সংবাদ

ভেজাল ঔষধে দেশ সয়লাব

বিশ্বের সর্বত্র বাংলাদেশী ঔষধের সুনাম ও চাহিদা বাড়লেও দেশের চিত্র ভিন্ন। একদিকে ঔষধ শিল্পের অভাবনীয় উন্নতি, অন্যদিকে দেশের বাজার ছেয়ে গেছে ভেজাল ঔষধে। সুচিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন মতে ভেজাল ঔষধ কিনে উল্টো নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যালোপ্যাথিক থেকে শুরু করে আয়ুর্বেদিক ও হারবাল সব ঔষধেই মিলছে ভেজাল। ঔষধ কোম্পানীগুলো ডাক্তারদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে রোগীদের এসব ঔষধ খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এসব ঔষধ খেয়ে কিডনী বিকল, বিকলাঙ্গতা, লিভার, মস্তিষ্কের জটিল রোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। পাশাপাশি রোগীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০০৯ সালের জুন-জুলাই মাসে রিড ফার্মাসিউটিক্যালস নামক একটি ঔষধ কোম্পানীর প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে কিডনী বিকল হয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ২৪ শিশুর মৃত্যু হয়। যাতে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরে তদন্তে দেখা যায় যে, ট্যানারী শিল্পে রং হিসাবে ব্যবহৃত ডায়াথেলিন গ্লাইকল কেমিক্যাল মিশ্রিত প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়েই এইসব শিশুর মৃত্যু হয়। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, খোদ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের অসাধু কর্মকর্তারাই বিভিন্ন কোম্পানী থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে থাকেন। ফলে ভেজাল বিরোধী অভিযান প্রহসনে পরিণত হয়। যদিও গত আগষ্ট মাসে নিম্নমানের ঔষধ উৎপাদন করায় ৪৪টি ঔষধের রেজিস্ট্রেশন বাতিল এবং ১৪টি প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের এন্টিবায়োটিক উৎপাদন বন্ধ করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।

ঔষধ বিক্রেতারা জানান, বেশী লাভের কারণে তারা ভেজাল ঔষধ বিক্রি করে। এসবের কারণে তারা ধরা পড়লে তাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা ঔষধ কোম্পানীগুলোই করে থাকে। একই সঙ্গে তাদের যা জরিমানা করা হয় তা সব দিয়ে দেয় ঔষধ কোম্পানীগুলো। তারা আরও জানান, অনেক বড় কোম্পানীও ভেজাল বানিয়ে থাকে। সবাইকে এসব ঔষধ দেয়া হয় না। যারা ঔষধ সম্পর্কে বুঝে না তাদের দেয়া হয়। আর বেশীর ভাগ লোক প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ঔষধ নেয়। তাদের এসব ঔষধ দেয়া সহজ হয়।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বে ১৫ শতাংশ ঔষধই ভেজাল। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ ভেজাল ঔষধ তৈরী হয় ভারতে। এরপর নাইজেরিয়ায় ২৩ শতাংশ। এ দেশটির মোট ঔষধের মধ্যে ৪১ ভাগ ভেজাল ঔষধ। কিন্তু বাংলাদেশের ঔষধ নিয়ে কোন গবেষণা করা হয়নি। তবে দেশের একটি বেসরকারী সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে শতকরা ১০ ভাগ ভেজাল ঔষধ বিক্রি হয়। যার মূল্য ১ হাযার কোটি টাকা।

দেশে দু’টি ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরী রয়েছে। একটি রাজধানীর মহাখালীতে আর একটি চট্টগ্রামে। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে গিয়ে দেখা যায় যে, অলস সময় পার করছেন কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, জব্দ করা ঔষধগুলোর বেশীর ভাগই টেস্টের আগেই বদলে ফেলা হয়। ঔষধ কোম্পানীগুলোর সঙ্গে এখানকার কিছু কর্মকর্তার যোগসূত্র রয়েছে বলে তিনি জানান। ঔষধ টেস্টিং ল্যাবরেটরী দেয়া তথ্যমতে, ২০১৫ সালে ঔষধের নমুনা সংগ্রহ করা হয় ৭ হাযার ১টি। এর মধ্যে মানোত্তীর্ণ নমুনার সংখ্যা ৬ হাযার ৬১২টি ও মান-বহির্ভূত নমুনার সংখ্যা ২৫৬।

ঔষধ প্রশাসনের অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ কারখানার সংখ্যা ২৮১টি, ইউনানির সংখ্যা ২৬৬টি, আয়ুর্বেদিক ২০৭টি, হোমিওপ্যাথিক ৭৯টি ও হারবাল ৩২টি। এসব কারখানার মনিটরিং ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এছাড়া সরকারী হাসপাতালের বিনামূল্যের ঔষধ ফার্মেসীগুলোতে বিক্রি হচ্ছে অবাধে। একই সঙ্গে ঔষধের মেয়াদ টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে তা বিক্রি করছে ফার্মেসীগুলো।

বাংলাদেশের ঔষধের সবচেয়ে বড় পাইকারী মার্কেট রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের এলাকা। ভেজাল ও নিম্নমানের ঔষধ তৈরীর অন্যতম আখড়াও হচ্ছে ঢাকার মিটফোর্ড এলাকা এবং এখান থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভেজাল ঔষধ ছড়াচ্ছে। এরপরও এখানে কোন ঔষধ টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা নেই।

এছাড়া চিকিৎসকরাও মোটা অংকের কমিশনের লোভে প্রায়ই অনুমোদনবিহীন ঔষধ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে লিখে থাকেন। এসব ঔষধের চাহিদা থাকায় দোকানীরাও বাড়তি মুনাফার লোভে বিক্রি করছেন। ফলে সরকার একদিকে রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে মানহীন ও অনিরাপদ ঔষধ ব্যবহার করে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button