হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)

হোদায়বিয়ার ঘটনা

পূর্বের অংশ পড়ুন: বানুল মুছত্বালিক্ব অথবা মুরাইসী‘ যুদ্ধ

(৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এক রাতে স্বপ্ন দেখানো হ’ল যে, তিনি স্বীয় ছাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করেছেন এবং ওমরাহ করেছেন। কেউ মাথার চুল ছেটেছে কেউ মুন্ডন করেছে (ফাৎহ ৪৮/২৭)। এ স্বপ্ন দেখার পরে তিনি ওমরাহ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ছাহাবীগণকে প্রস্ত্তত হ’তে বলেন। ইতিপূর্বে খন্দক যুদ্ধে বিজয় লাভের পর সমগ্র আরবে মুসলিম শক্তিকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে গণ্য করা হ’তে থাকে। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কিছুটা স্বস্তির মধ্যে ছিলেন।

মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা : অতঃপর ১লা যুলক্বা‘দাহ সোমবার তিনি ১৪০০ (অথবা ১৫০০) সাথী নিয়ে মদীনা হ’তে রওয়ানা হন। লটারিতে এবার তাঁর সফরসঙ্গী হন উম্মুল মুমেনীন হযরত উম্মে সালামাহ (রাঃ)। সফর অবস্থার নিয়মানুযায়ী কোষবদ্ধ তরবারি এবং মুসাফিরের হালকা অস্ত্র ব্যতীত অন্য কোন অস্ত্র তাঁদের নিকটে রইল না। অতঃপর মদীনার অনতিদূরে যুল-হুলায়ফা পৌঁছে তাঁরা নিয়মানুযায়ী স্ব স্ব কুরবানীর পশুর গলায় হার পরালেন এবং উটের পিঠের কুঁজের উপরে সামান্য কেটে রক্তপাত করে কুরবানীর জন্য চিহ্নিত করলেন। এরপর ওমরাহর জন্য এহরাম বেঁধে রওয়ানা হ’লেন। মুসলমানদের মিত্র খোযা‘আ গোত্রের জনৈক ব্যক্তিকে গোয়েন্দা হিসাবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আগেই পাঠিয়েছিলেন মক্কায় কুরায়েশদের গতিবিধি জানার জন্য। রাসূল (ছাঃ) ‘আসফান’ (عسفان) পৌঁছলে উক্ত গোয়েন্দা এসে খবর দেয় যে, কুরায়েশরা ওমরাহতে বাধা দেওয়ার জন্য এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্ত্ততি নিচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে তারা তাদের মিত্র বেদুঈন গোত্র সমূহকে সংঘবদ্ধ করছে।

পরামর্শ বৈঠক :

উক্ত গোয়েন্দা রিপোর্ট পাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ বৈঠকে বসলেন এবং তাদের নিকটে দু’টি বিষয়ে মতামত চাইলেন। এক- কুরাইশের সাহায্যকারী গোত্রগুলির উপরে হামলা চালিয়ে তাদেরকে পরাভূত করব অথবা দুই- আমরা ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে যাত্রা অব্যাহত রাখব এবং পথে কেউ বাধা দিলে মুকাবিলা করব। হযরত আবুবকর (রাঃ) শেষোক্ত প্রস্তাবের পক্ষে মত প্রকাশ করলেন। অতঃপর মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু হ’ল।

খালেদের অপকৌশল :

কিছুদূর অগ্রসর হ’তেই জানা গেল যে, মক্কার মহা সড়কে ‘কোরাউল গামীম’ (كراع الغميم) নামক স্থানে খালেদ ইবনে ওয়ালীদ ২০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে প্রস্ত্তত হয়ে আছে মুসলিম কাফেলার উপরে হামলা করার জন্য। যেখান থেকে উভয় দল পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছিল দূর থেকে খালেদ মুসলমানদের যোহরের ছালাত আদায়ের দৃশ্য অবলোকন করে বুঝতে পারেন যে, মুসলমানেরা ছালাত আদায় কালে দুনিয়া ভুলে যায় ও আখেরাতের চিন্তায় বিভোর হয়ে যায়। শয়তান তার মনে কু-মন্ত্রণা দিল যে, আছরের ছালাত আদায় কালেই তিনি মুসলিম কাফেলার উপরে ক্ষিপ্রগতিতে হামলা চালিয়ে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। আল্লাহ পাক তাদের এ চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেবার জন্য তার রাসূলের উপরে এ সময় ছালাতুল খাওফের বিধান নাযিল করলেন (নিসা ৪/১০১-১০২)। ফলে আছরের ছালাতের সময় একদল যখন ছালাত আদায় করলেন, অন্যদল তখন সতর্ক পাহারায় রইলেন। এতে খালেদের পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে গেল।

হোদায়বিয়ায় অবতরণ ও পানির সংকট :

শান্তিপ্রিয় রাসূল (ছাঃ) যুদ্ধ এড়ানোর জন্য মহাসড়ক ছেড়ে ডান দিকে অাঁকাবাকা পাহাড়ী পথ ধরে অগ্রসর হ’তে থাকেন এবং মক্কার নিম্নাঞ্চল হোদায়বিয়ার শেষ প্রান্তে একটি ঝর্ণার নিকটে গিয়ে অবতরণ করলেন। ছহীহ বুখারীর একটি বর্ণনায় এসেছে যে, ঐ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর উষ্ট্রী ‘ক্বাছওয়া’ বসে পড়ে। লোকেরা বলল, ক্বাছওয়া নাখোশ হয়েছে (خلأت القصواء)। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ما خلأت القصواء، وما ذاك لها بخلق، ولكن حبسها حابس الفيل- ‘ক্বাছওয়া নাখোশ হয়নি, আর এটা তার চরিত্রে নেই। কিন্তু তাকে আটকে দিয়েছেন সেই সত্তা যিনি (আবরাহার) হস্তীকে (কা‘বায় হামলা করা থেকে) আটকিয়েছিলেন’।[1] তৃষ্ণার্ত সাথীদের পানির সমস্যা সমাধানে উক্ত ঝর্ণা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যর্থ হয়ে গেল। তখন সবাই রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পানির আবেদন করল। রাসূল (ছাঃ) নিজের শরাধার থেকে একটি তীর বের করে তাদের হাতে দিলেন এবং সেটাকে ঝর্ণায় নিক্ষেপ করার জন্য বললেন। فوالله ما زال يجيش لهم بالري حتى صدروا عنه، ‘অতঃপর আল্লাহর কসম! ঝর্ণায় অতক্ষণ পর্যন্ত পানি জোশ মারতে থাকল, যতক্ষণ না তারা পরিতৃপ্ত হ’লেন এবং সেখান থেকে (মদীনায়) ফিরে গেলেন’। বস্ত্ততঃ এটি ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর অন্যতম মু‘জেযা।

মধ্যস্থতা বৈঠক :

হোদায়বিয়ায় অবতরণের কিছু পরে মুসলমানদের হিতাকাংখী বনু খোয়া‘আহর নেতা বুদাইল বিন অরক্বা (بديل بن ورقاء) কিছু লোক সহ উপস্থিত হ’লেন। তিনি এসে খবর দিলেন যে, কুরায়েশ নেতা কা‘ব বিন লুওয়াই (كعب بن لؤى) সৈন্য-সামন্ত এমনকি নারী-শিশু নিয়ে হোদায়বিয়ার পর্যাপ্ত পানিপূর্ণ ঝর্ণার ধারে শিবির স্থাপন করেছে, আপনাদের বাধা দেওয়ার জন্য ও প্রয়োজনে যুদ্ধ করার জন্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তুমি তাদেরকে গিয়ে বল যে, আমরা এখানে যুদ্ধ করতে আসিনি। স্রেফ ওমরাহ করাই আমাদের উদ্দেশ্য। কুরায়েশরা ইতিপূর্বে যুদ্ধ করেছে এবং তারা পর্যুদস্ত হয়েছে। তারা চাইলে আমি তাদের জন্য একটা সময় বেঁধে দেব, সে সময়ে তারা সরে দাঁড়াবে (এবং আমরা ওমরাহ করে নেব)। এরপরেও তারা যদি না মানে এবং কেবল যুদ্ধই তাদের কাম্য হয়, وإن أبوا إِلا القتال فوالذي نفسي بيده لأقاتلنهم على أمري هذا حتى تنفرد سالفتي، ولينفذن الله أمره- তাহ’লে যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম করে বলছি, আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে এই দ্বীনের জন্য যুদ্ধ করব যতক্ষণ না আমার আত্মা বিচ্ছিন্ন হয় অথবা আল্লাহ স্বীয় দ্বীনের ব্যাপারে একটা ফায়ছালা করে দেন’।

অতঃপর বুদাইল গিয়ে কুরায়েশ নেতাদের কাছে রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য যথাযথভাবে বিবৃত করলেন। তরুণরা এ বক্তব্যকে তাচ্ছিল্য করল। কিন্তু নেতারা মূল্যায়ন করলেন এবং আলোচক হিসাবে তাদের পক্ষ থেকে মুকরিয বিন হাফছ (مكرز بن حفص) -কে পাঠালেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে দূর থেকে দেখেই মন্তব্য করলেন, هذا رجل غادر ‘এ ব্যক্তি চুক্তি ভঙ্গকারী’। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাকে সেসব কথাই বললেন, যা ইতিপূর্বে বুদাইল ও তার সাথীদের বলেছিলেন। মুকরিয ফিরে গিয়ে কুরায়েশদের সেসব কথা জানালো।

এরপর কুরায়েশ মিত্র বনু কেনানা গোত্রের হালীস বিন আলক্বামা (حليس بن علقمة) এলো। দূর থেকে তাকে দেখে রাসূল (ছাঃ) মন্তব্য করলেন, هو من قوم يعظمون البدن ‘এ ব্যক্তি এমন একটি গোত্রের, যারা কুরবানীর পশুকে সম্মান করে’। অতএব তোমরা পশুগুলিকে দাঁড় করিয়ে দাও। কাছে এলে লোকটি কুরবানীর পশু সমূহ দেখে খুশীতে বলে উঠলো, سبحان الله ما ينبغي لهؤلاء أن يصدوا عن البيت ‘সুবহানাল্লাহ! এইসব লোককে আল্লাহর ঘর থেকে বিরত রাখা উচিত নয়’। এই বলেই লোকটি ফিরে গেল এবং কুরায়েশদের নিকটে তার উত্তম মতামত পেশ করল।

এ সময় সেখানে উপস্থিত উরওয়া বিন মাসঊদ ছাক্বাফী বলে উঠলো, এই লোকটি (মুহাম্মাদ) তোমাদের নিকটে একটা ভাল প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তোমরা সেটা কবুল করে নাও এবং আমাকে একবার তার কাছে যেতে দাও’। অতঃপর নেতাদের অনুমতি নিয়ে সে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হ’ল। রাসূল (ছাঃ) তাকে সেসব কথাই বললেন, যা তিনি ইতিপূর্বে বুদাইলকে বলেছিলেন। জবাবে উরওয়া বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! যদি তুমি নিজ সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দাও, তবে ইতিপূর্বে কোন আরব এরূপ করেনি। আর যদি বিপরীতটা হয়, (অর্থাৎ তুমি পরাজিত হও) তবে আল্লাহর কসম! তোমার পাশে এমন কিছু নিকৃষ্ট লোককে (أرى أوباشًا من الناس خلقًا أن يفروا ويدعوك) দেখছি, যারা তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে’। তার এ মন্তব্য শুনে ঠান্ডা মেযাজের আবুবকর (রাঃ) রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন, امصص بظر اللات أنحن نفر عنه؟ ‘লাতের লজ্জাস্থানের ঝুলন্ত চর্ম লেহন করতে থাক। আমরা রাসূলকে ছেড়ে পালিয়ে যাব’? এরপর উরওয়া রাসূলের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে থাকে। কথার ফাঁকে ফাঁকে সে বারবার রাসূলের দাড়িতে হাত দিচ্ছিল। ওদিকে পাশে দাঁড়ানো মুগীরা বিন শো‘বা (রাঃ) নিজ তরবারির বাঁটে হাত দিচ্ছিলেন ও উরওয়াকে ধমক দিয়ে বলছিলেন, أخر يدك عن لحية رسول الله صلى الله عليه وسلم ‘তোমার হাতকে রাসূলের দাড়ি থেকে দূরে রাখ’। এভাবে উরওয়া রাসূলের প্রতি ছাহাবীদের ভালাবাসার নমুনা সমূহ প্রত্যক্ষ করল। উল্লেখ্য যে, মুগীরা ছিলেন উরওয়ার ভাতিজা।

আলোচনা শেষে উরওয়া কুরায়েশদের নিকটে ফিরে গিয়ে খবর দিলأَىْ قَوْمِ ، وَاللهِ لَقَدْ وَفَدْتُ عَلَى الْمُلُوكِ، وَوَفَدْتُ عَلَى قَيْصَرَ وَكِسْرَى وَالنَّجَاشِىِّ وَاللهِ إِنْ رَأَيْتُ مَلِكًا قَطُّ ، يُعَظِّمُهُ أَصْحَابُهُ مَا يُعَظِّمُ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ  مُحَمَّدًا، ‘হে আমার কওম! আল্লাহর কসম! আমি কিসরা, কায়ছার ও নাজ্জাশী প্রমুখ সম্রাটদের দরবারে প্রতিনিধি হিসাবে গিয়েছি। কিন্তু কোন সম্রাট-এর প্রতি তার সহচরদের এমন সম্মান করতে দেখিনি, যেমনটি দেখেছি মুহাম্মাদের প্রতি তার সাথীদের সম্মান করতে’। অতঃপর তিনি রাসূলের ছাহাবীদের সম্মান প্রদর্শনের এবং ভক্তি শ্রদ্ধার কতগুলি উদাহরণ পেশ করে বলেন, আল্লাহর কসম! তারা তাঁর থুথু হাতে ধরে মুখে ও গায়ে মেখে নেয়। তার ওযূর ব্যবহৃত পানি ধরার জন্য প্রতিযোগিতা করে। তার নির্দেশ পালনের জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকে, তাঁর কথা বলার সময় সকলের কণ্ঠস্বর নীচু হয়ে যায়, অধিক সম্মানের কারণে কেউ তাঁর প্রতি পূর্ণভাবে দৃষ্টিপাত করে না’। অতএব যে প্রস্তাব তিনি তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন, তোমরা তা কবুল করে নাও’।

ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন যে, উরওয়ার উপস্থিতিতে ছাহাবীগণ ভক্তির এই বাড়াবাড়ি প্রদর্শন করেছিলেন, তাকে বাস্তবে একথা বুঝিয়ে দেবার জন্য যে, যারা তাদের নেতার ভালোবাসায় এতদূর করতে পারে ও এতবড় সম্মান ও ভক্তি দেখাতে পারে, তাদের সম্পর্কে উরওয়া কিভাবে ধারণা করতে পারেন যে, কুরায়েশদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হলে তারা রাসূলকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে ও তাঁকে শত্রুদের হাতে সমর্পণ করবে? বরং বিভিন্ন গোত্রীয় যুদ্ধে স্রেফ গোত্রীয় সম্পর্কের চাইতে তারা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর দ্বীনের প্রতি সাহায্যের ক্ষেত্রে সবচাইতে দৃঢ় ও আপোষহীন। ইবনু হাজার বলেন, এই ঘটনায় বুঝা যায় যে, নেক মকছূদ হাছিলের জন্য যেকোন বৈধ পন্থা অবলম্বন করা যায়’।[2] বস্ত্ততঃ এই ধরনের বাড়াবাড়ি আচরণের ঘটনা অন্য সময়ে দেখা যায়নি।

কুরায়েশ তরুণদের অপকৌশল :

বুদাইল, মুকরিয, হালীস ও উরওয়ার রিপোর্ট কাছাকাছি প্রায় একই রূপ হওয়ায় এবং সকলে রাসূলের দেওয়া    প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করায় কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ আপোষ করার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। কিন্তু তরুণরা এর বিরুদ্ধে মত পোষণ করে। তারা নিজেরা গোপনে পৃথকভাবে এক কৌশল প্রস্ত্তত করে যে, রাতের অন্ধকারে তারা মুসলিম শিবিরে অতর্কিতে প্রবেশ করে এমন হৈ চৈ লাগিয়ে দেবে, যাতে উভয়পক্ষে যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠে। পরিকল্পনা মোতাবেক ৭০ কিংবা ৮০ জন যুবক ‘তানঈম’ পাহাড় হ’তে নেমে সোজা মুসলিম শিবিরে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রহরীদের নেতা মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর হাতে সবাই গ্রেফতার হয়ে যায়। পরে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সন্ধির প্রতি আগ্রহের কারণে (رغبة في الصلح) সবাইকে ক্ষমা করেন ও মুক্ত করে দেন। এ প্রসঙ্গে সূরা ফাৎহ ২৪ আয়াতটি নাযিল হয় (وَهُوَ الَّذِي كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُمْ بِبَطْنِ مَكَّةَ) ।

ওছমানকে মক্কায় প্রেরণ :

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কুরায়েশদের নিকটে এমন একজন দূত প্রেরণের চিন্তা করলেন, যিনি তাদের নিকটে গিয়ে বর্তমান সফরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জোরালোভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন এবং অহেতুক যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পারেন। এজন্য তিনি প্রথমে হযরত ওমরকে নির্বাচন করলেন। কিন্তু তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন এবং কারণ হিসাবে বললেন যে, মক্কায় বনু কা‘ব গোত্রের একজন লোকও নেই যে আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে যদি আমি আক্রান্ত হই’। বরং আপনি ওছমানকে প্রেরণ করুন। কেননা সেখানে তার আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। তিনি আপনার বার্তা তাদের নিকটে ভালভাবে পৌঁছাতে পারবেন’।

অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ওছমানকে ডাকলেন এবং তাকে কুরায়েশ নেতাদের কাছে পাঠালেন এই বলে যে, إنا لم نأت لقتال وإنما جئنا عمارًا- ‘আমরা লড়াই করতে আসিনি বরং আমরা এসেছি ওমরাহকারী হিসাবে’। তিনি তাদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিতে বললেন। এছাড়াও মক্কার লুক্কায়িত মুমিন নর-নারীদের কাছে সত্বর বিজয়ের সুসংবাদ শুনাতে বললেন এবং বলতে বললেন যে, আল্লাহ শীঘ্র তাঁর দ্বীনকে মক্কায় বিজয়ী করবেন। তখন আর কাউকে তার ঈমান লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন হবে না’।

আদেশ পাওয়ার পর হযরত ওছমান (রাঃ) মক্কাভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। বালদাহ (بلدح) নামক স্থানে পৌঁছলে কুরায়েশদের কিছু লোক তাঁকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন? জবাবে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে অমুক অমুক কাজে পাঠিয়েছেন। তারা বলল, قد سمعنا ما تقول ‘আমরা শুনেছি আপনি যা বলবেন’। এমন সময় আবান ইবনু সাঈদ ইবনুল আছ এসে তাঁকে খোশ আমদেদ জানিয়ে নিজ ঘোড়ায় তাকে বসিয়ে নিলেন। অতঃপর মক্কায় উপস্থিত হয়ে ওছমান (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ মোতাবেক নেতৃবৃন্দের নিকটে বার্তা পৌঁছে দিলেন ও তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। বার্তা পৌঁছানোর কাজ শেষ হ’লে নেতারা তাঁকে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পূর্বে তিনি তাওয়াফ করতে অস্বীকার করলেন।

ওছমান হত্যার গুজব ও বায়‘আতে রেযওয়ান :

ওছমান (রাঃ) প্রদত্ত প্রস্তাবনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও জবাব প্রদানের জন্য কুরায়েশ নেতাদের শলা-পরামর্শ কিছুটা দীর্ঘায়িত হয়। এতে তাঁর প্রত্যাবর্তন বিলম্বিত হয়। ফলে মুসলিম শিবিরে তাঁর হত্যার গুজব রটে যায়। সংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে উঠলেন, لا نبرح حتى نناجز القوم ‘বদলা না নেয়া পর্যন্ত আমরা স্থান ত্যাগ করব না’। অতঃপর তিনি সবাইকে বায়‘আতের জন্য আহবান জানালেন। তখন সবাই ঝাঁপিয়ে এসে বায়‘আত করল এই মর্মে যে, তারা কখনোই পালিয়ে যাবে না। একদল মৃত্যুর উপরে বায়‘আত করল। প্রথম বায়‘আতকারী ছিলেন আবু সেনান আসাদী। অতঃপর দক্ষ তীরন্দায সালমাহ ইবনুল আকওয়া‘ শুরুতে, মাঝে এবং শেষে মোট তিনবার বায়‘আত করেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের হাত ধরে বললেন, هذه عن عثمان ‘এটি ওছমানের পক্ষ হ’তে’। এভাবে যখন বায়‘আত সম্পন্ন হয়ে গেল, তখন ওছমান এসে হাযির হলেন এবং তিনিও বায়‘আত করলেন। একজন মাত্র বায়‘আত করেনি। তার নাম ছিল জুদ বিন ক্বায়েস (جد بن قيس)। সে ছিল মুনাফিকদের অন্তর্ভুক্ত। বায়‘আতটি সম্পন্ন হয় একটি বৃক্ষের নীচে। এ সময় মা‘ক্বিল বিন ইয়াসার (রাঃ) বৃক্ষের ডালটি ‘উচু করে ধরে রেখেছিলেন, যাতে তা রাসূলের গায়ে স্পর্শ না করে এবং হযরত ওমর (রাঃ) রাসূলের হাতটি ধরে রেখেছিলেন (যাতে অধিক বায়‘আতের কারণে তিনি কষ্টবোধ না করেন)। এ ঘটনাই বায়‘আতুর রিযওয়ান (بيعة الرضوان) বা সন্তুষ্টির বায়‘আত নামে খ্যাত। কেননা আল্লাহ পাক মুসলমানদের এই স্বতঃস্ফূর্ত বায়‘আত গ্রহণে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং সাথে সাথে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেছিলেন- لَقَدْ رَضِيَ اللهُ عَنِ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذْ يُبَايِعُوْنَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِيْنَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحاً قَرِيْباً- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছন মুমিনদের উপরে যখন তারা বায়‘আত করছিল তোমার নিকটে বৃক্ষের নীচে। আল্লাহ অবগত ছিলেন যা তাদের অন্তরে ছিল। অতঃপর তিনি তাদের উপরে বিশেষ প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন’ (ফাৎহ ৪৮/১৮)। এছাড়াও আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الَّذِيْنَ يُبَايِعُوْنَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُوْنَ اللهَ يَدُ اللهِ فَوْقَ أَيْدِيْهِمْ فَمَن نَّكَثَ فَإِنَّمَا يَنْكُثُ عَلَى نَفْسِهِ وَمَنْ أَوْفَى بِمَا عَاهَدَ عَلَيْهُ اللهَ فَسَيُؤْتِيْهِ أَجْراً عَظِيْماً
‘যারা আপনার নিকটে আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করল, তারা তো আল্লাহর কাছেই বায়‘আত করেছে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে। অতঃপর যে ব্যক্তি বায়‘আত ভঙ্গ করে, সে তার নিজের ক্ষতির জন্যই সেটা করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে, সত্বর আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কারে ভূষিত করবেন’ (ফাৎহ ৪৮/১০)

হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, ঐদিন আমাদের সংখ্যা চৌদ্দশত ছিল এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, أنتم اليوم خير أهل الأرض ‘তোমরাই ভূ-পৃষ্ঠের সেরা’।[3] উম্মে মুবাশশির (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ يَدْخُلُ النَّارَ إِنْ شَاءَ اللهُ مِنْ أَصْحَابِ الشَّجَرَةِ أَحَدٌ الَّذِينَ بَايَعُوا تَحْتَهَا ‘আল্লাহ চাহেন তো ঐদিন বৃক্ষতলে বায়‘আতকারীদের কোন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না’।[4] ফলে এই বায়‘আতে অংশগ্রহণকারীগণের অবস্থা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ন্যায় হয়ে গেছে। তাঁরা সবাই হ’লেন জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত (ফালিল্লাহিল হাম্দ)

হোদায়বিয়ার সন্ধি ও তার দফা সমূহ :

অতঃপর কুরায়েশদের পক্ষ হ’তে সোহায়েল বিন আমরকে প্রেরণ করা হ’ল। প্রেরণের সময় তাকে জোরালোভাবে একথা বলে দেওয়া হয় যে, সন্ধি চুক্তির পূর্বশর্ত এটাই হবে যে, তাদেরকে এবছর ওমরাহ না করেই ফিরে যেতে হবে। যাতে আরবরা একথা বলার সুযোগ না পায় যে, মুসলমানেরা আমাদের উপরে যবরদস্তি প্রবেশ করেছে। দূর থেকে সোহায়েলকে আসতে দেখে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মন্তব্য করেন যে, قد سهل لكم أمركم ‘তোমাদের জন্য কাজ সহজ করা হয়েছে। কুরায়েশরা সন্ধি চায় বলেই এ লোকটিকে পাঠিয়েছে’। অতঃপর সুহায়েল এসে দীর্ঘক্ষণ আলোচনার পর উভয় পক্ষ নিম্নোক্ত দফাসমূহে একমত হয়।-

১। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ বছর মক্কায় প্রবেশ না করেই সঙ্গী-সাথীসহ মদীনায় ফিরে যাবেন। আগামী বছর ওমরাহ করবেন এবং মক্কায় তিনদিন অবস্থান করবেন। সঙ্গে সফরের প্রয়োজনীয় অস্ত্র থাকবে এবং তরবারি কোষবদ্ধ থাকবে। কুরায়েশগণ তাদের কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না।

২। দু’পক্ষের মধ্যে আগামী ১০ বছর যাবৎ যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। এই সময় লোকেরা নিরাপদ থাকবে। কেউ কারু উপরে হস্তক্ষেপ করবে না।

৩। যারা মুহাম্মাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে, তারা তার দলে এবং যারা কুরায়েশ-এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে, তারা তাদের দলে গণ্য হবে। তাদেরকে উক্ত দুই দলের অংশ বলে গণ্য করা হবে। এরূপ ক্ষেত্রে তাদের কারু উপরে অত্যাচার করা হ’লে সংশ্লিষ্ট সকল দলের উপরে অত্যাচার করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে।

৪। কুরায়েশদের কোন লোক পালিয়ে মুহাম্মাদের দলে যোগ দিলে তাকে ফেরৎ দিতে হবে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের কেউ কুরায়েশের নিকটে গেলে তাকে ফেরৎ দেওয়া হবে না।

উপরোক্ত দফাগুলিতে একমত হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) হযরত আলীকে ডাকলেন। অতঃপর তাকে লিখবার নির্দেশ দিয়ে বললেন, লিখ- ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’। সুহায়েল বলল, ‘রহমান’ কি আমরা জানি না। বরং লেখ- ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আলীকে তাই-ই লিখতে বললেন। অতঃপর লিখতে বললেন- هذا ما صالح عليه محمد رسول الله ‘এগুলি হ’ল সেইসব বিষয় যার উপরে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সন্ধি করেছেন’। সোহায়েল বাধা দিয়ে বলল, لو نعلم أنك رسول الله ما صددناك عن البيت ولا قاتلناك- ‘যদি আমরা জানতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহ’লে আমরা আপনাকে আল্লাহর ঘর হ’তে বিরত রাখতাম না এবং আপনার সঙ্গে যুদ্ধও করতাম না’। অতএব লিখুন ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, إني رسول الله وإن كذبتموني ‘আমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল। যতই তোমরা আমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত কর না কেন’? অতঃপর তিনি আলীকে ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দ মুছে ‘মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ’ লিখতে বললেন। فأبى علي أن يمحو هذا اللفظ ‘কিন্তু আলী ওটা মুছতে অস্বীকার করলেন’। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিজ হাতে ওটা মুছে দিলেন। তারপর চুক্তিনামা লিখন সম্পন্ন হ’ল।

চুক্তি সম্পাদনের পর বনু খোযা‘আহ রাসূলের সাথে এবং বনু বকর কুরায়েশদের সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হ’ল। অবশ্য বনু খোযা‘আহ আব্দুল মুত্ত্বালিবের সময় থেকেই বনু হাশেমের মিত্র ছিল, যা বংশ পরম্পরায় চলে আসছিল।

আবু জান্দালের আগমনে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা

সন্ধিপত্র লেখার কাজ চলছে এরি মধ্যে সুহায়েলপুত্র আবু জান্দাল শিকল পরা অবস্থায় পা হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে এসে উপস্থিত হয়েই মুসলিম শিবিরে ঢুকে পড়ল। তাকে দেখে সোহায়েল বলে উঠলেন, এই আবু জান্দালই হ’ল প্রথম ব্যক্তি যে বিষয়ে আমরা চুক্তি করেছি যে, আপনি তাকে ফেরৎ দিবেন। (কেননা সে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই পালিয়ে আপনার দলে এসেছে)। রাসূল (ছাঃ) বললেন, এখনও তো চুক্তি লিখন কাজ শেষ হয়নি? সোহায়েল বলল, আল্লাহর কসম! তাহ’লে চুক্তির ব্যাপারে আমি আর কোন কথাই বলব না’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, অন্ততঃ আমার খাতিরে তুমি তাকে ছেড়ে দাও’। সুহায়েল বলল, আপনার খাতিরেও আমি তাকে ছাড়ব না। রাসূল (ছাঃ) বললেন, بلى فافعل ‘হাঁ এটুকু তোমাকে করতেই হবে’। সে বলল, ما أنا بفاعل ‘না আমি তা করব না’। অতঃপর সোহায়েল আবু জান্দালের মুখে চপেটাঘাত করে তার গলার কাপড় ধরে টানতে টানতে মুশরিকদের নিকটে নিয়ে চলল। আবু জান্দাল তখন অসহায়ভাবে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল ‘হে মুসলিমগণ! আমি কি মুশরিকদের কাছে ফিরে যাব? ওরা আমাকে দ্বীনের ব্যাপারে ফিৎনায় নিক্ষেপ করবে’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, يا أبا جندل، اصبر واحتسب، ‘হে আবু জান্দাল! ধৈর্য ধর এবং ছওয়াবের আশা কর। আল্লাহ তোমার ও তোমার সাথী দুর্বলদের জন্য মুক্তির পথ ও প্রশস্ত রাস্তা তৈরী করে দেবেন। আমরা কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধি করেছি। তারা ও আমরা পরস্পরে আল্লাহর নামে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। যা আমরা ভঙ্গ করতে পারি না’।

এরপর হযরত ওমর (রাঃ) অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে গিয়ে আবু জান্দালের নিকটে পৌঁছে তাকে বললেন, اصبر يا أبا جندل، فإنما هم المشركون، وإنما دم أحدهم دم كلب، ‘ধৈর্য ধর হে আবু জান্দাল! ওরা তো মুশরিক। ওদের রক্ত তো কুকুরের রক্তের ন্যায়’। বলেই তিনি তরবারির হাতল তার নিকটবর্তী করে দিলেন। তিনি বলেন যে, আমার ধারণা ছিল সে তরবারিটা নিয়ে নেবে ও তার বাপকে শেষ করে দেবে।

ওমরাহ হ’তে হালাল হ’লেন সবাই :

চুক্তি সম্পাদনের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবাইকে হালাল হওয়ার জন্য স্ব স্ব পশু কুরবানী করতে বললেন। তিনি পরপর তিনবার একথা বললেন। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। তখন রাসূল (ছাঃ) উম্মে সালামাহর কাছে গিয়ে বিষয়টি বললেন। তিনি পরামর্শ দিলেন যে, আপনি এটা চাইলে ‘সোজা বেরিয়ে যান ও কাউকে কিছু না বলে নিজের উট নহর করুন। অতঃপর নাপিত ডেকে নিয়ে নিজের মাথা মুন্ডন করুন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাই করলেন। তখন সবাই উঠে দাঁড়ালো ও স্ব স্ব কুরবানী সম্পন্ন করল। অতঃপর কেউ মাথা মুন্ডন করল, কেউ চুল ছাটলো। সবাই এত দুঃখিত ছিল যে, যেন পরস্পরকে হত্যা করবে। সেই সময় প্রতি সাত জনে একটি গরু অথবা একটি উট নহর করেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আবু জাহলের হৃষ্টপুষ্ট নামকরা উটটি নহর করেন (যা বদরযুদ্ধে গণীমত হিসাবে হস্তগত হয়েছিল), যার নাকে রূপার তৈরী নোলক ছিল। উদ্দেশ্য, যাতে মক্কার মুশরিকেরা মনোকষ্টে ভোগে। এই সময় রাসূল (ছাঃ) মাথা মুন্ডনকারীদের জন্য তিনবার ও চুল কর্তনকারীদের জন্য একবার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এই সফরে এহরাম অবস্থায় অসুখ বা কষ্টের কারণে মাথা মুন্ডনকারীর জন্য ফিদইয়া হিসাবে ছিয়াম, ছাদাক্বা অথবা একটি কুরবানীর বিধান নাযিল হয়। যা কা‘ব বিন উজরাহর (كعب بن عجرة) কারণে  নাযিল হয়েছিল।

মুহাজির মহিলাদের ফেরৎ দানে অস্বীকৃতি :

এই সময় মক্কা হ’তে বেশ কিছু মুমিন মহিলা আগমন করলেন, যারা মদীনায় হিজরত করতে চান। তাদের অভিভাবকগণ তাদের ফেরৎ নিতে এলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, সন্ধিচুক্তিতে পুরুষ মুহাজিরের কথা বলা আছে, মহিলাদের কথা নেই। কেননা চুক্তির ভাষ্য হ’ল এই যে, وَعَلَى أَنَّهُ لَا يَأْتِيْكَ مِنَّا رَجُلٌ وَإِنْ كَانَ عَلَى دِيْنِكَ إِلَّا رَدَدْتَهُ إِلَيْنَا ‘আমাদের মধ্যকার কোন পুরুষ (رجل) যদি আপনার নিকটে আসে, সে আপনার দ্বীনের উপরে হ’লেও তাকে আপনি ফেরৎ দিবেন’।[5] এখানে মহিলাদের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। একই সময়ে উক্তরূপ মহিলা মুহাজিরদের সম্পর্কে সূরা মুমতাহিনা ১০ আয়াতটি নাযিল হয়। যাতে বলা হয় যে, এইসব মুহাজির মহিলাগণকে পরীক্ষা করো। পরীক্ষায় সত্যিকারের মুমিন প্রমাণিত হ’লে তাদেরকে কাফেরদের নিকটে ফেরৎ দিয়ো না। কেননা কাফেরগণ তাদের জন্য হালাল নয়। অতঃপর ঐসব মহিলাদেরকে যথাযথভাবে মোহর দানের মাধ্যমে মুমিনদের সাথে বিবাহের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তাদের কাছ থেকে বায়‘আত গ্রহণের আদেশ দেওয়া হয় (মুমতাহিনা ৬০/১২)। উক্ত আয়াত নাযিলের ফলে হযরত ওমর (রাঃ) মক্কায় তাঁর দু’জন মুশরিক স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন। যারা পরে একজন মু‘আবিয়ার সাথে, অন্যজন ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার সাথে বিবাহিতা হন।

সন্ধির ব্যাপারে মুসলমানদের বিষণ্ণতা ও রাসূলের সাথে হযরত ওমরের বিতর্ক : হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির দু’টি বিষয় মুসলিম কাফেলার অন্তরে দারুণভাবে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, যা তাদের হৃদয়কে দুঃখে ও বেদনায় ভারাক্রান্ত করে ফেলেছিল। এক- রওয়ানা হবার সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন যে, আমরা বায়তুল্লাহ গমন করব ও তাওয়াফ করব। অথচ এখন তিনি তা না করেই ফিরে যাচ্ছেন। দুই- তিনি আল্লাহর রাসূল এবং তিনি সত্যের উপরে আছেন। উপরন্তু আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার ওয়াদা দিয়েছেন। তাহ’লে কুরায়েশদের চাপে তিনি কেন এরূপ হীন শর্তে সন্ধি করলেন।

বলা বাহুল্য  উসায়েদ বিন হুযায়ের, সা‘দ বিন উবাদাহ, সাহল বিন হুনায়েফ এবং অন্যান্য সকলের অনুভূতির মুখপাত্র স্বরূপ ওমর ফারূক (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে উপস্থিত হয়ে নিম্নোক্ত বাদানুবাদ করেন। ওমর বলেন, হে রাসূল! أَلَسْنَا عَلَى الْحَقِّ وَهُم عَلَى الْبَاطِلِ ‘আমরা কি হক-এর উপরে দন্ডায়মান নই? এবং কাফিররা বাতিলের উপরে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হাঁ।[6] ওমর বললেন, أَلَيْسَ قَتْلَانَا فِي الْجَنَّةِ وَقَتْلَاهُمْ فِي النَّارِ؟ ‘আমাদের নিহতেরা কি জান্নাতে নয়? এবং তাদের নিহতেরা জাহান্নামে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হাঁ। ওমর বললেন, তাহ’লে কেন আমরা দ্বীনের ব্যাপারে ছাড় দেব এবং ফিরে যাব? অথচ আল্লাহ পাক এখনো আমাদের ও তাদের মাঝে কোনরূপ ফায়ছালা করেননি? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে ইবনুল খাত্ত্বাব! আমি আল্লাহর রাসূল এবং আমি তাঁর অবাধ্যতা করি না। তিনি আমার সাহায্যকারী এবং তিনি কখনোই আমাকে ধ্বংস করবেন না’। ওমর বললেন, আপনি কি আমাদেরকে বলেননি যে, আমরা আল্লাহর ঘরে গমন করব ও তাওয়াফ করব’? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হাঁ। তবে আমি কি তোমাকে বলেছিলাম যে, আমরা এবছরই সেটা করব’? ওমর বললেন, না’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাহ’লে অবশ্যই তুমি আল্লাহর ঘরে আসবে ও তাওয়াফ করবে’।

অতঃপর ওমর (রাঃ) রাগতঃভাবে বেরিয়ে আবুবকর (রাঃ)-এর কাছে গেলেন ও একইরূপ অভিযোগ করলেন। তিনিও তাকে রাসূলের ন্যায় জবাব দিলেন এবং আরও বললেন, فَاسْتَمْسِكْ بِغَرْزِهِ حَتَّى تَمُوْتَ فَوَاللهِ إِنَّهُ لَعَلَى الْحَقِّ ‘আমৃত্যু তাঁর রাস্তা কঠিনভাবে অাঁকড়ে থাক। আল্লাহর কসম! তিনি অবশ্যই হক-এর উপরে আছেন’।[7] এর মাধ্যমে আবুবকর (রাঃ)-এর ঈমানী নিষ্ঠা ও অবিচলতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

এরপরে মদীনায় ফেরার পথে কুরাউল গামীম (كراع الغميم) পৌঁছলে সূরা ফাৎহ-এর পথম আয়াতগুলি নাযিল হয়। যেখানে বলা হয়, إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُبِينًا ‘আমরা আপনাকে স্পষ্ট বিজয় দান করেছি’। রাসূল (ছাঃ) ওমরের নিকটে লোক পাঠিয়ে আয়াতটি শুনিয়ে দিলেন। তখন ওমর এসে বললেন, يَا رَسُوْلَ اللهِ، أَوَ فَتْحٌ هُوَ؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি বিজয় হ’ল’? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হাঁ। তখন তিনি খুশী হ’লেন ও ফিরে গেলেন। অতঃপর ওমর (রাঃ) তার বাড়াবাড়ির কারণে দারুণ লজ্জিত হ’লেন। তিনি বলেন যে, আমি এজন্য অনেক নেক আমল করেছি। সর্বদা ছাদাক্বা করেছি, ছিয়াম রেখেছি, নফল ছালাত আদায় করেছি, দাস-দাসী আযাদ করেছি- শুধু ঐদিন ঐকথাগুলি বলার গোনাহর ভয়ে। এখন আমি মঙ্গলের আশা করছি’।[8] এভাবে ২৮০ মাইল দূর থেকে এহরাম বেঁধে এসে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে থাকতে ফিরে যেতে হ’ল। অথচ কা‘বা গৃহ এমন একটি স্থান যেখানে পিতৃহন্তা আশ্রয় নিলেও তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়। কিন্তু আড়াই হাযার বছর থেকে চলে আসা এই রেওয়াজ রাসূল ও তাঁর সাথী মুসলমানদের জন্য ভঙ্গ করা হ’ল এবং তাদেরকে কা‘বা গৃহ যেয়ারতে বাধা দেওয়া হ’ল। শান্তির বৃহত্তর স্বার্থে রাসূল (ছাঃ) তা মেনে নিলেন।

হোদায়বিয়া সন্ধির গুরুত্ব ও রাসূলের শান্তিপ্রিয়তা :

১। হোদায়বিয়ার সন্ধি ছিল ইসলামের ইতিহাসে একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা এবং নিঃসন্দেহে তা ছিল মুসলমানদের জন্য স্পষ্ট বিজয়। কারণ- ইতিপূর্বে কুরায়েশরা আরব উপদ্বীপের অধিবাসীদের ধর্মীয় ও পার্থিব নেতৃত্বের একচ্ছত্র অধিকারী বলে সর্বদা গর্ব অনুভব করত। আর সেকারণে মদীনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শক্তিকে তারা আমলেই নিত না। কিন্তু হোদায়বিয়ার সন্ধির ফলে তারা এই প্রথম রাসূলের নেতৃত্বে মদীনার ইসলামী শক্তিকে তাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে স্বীকৃতি দিল। চুক্তির তৃতীয় ধারাটির মাধ্যমে একথাটি স্পষ্টভাবেই স্বীকার করা হয়েছে।

২। আগামী দশ বছরের জন্য ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তিটাই ছিল প্রকৃত অর্থে মুসলিম শক্তির জন্য ‘স্পষ্ট বিজয়’ (فَتْحٌ مُبِينٌ) । কেননা সর্বদা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলে কোন আদর্শই যথার্থভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এই চুক্তির ফলে কাফিরদের সাথে যোগাযোগ সহজ হয় এবং তাদের মধ্যে দ্বীনের  তাবলীগের  পথ  খুলে  যায়। এতে ইসলাম দ্রুত বিস্তার লাভ করে। অতএব নির্বিঘ্ন প্রচারের সুযোগ লাভের স্বার্থে এবছর ওমরাহ না করে ফিরে যাবার মত হীনতামূলক শর্ত মেনে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও শান্তিপ্রিয়তার দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন, বিশ্ব ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। এতে ফল হ’ল এই যে, পরের বছর ক্বাযা ওমরাহ করার সময় ২০০০ এবং দু’বছর পর মক্কা বিজয়ের সময় ১০,০০০ মুসলমান রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন।

৩। যুদ্ধই যে সবকিছুর সমাধান নয়, বরং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠাই মূল লক্ষ্য, এর প্রমাণ হিসাবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) শক্তিশালী অবস্থানে থেকেও এবং কুরায়েশদের উসকানি সত্ত্বেও সর্বদা যুদ্ধ এড়াতে চেয়েছেন এবং সবশেষে নিজেই অগ্রণী হয়ে হযরত ওছমানকে কুরায়েশ নেতাদের কাছে দূত হিসাবে প্রেরণ করেন। এর দ্বারা ইসলাম যে শান্তির ধর্ম এবং তিনি যে বিশ্ব মানবতার জন্য শান্তির দূত (رحمة للعالمين) হিসাবে আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত পুরুষ (আম্বিয়া ২১/১০৭), তিনি সেটারই স্বাক্ষর রেখেছেন। কেননা মুসলমান তার জীবন ও সম্পদ সবকিছুর বিনিময়ে দুনিয়াতে স্রেফ আল্লাহর খেলাফত ও তাঁর বিধানাবলীর প্রতিষ্ঠা দেখতে চায়। গণীমত লাভ বা বাদশাহী করা তাদের জীবনের লক্ষ্য নয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই মহাকবি আল্লামা ইকবাল বলেন,

شهادت هے مطلوب ومقصود مؤمن
نه مال غنيمت نه كشور كشائي-

‘মুমিনের লক্ষ্য হ’ল শাহাদাত লাভ করা।

গণীমত বা বাদশাহী লাভ করা নয়’।[9]

৪। প্রথম দফাটি মুসলিম পক্ষের জন্য অবমাননাকর মনে হ’লেও এতে পরের বছর নিরাপদে ওমরাহ করার গ্যারান্টি ছিল। এর মাধ্যমে রাসূলের স্বপ্ন স্বার্থক হবার সুযোগ লাভ হয়।

৫। হোদায়বিয়ার সন্ধির চার দফা চুক্তির মধ্যে কুরায়েশগণ মুসলমানদের তিনটি বিষয়ে সুযোগ দানের বিনিময়ে নিজেরা মাত্র একটি সুযোগ লাভ করে। মুসলমানদের তিনটি সুযোগ হ’ল : পরের বছর ওমরাহ করার নিশ্চয়তা, আগামী দশ বছর যুদ্ধ না করা এবং সাধারণ আরব গোত্রগুলিকে মুসলিম পক্ষে যোগদানের সুযোগ প্রদান। পক্ষান্তরে কুরায়েশরা সুযোগ লাভ করেছিল কেবল চতুর্থ দফার মাধ্যমে। যাতে বলা হয়েছে যে, তাদের কেউ পালিয়ে গিয়ে মুসলিম পক্ষে যোগ দিলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এটা ছিল নিতান্তই গুরুত্বহীন। কেননা এভাবে প্রকাশ্যে যারা হিজরত করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তারা এটা করে। আবু জান্দাল, আবু বাছীর প্রমুখের ঈমানী জাযবাকে এই চুক্তি দিয়ে আটকে রাখা যায়নি। তারা সিরিয়ার নিকটবর্তী সমুদ্রোপকুলে পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে অন্যান্য মুসলমানদের নিয়ে দল গঠন করে ও কুরায়েশদের বাণিজ্য কাফেলার জন্য প্রতিবন্ধক ও কঠিন হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এই ধারাটি অবশেষে কুরায়েশদের বিপক্ষে চলে যায় এবং তারা মদীনায় গিয়ে উক্ত ধারা বাতিলের আবেদন জানায় ও মুসলমানদের মদীনায় ফিরিয়ে নেবার আবেদন জানায়। কার্যতঃ চুক্তির ৪র্থ ধারাটি বাতিল গণ্য হয়। উল্লেখ্য যে, আবু জান্দালকে মক্কায় বন্দী করার পরিণাম ফল এই হয়েছিল যে, এক বছরের মধ্যেই সেখানে প্রায় তিন শতাধিক লোক ঈমান এনেছিল। পরের বছর অর্থাৎ ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে ওছমান বিন তালহা, খালেদ ইবনু ওয়ালীদ ও আমর ইবনুল আছ-এর মত ব্যক্তিগণ মদীনায় গিয়ে ইসলাম কবুল করেন। মসজিদে নববীতে এঁদের দেখে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, ان مكة قد ألقت إلينا أفلاذ كبدها ‘মক্কা তার কলিজার টুকরাগুলোকে আমাদের কাছে সমর্পণ করেছে’।[10] এছাড়াও গোপনে ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা ছিল অগণিত। যারা মক্কা বিজয়ের পরে নিজেদের প্রকাশ করেন। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, ফলাফলের বিচারে পুরা চুক্তিটিই মুসলমানদের পক্ষে চলে গেছে। এর মাধ্যমে রাসূলের গভীর দূরদৃষ্টির পরিচয় ফুটে ওঠে। হোদায়বিয়ার সন্ধি তাই নিঃসন্দেহে ছিল ‘ফাৎহুম মুবীন’ বা স্পষ্ট বিজয়। যা শুরুতে ওমরের মত দূরদর্শী ছাহাবীরও বুঝতে ভুল হয়েছিল।

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :

১। যুদ্ধ নয়, শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল উদ্দেশ্য। এজন্য কিছু ছাড় দিয়ে হ’লেও সর্বদা সন্ধির পথে চলাই হ’ল ইসলামের নীতি।

২। সংগঠনের আমীর হবেন শান্তিবাদী এবং সবার চাইতে অধিক জ্ঞানী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন।

৩। আমীরের কোন সিদ্ধান্ত কর্মীদের মনঃপুত না হ’লে ছবর করতে হবে এবং তা মেনে নিতে হবে।

৪। সর্বদা আমীরের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। যৌথ নেতৃত্ব বলে ইসলামে কিছু নেই।

৫। মহিলারা পুরুষের উপরে নেতৃত্ব না দিলেও রাজনৈতিক ও সামাজিক সকল ব্যাপারে তাদের উত্তম পরামর্শ অবশ্যই গ্রহণীয়। যেমন হোদায়বিয়ার সন্ধির পর উম্মে সালামাহর একক পরামর্শ রাসূল (ছাঃ) গ্রহণ করেন, যা সবচেয়ে ফলপ্রসু প্রমাণিত হয়।

পরবর্তী অংশ পড়ুন: খায়বর যুদ্ধ


[1] বুখারী, মিশকাত হা/৪০৪২ ‘জহাদ’ অধ্যায়-১৯, ‘সন্ধি’ অনুচ্ছেদ-৯; ইবনু কাছীর হাদীছটি সূরা ফাৎহ ২৬ আয়াত ও সূরা ফীল-এর তাফসীরে উদ্ধৃত করেছেন

[2] ফাৎহুল বারী ৫/৪০২, হা/২৭৩১-৩৩-এর ব্যাখ্যা, ‘শর্ত সমূহ’ অধ্যায়-৫৪, ‘যুদ্ধবাদীদের সাথে সন্ধি ও শর্ত সমূহ’ অনুচ্ছেদ-১৫

[3] বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬২১৯ ‘মানাক্বিব’ অনুচ্ছেদ-১২

[4] মুসলিম হা/২৪৯৬

[5] বুখারী হা/২৭৩২।

[6] বুখারী হা/২৫২৯।

[7] বুখারী হা/২৫২৯; আর-রাহীক্ব ১/৩০৯।

[8] ফাৎহুল বারী ৭/৪৩৯-৪৫৮।

[9] আর-রাহীক্ব, উর্দূ পৃঃ ৫৬০।

[10] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/২২৯।

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button