আদব ও আমল

ইবাদতের মৌসুম শীতকাল

পৃথিবীতে রাত-দিনের পালাবদল আর ঋতু-বছরের গমনাগমন আল্লাহর নিদর্শন ও নিয়মের অংশ। পবিত্র মহান সে সত্তা, যার আদেশে মাসের চক্র পূর্ণ হয় এবং যুগের চাকা ঘোরে। তাঁর ইচ্ছাই চূড়ান্ত এবং তাঁর প্রজ্ঞাই নিয়ামক। আল্লাহর সৃষ্টি ও সৃষ্টিজগত আবলোকন করে সজীব প্রাণ ও সচেতন মুমিন শিক্ষা গ্রহণ করে। আল্লাহ বলেন,
﴿ يُقَلِّبُ ٱللَّهُ ٱلَّيۡلَ وَٱلنَّهَارَۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَعِبۡرَةٗ لِّأُوْلِي ٱلۡأَبۡصَٰرِ ٤٤ ﴾ [النور: ٤٤] 
‘আল্লাহ দিন ও রাতের আবর্তন ঘটান, নিশ্চয়ই এতে অন্তরদৃষ্টিসম্পন্নদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।’ {সূরা আন-নূর, আয়াত : ৪৪}

তিনি আরও বলেন,
﴿ وَهُوَ ٱلَّذِي جَعَلَ ٱلَّيۡلَ وَٱلنَّهَارَ خِلۡفَةٗ لِّمَنۡ أَرَادَ أَن يَذَّكَّرَ أَوۡ أَرَادَ شُكُورٗا ٦٢ ﴾ [الفرقان: ٦١] 
‘আর তিনি দিবা-রাত্রিকে পরস্পরের অনুগামী করেছেন। যে উপদেশ গ্রহণ করতে চায় অথবা কৃতজ্ঞ হতে চায় তার জন্য।’ {সূরা আল-ফুরকান, আয়াত : ৬২}

আমাদের কর্তব্য হবে শীত, গরম, বসন্ত, হেমন্ত আর বৃষ্টিকালের রূপান্তর নিয়ে চিন্তা করা। শীতকালের দিন-রাত সম্পর্কে একটু ভেবে দেখা। আমাদের পূর্বসুরী নেককার ব্যক্তিরা ঋতুবদলের সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনা ও কর্মসূচিতেও সংযোজন-বিয়োজন ঘটাতেন। শীতকালকে তাঁরা ইবাদতের সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করতেন। যেমন- আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন, ‘শীতকাল সুস্বাগত, এতে বরকত নাজিল হয়। এর রাতগুলো যেমন ইবাদতে দণ্ডায়মান হওয়ার জন্য দীর্ঘ হয়, দিনগুলো তেমনি সংক্ষিপ্ত হয় রোজা রাখার জন্য।’
আমের ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الْغَنِيمَةُ الْبَارِدَةُ الصَّوْمُ فِى الشِّتَاءِ».
‘শীতল গনিমত হলো শীতকালে রোজা।’ [তিরমিযী : ৮০২]

উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
الشتاءُ غنيمةُ العابِدين
‘শীতকাল হলো ইবাদতকারীদের জন্য গনিমতস্বরূপ।’

শীত তো এমন গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) যা কোনো রক্তপাত কিংবা চেষ্টা বা কষ্ট ছাড়াই অর্জিত হয়েছে। সবাই কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই এ গনিমত স্বতঃস্ফূর্তভাবে লাভ করে। কোনো প্রচেষ্টা বা পরিশ্রম ব্যতিরেকে পরিষ্কার তা ভোগ করে।

একজন মুমিন শীতের লম্বা রাতগুলোয় যেমন তার সুখনিদ্রার অংশ নির্ধারণ করে, তেমনি সে অপর অংশকে নির্বাচন করে ইবাদত-বন্দেগির জন্য। নেককার পুণ্যাত্মারা এ রাতগুলোয় সালাত-যিকরে নিরত হন। সালাতে দাঁড়ানো ইবাদতকারীরা দীর্ঘ মোনাজাতের অপার্থিব স্বাদ গ্রহণ করেন। নিজের রবের কাছে তারা আপন প্রয়োজনাদি তুলে ধরেন। আপন মুনিবের কাছে নিজের দারিদ্র ও অভাবের কথা খুলে বলেন। দয়াময় মাবুদের সামনে নিজ নিজ অপরাধ-অনাচারের কথা স্মরণ করে কান্নাবিগলিত হন। শীতকাল প্রবেশ করলে উবাইদ বিন উমাইর বলতেন,
يا أهل القرآن! طالَ ليلُكم لقراءَتكم فاقرءوا، وقصُرَ النهارُ لصيامِكم فصُوموا.
‘হে কোরআনের অধিকারী, তোমাদের রাতগুলো তেলাওয়াতের জন্য প্রলম্বিত করা হয়েছে, অতএব তা পড়তে থাক। আর রোজা রাখার জন্য তোমাদের দিনগুলো সংক্ষেপিত করা হয়েছে, তাই বেশি বেশি রোজা রাখ।’
তাদের মধ্যে কতই না ব্যবধান যারা যিকর, তেলাওয়াত, দু‘আ, মোনাজাত, তাহাজ্জুদ ও রোজার মধ্য দিয়ে শীতের উদযাপন করে আর যারা গাফেল ও বেখবর হয়ে অনর্থক কাজে এর রাতগুলো অতিবাহিত করে, যেন সে কিয়ামতের হিসাব-নিকাশ পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছে। এদের থেকে তাদের ব্যবধান বিস্তর, যারা আপন রবের সামনে দাঁড়িয়ে ও সিজদাবনত হয়ে রাত যাপন করে। কোরআনের ভাষায়,
﴿ كَانُواْ قَلِيلٗا مِّنَ ٱلَّيۡلِ مَا يَهۡجَعُونَ ١٧ وَبِٱلۡأَسۡحَارِ هُمۡ يَسۡتَغۡفِرُونَ ١٨ ﴾ [الذاريات: ١٧،  ١٨] 
‘রাতের সামান্য অংশই এরা ঘুমিয়ে কাটায়। আর রাতের শেষ প্রহরে এরা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকে।’ {সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত : ১৭-১৮}

এদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন,
﴿أَمَّنۡ هُوَ قَٰنِتٌ ءَانَآءَ ٱلَّيۡلِ سَاجِدٗا وَقَآئِمٗا يَحۡذَرُ ٱلۡأٓخِرَةَ وَيَرۡجُواْ رَحۡمَةَ رَبِّهِۦۗ قُلۡ هَلۡ يَسۡتَوِي ٱلَّذِينَ يَعۡلَمُونَ وَٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَۗ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٩﴾ [الزمر: ٩] 
‘যে ব্যক্তি রাতের প্রহরে সিদজাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার রব-এর রহমত প্রত্যাশা করে (সে কি তার সমান যে এরূপ করে না)।’ {সূরা আয-যুমার, আয়াত : ৯}

এরা ইহজগতের শীত দেখে জাহান্নামের অত্যধিক শীতের কথা স্মরণ করে। এদের প্রার্থনার বাক্য উচ্চারণ করে আল্লাহ বলেন,
﴿ وَٱلَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱصۡرِفۡ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَۖ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًا ٦٥ إِنَّهَا سَآءَتۡ مُسۡتَقَرّٗا وَمُقَامٗا ٦٦ ﴾ [الفرقان: ٦٤،  ٦٥] 
‘আর যারা বলে, ‘হে আমাদের রব, তুমি আমাদের থেকে জাহান্নামের আযাব ফিরিয়ে নাও। নিশ্চয় এর আযাব হল অবিচ্ছিন্ন। নিশ্চয় তা অবস্থানস্থল ও আবাসস্থল হিসেবে অত্যন্ত নিকৃষ্ট।’ {সূরা আল-ফুরকান, আয়াত : ৬৪-৬৫}

পক্ষান্তরে আত্মভোলা অপর লোকেরা খামোখা রাত জাগে। বাজে আড্ডা-গল্পে রজনী কাটিয়ে দেয়। অবৈধ বিষয়াদি দেখা, শোনা বা পড়ায় যামিনী পার করে দেয়। হায় আফসোস, হায় পরিতাপ এসব গাফেলের জন্য। লক্ষ্য রাখতে হবে, শীতে গাফেলদের সারিতে যেন আমরা অন্তর্ভুক্ত না হই। ইবাদতে যেন অলসতা না করি। উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আপন ছেলেকে অনেকগুলো উপদেশ দেন, তার মধ্যে তিনি বলেন, ‘আর শীতের দিনে সুচারুরূপে অযু করাও (বড় গুরুত্বপূর্ণ ও পুণ্যের কাজ)।’
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« أَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللَّهُ بِهِ الْخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ ». قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ « إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ وَانْتِظَارُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الصَّلاَةِ فَذَلِكُمُ الرِّبَاطُ ».
‘আমি কি তোমাদের এমন কাজের কথা বলব না যদ্বারা গুনাহ মাফ হয় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়?’ সাহাবীরা বললেন, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন, ‘মন না চাইলেও অযু করা, অধিক পদক্ষেপে মসজিদে যাওয়া এবং এক নামাজের পর আরেক নামাজের জন্য অপেক্ষা করা।’ [মুসলিম : ৬১০]

গরম পানি দিয়ে অযু করায় কোনো সমস্যা নেই। অযুর পর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মুছে শুকিয়ে ফেলাতেও সমস্যা নেই। উপরন্তু সীমাহীন শীতের জায়গায় জীবনের আশংকা হলে অযুর বদলে তায়াম্মুম বৈধ করা হয়েছে। এটা আল্লাহর দয়া ও দান। এটা তাঁর পক্ষ থেকে বিশেষ ছাড় ও অনুদান। শীতবস্ত্র সংগ্রহেও কোনো সমস্যা নেই। এসবও বরং আল্লাহর নেয়ামতের অংশ। উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নিজ শাসনামলে গভর্নরদের উদ্দেশে শীতের আগমনলগ্নে লিখতেন,
إن الشَّتاءَ قد حضَرَ وهو عدوٌّ لكم، فتأهَّبُوا له أُهبتَه من الصُّوفِ والخِفافِ والجوارِب، واتَّخِذوا الصُّوفَ شِعارًا” أي: مما يلِي الأجساد، “ودِثارًا” أي: فوق الملابِس، “فإنَّ البردَ عدوٌّ سريعٌ دخولُه، بعيدٌ خروجُه”.
‘শীত কিন্তু এসে গেল, এ তোমাদের দেহের শত্রু। অতএব এর প্রতিরোধে পশম, মোজা, হাতমোজা ইত্যাদির প্রস্তুতি নাও। আর পশম দিয়ে গায়ের চামড়ায় এবং শরীরের পোশাকে শীতের আক্রমণ ঠেকাও। কারণ শীত খুব দ্রুত প্রবেশ করে কিন্তু বিদায় নিতে বিলম্ব ঘটায়।’
দেখুন আল্লাহ কিভাবে আমাদের উষ্ণতার পরশ সৃষ্টির নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন,
﴿ وَٱلۡأَنۡعَٰمَ خَلَقَهَاۖ لَكُمۡ فِيهَا دِفۡءٞ وَمَنَٰفِعُ وَمِنۡهَا تَأۡكُلُونَ ٥ ﴾ [النحل: ٥] 
‘আর চতুষ্পদ জন্তুগুলো তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন তাতে রয়েছে উষ্ণতার উপকরণ ও বিবিধ উপকার।’ (সূরা আন-নাহল, আয়াত : ৫)

শীতকালকে আমাদের গ্রহণ করতে হবে ইবাদতের সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে। জাহান্নামের অসহ্য শীতের কথা স্মরণ আলস্য ত্যাগ করে এর রাতগুলোয় ইবাদতে মশগুল হতে হবে। সারা বছর না পারলেও শীতের দীর্ঘ রাতের কিছু অংশ জেগে তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস গড়তে হবে। তেমনি ছোট দিনে কোনো রোজা কাজা থাকলে আদায় করতে হবে এবং নফল রোজাও করার সুযোগ নিতে হবে। পাশাপাশি শীতকালে আমাদের আশপাশের বস্ত্রহীন, শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। যারা সরাসরি আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করেন তাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে এ আগুন থেকে কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা না ঘটে। ঘুমানোর আগে মনে করে আগুন নিভিয়ে দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 
« إِنَّ هَذِهِ النَّارَ إِنَّمَا هِىَ عَدُوٌّ لَكُمْ ، فَإِذَا نِمْتُمْ فَأَطْفِئُوهَا عَنْكُمْ » .
‘এই আগুন হলো তোমাদের দুশমন, তোমরা ঘুমাতে যাওয়ার আগে এসব নিভিয়ে দেবে।’ [বুখারী : ৬২৯৪; মুসলিম : ২০১৬]

(২ সফর ১৪৩৫ হি. মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ)

—————
– শায়খ ড. সালেহ বিন আবদুল্লাহ বিন হুমাইদ
অনুবাদ : আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button