সমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

বর্তমান পরিস্থিতিতে ইমামদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

আজকের ফিৎনাপূর্ণ ও দুর্যোগময় সময়ে পৃথিবীর অবস্থা অত্যন্ত বিশৃঙ্খল। মানবতা আহাজারি করছে। ভয়-ভীতির এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যে, জাতি চরমপন্থীদের থেকে বহু দূর-দূরান্তে আত্মরক্ষায় বাধ্য হচ্ছে। অন্যায়-অত্যাচার এবং চরমপন্থার সীমা এতদূর ছাড়িয়ে গেছে যে, ধর্ম ও রাজনীতি চরমপন্থার বলির পাঠা হচ্ছে। পৃথিবীতে যে জাতি নিরপরাধ, তাদেরকে রক্তপিপাসু ও অত্যাচারী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। আর যারা অত্যাচারী ও ত্রাস সৃষ্টিকারী তারা নিজেদেরকে নিষ্পাপ এবং নিজেদের অপরাধমূলক কর্মকান্ডকে আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসাবে বিশ্বাস করাতে সদা তৎপর রয়েছে। সমগ্র পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ও ভয়-ভীতির এক আশ্চর্য পরিবেশ বিরাজমান। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া সব জায়গায় অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিশেষতঃ মুসলিম বিশ্বে (সিরিয়া ও ইরাক) ইসলামের নামে হিংস্র খেলা চলছে। কোথাও আইএস বা ইসলামিক স্টেটের অন্তরালে যুলুম-নির্যাতন ও বর্বরতা প্রদর্শন করা হচ্ছে। আবার কোথাও শী‘আ ইযমের প্রসারের জন্য আলেমদেরকে হত্যা, মসজিদগুলিকে ধ্বংস এবং মন্দির ও গীর্জাগুলিকে আবাদ করা হচ্ছে। এই দুই ধারার বিপরীতে ইউরোপ ও আমেরিকা আরেক রকম চরমপন্থার মহোৎসব চালাচ্ছে। এদের সকলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ইসলামকে ধ্বংস করা এবং মুসলমানদেরকে খতম করা।

বর্তমান যুগে মুসলমানরা যেমন বৈদেশিক বিভিন্ন পরীক্ষার সম্মুখীন, তেমনি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও অগণিত সামাজিক অনাচারে নিমজ্জিত ও পরিবেষ্টিত রয়েছে। মদ্যপান, জুয়াখেলা, অশ্লীলতা, বিলাসিতা, ব্যভিচার ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বিয়ে-শাদীতে তিলক ও যৌতুকের মত হিন্দুয়ানী প্রথাকে লজ্জাজনক মনে করা হয় না। শিরক-বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বন্যা প্রবাহকে থামানোর নাম নেয় না। মোটকথা মুসলিম জাতি সবদিক থেকেই মুছীবত, দুঃখ ও বিপদের সম্মুখীন। তাদেরকে এসব ফিৎনা থেকে মুক্তি দেয়া অত্যন্ত যরূরী। শুধুমাত্র আলেম, সম্মানিত ইমাম ও মহান সংস্কারকগণই এই প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর জাতির সংস্কারের দায়িত্ব অর্পণ করে তাদেরকে বড় মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছেন এবং তাদের অধিকার রক্ষা করা ও তাদের আনুগত্য করাকে আবশ্যক করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ  ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর ও তোমাদের মধ্যকার আমীরের আনুগত্য কর’ (নিসা ৪/৫৯)

প্রকাশ থাকে যে, শারঈ বিষয়ে হকপন্থী আলেম-ওলামা, ফকীহ ও সম্মানিত ইমামদের অনুসরণ করতে হয়। তারা সৎ কাজ করার ও তা প্রচারের এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার যে আদেশ দিবেন, তার অনুসরণ ও আনুগত্য করতে হবে। ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনে যে পদক্ষেপই তারা গ্রহণ করবেন তার অনুসরণ আবশ্যক হবে। কেননা এটা তাদের অধিকার। তবে হ্যাঁ, তারা যদি আল্লাহর অবাধ্যতার হুকুম দেন তাহ’লে তাদের অনুসরণ করা যাবে না। কেননা আল্লাহর অবাধ্যতায় তাদের আনুগত্যের অধিকারই আল্লাহ দেননি। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لاَ طَاعَةَ فِى مَعْصِيَةٍ، إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِى الْمَعْرُوفِ ‘পাপের কাজে কোন আনুগত্য নেই। আনুগত্য কেবল ভাল কাজে’।[1]

ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে জানা যায় যে, সমাজ সংস্কারে আলেম-ওলামা এবং মসজিদের ইমামগণ কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন। প্রত্যেক যুগে ধর্ম ও জাতির সংস্কারকগণ সমাজকে দুঃখ-বেদনা ও বিপদ থেকে মুক্ত করে তাদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন।

বর্তমান অবস্থা যখন ওলট-পালট ও অস্থির, মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হত্যা ও হামলা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, হররোজ বোমা বিস্ফোরণ ও আত্মঘাতী হামলা চলছে, এসব বিস্ফোরণের ফলে নিরাপরাধ মানুষ নিহত হচ্ছে, সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে, সরকারী ও বেসরকারী ধন-সম্পদ নষ্ট করা হচ্ছে, গোঁড়ামি, সংকীর্ণতা ও অসহিষ্ণুতার বিষাক্ত পরিবেশ বিরাজ করেছে সর্বত্র। এমন নাযুক পরিস্থিতিতে আলেম-ওলামা, ইমাম, ধর্ম ও জাতির সংস্কারকদের দায়িত্ব হ’ল- জাতি ও সমাজ সংশোধনের কাজ আজ থেকেই শুরু করা। সেজন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা গ্রহণ করা। কেননা শান্তি ও নিরাপত্তা ছাড়া সুখী সমাজ গঠন অসম্ভব। যেখানে শান্তি ও নিরাপত্তা বিরাজ করবে, সেখানে জান, মাল, মান-সম্মান নিরাপদে থাকবে। আর যেখানে বিশৃঙ্খলা, প্রোপাগান্ডা, অনিয়ম ও ভয়-ভীতি বিদ্যমান থাকবে সেখানে ফরয ও হক আদায়ও নিয়মানুযায়ী সম্পাদিত হবে না। বরং সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি স্বীয় জান-মাল ও পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকবে। নিরাপত্তার গুরুত্ব, বড়ত্ব ও উপকারিতার প্রেক্ষাপটে হযরত ইবরাহীম (আঃ) এই সারগর্ভ দো‘আ করেছিলেন- رَبِّ اجْعَلْ هَذَا بَلَدًا آمِنًا ‘হে আমার পালনকর্তা! আপনি এই স্থানকে শান্তির নগরীতে পরিণত করে দিন’ (বাক্বারাহ ২/১২৬)। আল্লাহ তা‘আলা এই শহরে এমন শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, আজ গোটা পৃথিবীতে সঊদী শাসন ব্যবস্থাকে উদাহরণ হিসাবে পেশ করা হয়ে থাকে।

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! মুসলমানদের আমলগত ত্রুটি, উশৃঙ্খল চিন্তা-ভাবনা এবং নৈতিক দেওলিয়াপনা দূর করা সময়ের সবচেয়ে বড় দাবী। এজন্য মসজিদের ইমাম এবং দ্বীন ও ঈমানের পাহারাদারদেরকে কর্মসূচী নির্ধারণ করে সামনে অগ্রসর হ’তে হবে এবং তদনুযায়ী আক্বীদা ও আমল সংশোধন করতে হবে। নিম্নে কতগুলি পয়েন্ট উল্লেখ করা হচ্ছে, যার আলোকে ইমামগণ বর্তমান সময়ের চাহিদা পূরণ ও নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারে।

(১) ব্যক্তি ও সমাজের আমল ও আক্বীদা সংশোধনের জন্য ব্যক্তিগত ও সামাজিক সবদিক থেকেই জোরালো প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ, দাওয়াত ও তাবলীগ, জুম‘আর খুৎবা, দরসে কুরআন, দরসে হাদীছ, মাসিক, পাক্ষিক অথবা সাপ্তাহিক দাওয়াতী কর্মসূচীর মাধ্যমে লোকজনকে সংশোধন করতে হবে। নেশা বন্দের আন্দোলন চালিয়ে মানুষদেরকে নেশার কুফল ও ধ্বংসকারিতা সম্পর্কে জানাতে হবে। যৌতুক ও তিলকের মত রসম-রেওয়াজকে নির্মূল করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং বলতে হবে যে, ইসলামে যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া হারাম। নবীর সুন্নাত, রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শ এবং ছাহাবায়ে কেরামের কর্মপদ্ধতিতে কোথাও এর কোন প্রমাণ নেই।

(২) নেশাখোর, যৌতুক লোভী এবং অন্যান্য অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদেরকে নিবৃত্ত করার জন্য সমাজের মন্ডল ও সরদারদের সাথে সম্মিলিতভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হ’তে হবে যে, এমন লোকদের বিবাহ-শাদী, বিপদ-মুছীবতে আমরা সহযোগিতা করতে পারব না। কারণ আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ‘তোমরা সৎকর্ম ও আল্লাহভীতির কাজে পরস্পরকে সাহায্য কর এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে একে অপরকে সাহায্য করো না’ (মায়েদাহ ৫/২)

যখন অপরাধীদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হবে তখন তারা সংশোধন হবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু সমাজপতিরা যদি তাদের সাথে এরূপ আচরণ না করে বরং তাদের সাথে একাকার হয়ে যায়, তাহ’লে নিম্নোক্ত হাদীছটি পুনরায় পড়া এবং চিন্তা-ভাবনা করা উচিত যে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ রাববুল আলামীনের সামনে তারা কি জবাব দিবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ‘নেতা বা প্রধান হচ্ছেন দায়িত্বশীল। (ক্বিয়ামতের দিন) তিনি স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন’।[2]

(৩) মসজিদের ইমামগণ যেমন জাতির আমলগত সংস্কারের যিম্মাদার, তেমনি আক্বীদাগত সংস্কার ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করারও পুরাপুরি দায়িত্বশীল। বাতিল আক্বীদা ও মতবাদকে খন্ডন করা এবং ভ্রান্ত চিন্তাধারার মূলোৎপাটন করা তাদের প্রধান দায়িত্ব। যদি আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদ পরিপন্থী কোন আওয়ায উঠে অথবা রাসূল (ছাঃ)-এর রিসালাতের অবমাননা করা হয়, ছাহাবায়ে কেরামকে গালি দেয়া হয়, তাহ’লে এই ধরনের ভ্রান্ত চিন্তাধারা সম্পর্কে জাতিকে অবগত করা ইমামদের কর্তব্য।

বর্তমানে শী‘আ ও খুমীনী ইযম বেগবান। ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও বাহরাইনের শাসকশ্রেণী শী‘আ আদর্শের বাহক। তাদের পক্ষ থেকে ইসলাম, কুরআন মাজীদ এবং হাদীছে নববীর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালানো হচ্ছে। সাধারণভাবে ছাহাবায়ে কেরামসহ শায়খায়ন (আবুবকর ও ওমর) ও মা আয়েশা ছিদ্দীক্বা (রাঃ)-কে গালি-গালাজ করা হচ্ছে এবং সঊদী শাসকদের বিরুদ্ধে ইহূদীদের সাথে ষড়যন্ত্র করে পরিবেশ খারাপ করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। হারামাইনের পবিত্রতাকে নষ্ট করার অশুভ প্রচেষ্টা চলছে। মিনায় সংঘটিত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটানোর পর এটা বুঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে, সঊদী শাসন ব্যবস্থায় মুসলমান, হাজী ও যিয়ারতকারীদের শান্তি-নিরাপত্তা নেই। এজন্য তাদের পরিবর্তে শী‘আদেরকে হারামাইনের সেবা করার সুযোগ দেওয়া উচিত। এমন ভয়াল ষড়যন্ত্র এবং ফিৎনাপূর্ণ বক্তৃতা ও দর্শনের মোকাবেলা করা সকল মুসলমানের দায়িত্ব। এ বিষয়ে চেতনা সৃষ্টি করা সম্মানিত ইমামদের কর্তব্য। তারা জুম‘আর খুৎবার মাধ্যমে শী‘আ আক্বীদা এবং ইসলামের সাথে তাদের শত্রুতা সম্পর্কে লোকদেরকে অবগত করবেন। কেননা অনেক মুসলমান এমনটা মনে করে যে, সুন্নী মুসলমান একটি দল আর শী‘আ অন্য আরেকটি দল। ব্যাস এতটুকুই। অথচ একথা ঠিক নয়। ইসলামের সাথে শী‘আদের কোন সম্পর্ক নেই। শী‘আরা রাসূল (ছাঃ)-এর পরিবারের প্রতি ভালবাসার নামে একটি ইহূদী ও সাবায়ী দল। যাকে আব্দুল্লাহ বিন সাবা নামক এক ইহুদী গঠন করে হযরত ওছমান ও আলী (রাঃ)-কে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল এবং মুসলমানদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করে উম্মতের শৃঙ্খলা বিনষ্ট করেছিল। এরপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সময়ে সুন্নী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাদেরকে ধ্বংস করেছিল। হাজরে আসওয়াদকে চুরি করে পবিত্র মক্কায় ফিৎনা-ফাসাদ প্রসারের অপচেষ্টা করেছিল। আজও ঐরূপ ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করার সম্ভাব্য সকল চেষ্টাই তারা করে যাচ্ছে। যরূরী হ’ল যে, মিম্বর-মিহরাবের শোভা ইমাম, দাঈ, দ্বীন ও ঈমানের প্রহরীগণ তাদের মুখোশ উন্মোচন করবে এবং বর্ণনা করবে যে, শী‘আ ও শী‘আ তোষণকারী সরকার ইসলাম বিরোধী। তাদের আক্বীদাসমূহও বাতিল (বিস্তারিত দেখুন : আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর রচিত ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ’)

আসলে তারা কুরআন মাজীদকে বিকৃত ও বাতিল মনে করে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ ‘আমরাই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই এর সংরক্ষণকারী’ (হিজর ৯)। তারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে রাসূল মানে না। অথচ আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا ‘আমি তোমাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি’ (আহযাব ৩৩/৪৫)

তারা ছাহাবায়ে কেরামকে গালি দেয়। অথচ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِى ‘তোমরা আমার ছাহাবীদের গালি দিবে না’।[3] বিশেষ করে হযরত আবুবকর (রাঃ), ওমর (রাঃ) এবং মা আয়েশা (রাঃ)-কে গালি-গালাজ করে। যা কুরআন মজীদ খন্ডন করেছে। এক্ষণে তাদের প্রত্যুত্তর দেয়ার দায়িত্ব শুধুমাত্র ইমামদের।

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! বর্তমানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে চরমপন্থা একটি বড় ফিৎনা রূপে আবির্ভূত হয়েছে। কিছু পথভ্রষ্ট মুসলমান আত্মহত্যার মাধ্যমে ভীতি সঞ্চারকে বৈধ ও উত্তম কাজ মনে করছে এবং তরুণ ও যুবকদেরকে ভুলিয়ে এর ক্রীড়নকে পরিণত করছে। যখন তাদের পক্ষ থেকে চরমপন্থী কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তখন তাদেরকে দমন করার নামে আমেরিকা ও ইউরোপের পক্ষ থেকে বৈশ্বিক সন্ত্রাস শুরু হয়ে যায়। যার দরুন সম্পদ ধ্বংস হয়, নিরপরাধ লোকজন মারা যায়, নিষ্পাপ শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা বলির পাঠা হয়। উল্লিখিত দু’ধরনের চরমপন্থা ও সন্ত্রাস সম্পর্কে জাতিকে সতর্ক করা এখন সময়ের দাবী এবং ইমামদের দায়িত্ব। চরমপন্থা চরমপন্থাই, যা ইসলামে হারাম। অনুরূপভাবে আত্মহত্যাও হারাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

مَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فَهْوَ فِى نَارِ جَهَنَّمَ، يَتَرَدَّى فِيهِ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا، وَمَنْ تَحَسَّى سَمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فَسَمُّهُ فِى يَدِهِ، يَتَحَسَّاهُ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا، وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ ، فَحَدِيدَتُهُ فِى يَدِهِ، يَجَأُ بِهَا فِى بَطْنِهِ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا-

‘যে ব্যক্তি কোন পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে সে জাহান্নামের আগুনে পুড়বে। আর চিরকাল সে জাহান্নামের ভিতর ঐভাবে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে তার বিষ জাহান্নামে তার হাতে থাকবে। চিরকাল সে জাহান্নামের মধ্যে তা পান করতে থাকবে। আর যে লোহার আঘাতে আতমহত্যা করবে সে জাহান্নামে উক্ত অস্ত্র হাতে নিয়ে স্বীয় পেটে বিদ্ধ করতে থাকবে এবং চিরস্থায়ীভাবে তথায় থাকবে’।[4]

এই হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আত্মঘাতী হামলা হারাম। আত্মহত্যাকারী জাহান্নামে থাকবে। এভাবে তার কর্মকান্ড ভয়-ভীতি সৃষ্টিকারী এবং রক্তারক্তি ছাড়া কিছুই নয়। ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে কারো রক্ত ঝরানোও হারাম। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী,مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا ‘যে কেউ জীবনের বদলে জীবন অথবা জনপদে অনর্থ সৃষ্টি করা ব্যতীত কাউকে হত্যা করে, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করে। আর যে ব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করে, সে যেন সকল মানুষের জীবন রক্ষা করে’ (মায়েদাহ ৫/৩২)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِى شَهْرِكُمْ هَذَا فِى بَلَدِكُمْ هَذَا ‘নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত ও সম্পদ তোমাদের জন্য হারাম। যেমন এই (আরাফার) দিন, এই মাস (যিলহজ্জ) ও এই শহর (মক্কা) তোমাদের জন্য হারাম’।[5] মুসলমানের রক্ত যেমন সম্মানিত, তেমনি তার সম্পদও সম্মানিত। আত্মঘাতী হামলা ও বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে ধ্বংসলীলা চালানো অবৈধ ও হারাম।

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! আজ ‘আইএস’-এর মাধ্যমে ইসলামিক স্টেট কায়েম করার ছুতোয় চরমপন্থী কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। মানুষের সামনে তাদের স্বরূপ তুলে ধরা আলেম, মসজিদের ইমাম ও খতীবদের মৌলিক দায়িত্ব। কেননা অনেক মুসলমান পদভ্রষ্ট হয়ে তাদের দলে চলে যাচ্ছে এবং ইসলামের বদনামের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমতপরিস্থিতিতে জুম‘আর খুৎবা, ওয়ায-নছীহত এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের মাধ্যমে লোকদেরকে সচেতন করা যরূরী। নতুবা আল-কায়েদার বাহানায় একবার ইরাক ও আফগানিস্তান ধ্বংস হয়েছে। আর এখন ‘আইএস’-এর বাহানায় মুসলিম বিশ্ব বরবাদ হবে।

আসলে ‘আইএস’ একটা খারেজী ও ইহূদী সংগঠন। যার প্রতিষ্ঠাতা ইহূদী বংশোদ্ভূত আবুবকর বাগদাদী। যিনি স্বীয় নাম ইলিয়ট শামউন পরিবর্তন করে আবুবকর বাগদাদী রেখেছেন এবং নিজেকে ‘আমীরুল মুমিনীন’ আখ্যা দিয়েছেন। আর নির্দ্বিধায় মানুষ হত্যা শুরু করে দিয়েছেন। যার কারণে তার বর্বর খুনোখুনি যেন চিৎকার দিয়ে বলছে যে, ইসলামের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তো মানবতাকে ধ্বংস করার জন্য এসেছি। আর যদি সে ইহূদী না হয়ে থাকে তাহ’লে খারেজী সম্প্রদায়ের সরদার। যে ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন يَمْرُقُونَ مِنَ الدِّينِ مُرُوقَ السَّهْمِ مِنَ الرَّمِيَّةِ ‘তারা দ্বীন থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমন তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়’।[6]

তারা আকার-আকৃতিতে মুসলমান মনে হবে, ছালাত আদায় করবে, কুরআন তেলাওয়াত করবে। কিন্তু তাদের অবস্থা এমন হবে যে,  তারা পৃথিবীতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি হবে। যাই হোক না কেন, তাদের ভয়াবহতা সম্পর্কে জাতি ও দেশবাসীকে অবহিত করা এখন সময়ের অনিবার্য দাবী। আর এ কাজ ইমাম ও আলেমগণ যেভাবে করতে পারবেন, অন্য কেউ তা করতে পারবে না। এজন্য লেখনী, আলোচনা, খুৎবা, সাংবাদিকতা এবং অন্যান্য মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষজনকে বলতে হবে যে, ইসলাম এই ধরনের ভীতিকর ও চরমপন্থী কার্যক্রমকে আগাগোড়াই অপসন্দ করে এবং মুসলমানদেরকে তা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়।

(৪) বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ধর্ম ও জাতিকে অবহিত করার জন্য কনফারেন্স, সেমিনার ও কনভেনশনের আয়োজন করে সেখানে বড় বড় আলেম, গবেষক ও জাতির শিক্ষিত ব্যক্তিদেরকে আহবান করা যায়। সেখানে স্পর্শকাতর বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হলে তাতে কাঙ্ক্ষিত উপকার হবে।

আমাদের পূর্বসূরী আলেম-ওলামা ও ইমামগণ দেশের স্বাধীনতায় যে অবদান রেখেছেন এবং যে আত্মত্যাগ করেছেন, তা বিরল। শত শত বরং লাখো আহলেহাদীছকে সে সময় হত্যা করা হয়েছে। যেমনটা ড. তারা চাঁদ এবং পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেছেন। আজও আহলেহাদীছ কমিউনিটি ও মসজিদের ইমামগণ দেশের উন্নতি ও অগ্রগতিতে অনুরূপ অবদান রাখতে ও খিদমত আঞ্জাম দিতে প্রস্ত্তত রয়েছে।

শেষ কথা হ’ল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিটি মুহূর্তের খবর রাখা এবং তা সমর্থন অথবা প্রত্যাখ্যান করা ইমামদের দায়িত্ব। এজন্য ইমামদেরকে শারঈ জ্ঞানে অভিজ্ঞ হওয়ার সাথে সাথে বৈশ্বিক উন্নয়ন, বিবর্তন, আন্দোলন ও সংগঠন সমূহ সম্পর্কে জানা অত্যন্ত যরূরী (ঈষৎ সংক্ষেপায়িত ও পরিমার্জিত)।

 

মূল (উর্দূ) : ড. রহমাতুল্লাহ সালাফী
কাঠিহার, বিহার, ভারত।
অনুবাদ : তানযীলুর রহমান
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।

[সৌজন্যে : পাক্ষিক তারজুমান, দিল্লী, ৩৬ বর্ষ, ২১তম সংখ্যা, ১-১৫ই নভেম্বর ২০১৬, পৃঃ ১৪-১৭]


[1]. বুখারী হা/৭২৫৭; মুসলিম হা/১৮৪০

[2]. বুখারী হা/৮৯৩

[3]. বুখারী হা/৩৬৭৩

[4]. বুখারী হা/৫৭৭৮

[5]. মুসলিম হা/১২১৮

[6]. বুখারী হা/৩৩৪৪

মন্তব্য করুন

Back to top button