সমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

কাছে আসার গল্প এবং বাস্তবতা

প্রোডাক্ট মার্কেটিং-এর তিনটে প্রধান উদ্দেশ্যের একটি হলো একটা সমাজ বা সংস্কৃতির জন্য মূল্যবোধ বা ‘স্টেরিওটাইপ’ তৈরি করে দেওয়া। কখনো এরা বিদ্যমান সমাজকে আয়না বা mirror-এর মতো তুলে ধরে আর কখনো একে নতুন আকৃতি বা mould দেওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। ফলে নতুন এক স্বাভাবিকত্ব বা স্টেরিওটাইপ তৈরি করে দেওয়া যায়। কারণ, বেশিরভাগ মানুষই যা দেখে তাই অনুসরণ করে। ভাবে আমারও এমনটাই হতে হবে।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এদেশে এসেছে মুক্তবাজার অর্থনীতির সুযোগ নিয়ে। কিন্তু পণ্যের মার্কেটিং করতে গিয়ে তারা প্রথম প্রথম মিররের কাজ করলেও এখন তারা মৌল্ড করার মওকা নিয়েছে। সেজন্যে সংস্কৃতিতে এক অদ্ভুত পরিচয়হীনতার সৃষ্টি হয়েছে। গত এক দশক আগে যেখানে লজ্জা ছিল ছেলেমেয়েদের অলংকার, সেখানে আজকালের বেশিরভাগ কমার্শিয়ালের টার্গেট থাকে ছেলেমেয়েদেরকে লজ্জাহীন এক প্রবৃত্তির দাস বানিয়ে দেওয়া। পাশাপাশি নাটকে, সিনেমাতে ক্রমাগত শেখানো হচ্ছে তোমার আদর্শ বা model হলো ঐ লম্পট ছেলেটা কিংবা ঐ বেহায়া মেয়েটা। সিরিয়াসলি। আপনার অবাক লাগার কথা পার্ফিউমের বিজ্ঞাপন কেন মেয়েগুলোকে কীভাবে আত্মমর্যাদাহীন করে দেয় একটা ছেলের জন্যে। কিংবা টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন কীভাবে আহ্বান করে বিপরীত লিঙ্গের জন্য নিজেকে সস্তা করে দিতে। শরীর দেখানোকে এখন নতুন নাম দেওয়া হয়েছে, ‘সাহস’। সাবান, ময়েশ্চারাইজিং লোশন, ফেয়ারনেস ক্রীম কোনোকিছুই এ ‘সাহসিকতা’র বাইরে এখন নেই। আপনি একটা কুয়োর মধ্যে। এ প্রান্ত থেকে আপনাকে সাহস করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর ওপ্রান্তে জাহান্নামের আগুন। হ্যাঁ! জাহান্নামে যেতে সাহস লাগে বৈকি! না’উযুবিল্লাহি মিন যালিক। প্রথমে দূরে থাকলেও এক সময় এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। এই মানসিকতাটাই ওদের লক্ষ্য।

দীর্ঘ উপনিবেশ একটা পরাজিত মাইন্ডসেট নির্ধারণ করে দেয়। সাধারণত কোনো একক সময়ে কোনো পরাশক্তির সংস্কৃতি অন্যান্য সংস্কৃতিকে দখল করে নেয়। ঔপনিবেশিক মনকে স্বাধীনচেতা না করতে পারলে পূর্ণ ইসলামিক বিকাশ অসম্ভব। পশ্চিমারা তাদের কলোনিগুলোতে ‘মাস্টার’ হিসেবে আধিপত্য করতো আর কলোনাইযডগণ তাদের নিজেদেরকে ‘ইনফেরিয়র’ ভাবতো। এই ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা মনকে ঔপনিবেশিক বা কলোনাইযড মন বলা যায়। দুর্ভাগ্য হলো মুসলিমরা ভুলে গেছে যে তারা ‘শ্রেষ্ঠ জাতি’ যাদের বের করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য। এ কথা পবিত্র কুর’আনে সূরা আলি ইমরানসহ অনেক সূরার বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা উল্লেখ করেছেন।

পশ্চিমে মাত্র গত ৪ দশক ধরে স্বেচ্ছাচারী যৌনতাকে স্বাভাবিক করতে অনেকগুলো মাধ্যম কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে এখন একে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে তা ভাবনার মাত্রাকে অতিক্রম করে গেছে। এখন এটা খুব ‘স্বাভাবিক’। ফলত খোদ আমেরিকায়ই The U.S. Census Bureau এর তথ্য (২০১২) অনুযায়ী প্রতি তিন সেকেন্ডে একটি করে ডিভোর্স সংঘটিত হয়। গড়ে আট বছর একেজনের সংসার টিকে। আমেরিকার শিশুদের অর্ধেক তাদের পিতামাতার ডিভোর্স দেখে এক বঞ্চিত জীবনের মধ্যে গড়ে উঠে। আর এর প্রায় অর্ধেক তাদের বাবা-মায়ের দ্বিতীয় ডিভোর্স দেখে।

গণমাধ্যমগুলো আর স্পন্সরড বিলবোর্ড কিংবা ফেবু পেইজে লক্ষ্যহীন এক ভোগবাদী সমাজ বিনির্মাণে ‘এগোচ্ছে’ প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশে এখন দিবসের অভাব নেই। গত কয়েক দশক আগেও ‘পহেলা বৈশাখ’ এত জমজমাট ছিল না। জমজমাট ছিল না ‘পহেলা ফাল্গুন’ বা পুঁজিবাদী ‘মাদার্স ডে’, ‘ফাদার্স ডে’, ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে’ কিংবা ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’। প্রজন্মকে বোঝানো হচ্ছে, ‘বয়স তো মাত্র তেইশ, এখন না হলে কখন?’ কী কখন? না, তার সদুত্তর নেই। প্রজন্মকে বোঝানো হচ্ছে ‘বন্ধু ছাড়া লাইফ ইম্পসিবল’। তা এই ‘জাস্ট ফ্রেন্ড’রা তাদের নিয়ে কী কী ভাবে তা কিন্তু গণমাধ্যম বোঝাচ্ছে না। কিন্তু কিছুদিন পরপর খবরে প্রকাশ হয় যা হওয়ার তা।

শয়তান তো চায়ই আমাদের লজ্জাকে আমাদের কাছ থেকে দূর করে দিতে। “কাছে আসার গল্প”-এর নামে এ দেশে বিবাহ বহির্ভুত ‘প্রেম’ নামক সুড়সুড়িকে রাখঢাকহীনভাবেই স্বাভাবিক করে দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। অশ্লীলতা ও শারীরিক ভোগের নার্কটিকে বিশাল এক শ্রেণিকে জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য ভুলিয়ে মনের খায়েশের পূজারী করে দেওয়ার সুযোগ তারা মিস করছেন না। ফলত বাংলাদেশে এখন ধর্ষণ, পরকীয়া, অসুস্থ দাম্পত্যজীবন বা গর্ভপাত, সুইসাইড, স্ক্যান্ডাল ইত্যাদি ধীরে ধীরে ‘স্টেরিওটাইপ’ হয়ে যাচ্ছে। এরা আমাদের নির্ধারণ করে দিচ্ছে আমরা কী খাব, পড়ব, পরব, কোথায় ঘুরব এমনকি কী ভাববো আর কী ভাববো না। এভাবে ‘নারীত্ব’, ‘পুরুষত্ব’ ‘যৌবন’ প্রভৃতির এক নতুন মানে তৈরি করা হয়েছে ও হচ্ছে। নিজের শালীনতা-লজ্জাকে বিসর্জন দিয়ে পুরুষের মনোরঞ্জনের যে নারী স্বাধীনতা উপহার দেওয়া হয়েছে তার দরজার ওপাশে আছে লাম্পট্য, লুইচ্চামি আর টাকার জন্য সবকিছু করার মানসিকতা। ‘পুরুষত্ব’ বলতে যে বেহায়া আত্মমর্যাদাহীনতা, মেয়েবাজি, অশ্লীল কথার ফেরিওয়ালা, তথাকথিত ড্যাম-কেয়ার জীবন কিংবা নির্জীব মানসিকতার এক ধারণা যেভাবে গুলিয়ে খাওয়ানো হয়েছে তার ফলাফলে গ্যাং কালচার, পর্নোগ্রাফিময় জীবন আর অনৈতিক জীবন তৈরিতেই তা সফল হয়েছে। এখন অনেক যুবক-যুবতীর কাছে যৌবন মানে হারিয়ে যাওয়ার সময়। স্রোতে হারিয়ে যাওয়া। আমাদের এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে এক অসুস্থ নৈতিকতা বিবর্জিত সমাজে। তারা কাছে আসার চকমকে গল্পগুলো শোনাচ্ছে। কিন্তু এরপর কী কী হচ্ছে তা কখনো শোনাচ্ছে না।

আপনার মন যদি এ প্রবৃত্তি বা desire এর গোলামই হয়ে যায় তবে জেনে রাখা ভালো, আপনার জন্ম কিন্তু কোনো চারপেয়ে জন্তুর মতো জন্মালাম, খাওয়া-দাওয়া করলাম, অন্যান্য জৈবিক প্রয়োজন পূরণ করলাম আর মরে গেলাম জাতীয় চক্রে সীমাবদ্ধ হওয়ার জন্য না। এ জীবনের উদ্দেশ্য কী? আল্লাহ পবিত্র কুর’আনে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন ‘আমি জ্বিন ও মানবকে আমার ‘ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ ‘ইবাদাত কী? আপনার প্রতিটি কাজই ‘ইবাদাত যদি তা একমাত্র আল্লাহর দেখানো পথে হয়, আপনার মনগড়া নাহয়। একটা কথা মনে রাখা দরকার- সমাজের বাস্তবতা সবসময় এক রকম থাকে না। কিন্তু সত্য-মিথ্যার মাপকাঠি, ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে অপরিবর্তনীয়।

জীব মাত্রেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাই আল্লাহ বিয়ের পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন সুনির্দিষ্ট কাউকে জীবনসঙ্গী করে জৈবিক চাহিদা পূরণ ও আদর্শ পরিবার গঠনের জন্য। পাশাপাশি বলে দিয়েছেন ‘যিনা-ব্যভিচারের কাছেও যেওনা।’ বলে দিয়েছেন অন্য নারীর সামনে পড়লে দৃষ্টি অবনত করো। নারীকে বলা হয়েছে পর্দা করো। আর উভয়কেই নিজেকে পবিত্র করে গড়তে বলা হয়েছে।

যৌবন হলো আল্লাহর ‘ইবাদাতে নিজেকে ব্যপৃত করার সময়। এই জীবনের ৬০-৭০ বছরে ২০-৩০ বছরের যৌবনকে যাচ্ছেতাই করে আখিরাতের অনন্ত সময়কে স্যাক্রিফাইস কেবল বোকা হলেই করা সম্ভব। ৫০ হাজার বছর ব্যাপী হাশরের ময়দানের কঠিন অবস্থায় যেদিন অন্য কোনো ছায়া থাকবেনা এমন অবস্থায় যে সাত শ্রেণির মানুষগুলো আল্লাহর আরশের ছায়া লাভ করবেন এর এক শ্রেণি হলো আল্লাহর ‘ইবাদাতে গড়া যুবক-যুবতী। মূর্খতার নিগড় থেকে মুক্ত করে সমাজটাকে সুস্থতায় নিয়ে যাওয়া তখনই সম্ভব যখন ইসলামের মূল্যবোধ নিজের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। মূর্খতায় আবদ্ধ সে আরব সমাজে মানুষগুলো ইসলাম গ্রহণের পর আমূলে বদলে গেলেন। রাসূলুল্লাহর ﷺ গোটা চরিত্রটাই কুর’আন। এ কুর’আন এক পরশ পাথর যার স্পর্শে সোনার মানুষ হয়েছিলেন যারা- ঈমানে, সাহসে, চিন্তায়, আদর্শে, শৌর্যে, চরিত্রে ও কর্মে, মুসলিমদের স্টার-সেলিব্রিটি ও প্যারাগন সেই মানুষগুলো।

#HujurHoye

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button