ইহকাল-পরকাল

জিন, জাদুটোনা ও বদনজর

অদেখা ভুবনের অস্তিত্ব

আল্লাহ তাআলা এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করে একে নিয়মের অধীন করেছেন। কিছু জিনিস আপনার হয়ে কাজ করে, আর কিছু জিনিস আপনার নিজে কাজ করে অর্জন করে নিতে হয়। যেমন, সূর্যের আলো, বায়ুমণ্ডল, বৃষ্টি এসব আপনি বিনা খরচায় পেয়ে যান। কিন্তু কৃষিকাজ করে ফসল ফলানো, খনি থেকে খনিজ আহরণের জন্য পরিশ্রম করতে হয়।

এগুলো হলো মানবজাতির জন্য দেওয়া নিয়ম। তেমনি জিন ও তাদের ব্যবহার্য জিনিসের জন্যেও তাদের সত্তার প্রকৃতি অনুযায়ী নিয়ম নির্ধারিত আছে। তারা দেয়াল ভেদ করে যেতে পারে, দেহাকৃতি পরিবর্তন করতে পারে। ফেরেশতাদের জন্যও নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। আল্লাহর আদেশে তাঁরা আসমান জমিনের মাঝে চলাফেরা করেন, বিভিন্ন রূপধারণ করতে পারেন।

অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানগুলো দুভাবে অর্জিত হয়। নিজে অবলোকন করা আর গবেষণাগারে পরীক্ষা করা। কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে আমাদের জ্ঞানবুদ্ধিকে থামতে হয়। অদেখা জগতের জ্ঞান আমাদের আয়ত্তের বাইরে। যেমন- ফেরেশতাদের জগত সম্পর্কে আমাদের কোনো চাক্ষুস ধারণা নেই।

জিনদের জগতটাও এমন। তাদের মধ্যে আল্লাহভীরু ও নাফরমান আছে। কিন্তু কোনো প্রকার সম্পর্কেই আমরা চাক্ষুসভাবে জানি না। জাহান্নামিদের খাবার যাক্কুম গাছের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ বলেন, “এটি একটি বৃক্ষ যা উদগত হয় জাহান্নামের মূলে। এর ফল শয়তানের মাথার মত।” (সূরা সফফাত ৩৭:৬৪-৬৫)

আল্লাহ এখানে শয়তানের মাথার উপমা দিয়েছেন কারণ আমরা এর সম্পর্কে জানি না। কিন্তু শয়তানের মাথা বলতেই আমাদের মাথায় ভয়ানক একটি চিত্র আসে। যে কোনো শিল্পীর চেয়ে আল্লাহর আঁকা এই চিত্রই অধিক আবেদন সৃষ্টি করে।

গায়েব কী?

অনেক বিষয়ই আল্লাহ আমাদের জ্ঞানবুদ্ধির আয়ত্তের বাইরে রেখেছেন। এসব ক্ষেত্রে আল্লাহ যা বলেছেন তাই বিশ্বাস করা ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই। আল্লাহ বলেন, “নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলের সৃজনকালে আমি তাদেরকে সাক্ষী রাখিনি এবং তাদের নিজেদের সৃজনকালেও না। এবং আমি এমনও নই যে, বিভ্রান্ত কারীদেরকে সাহায্যকারীরূপে গ্রহণ করবো।” (সূরা কাহফ ১৮:৫১)

কেউ যদি আল্লাহর কথার বিপরীত কিছু বলে আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একসময় দাবি করা হয় যে মানুষ ও বাঁদরের মধ্যকার “মিসিং লিংক” আবিষ্কৃত হয়েছে। তারা মানুষের একটি খুলি খুঁজে পেয়েছে যার চোয়াল বাঁদরের। তারা দাবি করে যে এ থেকেই প্রমাণিত হয় মানুষ হলো বাঁদরের বংশধর। পরে যখন খুলিটিকে উচ্চতর গবেষণার জন্য নেওয়া হয় তখন আবিষ্কার হয় যে, মানুষের খুলিতে বাঁদরের চোয়াল কৃত্রিমভাবে জোড়া দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে যা প্রাথমিক গবেষণায় ধরা পড়েনি।

গায়েবের ব্যাপারে আল্লাহর কথাকে সরাসরি মেনে নিলে অনেক সময় ও অর্থ বেঁচে যেতো। কারণ এসব গবেষণা ঘুরেফিরে আল্লাহর কথাকেই সত্য প্রমাণ করে।

অস্তিত্ব ও বিজ্ঞান

কোনো জিনিসের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা জানি না, এর অর্থ এই না যে সেটার অস্তিত্ব নেই। আল্লাহ হয়তো আমাদের চারপাশে সেসব জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন। সেসব আমাদের জীবনকে প্রভাবিতও করছে। কিন্তু আমরা আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার জন্য তা স্বীকার করছি না। অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না এমন জীবাণুগুলো সম্পর্কে মানুষ একসময় জানতোও না। অথচ এদের কারণে কত রোগের সৃষ্টি হয়। একটা সময়ে এসে আল্লাহ আমাদেরকে এদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানার বৈজ্ঞানিক সামর্থ্য দিলেন। কিন্তু এর অর্থ তো এই না যে আমাদের জানার আগে তাদের অস্তিত ছিলো না।

জগতে ছড়িয়ে আছে প্রমাণ

আণুবীক্ষণিক জগতে যা সত্য, দূরবীক্ষণিক জগতেও তা সত্য। এত লক্ষ কোটি তারকা আমরা আবিষ্কার করার আগেও ছিলো। ভূগর্ভস্থ খনিজের অস্তিত্ব আগে থেকেই ছিলো। আল্লাহ বলেন, “নভোমন্ডলে, ভুমন্ডলে, এতদুভয়ের মধ্যবর্তী স্থানে এবং সিক্ত ভূগর্ভে যা আছে, তা তাঁরই আয়ত্তাধীন।” (সূরা ত্বা হা ২০:৬)

মানুষ প্রকৃতিতে কিছু যোগ করেনি, কিছু সরিয়েও নেয়নি। আল্লাহই প্রকৃতিতে এমন উপাদান রেখেছেন যার ফলে দূরদূরান্তে শব্দ ও চিত্র পাঠানো যায়। সভ্যতার যে সময়টায় এসে সেগুলো আবিষ্কৃত হবে বলে আল্লাহ চেয়েছেন, তখনই মানুষ এসব আবিষ্কার করেছে।

অস্তিত্বের উপলব্ধি

বিজ্ঞান কোনোকিছু সৃষ্টি করে না। এটি প্রকৃতির মাঝে আগে থেকেই লুক্কায়িত বৈশিষ্ট্যগুলোকে উদঘাটন করে। অজানা ভুবনের বিষয়টিও এরকমই, যার অস্তিত্বের অনেক প্রমাণ আছে কিন্তু আমরা উপলব্ধি করি না। আল্লাহ যখন চান, তখনই কোনো অজানা বিষয় আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়।

“তাঁর কাছেই অদৃশ্য জগতের চাবি রয়েছে। এ গুলো তিনি ব্যতীত কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা আছে, তিনিই জানেন। কোন পাতা ঝরে না; কিন্তু তিনি তা জানেন। কোন শস্য কণা মৃত্তিকার অন্ধকার অংশে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুস্ক দ্রব্য পতিত হয় না; কিন্তু তা সব প্রকাশ্য গ্রন্থে রয়েছে।” (সূরা আনআম ৬:৫৯)

“তোমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অভিপ্রায়ের বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পার না।” (সূরা তাকভীর ৮১:২৯)

অদেখা অস্তিত্ব অনেক

পূর্বের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে আমাদের অজানা অনেক সত্তারই অস্তিত্ব আছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ আমাদের যতটুকু জানিয়েছেন, তার বাইরে আমাদের কোনো চাক্ষুস জ্ঞান নেই।

এসব সত্তার মধ্যে আছেন ফেরেশতাগণ যাঁরা আল্লাহর নির্দেশে বিভিন্ন কাজে লিপ্ত।

“তারা আল্লাহ তা’আলা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে।” (সূরা তাহরীম ৬৬:৬)

এছাড়া আছে জিন জাতি যাদের মধ্যে কেউ আল্লাহভীরু, কেউ কাফির নাফরমান। এসব বিদ্রোহী জিন হলো শয়তান।

“আমাদের কেউ কেউ সৎকর্মপরায়ণ এবং কেউ কেউ এরূপ নয়। আমরা ছিলাম বিভিন্ন পথে বিভক্ত।” (সূরা জিন ৭২:১১)

শয়তানেরা মানুষের অকল্যাণকামী এবং তার ক্ষতি করতে তৎপর। মানুষ মাটি থেকে সৃষ্ট ও জিন আগুন থেকে সৃষ্ট হওয়ায় তারা এমন কিছু পারে যা আমরা পারি না। যেমন, তারা আমাদের দেখতে পায়, আমরা তাদের দেখি না।

“তার দলবল তোমাদেরকে দেখে, যেখান থেকে তোমরা তাদের দেখো না।” (সূরা আ’রাফ ৭:২৭)

তাহলে আমরা কীভাবে তাদের ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারি? আসলে এসব অদেখা সত্তা আল্লাহর দৃষ্টির বাইরে নয়। আল্লাহ না চাইলে এদের ক্ষতি করার কোনো ক্ষমতাই নেই। এমন কোনো সত্তা নেই যা মুহূর্তেরর জন্যও তাঁর নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হতে পারে।

“আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তিনি জীবিত, সবকিছুর ধারক। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়। আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর। কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে কিংবা পিছনে যা কিছু রয়েছে সে সবই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোন কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন।” (সূরা বাকারাহ ২:২৫৫)

আল্লাহর দয়া

মানুষ যদি আল্লাহর হুকুম মেনে চলে তাহলে আল্লাহ তাকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দিবেন। এমনকি সে ঘুমন্ত থাকলেও আল্লাহ আছেন তার নিরাপত্তা বিধানের জন্য। এসব জিন শয়তানের কোনো ক্ষমতাই নেই আল্লাহকে ফাঁকি দেওয়ার।

আল্লাহ যেমন আমাদের জিন সম্পর্কে জানিয়েছেন, তেমনি সিহর(জাদু) ও হাসাদ(হিংসাজনিত কুনজর) সম্পর্কে জানিয়েছেন। এর সাথে আরো জানিয়েছেন যে এদের নিজস্ব কোনো শক্তি নেই ক্ষতি করার।

ইবলিস আগুন থেকে তৈরি হওয়ায় নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভেবেছিলো। অথচ আগুন আল্লাহরই সৃষ্টি। এটি আল্লাহর হুকুম অমান্য করার লাইসেন্স নয়। ফলে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে সে চির অভিশপ্ত হয়।

“আল্লাহ বললেনঃ আমি যখন নির্দেশ দিয়েছি, তখন তোকে কিসে সেজদা করতে বারণ করল? সে বললঃ আমি তার চাইতে শ্রেষ্ট। আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা।” (সূরা আরাফ ৭:১২)

একইরকম ঘটনা কারুনের সাথে ঘটেছিলো।

“সে বললো, আমি এই ধন আমার নিজস্ব জ্ঞান-গরিমা দ্বারা পেয়েছি।” (সূরা ক্বাসাস ২৮:৭৮)

সে ভুলে গিয়েছিলো যে জ্ঞান আল্লাহরই দান। এটি পেয়ে তার আল্লাহর প্রতি আনুগত্য বাড়ানো উচিত ছিলো।

আমরাও যেন আল্লাহর নিয়ামাত পেয়ে নিয়ামাতদাতাকে ভুলে না যাই।

পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা জানলাম যে জাদুটোনা ও বদনজরের অস্তিত্ব আছে। আরো জেনেছি যে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী চললে এসব কোনো ক্ষতি করতে পারে না।

জাদু কী?

আল্লাহ কুরআনে জাদুর কথা বলেছেন। তাই মুসলিম হিসেবে আমাদের জাদুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেই হবে। আরবিতে জাদুকে বলে ‘সিহর’ যা এসেছে ‘সাহার’ থেকে। সাহার হলো রাতের শেষভাগ ও দিবসের প্রথমভাগের মাঝামাঝি সময়টা। এসময় পূর্ণ অন্ধকারও থাকে না, পূর্ণ আলোও থাকে না। দেখে বলা যায় না এটা কি রাত নাকি দিন।

সহজ ভাষায় বললে জাদু দুইরকম। একটাতে হাত সাফাইয়ের মাধ্যমে চোখকে ফাঁকি দেওয়া হয়। আরেকটাতে সত্যিকারের অতিমানবীয় শক্তির সাহায্য নেওয়া হয়।

মঞ্চে, অনুষ্ঠানে, সার্কাসে জাদুকররা যেসব জাদু দেখায় তা মূলত হাতসাফাই। তাদেরকে এমনভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয় যে তারা দ্রুত হাত পা চালাতে পারে। তাই মনে হয় যেন তারা শূন্য থেকে একটা গ্লাস নিয়ে আসলো। আবার চোখের সামনেই গ্লাসটা ভ্যানিশ হয়ে গেলো। চলন্ত ফ্যানের দিকে তাকালে বিষয়টা স্পষ্ট হয়। ফ্যান বন্ধ করলে সেটার ব্লেডের সংখ্যা আর তাদের মধ্যকার দূরত্ব বোঝা যায়। কিন্তু চলন্ত অবস্থায় এর গতির কারণে চোখ এসব বুঝতে পারছিলো না।

চোখের জাদু

কিন্তু আমরা বিশেষভাবে যে প্রকারের জাদু নিয়ে আলাপ করবো তা ভিন্ন। উচ্চতর পর্যায়ের একরকমের জাদু আছে যা দ্বারা চোখের উপর সত্যিকারের মায়াজাল তৈরি করা হয়। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।

মূসা (আঃ) এর বিরুদ্ধে ফিরাউনের রাজ্যের জাদুকররা যে জাদু করেছিলো তা এ ধরণের। তারা দর্শকদের চোখের উপর মায়াজাল সৃষ্টি করে যার ফলে তাদের ছোঁড়া জিনিসগুলোকে আঁকাবাঁকা সাপের মত মনে হয়। বাস্তবে সেগুলোর উপাদানে কোনো পরিবর্তনই হয়নি।

“তাদের যাদুর প্রভাবে হঠাৎ তাঁর মনে হলো যেন তাদের রশিগুলো ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে।” (সূরা ত্বা হা ২০:৬৬)

জাদু ও মুজিযা

যে যেই কাজে পারদর্শী, সে সেই কাজের সব গোপন রহস্য জানে। মূসা (আঃ) যখন তাঁর লাঠি ছুঁড়ে মারলেন, আল্লাহর ইচ্ছায় তা সত্যিকারের সাপে পরিণত হয়। জাদুকররা তাদের জাদুর সাথে এর পার্থক্য স্পষ্ট ধরতে পারে। তাদের চোখে যেহেতু মায়াজাল ছিলো না তাই তারা লাঠিকে সাপ হতে দেখে বুঝলো এটি আল্লাহরই ইচ্ছা। কোনো জাদুকর নয়, কেবল আল্লাহই পারেন লাঠিকে সাপ বানাতে। তখন জাদুকররা ঈমান আনে।

“অতঃপর জাদুকররা সেজদায় পড়ে গেলো। তারা বললোঃ আমরা হারুন ও মূসার পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম।” (সূরা ত্বা হা ২০:৭০)

ফিরাউন ও জাদুকরেরা

ফিরাউন নিজে জাদুকর ছিলো না। নিজেকে ইলাহ দাবি করলেও তার কোনো অতিমানবীয় ক্ষমতা ছিলো না। তাই জাদুকরদেরকে সে ঈমান আনা থেকে আটকাতে পারেনি। জাদুকরদের এই আচমকা ঈমান আনার কারণও সে বুঝতে পারেনি। সে ব্যাখ্যা দাঁড় করালো যে মূসাই আসলে তাদের নেতা, তাঁর সাথে মিলে তারা ফিরাউনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছে। সে জাদুকরদের ভয়াবহ শাস্তির হুমকি দেয়। কিন্তু জাদুকরদের কাছে মুজিযা এত স্পষ্ট ছিলো যে তারা হুমকিকে ভয় পায়নি।

“ফিরাউন বললো, আমার অনুমতি দানের পূর্বেই তোমরা কি তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলে? দেখছি সেই তোমাদের প্রধান, সে তোমাদেরকে যাদু শিক্ষা দিয়েছে। অতএব আমি অবশ্যই তোমাদের হস্তপদ বিপরীত দিক থেকে কর্তন করবো এবং আমি তোমাদেরকে খর্জুর বৃক্ষের কান্ডে শূলে চড়াব এবং তোমরা নিশ্চিত রূপেই জানতে পারবে আমাদের মধ্যে কার আযাব কঠোরতর এবং অধিক্ষণ স্থায়ী। যাদুকররা বললো, আমাদের কাছে যে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসেছে তার উপর এবং যিনি আমাদের কে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর উপর আমরা কিছুতেই তোমাকে প্রাধান্য দেবো না। অতএব, তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো। তুমি তো শুধু এই পার্থিব জীবনেই যা করার করবে।” (সূরা ত্বা হা ২০:৭১-৭২)

ভীতির ব্যবহার

চোখের উপর মিছে মায়াজাল সৃষ্টি করার মাধ্যমে জাদুকররা মানুষকে ভয় দেখায়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি জাদুকরের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এজন্যই জাদুকরদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টিকারী জিনিস ব্যবহারের প্রচলন আছে। যেমন কঙ্কালের খুলি, পরিবর্তিত কণ্ঠস্বর ইত্যাদি। ফলে ভয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। এর সাহায্যে জাদুকররা মানুষকে দিয়ে যা ইচ্ছা করিয়ে নেয়। জাদুর ক্ষমতা না জিনের সাহায্য?

জিন শয়তানেরা জাদুর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। ব্যাবিলন শহরে ফেরেশতা হারুত মারুত কর্তৃক জাদুবিদ্যা পরিচিতি লাভ করে। তারপর শয়তানেরা এটি শিখে ছড়িয়ে দেওয়া শুরু করে। কারণ জাদুবিদ্যা হলো কুফর। আর শয়তানেরা চায়ই মানুষকে কুফরে নিপতিত করতে।

“সুলাইমান কুফরি করেনি। শয়তানেরাই কুফরি করেছিলো। তারা মানুষকে জাদুবিদ্যা শিক্ষা দিতো।” ( সূরা বাক্বারাহ ২:১০২)

রূপ বদলের সূত্র

জিনেরা আগুন থেকে সৃষ্ট হওয়ায় তারা বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে। জাদুকরদের সাহায্য করতে শয়তানরা বিভিন্ন রূপ ধারণ করে মানুষের সামনে আসে। মানুষের দৃষ্টিসীমায় ধারণযোগ্য কোনো রূপ ধারণ না করলে জিনদেরকে মানুষ দেখতে পায় না।

মানুষের রূপ ধারণ করলে জিনেরাও মানুষের উপর প্রযোজ্য নিয়মের অধীন হয়ে যায়। যেমন- এ সময় কেউ তাকে গুলি করলে সে মারা যাবে। এজন্য তারা একটানা বেশিক্ষণ মানুষের রূপ ধরে থাকে না। রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) এক জিন নামাজের মাঝে বাধা দেয়। রাসূলুল্লাহ তাকে পরাস্ত করেন। তিনি চেয়েছিলেন তাকে মসজিদের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখতে। কিন্তু সুলাইমান (আঃ) দুআ করোছিলেন তাঁকে যেন এমন ক্ষমতা দেওয়া হয় যা আর কাউকে দেওয়া হয়নি। তাঁর একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো জিনকে বশীভূত করা। তাই অন্য কারো জন্য জিনকে বেঁধে রাখা ঠিক নয়। সুলাইমান (আঃ) এর দুআর কথা স্মরণ করে রাসূল (সাঃ) জিনটিকে ছেড়ে দেন।

মানুষের রূপ ধরে আসার কারণেই জিনটিকে বাঁধা সম্ভব ছিলো। তারা যদি মানুষের সীমাবদ্ধতাগুলো এড়িয়ে মানুষের রূপ ধরতে পারতো, তাহলে জিন শয়তানেরা আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলতো।

সাবা রাজ্যে

আগুন থেকে তৈরি হওয়া জিনদের এসব বিশেষ ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর জন্যই জাদুকররা জিনের সাহায্য নেয়। ধরুন আপনি একটি আপেল নিয়ে দেয়ালে র অন্যপাশে রেখে দিলেন। তাহলে দেয়ালের এপাশ থেকে আপনি আর আপেলের অস্তিত্ব টের পাবেন না। কিন্তু একটা আগুনের শিখা রাখলে আপনি দেয়ালে সেটার উত্তাপ অনুভব করবেন। কারণ আপেলের চেয়ে আগুনের বৈশিষ্ট্য আলাদা বলে সেটি দেয়ালের ভেতর দিয়েও নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

সাবা অঞ্চলের রাণী বিলকিস যখন সুলাইমান (আঃ) এর দরবারের দিকে রওনা দেন, তখন সুলাইমান (আঃ) তাঁর সভাসদদের সাথে আলোচনা করছিলেন।

“সুলায়মান বললেন, হে পরিষদবর্গ, তারা আত্নসমর্পণ করে আমার কাছে আসার পূর্বে কে বিলকীসের সিংহাসন আমাকে এনে দেবে? জনৈক দৈত্য-জিন বললো, আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার পূর্বে আমি তা এনে দেবো এবং আমি একাজে শক্তিবান, বিশ্বস্ত।” (সূরা নামল ২৭:৩৮-৩৯)

রাণী হিসেবে বিলকিসের অবশ্যই সে সময়কার দ্রুততম যানবাহন ছিলো। উপরের আয়াত থেকে বোঝা যায় জিনদের চলাফেরার গতি আর শক্তি এমন যে, বিলকিস একবার পথ অতিক্রম করার আগেই সেই জিন সেই দূরত্ব গিয়ে সিংহাসন বহন করে আবার ফিরেও আসতে পারবে।

মানুষের সামর্থ্য আর জিনের সামর্থ্য

শক্তির সমতা বজায় থাকলে নিরাপত্তা ও শান্তি বজায় থাকে। কেউ যখন নিজেকে অন্যদের চেয়ে শক্তিশালী বলে বুঝতে পারে, তখনই অবিচার ও অশান্তির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আল্লাহ হুকুম দিয়েছেন ন্যায়বিচার ও শান্তির। জাদুটোনার ক্ষেত্রে যেহেতু মানুষের চেয়ে উচ্চতর শক্তির সাহায্য নিয়ে ক্ষতি ও বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করা হয়, তাই আল্লাহ এটিকে কুফরি বলে আখ্যা দিয়েছেন।

হারুত-মারুত

“তারা ঐ শাস্ত্রের অনুসরণ করল, যা সুলায়মানের রাজত্ব কালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। সুলায়মান কুফর করেনি; শয়তানরাই কুফর করেছিল। তারা মানুষকে জাদুবিদ্যা এবং বাবেল শহরে হারুত ও মারুত দুই ফেরেশতার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত। তারা উভয়ই একথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, আমরা পরীক্ষার জন্য; কাজেই তুমি কাফের হয়ো না। অতঃপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যদ্দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তারা আল্লাহর আদেশ ছাড়া তদ্দ্বারা কারও অনিষ্ট করতে পারত না। যা তাদের ক্ষতি করে এবং উপকার না করে, তারা তাই শিখে। তারা ভালরূপে জানে যে, যে কেউ জাদু অবলম্বন করে, তার জন্য পরকালে কোন অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্নবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ যদি তারা জানত।” (সূরা বাকারা ২:১০২)

উপরের আয়াত থেকে আমরা জানতে পারলাম যে হারুত ও মারুত দুই ফেরেশতাকে ব্যাবিলন শহরে পাঠিয়ে তাদের দ্বারা জাদুবিদ্যা পৃথিবীতে আনা হয়।

ভালো ও মন্দ দ্বারা পরীক্ষা

“আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি।” (সূরা আম্বিয়া ২১:৩৫)

আল্লাহ পৃথিবীতে ধনসম্পদ রেখেছেন। সাথে সাথে এও বলে দিয়েছেন এ সম্পদ কীভাবে আয় ও ব্যয় করতে হবে। হারাম উপায়ে তা করলে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। তাই সম্পদ একটি পরীক্ষা। কাউকে সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়, কাউকে না দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। জাদুবিদ্যাও এমনই একটি পরীক্ষা। আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে এটিতে কোনো কল্যাণ নেই। এটি কুফরি। এটি চর্চা করলে অাখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। এ সবই আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও মানুষ এটি শিখেছে। তারপর সংসারে ভাঙন ধরানোসহ নানারকম অনাচার ছাড়া আর কিছুই করেনি।

মানবজাতিকে রক্ষা করবে বলে কেউ বন্দুক হাতে নিলো। তারপর বন্দুকের ক্ষমতায় দিশা হারিয়ে নিজেই খুনী হয়ে উঠলো। জাদুর ব্যাপারটাও এমন।

দুজন ফেরেশতা কেন?

ফেরেশতাগণ ভাল ও খারাপের প্রয়োজনের উর্ধ্বে। জাদুবিদ্যা দিয়ে তাদের কোনো লাভ নেই। তাঁরা এ থেকে উপকৃত বা এর দ্বারা বিপথগামী হতে পারবেন না। তাঁরা ছিলেন কেবল জাদুবিদ্যা পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্য একটি মাধ্যম।

আবার নবী রাসূলের দ্বারা জাদুবিদ্যা পরিচিতি লাভ করলে আরেক সমস্যা হতো। নবী রাসূলগণ সর্বক্ষেত্রে অনুসরণীয়। তাঁরা জাদু দেখালে মানুষ এটা বলার সুযোগ পেয়ে যেতো যে জাদু নিশ্চয় কোনো ভাল জিনিস।

হারুত মারুতকে নিয়ে প্রচলিত অনেক কিচ্ছা কাহিনী আছে। আমরা সেগুলো যাচাই না করে প্রচার করবো না।

সুলাইমান ও জাদু

সুলাইমান (আঃ) ও জাদুর কথা একই আয়াতে বলা হয়েছে। এর অর্থ এই না যে সুলাইমানের সময়ই পৃথিবীতে জাদু এসেছে। তাঁর অনেক আগের নবী সালিহ (আঃ) এর কাহিনীতেও জাদুর প্রসঙ্গ এসেছে। তার মানে হারুত মারুত সালিহ (আঃ) এরও আগে জাদুবিদ্যা এনেছিলেন। তাহলে সুলাইমান (আঃ) এর কথা উল্লেখের কারণ কী? এজন্য আমাদের আয়াতটির শানে নুযুল জানতে হবে।

আল্লাহর দেওয়া মুজিযা স্বরূপ সুলাইমানের (আঃ) বিশেষ কিছু ক্ষমতা ছিলো। এসব ক্ষমতা জাদু নয়, মুজিযা। সুলাইমান পশুপাখির ভাষা বুঝতেন, বাতাস তাঁর আজ্ঞাধীন ছিলো। আর জিনেরা তাঁর আদেশে অনেক শ্রমসাধ্য কাজ করতো, যেমন ডুবুরি, ইমারতনির্মাতা ইত্যাদি।

জিন শয়তানেরা জাদুটোনা করতে যেসব কিতাবাদি ব্যবহার করতো, সুলাইমান (আঃ) সেসব জোগাড় করিয়ে মাটিচাপা দেন। তাঁর মৃত্যুর পর জিন শয়তানেরা মানুষকে বলে যে ঐসব জাদুবিদ্যার কিতাব দ্বারাই সুলাইমান এত ক্ষমতাধর হয়েছিলেন (নাউযুবিল্লাহ)।

কালক্রমে সেসব কিতাব ইয়াহুদী আলেমদের কাছে থেকে যায়। মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন ওইসকল আলেমের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যান তখন তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে তাওরাতে মুহাম্মাদের(সাঃ) আগমনের ভবিষৎবাণী আছে। ইয়াহুদী আলেমরা বুঝতে পারে তিনিই সত্য নবী। কিন্তু তারা তা অস্বীকার করার স্বার্থে তাওরাত লুকিয়ে রেখে শয়তানদের সেসব কিতাব থেকে কুফরি কথা পড়তে থাকে। দাবি করে যে সুলাইমান (আঃ) এসব জাদু শিক্ষা দিতেন। তাদের দাবির মুখোশ উন্মোচন করে উক্ত আয়াত নাযিল হয়।

শয়তানের ওয়াহী!

ওয়াহী বা প্রত্যাদেশ হলো একটি গোপন যোগাযোগব্যবস্থা। বার্তাপ্রেরক আর বার্তাপ্রাপক ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না যে বার্তা আদানপ্রদান হয়ে গেছে। আল্লাহ তাঁর অনেক সৃষ্টিকেই কখনো না কখনো ওয়াহীর মাধ্যমে আদেশ করেছেন।

“আপনার পালনকর্তা মধু মক্ষিকাকে ওয়াহী করলেন, পর্বতগাত্রে, বৃক্ষ এবং উঁচু চালে গৃহ তৈরী কর।”(সূরা নাহল ১৬:৬৮)

“সেদিন সে(পৃথিবী) তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। কারণ, আপনার পালনকর্তা তাকে ওয়াহী করবেন।” (সূরা যিলযাল ৯৯:৪-৫)

শয়তানও তার সঙ্গী মানুষদের ওয়াহী পাঠায়।

“নিশ্চয় শয়তানরা তাদের আওলিয়াদেরকে (বন্ধুদেরকে) ওয়াহী করে-যেন তারা তোমাদের সাথে তর্ক করে। যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে।” (সূরা আনআম ৬:১২১)

শয়তানের কাছে গায়েবের জ্ঞান!

জিন শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের কাছে কী ওয়াহী পাঠায়? সহীহ বুখারির হাদীস থেকে প্রমাণিত যে, অতীতে শয়তানেরা উর্ধ্বজগতের নির্দিষ্ট স্থানে বসে আড়ি পাততো। ভবিষ্যতে ঘটিতব্য কিছুর ব্যাপারে ফেরেশতাদের দায়িত্ব সংক্রান্ত যেসব নির্দেশ নাযিল হতো, তার কিছু তারা শুনে ফেলতো। তারপর দ্রুত এসে গণক-জাদুকরদের তা জানাতো। গণকরা একটা সত্যির সাথে একশ মিথ্যা মিশিয়ে মানুষকে বলতো। তাদের কথার কিছু না কিছু সত্য হয়ে যায় দেখে মানুষ তাদের অদৃশ্যের জ্ঞানধারী ভেবে অনুসরণ করতে থাকে। এভাবে তাদের ব্রেইনওয়াশ করার পর এসব গণক ও জাদুকররা আল্লাহর কিতাবে নিজেদের কথা মিশ্রিত করে মানুষকে আস্তে আস্তে শিরক কুফরে লিপ্ত করে।

মুহাম্মাদ (সাঃ) এর উপর ওয়াহী নাযিলের সময় জিন শয়তানদের আড়ি পাতার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

“আমরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করছি, অতঃপর দেখতে পেয়েছি যে, কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিন্ড দ্বারা আকাশ পরিপূর্ণ। আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সংবাদ শ্রবণার্থে বসতাম। এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে সে জলন্ত উল্কাপিন্ড ওঁৎ পেতে থাকতে দেখে।” (সূরা জিন ৭২:৮-৯)

জাদু এবং বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ

পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা জানলাম যে আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে গিয়ে মানুষের কোনো ক্ষতি করার ক্ষমতা জিন শয়তান ও জাদুকরদের নেই। সুলাইমান (আঃ) এর রাজত্ব ছিলো আল্লাহরই ইচ্ছা। আল্লাহ চাইলেই অধিক শক্তিমানকে কম শক্তিমানের অধীন করে দিতে পারেন। ফলে সুলাইমান (আঃ) মানুষ হয়েও জিনদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। আবার আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে গিয়ে নবীরাও গায়েবের জ্ঞান হাসিল করতে পারেন না। যেমন- সুলাইমানের কাহিনীতে হুদহুদ পাখি এমন তথ্য নিয়ে এসেছিলো, যা সুলাইমান (আঃ) রাজা ও নবী হয়েও জানতেন না। জাদু ক্ষতি করে উপকার নয়

জাদু দিয়ে জিনদের বশ করা যায়। তাই এর ক্ষমতা সম্পর্কে জানার পর অনেকেই ভাবে যে “আমি এটা শিখে ভাল ভাল কাজ করবো।” এটা হলো মাথা ঠাণ্ডা অবস্থায় বলা কথা। কিন্তু সে যখন জাদু শিখবে, তখন অবশ্যই এর ফিতনায় পতিত হবে। কারণ আল্লাহ নিজেই বলে দিয়েছেন জাদু দিয়ে কোনো কল্যাণ হয় না।

“তারা তাই শিখেছে যা তাদের ক্ষতিই করবে, কোনো উপকার করবে না।” (সূরা বাকারা ২:১০২)

এখন কারো কাছে যদি মনেও হয় জাদু দিয়ে সে ভাল কাজ করবে, তা মিথ্যা। কারণ সেটা আল্লাহর কথার বিপরীতে যাবে।

জিনের কাছে চাইতে নেই

“অনেক মানুষ অনেক জিনের আশ্রয় নিত, ফলে তারা তাদের আত্মম্ভরিতা বাড়িয়ে দিত।” (সূরা জিন ৭২:৬)

জিনদের কাছে চাওয়ার মাঝে কোনো কল্যাণ নেই। যারা জাদুবিদ্যা চর্চা করে তারা বরং সাধারণ মানুষের চেয়ে নীচু জীবনযাপন করে আর খুবই গরীব হয়। টাকা রোজগারের জন্য তারা আমজনতার উপর নির্ভরশীল। তাহলে জিন বশ করে লাভ কী হলো?

ধনসম্পদের মত দৃশ্যমান বিষয়ের ক্ষেত্রে হারাম পন্থা অবলম্বন করলে যেমন ক্ষতি হয়, অদৃশ্য ক্ষমতার ব্যাপারে হারাম পন্থায় গেলেও একইরকম ক্ষতি হয়। ফিতনা (পরীক্ষা) দৃশ্যমান হতে পারে, যেমন- নারী, সম্পদ, সন্তান। আবার অদৃশ্যও হতে পারে, যেমন- জাদু। কিন্তু শেষোক্ত ফিতনাটি হলো অবিমিশ্র অকল্যাণ। একে ভাল উপায়ে ব্যবহার করে কল্যাণ বের করে আনার কোনো পথ নেই।

“যারা জাদুকর, তারা সফল হতে পারে না।” (সূরা ইউনুস ১০:৭৭)

“জাদুকর যেখানেই থাকুক, সফল হবে না।” (সূরা ত্বা হা ২০:৬৯)

স্বামী স্ত্রীকে পৃথক করা

জাদুর মাধ্যমে অনেক রকম ক্ষতিই করা যায়। আয়াতটিতে স্বামী স্ত্রীর সংসারে ভাঙন ধরানোর কথা বলা হয়েছে যা একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। দৃশ্যমান উপায়েও সংসার ভাঙা যায়। এর কথা ওর কানে লাগিয়ে কূটনামি করে অনেকেই অনেকের সংসার ভাঙে। এই কাজ জাদুর মাধ্যমেও অদৃশ্য শক্তির সাহায্যে করা যায়। কীভাবে সেটা আমাদের অজানা। হয়তো জিন শয়তান স্বামীর রূপ ধরে কুৎসিতভাবে স্ত্রীর সামনে আসে। ফলে স্ত্রীর মনে স্বামীর প্রতি বিতৃষ্ণা আসে। অথবা স্ত্রীর রূপ ধরে একইভাবে স্বামীর সামনে আসে। এর বাইরেও অনেক পদ্ধতি থাকতে পারে যা আমাদের অজানা।

গায়েবের বিষয়ে ‘কীভাবে’ বলে কিছু নেই

দৃশ্যমান বিষয়ের ক্ষেত্রে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা যায় একটা জিনিস ‘কীভাবে’ ঘটলো। যেমন এখন আমরা জানি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মিলে পানি তৈরী হয়। কিন্তু গায়েবের বিষয়ের ক্ষেত্রে ‘কীভাবে’ বলে কিছু নেই। এমনকি ইবরাহীম (আঃ) যখন দেখতে চাইলেন আল্লাহ কীভাবে মৃতকে জীবিত করেন, তখন আল্লাহ শুধু চাক্ষুস দেখিয়ে দিয়েছেন যে তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারেন। কিন্তু সেটা কীভাবে করা হলো, এর পেছনের মেকানিজমটা কী এসব কিছু জানানো হয়নি।

“আর স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম বলল, হে আমার পালনকর্তা আমাকে দেখাও, কেমন করে তুমি মৃতকে জীবিত করবে। বললেন; তুমি কি বিশ্বাস কর না? বলল, অবশ্যই বিশ্বাস করি, কিন্তু দেখতে এজন্যে চাইছি যাতে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করতে পারি। বললেন, তাহলে চারটি পাখী ধরে নাও। পরে সেগুলোকে নিজের পোষ মানিয়ে নাও, অতঃপর সেগুলোর দেহের একেকটি অংশ বিভিন্ন পাহাড়ের উপর রেখে দাও। তারপর সেগুলোকে ডাক; তোমার নিকট দৌড়ে চলে আসবে। আর জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, অতি জ্ঞান সম্পন্ন।” (সূরা বাকারাহ ২:২৬০)

জাদুকর ও জিনদের অদৃশ্যের জ্ঞান নেই

গায়েব বা অদৃশ্য দুইরকমের আছে। একটা হলো আপেক্ষিক অদৃশ্য। এটা কেউ জানে, কেউ জানে না। যেমন আপনার টাকা চুরি হলো। আপনি জানেন না চোর কে। পুলিশ এখনো তদন্ত করে বের করতে পারেনি চোর কে। কিন্তু চোর নিজে জানে সে যে চোর। সে যার কাছে চুরি করা টাকা রেখেছে সেও জানে কে চোর। আবার অতীতও এক ধরণের গায়েব। অতীতের এমন কোনো ঘটনা যার কোনো সাক্ষী বেঁচে নেই বা কোনো দলীল অবশিষ্ট নেই, তা আপনার কাছে গায়েব। কিন্তু ঘটনার সাক্ষীদের কাছে তা গায়েব ছিলো না। এ সবই আপেক্ষিক গায়েবের উদাহরণ।

আর কিছু হলো পরম অদৃশ্য। আল্লাহ ছাড়া কেউ তা জানে না। যেমন কিয়ামাত কখন হবে কেউ জানে না আল্লাহ ছাড়া।

“তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানী। পরন্ত তিনি অদৃশ্য বিষয় কারও কাছে প্রকাশ করেন না।” (সূরা জিন ৭২:২৬)

আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী ফেরেশতা বা নবী রাসূলকে ভবিষ্যতের কোনো ঘটনা সম্পর্কে জানাতে পারেন। তবে সেসব মাখলুক ততটুকুই জানে যতটুকু আল্লাহ জানান, এর বাইরে নয়।

“(হে নবী!) আপনি বলুন, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগতও নই।” (সূরা আনআম ৬:৫০)

তাই জাদুকর ও জিনেরা গায়েব জানে না। হ্যাঁ, জিনেরা তাদের গতি বা দীর্ঘ আয়ুর কারণে কিছু আপেক্ষিক গায়েব আপনার চেয়ে বেশি জানতে পারে। এসব বিষয় তারা গণক-জাদুকরদের জানালে তারা এসব বলে কেরামতি দেখায়।

পূর্বে বলা হয়েছে জিনেরা উর্ধ্বাকাশে আড়ি পেতে কথা শুনতো। সেগুলোও পূর্ণ জ্ঞান নয়। বরং যতটুকু শুনেছে, তার যতটুকু মনে রাখতে পেরেছে সেটুকুই। এখন তাদের সে উপায়ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

রাসূলুল্লাহর উপর জাদু করা হলো যখন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)

নবী রাসূলগণ (আঃ) ছিলেন আমাদের মতই মানুষ। শুধু তাঁদের উপর ওয়াহী নাযিল হতো। আল্লাহর সৃষ্ট যেসব প্রাকৃতিক নিয়ম মানুষের উপর প্রযোজ্য, তা নবী রাসূলগণের উপরও প্রযোজ্য। তাঁরাও সুরক্ষার জন্য আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাকে বিপদ থেকে বাঁচাতে চাইলে সম্ভাব্য অনেকরকম পদ্ধতিতেই বাঁচাতে পারেন। এখানে আমাদের বলার কোনো অধিকার নেই যে এভাবে না করে ওভাবে কেন করা হলো না।

উদাহরণস্বরূপ, জাদুকররা তাদের লাঠি ও দড়ি ছুঁড়ে মারার পর সেগুলোকে সাপের মত দেখে মূসা (আঃ) ভয় পেয়েছিলেন। এটি মানবীয় ভয় যা অতি স্বাভাবিক। কিন্তু এসব ভয়ের ফলে আল্লাহকে অমান্য করা হলে সেটা হতো গুনাহ। যাই হোক, আল্লাহ মূসা (আঃ) কে মুজিযা প্রদান করে জাদুকরদের উপর বিজয় দান করেন। এটা আল্লাহ অন্যভাবেও করতে পারতেন। জাদুকররা আসার আগেই তাদেরকে পরাজিত করাতে পারতেন। লাঠিকে সাপ বানানো ছাড়া অন্যরকম কোনো মুজিযা দিতে পারতেন। আল্লাহর কাছে কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু যে পদ্ধতিতে তিনি চেয়েছেন, সেভাবেই করেছেন।

মুহাম্মাদ (সাঃ) এর উপর জাদু করা সম্ভব হয়েছিলো তিনি মানুষ বলেই। আল্লাহ চাইলে জাদু কার্যকর হওয়ার আগেই রাসূলকে বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তিনি চেয়েছেন জাদু সংঘটিত করার পরে বাঁচাবেন, তাই পরে বাঁচিয়েছেন। এটাই আল্লাহর ইচ্ছা।

ইয়াহুদী গোত্র বনু যুরাইকের এক জাদুকর ছিলো লাবিদ বিন আসাম। সে এই জাদু করে। রাসূলের (সাঃ) চিরুনিতে আটকানো চুল সংগ্রহ করিয়ে পুরুষ খেজুর গাছের পরাগের চামড়ার সাথে মিলিয়ে জাদু করা হয়। এটি যি আরওয়ানের কূপের ভেতর রেখে দেওয়া হয়। জাদুর প্রভাবে রাসূলুল্লাহর মনে হতো কোনো একটা কাজ তিনি করেছেন, আসলে বাস্তবে তিনি তা করেননি।

তিনি আল্লাহর কাছে দীর্ঘ দুআ করলেন। তাঁকে স্বপ্নে দেখানো হলো যে দুজন ফেরেশতা এসে তাঁর মাথা ও পায়ের কাছে বসলেন। তাঁরা কথোপকথনের ভঙ্গিতে জাদুর বিষয়টি জানান। কে করেছে, কীভাবে করেছে তাও জানান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উক্ত কূপ থেকে জাদুর জিনিসটি তুলে নষ্ট করান এবং কূপটি মাটি দিয়ে ভরে দেন।

এ ঘটনার প্রেক্ষিতে সূরা ফালাক ও নাস নাযিল হয় বলে তাফসিরে উল্লেখ আছে। আসন্ন পর্বগুলোতে জাদু ও কুনজর থেকে সুরক্ষার উপায় হিসেবে আলোচিত হবে ইনশাআল্লাহ।

এই ঘটনা থেকে আমরা জাদুর সেই একই ধর্ম দেখলাম। জাদুর প্রভাবে এমন কিছু দেখা যায় যা আসলে বাস্তবে ঘটেনি। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে গিয়ে জাদু কোনো ক্ষতি করতে পারে না।

কুরআনে আল্লাহ মানুষ ও জিনকে চ্যালেঞ্জ করেছেন সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কুরআনের অনুরূপ কিছু বানাতে। জিনেরা যদি রাসূলের বিরোধিতায় হাত না লাগাতো, তাহলে এই চ্যালেঞ্জ পূর্ণ হতো না। জাদুটোনায় জিন ও মানুষ একসাথে কাজ করে। তাই ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো এই ঘটনার মাধ্যমে। নাযিলকৃত ওয়াহীর মধ্যে জাদুর প্রভাবে কোনো বিকৃত সৃষ্টি করা সম্ভব হলো না।

বদনজর সত্য

বদনজর হলো হিংসুকের হিংসার ফল। কাউকে কোনো নিয়ামাত পেতে দেখলে, সে সেটা হারিয়ে ফেলুক- এমন বাসনাই হলো হিংসা। হিংসার ফলে হিংসুকের কোনো লাভ হয় না। এমন না যে সেই নিয়ামাত ঘুরে এসে হিংসুকের কপালে নসিব হয়। হিংসার ফলে হিংসুকের কোনো লাভ হয় না। তবে তার বদনজরে পতিত ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

হিংসার ফলাফল চোখে দেখা যায় না বলে এটি কোনো ক্ষতি করতে পারে না- এমনটা ভাবা ঠিক নয়। মাইক্রোস্কোপিক জীবাণু দিয়েই সবচেয়ে বড় বড় রোগগুলো হয়।

লেজার রশ্মি, এক্স রে ইত্যাদি আবিষ্কার হওয়ার আগে আমরা জানতামও না এগুলো দিয়ে যে এতকিছু করা যায়। আজকাল লেজার রশ্মি ব্যবহার করে কোনো কাটাছেঁড়া ও রক্তপাত ছাড়াই জটিল অপারেশন সম্পন্ন হচ্ছে। বদনজরও এমন জিনিস যা আমাদের অলক্ষ্যেই টার্গেটে আঘাত হানে।

মানুষ যখন রেগে যায় তখন আমরা বলি তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। অথবা অগ্নিদৃষ্টি, দৃষ্টির আগুনে ভস্ম করে ফলা। আসলে তো মানুষের চোখ থেকে কিছু বের হয় না। কিন্তু ওই বিশেষ সময় চোখ এমন দেখায় যার ফলে আমাদের মনে এ ধরণের উপমাগুলো আসে।

হিংসুক যখন হিংসা করে

বদনজরের অস্তিত্ব কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সূরা ফালাক্বে হিংসুকের হিংসা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া হয়েছে।

“এবং হিংসুকের হিংসা থেকে যখন সে হিংসা করে।” (সূরা ফালাক্ব ১১৩:৫)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “কুনজর সত্য।” উপর্যুক্ত আয়াত থেকে বোঝা যায় যে মানুষের চোখ সবসময় কোনো হিংসা-রশ্মি নির্গত করতে থাকে না। যখন সে কারো নিয়ামাত দেখে মনে হিংসা অনুভব করে, তখনই এই বিশেষ অদৃশ্য উপাদানের কাজ শুরু হয়। তাই বলা হয়েছে ” যখন সে হিংসা করে।”

গিঁটে ফুঁ দেওয়া নারী

সূরাটিতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে

“এবং গিটে ফুঁ দানকারিনী নারীর অনিষ্ট হতে।” (সূরা ফালাক্ব ১১৩:৪)

নারী বলা হলেও এখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল জাদুকর বোঝানো হয়েছে। জাদু করার পদ্ধতিসমূহের মাঝে একটি হলো এরকম সুতায় গিট্টু দিয়ে তাতে কুফরি কালাম ইত্যাদি পড়ে ফুঁ দেওয়া। এই আয়াতে আল্লাহর কাছে জাদুটোনার ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাওয়া হচ্ছে।

ফালাক্ব এর রব্ব

রাতের আঁধার বিদীর্ণ করে যখন আলোকরশ্মি বের হয়ে আসে, সে সময়টার নাম ফালাক্ব। আঁধার অবস্থায় আমরা অসহায় হয়ে পড়ি। ঘুমন্ত অবস্থায় আমরা নিরাপত্তাহীন থাকি। চোর ডাকাত থেকে শুরু করে জাদুকর ও জিন শয়তানের কাজ করার সময় এই রাত। কিন্তু আল্লাহকে নিদ্রা বা তন্দ্রা স্পর্শ করে না। তিনি সর্বাবস্থায় আমাদের নিরাপত্তা দেন। আঁধার থেকে আলোতে আনার মালিকও তিনি। তাই তাঁকে বলা হয়েছে রব্বিল ফালাক্ব।

সৃষ্টির অনিষ্ট

আল্লাহ আমাদের যা দিয়েছেন সেসব আমরা ভাল কাজে লাগাতে পারি, খারাপ কাজেও লাগাতে পারি। যেমন আঙ্গুর থেকে মদও হয়, পবিত্র খাদ্যও হয়। অস্ত্র দিয়ে জিহাদও করা যায়, অন্যায় হত্যাও করা যায়। তাই আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন, সেসবের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে এই আয়াতে।

হিংসার কারণ

হিংসার কারণ হলো আল্লাহ যা দিয়েছেন তা নিয়ে সন্তুষ্ট না থাকা।

“পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যত বিপদ আসে, তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। এটা এজন্যে বলা হলো, যাতে তোমরা যা হারাও তজ্জন্যে দুঃখিত না হও এবং তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তজ্জন্যে উল্লসিত না হও। আল্লাহ কোন উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরা হাদীদ ৫৭:২২-২৩)

তাকদীরের ভাল মন্দের প্রতি বিশ্বাস থাকলে, ভাল কিছু ঘটলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলে, খারাপ কিছু ঘটলে সবর করলে আমরা হিংসা করা থেকে বাঁচতে পারবো। সুরক্ষার উপায়

ঝাড়ফুঁক করাকে বলা হয় রুকিয়া। কোনোরকম শির্ক কুফরের আশ্রয় না নিলে রুকিয়া করা জায়েয। তিনটি শর্ত পূরণ করলে রুকিয়া জায়েয হয়:
১। রুকিয়া করতে হবে কুরআনের আয়াত, আল্লাহর নামসমূহ, যিকির ইত্যাদি দিয়ে।
২। রুকিয়া আরবিতে অথবা মানুষের বোধগম্য ভাষায় হতে হবে। যারা ঝাড়ফুঁক করতে দুর্বোধ্য বিড়বিড় করে তারা কুফরি কালাম পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
৩। রুকিয়ার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা যাবে না। সুস্থতা দেওয়ার মালিক আল্লাহ।

শির্কি কুফরি উপায়ে যারা ঝাড়ফুঁক করে তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো (জিন শয়তান, ফেরেশতা, নেককার বুজুর্গ আউলিয়া, এমনকি নবীর) সাহায্য চায়।

তাবিজ ঝোলানো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শির্ক। এতে কুফরি কালাম, জিন শয়তানদের নাম ইত্যাদি থাকে। এভাবে তাবিজের অনুরূপ যে কোনো তালিসমান, পাথর ইত্যাদি ঝোলানো, গাড়িতে-বাড়িতে-গলায় যেখানেই হোক, জায়েয নেই। যে তাবিজে কুরআনের আয়াত থাকে তা ব্যবহারের বিষয়ে মতভেদ আছে।

জাদু আক্রান্তের চিকিৎসা

জাদু হারাম উপায়েও চিকিৎসা করা যায়। এজন্য অন্য জাদুকরের কাছে যাওয়া হয়। তুকতাক, তন্ত্র মন্ত্র, জিনের সাহায্য চিকিৎসা করে। কিন্তু এতে স্থায়ী সমাধানও হয় না, গুনাহও হয়।

কুরআন সুন্নাহ সম্মত উপায়ে জাদু নষ্ট করার সেরা পদ্ধতি হলো জাদুর বস্তুটি নষ্ট করে ফেলা, যেমনটা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) করেছেন বলে আমরা আগের আলোচনায় দেখেছি।

কিছু জাদু খাবারের সাথে দেওয়া হয়। এগুলো বমি, পায়খানা, হিজামা(cupping) করে দূষিত রক্ত বের করা, ঘাম ইত্যাদির মাধ্যমে বের করা হয়। এটি জাদুর প্রকৃতির উপর নির্ভর করে একেক রকম হয়। কিছু জাদু পুড়িয়ে নষ্ট করতে হয়। কিছু জাদু আবার পুড়িয়ে গন্ধ নিলেই কার্যকর হয়। সেগুলো পোড়ানো যাবে না। ঝাড়ফুঁককারী ভালো আলেমের সাহায্যে জাদুর সঠিক প্রকৃতি ও চিকিৎসা নির্ণয় করতে হবে।

কিছু জাদু জিনের মাধ্যমে পাঠানো হয়। রুকিয়া করে জিন তাড়ালে তা ভালো হয়।

কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমেও জাদুর প্রভাব নষ্ট করা যায়।

জিনের স্পর্শ- লক্ষণ ও কারণ

জিন মানুষের দেহের বাইরে থেকে বা ভেতর থেকে আছর করতে পারে। এই আক্রমণ সারা দেহেও হতে পারে, নির্দিষ্ট অঙ্গেও হতে পারে। দীর্ঘ সময়ের জন্য হতে পারে, স্বল্প সময়ের জন্য হতে পারে (চিৎ হয়ে ঘুমানো অবস্থায়)।

জিনের আছরের ফলে খিঁচুনি ও অন্যান্য লক্ষণ দেখা দিতে পারে। জিনের আছর আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষার জন্য হতে পারে। কেউ আল্লাহর ইবাদত থেকে গাফেল হয়ে গেলে এসব কষ্টের মাধ্যমে কাফফারা হতে পারে। মানুষ অজান্তে জিনের গায়ে মূত্র বিসর্জন, পাড়া দেওয়া, কিছু ছুঁড়ে মারা ইত্যাদি করে থাকতে পারে। সেক্ষত্রে জিন ক্রোধান্বিত হয়ে প্রতিশোধ নিতে আছর করতে পারে। কোনো জিন কোনো মানুষের প্রেমে পড়ে তাকে আছর করতে পারে। অথবা জিনের মাধ্যমে কোনো জাদুকর জাদু করে থাকতে পারে। মুসলিম জিনকে আল্লাহকে ভয় করার কথা বলে ছাড়ানো সহজ। অমুসলিম বা শয়তান জিনের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় রুকিয়া করা লাগতে পারে।

কীভাবে বাঁচা যায়?

অদৃশ্য শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিলে এসব সমস্যা থেকে এমনিই বেঁচে থাকা যায়। এর জন্য যা যা করা উচিত

১। পূর্ণ তাওহীদের অনুসরণ।
২। কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন গড়া।
৩। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সঠিক সময়ে আদায় করা। বেনামাজির উপর রুকিয়ার কার্যকারিতার সম্ভাবনা কম।
৪। আল্লাহর উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল করা।
৫। সকাল সন্ধ্যার যিকিরগুলো শিখে আমল করা।

রুকিয়ার আয়াতসমূহ

১। সূরা ফাতিহা।
২। সূরা বাকারা আয়াত ১-৫, ১০২, ১৬৩-১৬৪, ২৫৫, ২৮৫-২৮৬।
৩। সূরা আলে ইমরান আয়াত ১৮-১৯।
৪। সূরা মায়িদা আয়াত ৭২-৭৪।
৫। সূরা আ’রাফ আয়াত ৫৪-৫৬, ১১৭-১২২।
৬। সূরা ইউনুস আয়াত ৭৭-৮২।
৭। সূরা ত্বা হা আয়াত ৬৮-৬৯।
৮। সূরা মুমিনুন আয়াত ১১৫-১১৮।
৯। সূরা সফফাত আয়াত ১-১০, ১৫৮।
১০। সূরা আহক্বাফ আয়াত ২৯-৩২।
১১। সূরা আর রহমান আয়াত ৩৩-৩৮।
১২। সূরা হাশর আয়াত ২১-২৪।
১৩। সূরা ক্বলাম আয়াত ৫১-৫২।
১৪। সূরা জিন আয়াত ১-৯।
১৫। সূরা কাফিরূন।
১৬। সূরা ইখলাস।
১৭। সূরা ফালাক্ব।
১৮। সূরা নাস।

সকাল বিকাল করণীয় যিকির

১। আয়াতুল কুরসি ১ বার।
২। সূরা ইখলাস, ফালাক্ব, নাস ৩ বার করে।
৩। তিন বার বলবে,

بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلاَ فِي السّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

আল্লাহ্‌র নামে; যাঁর নামের সাথে আসমান ও যমীনে কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। আর তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী।

ঘুমানোর আগে পঠনীয় দুআ

১। ওজু করা। দু হাতের তালু এক করে সূরা ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস পড়ে ফুঁ দিয়ে সারা শরীরের সামনে পেছনে হাত বুলানো। এভাবে ৩বার করা।
২। আয়াতুল কুরসি পড়া।
৩। একবার পড়া

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ غَضَبِهِ وَعِقَابِهِ، وَشَرِّ عِبَادِهِ، وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّياطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ

আমি আশ্রয় চাই আল্লাহর পরিপূর্ণ কালামসমূহের অসীলায় তাঁর ক্রোধ থেকে, তাঁর শাস্তি থেকে, তাঁর বান্দাদের অনিষ্ট থেকে, শয়তানদের কুমন্ত্রণা থেকে এবং তাদের উপস্থিতি থেকে।

৪। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ঘুমানোর ইচ্ছা করতেন তখন তাঁর ডান হাত তাঁর গালের নীচে রাখতেন, তারপর এ দো‘আটি বলতেন:

اللَّهُمَّ قِنِي عَذَابَكَ يَوْمَ تَبْعَثُ عِبَادَكَ

হে আল্লাহ! আমাকে আপনার আযাব থেকে রক্ষা করুন, যেদিন আপনি আপনার বান্দাদেরকে পুনর্জীবিত করবেন।

রুকিয়ার আয়াত পড়া পানি ব্যবহারের নিয়ম

১। তিন সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ছোট তিন চুমুক পান করা।
২। এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন পানি দিয়ে গোসল করা।


সহায়ক গ্রন্থ:

১। কুরআন সুন্নাহর আলোকে জাদুটোনা ও কুনজর

২। ইসলামে রুকিয়া

– হুজুর হয়ে

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

  1. ইয়াহুদী আলেমরা তাওরাত লুকিয়ে রেখে যেসব কুফরি কথা আবৃত্তি করেছিল, তাদের সেই কথাগুলো কি টেক্সট আকারে পাওয়া যাবে? তা পেলে আজকালকার যাদুকরদের মুখোশ উন্মোচনে একটু সুবিধা হতো।

মন্তব্য করুন

Back to top button