যুলুমের পরিণাম ভয়াবহ
বিশ্বব্যাপী যুলুম বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানবাধিকার এখন কেবল শ্লোগানে পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় অধিকার, সত্য বলার অধিকার, জান-মাল-ইয্যতের অধিকার, বড়-ছোট ভেদাভেদ, পুরুষ ও নারীর ভেদাভেদ ইত্যাদি সব ধরনের মানবিক মূল্যবোধ এখন ভূলুণ্ঠিত। সর্বত্র যেন চলছে মত্ত হস্তীর লড়াই। বৃহৎ শক্তি অর্থ বৃহৎ অস্ত্রশক্তির মালিক। ধনী রাষ্ট্র অর্থ মুষ্টিমেয় ধনীদের রাষ্ট্র। গরীবেরা গণনার বাইরে। যেকোন অজুহাতে যেকোন রাষ্ট্রে বোমা ফেলে নিরীহ মানুষ হত্যা করাই এখন গণতন্ত্র উদ্ধারের বড় মাধ্যম। বিশ্বায়ন ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে দেশে দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ ও নির্যাতন এখন অঘোষিত আইনে পরিণত হয়েছে। এমনকি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার নীল নকশায় ক্ষমতার বদল হয়; ভোটাভুটি নাকি আইওয়াশ মাত্র। যুলুম করে শক্তিমানরা। তারা ব্যক্তি, দল, সরকারী প্রশাসন বা আদালত যে কেউ হ’তে পারে। আর যালেমদের বাঁচার হাতিয়ার হ’ল মিথ্যাচার। যে যত বড় যালেম, সে তত বড় মিথ্যাবাদী। রাষ্ট্রীয় নির্যাতনে বিশ্বব্যাপী দুর্নাম কুড়িয়েছেন জার্মানীর চ্যান্সেলর ও ফুয়েরার এডলফ হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫ খৃ.) এবং মিথ্যা প্রচারে দুর্নাম কুড়িয়েছেন তার তথ্যমন্ত্রী ও প্রচার বিভাগের প্রধান ড. জোসেফ গোয়েবল্স (১৮৯৭-১৯৪৫ খৃ.)। একটা জাজ্বল্যমান মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার কৌশল ছিল ‘একটি মিথ্যা শতবার বললে তা সত্যে পরিণত হয়ে যায়’। প্রধানতঃ তারই অপপ্রচারে জার্মানীতে লাখ লাখ ইহূদীর জীবন নাশ হয়েছিল। যদি বলি, এ যুগে ‘ইসলাম’কে টার্গেট বানানো হয়েছে, তাহ’লে সম্ভবতঃ ভুল হবে না।
হিটলার ছিলেন অষ্ট্রিয় বংশোদ্ভূত জার্মান রাজনীতিবিদ। যিনি সোস্যালিষ্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (সমাজতান্ত্রিক জার্মান শ্রমিক দল) বা ‘নাৎসী’ পার্টির নেতা ছিলেন। ১৯২১ সালে হিটলার উক্ত দলের নেতা হন। ১৯২৪ সালে গোয়েবল্স এ দলের সদস্য হন। বিদ্বেষ পূর্ণ বক্তৃতা ও ইহূদী বিরোধী তৎপরতার জন্য তিনি খ্যাত ছিলেন। হিটলার ৩০শে এপ্রিল রাজধানী বার্লিনে নিজ সদ্য বিবাহিত স্ত্রীসহ বাংকারে আত্মহত্যা করার পরদিন ১লা মে গোয়েবল্স সস্ত্রীক আত্মহত্যা করার আগে নিজের ৬ সন্তানকে হত্যা করেন। এভাবেই এই দুই কুখ্যাত ব্যক্তির নির্মম পরিণতি হয়। হিটলারের পুঁজি ছিল মোহনীয় বক্তৃতার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, ইহূদী বিদ্বেষ ও সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা। সমগ্রতাবাদী ও ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বের রাজনীতি ও শোষণমূলক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ছিল তার লক্ষ্য। অন্যদিকে গোয়েবল্সের কাজ ছিল হিটলারের যুলুমের পক্ষে জনমত ঠিক রাখা এবং সেজন্য নিত্য নতুন মিথ্যা রটনা করা। এ দু’জনকে সবাই ঘৃণা করলেও বাস্তবে তারাই পরবর্তী বিশ্ব রাজনীতিতে সবচেয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় ব্যক্তি হয়ে আছেন।
মিথ্যা তথ্য, মিথ্যা বক্তব্য, মিথ্যা সাক্ষী, মিথ্যা রায়- এ সবই এখন ডাল-ভাত। হিটলারের মতই এযুগে ক্ষমতারোহনের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হ’ল মিথ্যা প্রচারে ভুলিয়ে বাক্স ভরে সত্য-মিথ্যা ভোট নিয়ে নেতা হওয়া। এরপর গণবিরোধী হাযারো দুষ্কর্ম করা। কথিত ৬০ লাখ ইহূদীকে হত্যা করেও হিটলার ছিলেন জার্মানীর একচ্ছত্র নেতা। পুঁজি ছিল বর্ণবাদী মিথ্যাচার। এ যুগেও যেন নেওয়া হয়েছে ইসলাম বিরোধী মিথ্যাচার। যখন যাকে টার্গেট করা হচ্ছে, তখন তাকে তুলে নেওয়া হচ্ছে। তারপর গুম। তারপর যেকোন এক রাতে হত্যা করে পরদিন পত্রিকায় বন্দুক যুদ্ধের নাটক শুনানো হচ্ছে। অথবা তিন-চারদিন থানায় রেখে পরদিন বলা হচ্ছে, এই নামের কেউ থানায় ছিল না। ব্যস, একেবারেই হাওয়া। অথবা বহুদিন পর হঠাৎ একদিন সাংবাদিকদের ডেকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, লোকটি অমুক জঙ্গী দলের সদস্য। অতঃপর মিথ্যা মামলা দিয়ে বা অন্যদের কোন মামলায় জড়িয়ে দিয়ে আদালত ঘুরিয়ে কারাগারে পাঠানো এখন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। বিচারের আগেই রায় শেষ। পরিবার, এলাকাবাসী বা সংগঠনের লোকেরা তার পক্ষে কথা বলতে গেলে তাদের ভয় দেখানো হয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা একেবারেই চুপ। সবজান্তা আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতেই দেশকে জঙ্গী দেশ বলে পরিচিত করানো হচ্ছে। ফলে কমে গেছে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ। নিরপরাধ মযলূমদের পক্ষে সমাজ, থানা, আদালত কেউ মাথা তোলে না। এমনকি কথিত আইনজীবীরা একজোট হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে, অমুক ব্যক্তি বা দলের সদস্যের পক্ষে আইনী সহায়তা দেওয়া যাবে না। ভাগ্যিস এখনও ডাক্তাররা এমন সিদ্ধান্ত নেননি যে, অমুক দলের রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না।
যুলুমের উৎস হ’ল হিংসা ও অহংকার এবং বাহন হ’ল মিথ্যাচার। এই পাপে যখন কেউ ডুবে যায়, তখন সে হেন অপকর্ম নেই যে করতে পারে না। অজুহাত সৃষ্টির জন্য যালেমের উর্বর মস্তিষ্কে কোন তথ্যের অভাব হয় না। গোপাল ভাঁড়ের গল্প এদেশে খুবই প্রসিদ্ধ। ‘নদীর কিনারে একটা হরিণ শাবক পানি পান করছে। বনের রাজা বাঘ তাকে টার্গেট করল। কাছে এসে বলল, তোর এতবড় সাহস পানি ঘোলা করছিস। হরিণটি বলল, আমি তো পানিতেই নামিনি। ঘোলা করলাম কিভাবে? রাজা বলল, তুই করিসনি তোর বাপ করেছে। বলেই তার ঘাড় মটকালো’। এটাই হ’ল রাজার ন্যায় বিচার। এ যুগে এর দৃষ্টান্ত এখন সর্বত্র। যালেমরা সর্বদা প্রশংসা কুড়াচ্ছে। মযলূমরা নিভৃতে গুমরে মরছে। কিন্তু এটাই কি শেষ? বিগত যুগের নমরূদ-ফেরাঊন এবং আধুনিক যুগের হিটলার-গোয়েবল্স শত যুলুম করেও পৃথিবীতে স্থায়ী হ’তে পারেনি। কেননা আল্লাহর নীতি হ’ল একজনকে দিয়ে অন্যজনকে প্রতিহত করা (বাক্বারাহ ২৫১)। কিন্তু যালেমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এই যে, তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না।
যালেমদের পরকালীন পরিণতি :
(১) ক্বিয়ামতের দিন তারা আল্লাহর সামনে হাত কামড়াবে। আল্লাহ বলেন, ‘যালেম সেদিন নিজের দু’হাত কামড়ে বলবে, হায়! যদি (দুনিয়াতে) রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম’। ‘হায় দুর্ভোগ আমার! যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’। ‘আমার কাছে উপদেশ (কুরআন) আসার পর সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল। বস্ত্ততঃ শয়তান মানুষের জন্য পথভ্রষ্টকারী’ (ফুরক্বান ২৭-২৯)। (২) মযলূমদের প্রতিশোধ নেওয়ার পর নিঃস্ব অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। রাসূল (ছাঃ) একদিন বলেন, তোমরা কি জানো নিঃস্ব কে? সবাই বলল, যার কোন ধন-সম্পদ নেই। তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যে ক্বিয়ামতের দিন ছালাত, ছিয়াম, যাকাত নিয়ে হাযির হবে। অতঃপর লোকেরা এসে অভিযোগ করে বলবে যে, তাকে ঐ ব্যক্তি গালি দিয়েছে, মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, তার মাল গ্রাস করেছে, হত্যা করেছে, প্রহার করেছে। অতঃপর তার নেকী থেকে তাদের একে একে বদলা দেওয়া হবে। এভাবে বদলা দেওয়া শেষ হবার আগেই যখন তার নেকী শেষ হয়ে যাবে, তখন বাদীদের পাপ থেকে নিয়ে তার উপর নিক্ষেপ করা হবে। অবশেষে ঐ ব্যক্তিকে জাহান্নামে ছুঁড়ে ফেলা হবে’ (মুসলিম হা/২৫৮১)। তিনি আরও বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই হকদারকে তার হক আদায় করে দেয়া হবে। এমনকি শিংওয়ালা ছাগল যদি শিংবিহীন ছাগলকে গুঁতো মেরে কষ্ট দিয়ে থাকে, সেটারও বদলা নেওয়া হবে (মানুষকে ন্যায়বিচার দেখানোর জন্য)’ (মুসলিম হা/২৫৮২)। (৩) অহংকার চূর্ণ করে নিকৃষ্ট পিপীলিকার ন্যায় উঠানো হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন অহংকারীদের পিপীলিকার ন্যায় জড়ো করা হবে। যদিও তাদের আকৃতি হবে মানুষের। অপমান তাদেরকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করে নিবে। অতঃপর তাদেরকে ‘বূলাস’ নামক জাহান্নামের কারাগারের দিকে হাঁকিয়ে নেওয়া হবে। যেখানে আগুনের লেলিহান শিখা তাদের উপর ছেয়ে যাবে। আর তাদেরকে পান করানো হবে জাহান্নামীদের দেহ নিঃসৃত ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ নামক কদর্য পুঁজ-রক্ত’ (তিরমিযী হা/২৪৯২)। অতএব অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকারী ও মিথ্যা মামলা দানকারীরা সাবধান!