়েকটি মৌলিক কারণ সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ্।

প্রথম কারণ : ধর্মে বাড়াবাড়ি (الغلو في الدين) :

গুলূ (غلو) তথা ধর্ম পালনে বাড়াবাড়ি, এটা মুসলিম উম্মাহর পদস্খলনের অন্যতম কারণ। আদম (আঃ)-কে পৃথিবীতে প্রেরণের পর থেকে তাওহীদ বা এক আল্লাহর ইবাদতের লক্ষ্যে মানবজাতির জীবন যাত্রার সূচনা হয়। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘আদম ও নূহ (আঃ)-এর মাঝে দশ শতাব্দীর ব্যবধান ছিল। আর এ দীর্ঘ সময় তারা সবাই খাঁটি মুসলিম ছিলেন’।[1] অতঃপর কালক্রমে তারা নেক ও সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে গিয়ে সীমালংঘন শুরু করে। ফলে তাদের আক্বীদা-বিশ্বাসে ভ্রষ্টতার অনুপ্রবেশ ঘটে। নেককার বান্দাদের সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করার সুযোগে শয়তান তাদের মূর্তি তৈরী করে তার পূজা করাকেই তাদের জন্য মনোহর করে তুলে। ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর ছহীহ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَقَالُوْا لَا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوْثَ وَيَعُوْقَ وَنَسْرًا- ‘তারা বলে, তোমরা তোমাদের উপাস্যদের ত্যাগ কর না এবং ত্যাগ কর না ওয়াদ, সুয়া, ইয়াগূছ, ইয়াঊক ও নাসরকে’ (নূহ ৭১/২৩)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘এরা নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নেককার বান্দা ছিলেন। তাদের মৃত্যুর পর শয়তান তাদের অনুসারীদেরকে এই বলে প্ররোচিত করল যে, তোমরা যেসব মহাপুরুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করে উপাসনা কর, তারা যে জায়গাগুলিতে বসতো সেখানে যদি তাদের প্রত্যেকের নামে প্রতিমা স্থাপন করে রেখে দাও, তাহ’লে তোমাদের উপাসনা পূর্ণতা লাভ করবে এবং বিনয় ও একাগ্রতা অর্জিত হবে। শয়তানের ধোঁকা বুঝতে না পেরে তারা মহাপুরুষদের প্রতিকৃতি তৈরী করে উপাসনালয়ে স্থাপন করল এবং তাদের স্মৃতি জাগরিত করে ইবাদতে বিশেষ মনোযোগ আসতে লাগল। কালক্রমে তারা সবাই দুনিয়া থেকে বিদায় নিল এবং নতুন এক বংশধর তাদের স্থলাভিষিক্ত হ’ল। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এ মূর্তিগুলি তৈরী এবং তা স্থাপনের প্রকৃত রহস্য অজানা ছিল। এ সুযোগে শয়তান এসে তাদেরকে বলল, তোমাদের পূর্বপুরুষরা এই মূর্তিগুলোরই উপাসনা করত। সুতরাং তোমরাও কর। তারা শয়তানের ফাঁদে পড়ে সেগুলোর পূজা শুরু করে দিল। এভাবেই তাদের ইবাদতের মধ্যে শিরকের সংমিশ্রণ ঘটল, যার মূল কারণ ছিল নেক ও সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের প্রতি ভালবাসায় অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি।

গুলূ বা ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি একটি মারাত্মক ব্যাধি, যা আক্বীদা ও বিশ্বাসকে বিনষ্ট করে ফেলে। জাতিকে ধ্বংস করে। কারণ এর ফলে মানুষ আল্লাহর নির্দেশকে লংঘন করে এবং তাঁর বিধান পালনে সীমাতিক্রম করে। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে এবং কাউকে সম্মান করার ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত করতে নিষেধ করেছেন। তা আক্বীদা-বিশ্বাস, কথা ও কর্ম যে কিছুর মাধ্যমেই হোক না কেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوْا فِيْ دِيْنِكُمْ ‘হে আহলে কিতাবগণ! তোমরা তোমাদের দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করো না’ (নিসা ৪/১৭১)। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তা অতিক্রম করো না। অত্র আয়াতে ‘আহলে কিতাব’ বলতে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন এবং উম্মতে মুহাম্মাদীকেও একই নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন,فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلَا تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ ‘অতএব তুমি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছ সেভাবে দৃঢ় থাক এবং যারা তোমার সাথে (শিরক ও কুফরী থেকে) তওবা করেছে তারাও। আর তোমরা সীমালংঘন করো না। নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের সকল কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করেন’ (হূদ ১১/১১২)

ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَإِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِى الدِّيْنِ فَإِنَّمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ فِى الدِّيْنِ ‘তোমরা দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থেকো। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা দ্বীনের ব্যাপারে সীমালংঘনের কারণেই ধ্বংস হয়েছে’।[2]

রাসূল (ছাঃ) কবরের পাশে কিংবা কবরের উপরে মসজিদ নির্মাণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। কেননা ছালেহীনের কবরের পাশে ইবাদত করলে তা একপর্যায়ে তাদেরই ইবাদত হয়ে যেতে পারে। একদা উম্মু হাবীবা ও উম্মু সালামা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে হাবশায় (আবিসিনিয়া) অবস্থিত গির্জার কথা বলেন, যাতে কিছু ছবি ও মূর্তি ছিল। তিনি শুনে  বললেন,أُولَئِكَ إِذَا كَانَ فِيْهِمُ الرَّجُلُ الصَّالِحُ فَمَاتَ بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا، وَصَوَّرُوْا فِيْهِ تِلْكَ الصُّوَرَ، فَأُوْلَئِكَ شِرَارُ الْخَلْقِ عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘ওরা এমন জাতি যে, তাদের মধ্যে কোন নেককার লোক মারা গেলে তারা তার কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করত এবং তাদের (সম্মানার্থে) সেখানে ছবি ও মূর্তি স্থাপন করতো। ওরাই কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি হিসাবে পরিগণিত হবে’।[3] তেমনিভাবে রাসূল (ছাঃ) তাঁর অতিরঞ্জিত প্রশংসা করতে নিষেধ করে বলেন,لاَ تُطْرُوْنِىْ كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ  ‘তোমরা আমার প্রশংসায় অতিরঞ্জন কর না, যেমন নাছারারা (খ্রীষ্টানরা) মারিয়াম পুত্র ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে করেছে। আমি কেবল আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা বল, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’।[4]

الإطراء প্রশংসায় বাড়াবাড়ি অর্থাৎ কারো প্রশংসার ব্যাপারে বাতিল ও মিথ্যার মাধ্যমে সীমালংঘন করা। আর রাসূল (ছাঃ) لا تطروني ‘তোমরা আমার অতিশয় প্রশংসা কর না’-এর অর্থ তোমরা আমার মিথ্যা প্রশংসা কর না। অথবা তোমরা আমার প্রশংসা করার ব্যাপারে সীমাতিক্রম কর না।

الغلو তথা বাড়াবাড়ি বিষয়টি খ্রীষ্টানদের মাঝে ব্যাপক। কেননা তারা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে ঈসা (আঃ)-কে উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করেছে। তারা তাঁর ইবাদত করে যেমন আল্লাহর ইবাদত করে। এমনকি যারা নিজেদেরকে ঈসা (আঃ)-এর অনুসারী দাবী করে, তারা তাদেরকে মা‘ছূম বা নিষ্পাপ মনে করে, তাদের প্রতিটি কথা হক বা বাতিল যাই হোক না কেন, তারা তা বিশ্বাস করে এবং অন্ধের মত তা অনুসরণও করে। অপরপক্ষে ইহুদীরা ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে খ্রীষ্টানদের পুরো বিরোধী আক্বীদা পোষণ করে এবং তারা তাঁকে জারজ সন্তান মনে করে (নাঊযুবিল্লাহ)।

রাসূল (ছাঃ) যে বাড়াবাড়িকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন, উম্মতে মুহাম্মাদীও তাতেই লিপ্ত। যেমন অনেক মানুষ আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে এবং তাদের জন্য নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করেছে। ফলে তারা ইহুদী-খ্রীষ্টান ও তাদের সমতুল্যদের সাথে মিলে গেছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে সম্প্রদায় যাদের সাথে সাদৃশ্য রাখে, তারা তাদেরই দলভুক্ত’।[5] যেমন চতুর্থ খলীফা আলী (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ধর্মত্যাগী খারেজীদের আবির্ভাব ঘটেছিল। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কারণে তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। আর এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন, যা ছহীহ হাদীছ গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। অনুরূপ রাফেযী, কাদারিয়া, জাহ্মিয়া ও মু‘তাযিলারাও দ্বীনের মধ্যে সীমালংঘন করেছে। তিনি আরোও বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে নিজেকে মুসলিম দাবী করে এবং পর্যাপ্ত ইবাদত করার পরও দ্বীনের বাপারে বাড়াবাড়ি করার কারণে কাউকে যদি ইসলাম বহির্ভূত গণ্য করা হয়ে থাকে, তাহ’লে জেনে রাখা দরকার যে, বর্তমানে নিজেকে কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী দাবী করেও একই কারণে দ্বীন থেকে খারিজ হ’তে পারে। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে (غلو) তথা ধর্মের নামে এমন বাড়াবাড়ি করা, যাকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীমে তিরস্কার ও ভৎর্সনা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে আহলে কিতাব! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না’ (নিসা ৪/১৭১)

উপরোক্ত অলোচনা হ’তে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, মানবজাতি যে সকল ফিৎনায় পতিত হয়, তন্মধ্যে বাড়াবাড়ি সবচেয়ে বড়। আর মুসলিম উম্মাহর সঠিক দ্বীন এবং সুস্থ চিন্তা-চেতনা থেকে বিচ্যুত হওয়ার অন্যতম কারণ ধর্মীয় বিষয়ে সীমালংঘন, যা মানুষকে গায়রুল্লাহর ইবাদতের দিকে ঠেলে দেয়। যেমন আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে আওলিয়া ও নেককার বান্দাদের নৈকট্য কামনা করা, তাদেরকে অসীলা হিসাবে গ্রহণ করা, তাদের কবরের পাশে ছালাত আদায়, তাদের কাছে দো‘আ ও মাগফিরাত কামনা করা, যবেহ করা, মানত করা, নযর মানা, কবর তওয়াফ করা এবং এসবের মাধ্যমে বরকত কামনা করা ইত্যাদি। এসবই শিরকের অন্তভুর্ক্ত, যা থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে সতর্ক করেছেন।

দ্বিতীয় কারণ : ধর্ম সম্বন্ধে অজ্ঞতা(الجهل بالدين) :‏‎ ‎

ধর্মীয় বিষয়ে ‎অজ্ঞতা একটি মারাত্মক ব্যাধি, যা মানুষকে পথভ্রষ্ট করে এবং এক পর্যায়ে তাকে ধ্বংসে ‎নিপতিত করে। তাই মুসলিম জাতির সঠিক পথ হ’তে বিচ্যুতির অন্যতম কারণ এই ধর্মীয় ‎অজ্ঞতা। রাসূল (ছাঃ) বলেন,‎

‏ إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا، يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا، اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوْسًا جُهَّالاً فَسُئِلُوْا، فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ، فَضَلُّوْا وَأَضَلُّوْا-

‘আল্লাহ তা‘আলা মানুষের নিকট থেকে বিদ্যা একেবারে তুলে নিবেন না।‎‏ ‏তবে ‎আলেমগণকে তুলে নেয়ার মাধ্যমে ইল্ম উঠিয়ে নিবেন। এমনকি একজন ‎আলেমও অবশিষ্ট থাকবে না। তখন মানুষ মূর্খ লোকদেরকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করবে। অতঃপর ‎তাদেরকে (দ্বীনের বিষয়ে) জিজ্ঞেস করা হ’লে তারা না জেনেই ফৎওয়া দিবে। ফলে তারা নিজেরা ‎পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে’।[6]

ইমাম নববী (রহঃ) অত্র হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘উল্লিখিত হাদীছে আলেমগণের বক্ষ ‎হ’তে ইলম উঠিয়ে নেয়া উদ্দেশ্য নয়। বরং এর অর্থ হ’ল আলেমগণের মৃত্যু ‎হবে, আর মানুষ অজ্ঞ লোকদেরকে ধর্মীয় বিষয়ে ফায়ছালাকারী হিসাবে গ্রহণ করবে। ফলে ‎তারা না জেনেই ফায়ছালা দিবে। এতে করে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরও ‎পথভ্রষ্ট করবে’।[7]

হাদীছে ‘ইলম’ দ্বারা কিতাব ও সুন্নাতের জ্ঞান বুঝানো হয়েছে, যা নবীগণের ‎উত্তরাধিকার ‎হিসাবে আলেমগণ পেয়ে থাকেন। তাই তাঁদের চলে যাওয়ায় ইলমও উঠে ‎যাবে, সুন্নাত ‎মুত্যুবরণ করবে, বিদ‘আত ছড়িয়ে পড়বে ও অজ্ঞতা ব্যাপক আকার ‎ধারণ ‎করবে। পক্ষান্তরে দুনিয়াবী শিক্ষা তো দিন দিন বৃদ্ধির পথে। ফলে  হাদীছ দ্বারা যে এই ‎বিদ্যা ‎উদ্দেশ্য নয় তা স্পষ্ট। এর প্রমাণ রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী,‎‏فَسُئِلُوْا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ، فَضَلُّوْا وَأَضَلُّوْا- ‘তাদেরকে (ফৎওয়া) জিজ্ঞেস করা হ’লে তারা না জেনেই ফৎওয়া দিবে, ‎ফলে ‎নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরকেও বিপথগামী করবে’। আর ভ্রষ্টতা †‎‎কবলমাত্র ‎শারঈ জ্ঞান না থাকলে হয়ে থাকে। কারণ  প্রকৃত আলেমগণ ইলম অনুযায়ী আমল ‎করেন, জাতিকে দিকনির্দেশনা দেন এবং তাদেরকে সত্য ও সঠিক পথের ‎দিশা দেন। আর সবচেয়ে বড় মূর্খতা হ’ল আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা এবং তাঁর সম্পর্কে না জেনেই ‎কিছু ‎বলা, তিনি যা হারাম করেছেন, তা হালাল সাব্যস্ত করা, অথবা যা হালাল করেছেন, ‎তা ‎হারাম করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‎

قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ-‏

‘তুমি বল, নিশ্চয়ই আমার প্রভু প্রকাশ্য ও গোপন সকল প্রকার অশ্লীলতা হারাম করেছেন এবং হারাম করেছেন সকল প্রকার পাপ ও অন্যায় বাড়াবাড়ি। আর তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না যে বিষয়ে তিনি কোন প্রমাণ নাযিল করেননি এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কথা বলো না যে বিষয়ে তোমরা কিছু জানো না’ (আ‘রাফ ৭/৩৩)। তিনি আরোও বলেন,‎‏فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِبًا لِيُضِلَّ النَّاسَ بِغَيْرِ عِلْمٍ إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ- ‘অতএব ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বড় যালেম আর কে আছে, যে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য বিনা প্রমাণে আল্লাহর উপরে মিথ্যারোপ করে? নিশ্চয়ই আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (আন‘আম ৬/১৪৪)। সুতরাং যে ব্যক্তি না জেনে ফৎওয়া দিবে, তাকে নিঃসন্দেহে নিজের পাপ এবং তা ‎অনুযায়ী ‎আমলকারীর পাপের বোঝা বহন করতে হবে।‎

মহান আল্লাহ্ বলেন,‎‎‏لِيَحْمِلُوْا أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِيْنَ يُضِلُّوْنَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ أَلاَ سَاءَ مَا يَزِرُوْنَ ‘ফলে কিয়ামতের দিন ওরা পূর্ণমাত্রায় বহন করবে ওদের পাপভার এবং তাদের পাপভার যাদেরকে ওরা অজ্ঞতা হেতু বিভ্রান্ত করেছে। সাবধান! কতই না নিকৃষ্ট ভার তারা বহন করবে’ (নাহল ১৬/২৫)

অজ্ঞতার ভয়াবহ বিপদ ব্যক্তির মাঝে এমনভাবে লুকিয়ে থাকে যে, সে ‎অহংকারবশতঃ সত্য শ্রবণে বিমুখ থাকে এবং সেটাকে ভারী বোঝা মনে করে। জ্ঞান ‎অর্জনকে সে ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তি বা ভূত-প্রেতের মত অদ্ভূত বলে ধারণা করে। ‎এমনকি ‎‎সে ধারণা করে যে, তা অর্জন করা তার পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। ফলে সে আজীবন ‎অজ্ঞই ‎‎থেকে যায়। অজ্ঞতা থেকে মুক্তির একমাত্র কার্যকারী ঔষধ শরী‘আতের জ্ঞান তথা কুরআন ও ‎সুন্নাতের ‎জ্ঞান অর্জন করা। কুরআন কারীমের অনেক জায়গায় এবং রাসূল (ছাঃ)-এর বহু ‎অমিয় ‎বাণীতে জ্ঞানার্জনের প্রতি উৎসাহিত করার পাশাপাশি জ্ঞানীদের মর্যাদা বর্ণনা ও ‎তার ‎ফযীলত আলোচিত হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেন,قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَالَّذِيْنَ لَا يَعْلَمُوْنَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ- ‘(হে নবী!) তুমি বল, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কী সমান? উপদেশ কেবল তারাই গ্রহণ করে, যারা বুদ্ধিমান’ (যুমার ৩৯/‏৯)। তিনি আরো বলেন,‎‎يَرْفَعِ اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا مِنْكُمْ وَالَّذِيْنَ أُوتُوْا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌ- ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং জ্ঞানপ্রাপ্ত, আল্লাহ তাদের মর্যাদা উঁচু করবেন, তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবগত’ (মুজাদালাহ ৫৮/১১)। মহান আল্লাহ আরোও বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল আলেমগণই তাঁকে ভয় করে’ (ফাত্বির ৩৫/‎‏২৮)।‎

জ্ঞানের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে হাদীছে সবিস্তার বর্ণনা এসেছে। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّيْنِ-‏ ‘আল্লাহ যার দ্বারা কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান ‎করেন’।[8] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِىْ اثْنَتَيْنِ رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَسُلِّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ فِىْ الْحَقِّ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ الْحِكْمَةَ، فَهْوَ يَقْضِىْ بِهَا وَيُعَلِّمُهَا-

‘কেবল দু’টি বিষয়ে ঈর্ষা করা বৈধ। এমন ব্যক্তি যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, সে তা হক্বের পথে ব্যয় করেছে। আর ঐ ব্যক্তি যাকে আল্লাহ হিকমত (শরী‘আতের জ্ঞান) দান করেছেন, অতঃপর সে তা দ্বারা বিচার ফায়ছালা করে এবং তা অন্যকেও শিক্ষা দেয়’।[9] তিনি আরো বলেন,

مَثَلُ مَا بَعَثَنِى اللهُ بِهِ مِنَ الْهُدَى وَالْعِلْمِ كَمَثَلِ الْغَيْثِ الْكَثِيْرِ أَصَابَ أَرْضًا، فَكَانَ مِنْهَا نَقِيَّةٌ قَبِلَتِ الْمَاءَ، فَأَنْبَتَتِ الْكَلأَ وَالْعُشْبَ الْكَثِيْرَ، وَكَانَتْ مِنْهَا أَجَادِبُ أَمْسَكَتِ الْمَاءَ، فَنَفَعَ اللهُ بِهَا النَّاسَ، فَشَرِبُوْا وَسَقَوْا وَزَرَعُوْا، وَأَصَابَتْ مِنْهَا طَائِفَةً أُخْرَى، إِنَّمَا هِىَ قِيْعَانٌ لاَ تُمْسِكُ مَاءً، وَلاَ تُنْبِتُ كَلأً، فَذَلِكَ مَثَلُ مَنْ فَقِهَ فِىْ دِيْنِ اللهِ وَنَفَعَهُ مَا بَعَثَنِى اللهُ بِهِ، فَعَلِمَ وَعَلَّمَ، ‏

‘আল্লাহ আমাকে যে হেদায়াত ও ইলম দিয়ে পাঠিয়েছেন তার দৃষ্টান্ত হ’ল যমীনের উপর পতিত প্রবল বর্ষণের ন্যায়। কোন কোন ভূমি থাকে উর্বর যা সেই পানি শুষে নিয়ে প্রচুর ঘাসপাতা এবং তরুলতা উৎপাদন করে। আর কোন কোন ভূমি থাকে এমন কঠিন যা পানি আটকে রাখে। আল্লাহ তা দিয়ে মানুষের উপকার করেন; তারা নিজেরা পান করে ও (পশুপালকে) পান করায় এবং তা দ্বারা চাষাবাদ করে। আবার কোন কোন জমি রয়েছে যা একেবারে মসৃণ ও সমতল; তা না পানি আটকে রাখে আর না কোন ঘাসপাতা উৎপাদন করে। এই হ’ল সেই ব্যক্তির দৃষ্টান্ত যে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং আল্লাহ আমাকে যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন তাতে সে উপকৃত হয়। ফলে সে নিজে শিক্ষা করে এবং অন্যকেও শিখায়’।[10]

এতদ্ব্যতীত কুরআন কারীমে ও হদীছে নববীতে আরোও অনেক দলীল রয়েছে, যাতে ইল্মের ফযীলত ও তা অর্জনের প্রতি উৎসাহিত করার পাশাপাশি সে অনুযায়ী আমল করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

তৃতীয় কারণ : ধর্মে বিদ‘আত সৃষ্টিالابتداع في الدين) ‏) :

মুসলিম জাতির পথভ্রষ্ট হওয়ার আরেকটি বড় কারণ বিদ‘আত। বিদ‘আত (‎البدعة‎) অর্থ নতুন সৃষ্টি। পূর্ব দৃষ্টান্ত ছাড়াই কোন কিছু উদ্ভাবন করাকে ‎বিদ‘আত বলা হয়। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,بَدِيْعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُوْلُ لَهُ كُنْ فَيَكُوْنُ- ‘তিনিই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলকে অনস্তিত্ব হ’তে অস্তিত্বে আনয়নকারী। যখন তিনি কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলেন, হও! অতঃপর হয়ে যায়’ (বাক্বারাহ ২/১১৭)। কোন ব্যক্তি যদি এমন একটি বিষয় উপস্থাপন করে, যা ইতিপূর্বে কেউ করেনি তাহ’লে বলা হয়, সে বিদ‘আত নিয়ে এসেছে। অর্থাৎ নতুন কিছু নিয়ে এসেছে।

পারিভাষিক অর্থে বিদ‘আতের পরিচয় দিতে গিয়ে ইমাম শাত্বেবী (রহঃ) বলেন, ‘দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন পন্থা সৃষ্টি করা, যা শরী‘আত মনে করে করা হয় এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করা হয়’। মোটকথা বিদ‘আত হ’ল দ্বীনের মধ্যে শরী‘আত মনে করে নতুন কিছু চালু করা, যা কুরআন ও হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয় এবং ছাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারাও সমর্থিত নয়। রাসূল (ছাঃ) দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছেন এবং তা থেকে সতর্ক করেছেন। তিনি তাঁর উম্মতের জন্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন যে, দ্বীনের মধ্যে প্রত্যেকটি বিদ‘আতই গোমরাহী। হাদীছে এসেছে,

عَنِ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ قَالَ صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم صَلاَةَ الصُّبْحِ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا بِوَجْهِهِ فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا فَقَالَ أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ-

‘ইরবায ইবনে সারিয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে ফজরের ছালাত আদায় করালেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ করে এমন সারগর্ভ বক্তব্য দিলেন, যাতে আমাদের অন্তর ভয়ে প্রকম্পিত হ’ল এবং চক্ষু অশ্রুসিক্ত হ’ল। এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! মনে হয়, এটিই বিদায়ী উপদেশ। সুতরাং আপনি আমাদের আরও ওছিয়ত করুন। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতি, আমীরের কথা শ্রবণ ও তাঁর আনুগত্যের অছিয়ত করছি, যদিও আমীর হাবশী ক্রীতদাস হয়। আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আমার পরে বেঁচে থাকবে, সে অচিরেই বহু মতভেদ দেখতে পাবে। সুতরাং সে অবস্থায় তোমরা আমার সুন্নাত ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরবে এবং তা দৃঢ়ভাবে ধরবে ও মাঢ়ির দাঁত দিয়ে অাঁকড়ে ধরে থাকবে। আর তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি থেকে সাবধান থাকবে। কেননা প্রত্যেকটি নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত, আর প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।[11] তিনি আরো বলেন,مَنْ أَحْدَثَ فِىْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু নতুন চালু করল যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত’।[12] অন্যত্র তিনি আরো বলেন,‎ مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ‏ ‘যে ব্যক্তি এমন আমল করল যে বিষয়ে আমাদের নির্দেশনা নেই তা প্রত্যাখ্যাত’।[13] নিঃসন্দেহে দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত আগেও ছিল, এখনো আছে। আর এটিই মুসলিম উম্মাহ্কে সঠিক পথ হ’তে বিচ্যুতির অন্যতম কারণ, যা মুসলিমদের ঐক্য বিনষ্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং একতা-সংহতি ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে। ফলে মানুষ নানা দল ও মতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। শাত্বেবী (রহঃ) বলেন, ‘অতঃপর কালক্রমে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় ও তাঁর মৃত্যুর পর ছাহাবীগণের যুগের অধিকাংশ সময় পর্যন্ত ইসলামে কোন ভেজালের অনুপ্রবেশ ঘটেনি। অর্থাৎ ইসলামের স্বকীয়তা বজায় ছিল এবং তাঁরা সকলেই সঠিক পথে ছিলেন। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে সুন্নাত হ’তে বিমুখতার রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা বিদ‘আত সমূহের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করে’।[14]

বিদ‘আতের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন,وَاعْلَمْ أَنَّ عَامَّةَ الْبِدَعِ الْمُتَعَلِّقَةِ بِالْعُلُومِ وَالْعِبَادَاتِ فِي هَذَا الْقَدَرِ وَغَيْرِهِ إنَّمَا وَقَعَ فِي الْأُمَّةِ فِي أَوَاخِرِ خِلَافَةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ كَمَا أَخْبَرَ بِهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَيْثُ قَالَ : مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ مِنْ بَعْدِي- ‘জেনে রাখা দরকার যে, খুলাফায়ে রাশেদা তথা চার খলীফার খেলাফতকালের শেষের দিকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে ইবাদতের ক্ষেত্রে বিদ‘আত ঢুকে পড়ে। আর এ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে, তারা অচিরেই ব্যাপক মতানৈক্য দেখতে পাবে। সুতরাং সে অবস্থায় তোমরা আমার সুন্নাত ও আমার পরবর্তী খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরবে’।[15]

কালক্রমে ক্বাদারিয়াদের বিদ‘আত প্রকাশ পায়। অতঃপর পর্যায়ক্রমে মুরজিয়া, শী‘আ ও খারেজীদের বিদ‘আত ছড়িয়ে পড়ে। যা রাসূল (ছাঃ) ঘোষিত শ্রেষ্ঠ যুগগুলির দ্বিতীয় যুগ তথা ছাহাবায়ে কেরামের সময়ে ঘটে। ঐ সমস্ত বিদ‘আত মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে তৎকালীন ছাহাবীগণ এসবের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং অপসন্দ করেন। অতঃপর মু‘তাযিলাদের বিদ‘আত প্রকাশ পায় এবং মুসলমানদের মাঝে ফিৎনা-ফাসাদ ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে ব্যাপক মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। কিছু মানুষ নিজেদের খেয়াল-খুশীর বশবর্তী হয়ে ঐ সকল বিদ‘আতের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এভাবেই দিন দিন বিদ‘আত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তা বিভিন্নরূপে মুসলিম সমাজে ঢুকে পড়ে।

আধুনিক যুগের বিদ‘আতসমূহ যেমন মীলাদুন্নবী অনুষ্ঠান, বিভিন্ন স্থান ও প্রাচীন নিদর্শনাবলী ও অলী-আওলিয়াদের জীবিত এবং মৃত ব্যক্তির মাধ্যমে বরকত কামনা করা ইত্যাদি। এছাড়া ইবাদতের ক্ষেত্রেও বিদ‘আত চালু রয়েছে যেমন ছালাতের শুরুতে আরবীতে নিয়ত পড়া, ছালাতের পর দলবদ্ধ মুনাজাত করা, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও মৃতব্যক্তির জন্য দো‘আ করার পর সূরা ফাতিহা পাঠ, মৃতের জন্য মাতম বা শোক সমাবেশের আয়োজন, ভোজের ব্যবস্থা ও কুরআন পাঠকারী ভাড়া করা…ইত্যাদি।

ইসরা ও মি‘রাজ, রাসূল (ছাঃ)-এর হিজরত… ইত্যাদি ধর্মীয় বিষয় উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এবং ছূফীদের বিশেষ পদ্ধতিতে যিকির করাও ইসলামী শরী‘আতে নবোদ্ভাবিত কর্ম বা বিদ‘আত। কেননা তাদের যিকিরের বাক্যসমূহ, পদ্ধতি ও সময়ের সাথে শারঈ যিকিরের কোন মিল নেই। বরং তা সম্পূর্ণ বিরোধী ও সাংঘর্ষিক। অনুরূপভাবে কবরের উপর ঘর নির্মাণ করে সেটিকে মসজিদ হিসাবে গ্রহণ করা, বরকতের আশায় সেখানে যিয়ারত করা, মৃতব্যক্তিদের অসীলা কামনা করা, এসবই শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

পরিশেষে ইমাম মালেক (রহঃ)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। তাঁর অন্যতম ছাত্র ও শিষ্য ইবনে মাজিশূন (রহঃ) বলেন, আমি ইমাম মালেক (রহঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে বিদ‘আত চালু করল এবং সেটিকে হাসানা বা ভাল মনে করল, সে যেন এমন দাবী করল যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) রিসালতের দায়িত্ব পালনে খেয়ানত করেছেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‎‎الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ ‏ ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম’ (মায়েদা ৫/৩)। সুতরাং সেদিন যা দ্বীন ছিল না, আজও তা দ্বীন হিসাবে পরিগণিত হবে না’।[16]

(চলবে)

– মীযানুর রহমান


[1]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, নবীদের কাহিনী  ১ম খন্ড, পৃঃ ৫১।

[2]. নাসাঈ হা/৩০৫৭; ইবনু মাজাহ হা/৩০২৯; ছহীহাহ হা/১২৮৩।

[3]. বুখারী হা/১৩৪১; মুসলিম হা/৫২৮; নাসাঈ হা/৭০৪।  

[4]. বুখারী হা/৩৪৪৫; মিশকাত হা/৪৮৯৭।

[5]. আবু দাউদ হা/৪০৩৩; মিশকাত হা/৪৩৪৭; ছহীহুল জামে‘ হা/২৮৩১।

[6]. বুখারী হা/১০০; মুসলিম হা/২৬৭৩; মিশকাত হা/২০৬।   

[7]. মিরকাত ১/২৯০ পৃঃ।

[8]. বুখারী হা/৩১১৬, ৭৩১২; মুসলিম হা/১০৩৭; মিশকাত হা/২০০।

[9]. বুখারী হা/১৪০৯, ৭১৪১; মুসলিম হা/৮১৬; মিশকাত হা/২০২।

[10]. বুখারী হা/৭৯; মুসলিম হা/২২৮২; মিশকাত হা/১৫০।

[11]. ইবনু মাজাহ হা/৪২; মিশকাত হা/১৬৫; ইরওয়াহ হা/২৪৫৫।

[12]. মুসলিম হা/৪৫৮৯; মিশকাত হা/১৪০।

[13]. মুসলিম হা/১৭১৮।

[14]. শাতেবী, আল-ই‘তিছাম ১/১২পৃঃ।

[15]. ঐ, ১/৩৩পৃঃ; ইবনু তায়মিয়া, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১০/২৫৪।

[16]. আল-ই’তিছাম, ১/৬৪-৬৫ পৃঃ।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button