আল্লাহ কোথায় আছেন?
ছোট একটা কুইজ হয়ে যাক। বলুন দেখি কোনটা সঠিক:
- আল্লাহ সব জায়গায় আছেন।
- আল্লাহ সবকিছুর এবং সবার ভেতরে আছেন।
- সবকিছুই, সমস্ত সৃষ্টি জগত আল্লাহর একটি অংশ।
- আল্লাহ সৃষ্টির ভেতরেও নেই, বাইরেও নেই।
- আল্লাহ ছাড়া আসলে আর কোন অস্তিত্ব নেই, সবকিছুই আল্লাহ।
আমরা যদি কমন সেন্স দিয়ে চিন্তা করি – নিশ্চয়ই আলাহ সব জায়গায় আছেন, না হলে তিনি সব কিছু দেখেন, শুনেন কি করে? যেহেতু সৃষ্টির আগে আল্লাহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর একটি অংশ দিয়ে সমস্ত সৃষ্টি জগত সৃষ্টি করেছেন। এমনও হতে পারে আসলে সবকিছুই আল্লাহরই একটি অংশ, আমরা আসলে আল্লাহরই ভিতরে আছি, এই দুনিয়াটা আসলে আমাদের মনের মধ্যে সৃষ্টি করা একটি মায়া মাত্র।
সঠিক উত্তর হল – এর সবগুলোই ভুল ধারণা। তবে আপনি কোন ধর্ম, গোত্র, ধারণায় বিশ্বাসী তার উপর নির্ভর করে আপনার কাছে এর সঠিক উত্তর কি হবে।
আপনি যদি হিন্দু হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি বিশ্বাস করবেন আল্লাহ সব জায়গায় আছেন এবং সবকিছুর মধ্যে আছেন। হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে তাদের সর্বশক্তিমান, অসীম, অপরিবর্তনীয়, চিরজীবী, সর্বব্যাপী সত্তা হচ্ছে ব্রাহ্মান (ব্রাহ্মা না কিন্তু), যে হচ্ছে সৃষ্টি জগতের সকল শক্তি, বস্তু, সময়, স্থান, জ্ঞান এবং মহাবিশ্বের ভিতরে এবং বাইরে যা কিছু আছে তার সবকিছু। তাকে যখন উপাসনা করা দরকার হয়, তখন তারা একটি অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক হাতি – গণেশ মূর্তির প্রতি মনোযোগ দেয়, কারণ তখন ব্রাহ্মান সেই মূর্তির মধ্যে ঘনীভূত হয়। তারা আসলে গণেশ মূর্তিটাকে পুজা করছে না, কারণ তারা জানে মূর্তিটার কোন ক্ষমতা নেই। বরং মূর্তিটার মধ্যে ঘনীভূত ব্রাহ্মানকে তারা পূজা করছে। এই হল হিন্দুদের ইয়গি বা তাদের জ্ঞানী আলেমদের ধারণা। অবশ্যই সাধারণ হিন্দুদের এত ভালো ধারণা নেই। তারা গণেশ মূর্তিকে পূজা করেই খুশি।
আপনি যখন বিশ্বাস করবেন আল্লাহ সব জায়গায় আছেন, তখন আপনি ধারণা করে নিচ্ছেন সৃষ্টি জগতের মধ্যে আল্লাহ মিশে আছেন। তার মানে হচ্ছে সকল সৃষ্টি আল্লাহরই অংশ। সুতরাং রাস্তায় যে কফ, থুথু পড়ে আছে, তার মধ্যেও আল্লাহ আছেন। আপনি যখন ভাত খাচ্ছেন, তখন আল্লাহরই অংশ খাচ্ছেন। যেহেতু সবকিছুর মধ্যেই আল্লাহ আছেন, সেহেতু সবকিছুই পবিত্র হতে বাধ্য। আপনার কাছে তখন গরু পবিত্র মনে হওয়া শুরু হবে, কারণ সেগুলোর মধ্যেও সৃষ্টিকর্তা আছেন। নানা ধরণের বিষাক্ত, হিংস্র প্রাণী যেমন সাপ, ইদুর, বানর পবিত্র মনে হওয়া শুরু হবে, কারণ সেগুলোর মধ্যেও সৃষ্টিকর্তা আছেন। একসময় অশ্লীল, নগ্ন মূর্তি, নানা ধরণের বিকৃত চিহ্নকে আল্লাহ মানতে আর কোন সমস্যা হবে না, যেহেতু সেগুলোর মধ্যেও আল্লাহ আছেন। এভাবে একসময় আপনি মূর্তি পূজায় – শিরকে ডুবে যাবেন।
বেশিরভাগ মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করে, কিন্তু একই সাথে তারা শিরকও করে। (১২:১০৬)
আল্লাহ সবকিছুর ভেতরে আছেন এই ধারণাটিকে আরেকটু বিশুদ্ধ করেছেন ইবন আরাবি এবং নয় শতকের বিজ্ঞানী জালাল আদ-দিন-সুয়ুতি। তাদের মত হচ্ছে – আল্লাহ ছাড়া আসলে আর কিছু নেই। সৃষ্টি জগত কোন আলাদা কিছু নয়। সবকিছুই আল্লাহ। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আপনি কেন আশে পাশের কোন কিছুকে উপাসনা করবেন? আল্লাহ তো আপনার, আমার, সবার মধ্যেই আছেন। বাইরের কোন কিছুর উপাসনা করে কি করবেন? তার চেয়ে আপনি নিজেকেই উপাসনা করতে পারেন – কারণ আপনি নিজেই আল্লাহ। আল্লাহর তাঁর রুহের একটি অংশ মানুষের মধ্যে দিয়ে দিয়েছেন, যখন তিনি আদমকে মাটি থেকে তৈরি করেছিলেন। সেই রুহের একটি অংশ এখনও মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে। মানুষের কাজ হচ্ছে আল্লাহর আরাধনা করে ধ্যানের উচ্চস্তরে গিয়ে আল্লাহর রুহের সাথে একাত্ত হয়ে যাওয়া। যারা এই উচ্চ পর্যায়ে চলে যেতে পারে তারা তখন অনেক অতীন্দ্রিয় কাজ করতে পারে। তারা মানুষের ভাগ্য বলে দিতে পারে। ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে। তাদের তখন আর সাধারণ মানুষের মত নামায পড়ার দরকার হয় না। এভাবেই শুরু হয় সূফী মতবাদ।
এরকম হাজারো শিরকের মধ্যে সূফী অনুসারীরা ডুবে গেছেন এবং ইসলামকে হিন্দু ধর্মের নানা রকম ধারণা দিয়ে ভরে ফেলেছেন। এক ধরনের সূফীরা বিশ্বাস করে যে তাদের সর্বোচ্চ যে সূফী সাধক, তিনি এতই উপরে উঠে গেছেন যে, তিনি অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী, ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন এবং তিনি গায়েবের (অদৃশ্যের) জ্ঞান অধিকারী। আল্লাহ কু’রআনে পরিস্কার বলে দিয়েছেন—
শুধু তাঁর কাছেই অদৃশ্যর (গায়েব) চাবি রয়েছে, তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না। (৬:৫৯)
এধরনের কথা কখনও শুনেছেন? “চিন্তা সকল শক্তির উৎস”, “আমি যা চাই, সেটাই ইতিবাচক চিন্তা দিয়ে পাবো”, “ধ্যানের উচ্চস্তরে গিয়ে মহাচৈতন্য এর সাথে বিলীন হয়ে যান”—এগুলো সূফীবাদ থেকে অনুপ্রাণিত। মানুষকে নানা ধরণের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা দিয়ে, মানুষকে আল্লাহর কাছা কাছি নিয়ে যাবার আকাঙ্খা থেকে এই সব মতবাদ এসেছে। দুঃখজনক ভাবে এগুলো সবই শিরক। কারণ আল্লাহ সকল শক্তির উৎস। আল্লাহ ইচ্ছা না করলে কোন কিছু ঘটে না। আল্লাহ কোন মহা চৈতন্য সৃষ্টি করেছেন বলে কু’রআনে কোন উল্লেখ নেই। মানুষের যদি কোন অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা থাকতো, তাহলে তা সবার আগে নবীদের (সা) মধ্যে থাকতো এবং তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ সবার আগে বের করে ফেলতেন। কিন্তু তারা সেটা পারেন নি। কু’রআনে পরিষ্কার ভাবে বলা আছেঃ
বল (মুহম্মদ), “আমি আল্লাহর রাসুলদের মধ্যে নতুন কিছু নই। আমি জানি না আমার সাথে কী করা হবে বা তোমাদের সাথে কী করা হবে। আমাকে যে ওহী দেওয়া হয়েছে, আমি শুধু সেটাই অনুসরণ করি। আমি একজন পরিষ্কার সাবধানকারী ছাড়া আর কিছু নই।” (৪৬:৯)
বল (মুহম্মদ), “আমার নিজের কল্যাণ বা অকল্যাণ করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই। আল্লাহ যা চান, সেটাই হয়। আর আমি যদি অতীন্দ্রিয় (গায়েব) কিছু জানতাম, তাহলে আমি অনেক কল্যাণ অর্জন করে নিতে পারতাম এবং আমার কোনো অকল্যাণ হতে দিতাম না। আমি একজন সাবধানকারী ছাড়া আর কিছু নই এবং একজন সুসংবাদ দাতা।” (৭:১৮৮)
সুতরাং আমাদের নবীর (সা) যদি কোন অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা না থাকে, তিনি যদি নিজের বা অন্যের ভাগ্য বলে দিতে না পারেন, তিনি যদি ‘মহাচৈতনের’ সাথে বিলীন হয়ে যেতে না পারেন, তাহলে আমরা কোথাকার কে?
যারা মহা চৈতন্যের সাথে বিলীন হয়ে যেতে পারেন, তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন মহা চৈতন্যের কাছ থেকে জেনে আসতে কালকে আবহাওয়া কেমন থাকবে। দেখুন তারা এরকম কিছু বলে কি না – “কালকে দেশের কোনো কোনো স্থানে আবহাওয়া শুষ্ক থাকবে, কোনো কোনো স্থানে হালকা অথবা মাঝারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। দেশের কিছু অঞ্চলে দমকা হাওয়া সহ ঝড় বৃষ্টিপাত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।”
তবে বাকি সকল ধর্ম, গোত্র, ধারণার মত সূফী বাদেরও নানা ধরন আছে এবং সকল সূফীরাই যে ভ্রান্ত ধারণার অনুসারী —এটা দাবি করাটা ঠিক হবে না। ধ্যনের একদম উচ্চস্তরে গিয়ে মানুষ আল্লাহর সাথে মিলিত হয়ে যাওয়ার মত অতিপ্রাকৃত ধারণা থেকে শুরু করে খুবই সাধারণ কিছু অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা যেমন ইচ্ছা শক্তি দিয়ে অসুখ দূর করে ফেলা – এরকম নানা গভীরতার সূফীবাদ প্রচলিত।
মানুষ আল্লাহর কাছাকাছি যেতে পারে – এর একটি চরম পর্যায়ের ধারণা হল খ্রিস্টানদের ধর্ম, যেখানে কিনা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা মানুষের রূপে একজন মানুষ মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। শুধু তাই না, আদমের পাপের কারণে মানব জাতির এত পাপ জমে গিয়েছিল যে, সেই পাপ ক্ষমা করার জন্য তাকে ক্রুশ বিদ্ধ হয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। যারা এই ধারণায় বিশ্বাস করেন, তাদেরকে আপনি কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারেন—
যদি যীশু স্বয়ং খোদা হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি যখন মাটিতে মাথা দিয়ে প্রার্থনা করতেন, তিনি তখন কার কাছে প্রার্থনা করতেন? নিজের কাছেই?
যীশু যখন আকুল হয়ে খোদার কাছে সাহায্য চেতেন, তখন তিনি কার কাছে সাহায্য চাইতেন? নিজের কাছেই? তিনি যখন খোদার কাছে একটি খাবার ভর্তি টেবিল চেয়েছিলেন, তখন কি তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘ও প্রভু, আমাদের প্রভু, …’ বলে নিজেকেই সম্বোধন করছিলেন?
যীশু নিজেই যখন বলেছেন তিনি অলৌকিক কোনো কিছুই নিজে করেন না, বরং তিনি ‘পিতার’ সাহায্য নিয়ে করেন, তাহলে তিনি আর পিতা এক হলেন কিভাবে?
খ্রিস্টানদের ধর্ম খুবই অযৌক্তিক ধর্ম। আপনি কোনো যুক্তি দিয়ে, এমনকি তাদের নিজেদের বাইবেল দিয়েও খুঁজে বের করতে পারবেন না, কীভাবে তারা এরকম একটি অবাস্তব ধারণায় বিশ্বাস করে।
E = mc2 = শিরক
আমাদেরকে বিজ্ঞান বইয়ে আইনস্টাইনের এই সূত্রটি পড়ান হয়, যার অর্থ হচ্ছেঃ
মহাবিশ্বে শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, শুধুমাত্র শক্তি বস্তুতে রুপান্তরিত হয় এবং বস্তু শক্তিতে রুপান্তরিত হয়।
এটি শিরক, কারণ শক্তি বা মহাবিশ্ব কোনোটাই অবিনশ্বর নয়। আল্লাহ শক্তিকে সৃষ্টি করেছেন এবং আল্লাহ মহাবিশ্বের সবকিছু একদিন ধ্বংস করে দিবেন।
আল্লাহ সব কিছুর সৃষ্টি কর্তা এবং তিনি সবকিছুর অধিপতি। (৩৯:৬২)
পৃথিবীতে যা আছে সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। (৫৫:২৬)
সুতরাং কোনো কিছুকে অবিনশ্বর মনে করাটা শিরক। একমাত্র আল্লাহ অবিনশ্বর।
আল্লাহর সম্পর্কে সঠিক ধারণা
কু’রআনে আল্লাহর সম্পর্কে সঠিক ধারণার জন্য অনেক আয়াত রয়েছে, যেমনঃ
তাঁর সাথে তুলনা করার মত আর কিছুই নেই। (৪২:১১)
তাঁর সাথে তুলনা করার মত কোন অস্তিত্ব নেই। (১১২:৪)
ওরা কখনও তাঁকে ওদের জ্ঞানের মধ্যে ধারন করতে পারবে না। (২০:১১০)
আমরা যদি আল্লাহর সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পারতামই, তাহলে সেটা আর কোন সৃষ্টিকর্তা হত না বরং সেটা এমন কিছু একটা হত যেটার ধারে কাছে কিছু আমরা এর আগে দেখেছি, কারণ মানুষ এমন কোনো কিছু কল্পনা করতে পারে না যেটা সে এর আগে কখনও দেখেনি। আপনি লক্ষ করবেন যত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী আছে সেগুলোতে এলিয়েনদেরকে দেখান হয় অক্টোপাসের মত শূর এবং মানুষের মত হাত-পা সহ; না হলে দেখা যায় গরিলার চামড়া, গরুর শিং, কুমিরের মত লেজ একসাথে মিশানো একটা কোনো প্রাণী; না হয় আলোর তৈরি মানুষের কাছাকাছি দেখতে কোনো একটা প্রাণী; না হলে প্লাজমার মত কোনো জীব। মানুষ কখনই আগে যা কোনোদিন দেখেনি, তার বাইরে কোনো কিছু কল্পনা করতে পারেনা। তার সমস্ত কল্পনা হচ্ছে পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া।
মোল্লা আলী আল-কারী একটা চমৎকার কথা বলেছেন – “আমরা আল্লাহকে কখনও আমাদের কল্পনায় ধারন করতে পারবো না। আমরা যেটাই কল্পনা করি, আল্লাহ হচ্ছেন সেটা ছাড়া অন্য কিছু, কারণ আল্লাহ বলেছেন, “ওরা কখনও তাঁকে ওদের জ্ঞানের মধ্যে ধারন করতে পারবে না।” (মিনাহ আল-রাউদ আল-আজহার ফি শারহ আল ফিকহ আল আকবার, পৃষ্ঠা ১১৭)
আল্লাহ স্থান এবং কালের উর্ধে কারণ তিনিই সকল স্থান (মহাবিশ্ব) এবং সময় সৃষ্টি করেছেন। তিনি যদি কোনোভাবে কোন স্থানে থাকতেন বা কোনো সময়ে থাকতেন, তাহলে প্রশ্ন আসতো – স্থান এবং কাল সৃষ্টির আগে তিনি কোথায় এবং কখন ছিলেন?
নিশ্চয়ই আল্লাহর সৃষ্টি জগতের কোন কিছুরই দরকার নেই। (২৯:৬)
আলী (রা) বলেছেন, “আল্লাহ অস্তিত্বমান ছিলেন যখন কোন স্থান ছিলনা, এবং তিনি এখন সেখানেই আছেন যেখানে তিনি সবসময়ই ছিলেন।” (আল ফারক বাইনা আল ফিরাক, পৃষ্ঠা ৩৩৩)
ইমাম আবু হানিফা বলেছেন, “যদি জিজ্ঞেস করা হয়, “আল্লাহ কোথায়?” তাহলে তাকে বল, আল্লাহ অস্তিত্বমান ছিলেন যখন কোনো স্থান ছিল না, সৃষ্টি জগত সৃষ্টি হবার আগে। এবং আল্লাহ অস্তিত্বমান ছিলেন যখন কোনো “কোথাও” ছিল না, কোনো সৃষ্টি, কিছুই ছিল না। তিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। (আল ফিকহ আল আবসাত, পৃষ্ঠা ২১)
একারণে যদি বলা হয় আল্লাহ আকাশে আছেন বা তিনি সব জায়গায় আছেন বা তিনি তাঁর আরশে আছেন, তাহলে সেটা ভুল। কারণ হচ্ছে এগুলো সবই তাঁর সৃষ্টি এবং এসব কিছুরই কোন সীমা আছে। আল্লাহকে কোনো সৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা যাবে না।
আবার এটাও যদি বলা হয়, “তাঁর সৃষ্টি জগতের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই এবং তিনি সৃষ্টি জগত থেকে আলাদাও নন”, তাহলে সেটাও ভুল, কারণ এই দুটো কখনও এক সাথে সত্য হতে পারে না। এর মানে দাঁড়ায় তিনি আসলে নেই।
আমরা যখনি বলি, “অমুক ওখানে আছে”, আমরা ধরে নেই অমুকের কোনো আকার আছে এবং সেটা কোনো একটি জায়গায় তার আকার ধারন করে আছে। আরেক ভাবে বললে, সেটা তার আকারের সমান কোনো একটা জায়গা দখল করে আছে। সুতরাং আমরা যখন ভাবি আল্লাহ আছেন, অনেক সময় আমরা ভুল ভাবে ধরে নেই: আল্লাহর কোনো আকার আছে এবং তিনি কোথাও, কোনো এক জায়গায়, তাঁর আকারের সমান কোনো জায়গা দখল করে আছেন। এই চিন্তাটা সম্পূর্ণ ভুল। আমাদেরকে সবসময় মনে রাখতে হবেঃ
তাঁর সাথে তুলনা করার মত কোনো অস্তিত্ব নেই। (১১২:৪)
আমরা যদি ভাবি – আল্লাহ বোধহয় এই মহাবিশ্বের বাইরে পুরো মহাবিশ্বকে ঘিরে আছেন – সেটাও ভুল ধারণা। তাহলে প্রশ্ন আসবে মহাবিশ্ব যখন ছিল না, তখন তিনি কোথায় ছিলেন? মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়ে নিশ্চয়ই আল্লার ভিতরে কোনো জায়গা দখল করে নেয়নি! আল্লাহ নিশ্চয়ই ‘সরে’ গিয়ে মহাবিশ্বের জন্য কোনো জায়গা করে দেননি!
একই ভাবে আমরা যদি ভাবি, মহাবিশ্ব হচ্ছে ত্রিমাত্রিক (প্রকৃতপক্ষে চার মাত্রা, তবে গত শতাব্দীতে ১১ মাত্রা, ২০ মাত্রা প্রস্তাব করা হয়েছে) এবং আল্লাহ আরও বেশি মাত্রায় আছেন, তাহলে সেটাও ভুল। কারণ মাত্রা আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। যখন মাত্রা ছিল না, তখন আল্লাহ কিভাবে ছিলেন? আবারো নিজেকে বার বার বলুনঃ
তাঁর সাথে তুলনা করার মত কোনো অস্তিত্ব নেই। (১১২:৪)
মনে রাখবেন, আপনি যাই ধারণা করে বের করবেন, আল্লাহ হচ্ছেন সেটা ছাড়া অন্য কিছু। আপনি যদি সৃষ্টিকর্তাকে ধারণা করতে পারতেনই, তাহলে সেটা আর আকার, স্থান, কালবিহীন, অতুলনীয় কোনো স্রষ্টা হত না। সেটা তখন তুলনা করা যায়, এমন কিছু হয়ে যাবে।
কিছু বিতর্কিত আয়াত
কু’রআনের কিছু আয়াত নিয়ে গত হাজার বছরে অনেক বিতর্ক হয়েছে। বেশিরভাগ বিতর্কের কারণ হলো: কিছু আয়াতের অর্থ আক্ষরিক অর্থে নিলে, তা আমাদের অভিজ্ঞতা এবং বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে যায়। এরকম কিছু আয়াত ব্যবহার করা হয় আল্লাহকে খ্রিস্টান গড এর মত লম্বা দাড়ি, হাত-পা ওলা এক সৃষ্টিকর্তা হিসেবে প্রমাণ করতে। আবার কিছু আয়াতকে ব্যবহার করা হয় কু’রআনকে ভুল প্রমাণ করতে ইত্যাদি। এসব আয়াত নিয়ে মানুষের আগ্রহের কোন সীমা নেই। এই ধরণের আয়াত এবং মানুষদেরকে নিয়ে আল্লাহ আমাদেরকে আগেই বলে রেখেছেনঃ
তিনিই তোমার (মুহম্মদ) প্রতি কিতাব অবতরণ করেছেন। এর কিছু আয়াতের অর্থ একদম পরিস্কার, সেগুলোই কিতাবের মূল ভিত্তি। এবং কিছু আয়াত রুপক অর্থে। যাদের অন্তরে কুটিলতা আছে, তারা ওই সব রুপক অর্থে আয়াতগুলোকে আগ্রহ নিয়ে খুঁজে বের করে সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য এবং নিজের ইচ্ছা মত অর্থ করার চেষ্টা করে। একমাত্র আল্লাহই সেগুলোর প্রকৃত অর্থ জানেন এবং যাদের গভীর জ্ঞান আছে তারা বলে, “আমরা এতে বিশ্বাস করি, এগুলো সবই আমাদের প্রভুর কাছ থেকে এসেছে” – শুধু মাত্র যারা বুদ্ধিমান, তারাই এ থেকে শিক্ষা নেয়। (৩:৭)
চলুন এরকম কিছু আয়াত দেখি।
আরশ কোথায়? আল্লাহ আরশে বসেন কিভাবে?
নিচের আয়াতগুলো নিয়ে ইসলামের একদম শুরু থেকে আরম্ভ হয়ে গত হাজার বছরে বহু বিতর্ক হয়েছেঃ
তোমাদের প্রভু হচ্ছেন আল্লাহ, যিনি ছয় দিনে/পর্যায়ে আকাশগুলো এবং পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি সিংহাসনে (আরশে) অধিস্থিত হয়েছেন। (৭:৫৪)
পরম করুণাময় সিংহাসনে (আরশে) সমাসীন/অধিস্থিত হয়েছেন। (২০:৫)
এই আয়াতগুলো নিয়ে অনেকেই আক্রমণ করেন যে, আল্লাহ কি সিংহাসনে বসেন? তিনি কি সিংহাসনে বসে সবকিছু নিয়ন্ত্রন করেন? তাঁর কি সৃষ্টি জগত নিয়ন্ত্রন করার জন্য সিংহাসন দরকার?
প্রথমত, আল্লাহর যদি আরশে বসার দরকার হয়, তাহলে তিনি আরশ বানাবার আগে কোথায় বসে ছিলেন?
দ্বিতীয়ত, আরশকে সিংহাসন অনুবাদ করা হলেও, কেন আমরা ধরে নিচ্ছি সেই সিংহাসন হচ্ছে মানুষ যে ধরণের চেয়ার, গদি, বালিশ দিয়ে সিংহাসন বানায়, সে ধরনের কিছু? আল্লাহর সিংহাসন যে মানুষের সিংহাসনের ধারে কাছেও কিছু একটা – এটা ধারণা করাটাও হাস্যকর।
পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্রগুলোতে সর্ব শক্তিমান সৃষ্টিকর্তাকে (ইব্রাহিম (আ) এর খোদাকে) দেখানো হয় বিশাল দেহী সাদা চুল-দাড়ি, সাদা আলখাল্লা পড়া এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক, যে মেঘের মধ্যে এক বিশাল সিংহাসনে বসে নিচে ছোট একটা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রন করে। মাঝে মাঝে সে আবার সাদা জামা এবং সাদা প্যান্ট পড়ে, মুখ ভর্তি তিল সহ এক কালো চামড়ার মানুষের রুপ নিয়ে পৃথিবীতে আসে। এগুলো দেখতে দেখতে আমাদের চিন্তা ভাবনার মধ্যে শিরক ঢুকে গেছে।
এরকম ভয়ঙ্কর অপমানজনক, আপত্তিকর ভাবে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে, কিন্তু মুসলমানরা তার কোনো প্রতিবাদ করছে না। মুসলমান, খ্রিস্টান এবং ইহুদিরা সবাই এক সর্ব শক্তিমান সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে। কিন্তু যুগে যুগে খ্রিস্টান এবং ইহুদিরা তাদের বানানো ভুয়া নবী, পাদ্রি, এবং রাব্বিদের মনগড়া শিক্ষা দিয়ে সৃষ্টিকর্তার ধারণাকে কলুষিত করে ফেলেছে, যেভাবে কিনা মুসলমানরা কয়েক লাখ জাল হাদিস দিয়ে ইসলামের শিক্ষাকে কলুষিত করে ফেলেছে।
খ্রিস্টান এবং ইহুদিরা যখন সর্ব শক্তিমান সৃষ্টিকর্তাকে ত্রিনিটি, সান-অফ-গড, মানুষ রুপী গড ইত্যাদি ধারণা দিয়ে অপমান করছে, তারা ইব্রাহিম(আ) এর খোদাকেই অপমান করছে, যিনি মুসলমানদেরও সৃষ্টিকর্তা। তারা এই সব অপপ্রচার করে মুসলমানদের মনের মধ্যেই শিরক ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মুসলমানদের উচিত সৃষ্টিকর্তার এত বড় অবমাননার প্রতিবাদ করা, যেভাবে তারা নবীর (সা) প্রতি অসন্মান হলে প্রতিবাদ করে। শুধু তাই না, মুসলমানদের উচিৎ ঈসা (আ) কে নিয়ে যে চরম ব্যঙ্গ করে কার্টুন, চলচ্চিত্র বানানো হচ্ছে, সেগুলোরও প্রতিবাদ করা, কারণ তিনি আমাদেরও নবী। আল্লাহ আমাদেরকে কোনো নবীর মধ্যে পার্থক্য করতে মানা করে দিয়েছেনঃ
রাসুল বিশ্বাস করেছে যা তাকে তার প্রভুর কাছ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে এবং বিশ্বাসীরাও। তারা সবাই বিশ্বাস করেছে আল্লাহ, তার ফেরেশতাদেরকে, তার কিতাবগুলোকে, এবং তার রাসুলদেরকে/বার্তাবাহকদেরকে। “আমরা তার বার্তাবাহকদের/রাসুলদের কারও মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না”, আর তারা বলে, “আমরা শুনি এবং আমরা মেনে চলি, আমাদেরকে ক্ষমা করুন আমাদের প্রভু এবং আপনার কাছেই আমরা ফেরত যাই”। (২:২৮৫)
তৃতীয়ত, আমাদেরকে বুঝতে হবে আরশ হচ্ছে এমন একটা সৃষ্টি, যেটা মহাবিশ্বের মত কোনো কিছু নয়। সেটি মহাবিশ্বের বাইরে, না ভিতরে, না কোন ভিন্ন মাত্রায় আছে – আমরা তার কিছুই জানি না। আমরা শুধুই জানি, সেটা মহাবিশ্ব নয়, কারণ আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি সমস্ত আকাশ (মহাকাশ) এবং পৃথিবী এবং আরশ সৃষ্টি করেছেন; এবং আরশ সৃষ্টি জগতের উর্ধে। যেহেতু আমরা মহাবিশ্বের বাইরে, আমাদের দেখা, শোনা, পরিমাপ করার ঊর্ধ্বে কোনো কিছু কোনোদিন কল্পনা করতে পারি না, সুতরাং আরশ কী, সেটাও আমরা কোনোদিন কল্পনা করতে পারবো না। সেই আরশে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা কীভাবে অধিষ্ঠিত হন, সেটা তো দুরের কথা।
আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের সীমিত ভাষা দিয়ে আরশের একটা ধারণা দিয়েছেন মাত্র। আমরা যেমন একটা পিঁপড়াকে তার ভাষা – ‘খাদ্য, আক্রমণ, পালাও’ এই তিনটি শব্দ দিয়ে কোন দিন বুঝাতে পারবো না কম্পিউটার কী, সেরকম মানুষকেও তার সীমিত ভাষা দিয়ে কখনই মহাবিশ্বের বাইরে, মানুষের অভিজ্ঞতার উর্ধে কোনোকিছুর ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়। মানুষের অত্যন্ত সীমিত ভাষা দিয়ে মোটামুটি ধারণা দেওয়া যায়, এরকম কিছু রুপক কথা আল্লাহ কু’রআনে বলেছেন। সেগুলো কোনভাবেই আক্ষরিক বর্ণনা নয়।
আল্লাহ কি আকাশে নন?
তোমরা কি নিশ্চিত যে, যিনি আকাশে আছেন, তিনি সেখান থেকে তোমাদের উপর পাথর বৃষ্টি করবেন না? তোমরা তখন জানতে পারবে আমার সাবধান বাণী কি। (৬৭:১৭)
এই আয়াতটি দেখিয়ে প্রমাণ করা হয় যে আল্লাহ আকাশে আছেন। এখন আল্লাহ যদি আকাশে থাকেন, তাহলে আকাশের কোথায় আছেন? তিনি কি বায়ুমণ্ডলে আছেন? নাকি বায়ুমণ্ডলের বাইরে মহাকাশে আছেন? মহাকাশে কোথায় আছেন? আমাদের ছায়াপথে, নাকি মহাবিশ্বের মাঝখানে যে অনন্ত শূন্যতা আছে সেখানে? যখন আকাশ ছিল না তখন আল্লাহ কোথায় ছিলেন?
মনে রাখবেন আরবি ‘সামা’ (আকাশ) অর্থ আমাদের মাথার উপরে অনন্ত অসীম পর্যন্ত যা আছে তার সব কিছু। এই মুহূর্তে আপনার ‘সামা’ বা আকাশ হচ্ছে যা কিছু আপনার মাথার উপর থেকে শুরু হয়ে অনন্ত অসীম পর্যন্ত গেছে। আমার মাথার উপরে এখন যা আছে, সেটা এখন আপনার পায়ের নিচে। আপনি আমি যদি পৃথিবীর দুই প্রান্তে বাস করি তাহলে আপনার মাথার উপরে যা থাকে, সেটা আমার পায়ের নিচে থাকে।
সুতরাং কোনোভাবেই প্রমাণ করা যায় না যে, আল্লাহ আকাশে আছেন। সঠিক ধারণা হচ্ছে তিনি সৃষ্টি জগতের উর্ধে আছেন। সেই উর্ধে অর্থ উপরে না কারণ সৃষ্টি জগতের কোন উপর বা নিচ নেই। আর আপনার কাছে যেটা এখন উপরে, আমি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে থাকলে আমার কাছে সেটা পায়ের নিচে কারণ পৃথিবী প্রায় গোলাকার। এছাড়াও এতদিন পর্যন্ত ধারণা করা হত মহাবিশ্ব হচ্ছে গোলাকার এবং বিগ ব্যাঙ্গের পর থেকে গোলাকৃতির মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু ২০০০ সালে প্রমাণিত হয়েছে মহাবিশ্ব সমতল। যদিও আমরা আমাদের চারিদিকে ত্রিমাত্রিক বিশ্ব দেখি কিন্তু প্রকৃত পক্ষে মহাবিশ্ব সমতল। চিন্তার বাইরে একটি ধারণা। বহু পদার্থবিজ্ঞানী বহু চেষ্টা করেও এর বিরুদ্ধে প্রমাণ করতে পারেন নি। মহাবিশ্ব সত্যিই সমতল! তবে সেটা কাগজের মত সমতল নয়। ভিন্ন ধরনের সমতল। যার অর্থ মহাবিশ্বের কোনো সীমা নেই, কোনো উপর বা নিচ বলে কিছু নেই।
সুতরাং আল্লাহ মহাকাশে আছেন এটা ভুল ধারণা। উপরের আয়াতটিতে এটাই বলা হয়েছে যে, আকাশে আল্লাহর আধিপত্য রয়েছে এবং তিনি ইচ্ছা করলেই অতি বৃষ্টি, উল্কাপাত, ধুমকেতু দিয়ে যে কোনো সময়, যে কোনো জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারেন। তিনি বহুবার সেটা করেছেন। তাই আল্লাহ মানুষকে বলছেন সেই সব ধ্বংস হয়ে যাওয়া জাতিগুলোর কথা মনে করে আল্লাহর ক্ষমতার কথা মনে রেখে সাবধান থাকতে। ইমাম আল-কুরতুবি বলেন, “এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, তোমরা কি তাঁকে ভয় কর না যাঁর ক্ষমতা, সার্বভৌমত্ব, সিংহাসন এবং রাজত্ব আকাশে রয়েছে। এখানে আকাশকে বিশেষ ভাবে বলার কারণ হল, যদিও আল্লাহর সবকিছুতেই ক্ষমতা রয়েছে, এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে আল্লাহর ক্ষমতার প্রকাশ আকাশে ঘটে। … আমি মনে করি এই আয়াতের অর্থ হবে, ‘তোমরা কি আকাশে যারা আছে তাদের সৃষ্টিকর্তাকে আর ভয় করো না?’” (আল-জামি’ লি আহকাম আল-কু’রআন, ৬৭:১৭ আয়াতের তাফসির)
কু’রআনে বেশ কিছু আয়াতে আল্লাহর কাছে ‘উর্ধে গমন’ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেই উর্ধে অর্থ আমাদের ত্রিমাত্রিক জগতের উপরের দিকে যাওয়া নয়। আপনি যদি ক্রমাগত আকাশের দিকে যেতে থাকেন, একদিন আপনি আল্লাহর কাছে গিয়ে পৌছাবেন, তা নয়। এই ‘উর্ধে’ ব্যাপারটি আমাদের কল্পনাতীত একটি ঘটনা, কারণ আমরা ত্রিমাত্রিক জগতের বাইরে কিছু কল্পনা করতে পারি না। এটি শুধু এটাই নির্দেশ করে যে, সৃষ্টিজগত এবং আল্লাহ এক নন।
আল্লাহ কি সবার মাঝে, সবখানে নন?
এই আয়াতগুলোকে ব্যবহার করা হয় প্রমাণ করার জন্য যে, আল্লাহ আমাদের সবার মধ্যে আছেন, তাই মানুষ একটি পবিত্র সত্তা এবং মানুষ ইচ্ছা করলে আল্লাহর সাথে এক হয়ে যেতে পারে।
নিশ্চিত ভাবে ‘আমি’ মানুষকে সৃষ্টি করেছি — ‘আমি’ জানি তার অন্তর তাকে কি বলে, ‘আমি’ তার ঘাড়ের ধমনী থেকেও নিকটে। (৫০:১৬)
আর যখন আমার বান্দারা তোমাকে (মুহম্মদ) আমার ব্যপারে জিজ্ঞাসা করে বল – নিশ্চয়ই আমি কাছেই আছি। আমি তাদের প্রার্থনায় সারা দেই যখন সে সরাসরি আমাকেই ডাকে। তাই তাদেরকে আমার প্রতি সারা দিতে দাও এবং তাদেরকে আমার উপর বিশ্বাস রাখতে দাও, যাতে করে তারা সঠিক পথ পেতে পারে। (২:১৮৬)
… তিনি তোমাদের সাথে আছেন, তোমরা যেখানেই থাকো না কেন। (৫৭:৪)
এই আয়াতগুলোকে ইবন আরাবি সমর্থক, মু’তাজিলি এবং সূফীরা ব্যবহার করেন এটা প্রমাণ করার জন্য যে, আল্লাহ মানুষের মাঝে রয়েছেন এবং তিনি সব জায়গায় আছেন।
কিন্তু আহল আস-সুন্নাহ (যারা কু’রআন, সুন্নাহের, চার ইমামের অনুসারী, সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি অনুসারি) তাদের মত হচ্ছে আল্লাহ সব জায়গায় নেই। এর জন্য যে সমস্ত আয়াতে আল্লাহ ‘ঊর্ধ্বে’ আছেন, ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে ‘ঊর্ধ্বে গমন’ করে এবং ঈসা নবীকে আল্লাহ ‘ঊর্ধ্বে’ তাঁর সান্নিধ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন —এই আয়াতগুলোকে প্রমাণ হিসেবে দেখায়।
ফেরেশতারা এবং রূহ তাঁর দিকে ঊর্ধ্বে গমন করে এক দিনে/পর্যায়ে যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। (৭০:৪)
তারা তাদের প্রভুকে, যিনি তাদের ঊর্ধ্বে, তাকে ভয় করে এবং তাদেরকে যা নির্দেশ করা হয় সেটাই করে। (১৬:৫০)
আবারো মনে রাখবেন, এই ঊর্ধ্বে অর্থ উপরের দিকে নয়। এর সাথে ত্রিমাত্রিক জগতের উর্ধের কোন সম্পর্ক নেই।
এছাড়াও তিনটি যুক্তি দেখানো হয়ঃ
ফিতরা – ছোট বাচ্চারা ফিতরা নিয়ে জন্ম হয়। ফিতরা হচ্ছে সত্যের প্রতি মানুষের জন্মগত সহজাত প্রবৃত্তি। একটি ছোট বাচ্চাকে যদি বলা হয় – ওই যে মাটিতে যে ময়লা পড়ে আছে, সেখানে আল্লাহ আছে – তাহলে বেশির ভাগ ছোট বাচ্চাই, যে আল্লাহ সম্পর্কে কিছুটা হলেও বুঝে, তা মেনে নেয় না। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে ঘৃণ্য কিছুতে আল্লাহ থাকতে পারে সেটা সে কখনই মেনে নিতে পারে না।
কিবলা – যদি আল্লাহ সব দিকেই থাকতেন, সব খানেই থাকতেন, তাহলে আমরা যে কোনো কিছুর, বা যে কারো দিকে মুখ করেই নামায পড়তে পারতাম। কিন্তু আমাদেরকে কোনো জীব বা বস্তুর প্রতি মুখ না করে বরং একটি কিবলার দিকে মুখ করে নামায পড়তে বলা হয়েছে। তার মানে এই না যে কা’বাতে আল্লাহ আছেন। সাড়া পৃথিবীর মুসলমানরা যেন যে দিকে ইচ্ছা সেদিকে মুখ করে নামায পড়া শুরু না করে এবং কোন দিকে তাকিয়ে নামায পড়া বেশি শুদ্ধ সেটা নিয়ে বিতর্ক শুরু করে না দেয়, সে কারনেই আল্লাহ সবাইকে একটি দিক নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি কখনও পৃথিবীর দিকে বা নিচের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করতে বলেন নি। হাদিসে দোয়া করার সময় নবীকে(সা) উপরের দিকে তাকাতে দেখা গেছে, যার অর্থ তিনি আল্লাহকে সৃষ্টির ‘উর্ধে’ মনে করতেন।
একজন মূর্তি পুজারি যখন মূর্তিকে পুজা করে, সে কিন্তু মূর্তিটাকে পুজা করে না, বরং সে মূর্তির ভেতরে যে স্রষ্টা আছে তাকে পুজা করে। এখানেই তাদের সাথে মুসলমানদের পার্থক্য। আমরা আল্লাহ কোনো সৃষ্টির মধ্যে আছেন – এটা গ্রহণ করি না।
যৌক্তিক প্রমাণ – যদি দুটো জিনিসের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে এটাই যুক্তি যুক্ত হয় যে সেই জিনিস দুটোর মধ্যে একটি হয় অন্যটির ভিতরে, না হয় জিনিস দুটি একে অন্য থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সুতরাং আল্লাহ যখন সৃষ্টি জগত সৃষ্টি করেন, তিনি হয় তা তাঁর ভিতরে সৃষ্টি করেছেন, না হলে তাঁর থেকে আলাদা করে সৃষ্টি করেছেন। এখন প্রথম সম্ভাবনাটি অযৌক্তিক কারণ তার অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহ, যিনি একজন অসীম এবং সীমাহীন ক্ষমতার এবং গুণের অধিকারী, তাঁর ভিতরে একটি অংশ রয়েছে যা অসীম নয়, সীমাবদ্ধ, যাতে অসম্পূর্ণতা এবং ত্রুটি রয়েছে। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি সঠিক – সৃষ্টি জগত আল্লাহর থেকে আলাদা বা ভিন্ন। সেটি কিভাবে আলাদা বা ভিন্ন সেটা আমরা কখনও কল্পনা করতে পারবো না, কারণ আমাদের কাছে আলাদা বা ভিন্ন এই ধারণাটি এই ত্রিমাত্রিক জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
তবে এই প্রতিটা যুক্তির অনেক পাল্টা যুক্তি আছে, বিশেষ করে যারা আল্লাহ সব জায়গায় আছেন, সব কিছুতে আছেন এই বিশ্বাস করেন, তারা বহু ধরণের যুক্তি দিয়েছেন। সেই যুক্তিগুলোর যথেষ্ট খণ্ডন করা হয়েছে। আপনি ইন্টারনেট ঘাঁটলেই পেয়ে যাবেন।
শেষ কথা
আল্লাহর সম্পর্কে গত হাজার বছরে বহু যুক্তি তর্ক হয়েছে। নানা দল, নানা সম্প্রদায় বিভক্ত হয়ে গেছে কারণ তারা আল্লাহর সংজ্ঞা সম্পর্কে একমত হয়ে পারেনি। মুসলমানদের মধ্যেই বহু ঝগড়া বিবাদ, দলীয় সংঘর্ষ হয়েছে আল্লাহকে নিয়ে, যা খুবই দুঃখ জনক। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন – আল্লাহকে নিয়ে এত মাত্রাতিরিক্ত বিচার বিশ্লেষণ করে কী লাভ? আমরা যদি আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখতে চাই, তার জন্য মাত্রাতিরিক্ত বিচার বিশ্লেষণের কোনো দরকার নেই। কু’রআন পড়ে আল্লাহর যে ধারণা পাওয়া যায়, সেটা ঠিকভাবে বুঝে, কু’রআনে যে আরও শত শত আয়াত আছে, সেগুলোর দিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া দরকার। সবার আগে নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা দরকার, আমাদের পরিবারকে ঠিক করা দরকার, সমাজে সংস্কার করা দরকার এবং দেশে ইসলামিক আইন প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করা দরকার। প্রতিদিন ২৩,০০০ মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে, ৪০০০ বাচ্চা ময়লা পানি খেয়ে মারা যাচ্ছে, শত শত নিরীহ মুসলমান অমুসলিমদের হাতে নিহত হচ্ছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম যে হারে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তা চলতে থাকলে আগামি তিন প্রজন্মের মধ্যে বহু মুসলিম পরিবার অমুসলিম পরিবারে পরিণত হবে। আমাদের সেই সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোর প্রতি মনোযোগ দিয়ে, সেই সমস্যাগুলো আগে সমাধান করা দরকার। আল্লাহ যদি আমাদেরকে বিচারের দিন জিজ্ঞেস করেন – আমরা কেন পাঁচ ওয়াক্ত নামায না পড়ে আল্লাহ কোথায় আছে এইসব নিয়ে যুক্তি তর্ক করেছি? কেন আমরা না খাওয়া গরীব মানুষ গুলোকে খাওয়ার ব্যবস্থা করে না দিয়ে দিনরাত ইন্টারনেট-এ সৃষ্টি জগত কিভাবে আসলো এইসব নিয়ে গবেষণা করেছি? কেন আমরা আল্লাহর দেওয়া একটা মাত্র বই – কু’রআন না পড়ে শ’খানেক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বই পড়েছি – তখন আমরা কী জবাব দিব?
– ওমর আল জাবির
(আংশিক সম্পাদিত)
আসসালামু ওয়ালাইকুম……।।
পোষ্টটার আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না …
আল্লাহ তাহলে আরশে নন ? আসমান তাহলে উপরে নয়?
রাসুল সাঃ মিরাজ রাজনীতে কথায় গিয়েছিলেন?
কুরআন নাজিল হয়েছে , নাজিল অর্থ কি?
রাক্বিব ভাই…! উনাকে এটাই জিজ্ঞাসা করেন ১৪৪১ হিজরী সন আগে আবু জাহিলের নাম, ‘আবুল হিক্বাম’ থেকে “আবু জাহিল” নাম করন করার স্বার্থকতা কি ছিল এবং কেন্,?