‘তোমাই’ ইশকুলে তত্তচান
নতুন ইশকুল
মায়ের হাত ধরে গুটগুট করে হেঁটে ইশকুলের গেটের কাছে পৌঁছুলো তত্তচান। তার আগের ইশকুলে ছিলো ইয়াব্বড় লোহার গেট। আর এই ইশকুলের গেটটা একদম অন্যরকম। দুপাশে দুটো গাছের গুঁড়ি। তার গা বেয়ে আবার সবুজ লতানো গাছ উঠে গেছে। লতাপাতা- ফুলসহ গেটটাকে দেখতে কী সুন্দরই না লাগছে!
গাছের গুঁড়ির গায়ে একটা নামফলক বসানো আছে। তত্তচান বানান করে পড়তে লাগলো- ‘তো- মা- ই- গা- কু- য়েন’
তত্তচান মা-কে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো- ‘তোমাই’ মানে কী। কিন্তু হঠাৎই সে এমন কিছু দেখতে পেলো যে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলো না! যেন স্বপ্নের কোনো দৃশ্য-
“মামণিইই! এটা কি একটা রেলগাড়ি? দেখো, ওই যে ইশকুলের মাঠে একটা রেলগাড়ি!”
বন্ধুরা, এই ফাঁকে তোমাদের বলে রাখি ‘তোমাই’ ইশকুল খুব মজার একটা ইশকুল। তত্তচান যে রেলগাড়িটা দেখেছে ওইটার আসলে ইশকুলঘর। মানে কি না ওখানেই ইশকুলের ক্লাসরুম। মোট ছয়টা বগি আছে পুরোনো রেলগাড়িটার। সুন্দর করে রঙ করা এসব বগিতে ‘তোমাই’ ইশকুলের বাচ্চারা ক্লাশ করে।
তত্তচান তো একছুটে গিয়ে দেখতে চাইলো রেলগাড়ির ভেতর কী আছে। কিন্তু মা ওকে যেতে দিলেন না! তিনি বললেন- “ওগুলো ক্লাসরুম তত্তচান! ক্লাশ চলছে এখন। আর তুমি তো এখনো ইশকুলে ভর্তিই হও নি! তোমাকে এখানকার হেডমাস্টারমশাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে। তিনি যা যা জিজ্ঞেস করবেন সব সুন্দর করে উত্তর দিতে হবে। তাহলে তুমিও এই ইশকুলে পড়তে পারবে। বুঝলে?”
এক্ষুনি যে রেলগাড়িতে ওঠা যাবে না- এইটা ভেবে তত্তচানের মন খুব খারাপ হলো। সে বললো,
“আচ্ছা ঠিক আছে! কিন্তু ইশকুলটা আমার খুউব পছন্দ হয়েছে মামণি!”
“আচ্ছা চলো আমরা হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে যাই।”
হেডমাস্টারমশায়
তোমাই ইশকুলের চারদিক দেয়ালের বদলে গাছ দিয়ে ঘেরা ছিলো। আর ইশকুল মাঠের দু’পাশে ছিলো অনেক লাল-হলুদ-বেগনী ফুলের ঝাড়। হেডমাস্টারমশাইয়ের অফিস ছিলো গেটের কাছে একটা ভবনে। ফুলের ঝাড়ের পাশ দিয়ে একটা সুন্দর পাথরের সিঁড়ি। এই সিঁড়ি দিয়েই হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘরে যেতে হয়।
তত্তচানকে সামলে রাখা দায়! পাথরের সিঁড়ি দেখেই তো তত্তচান লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে গেলো। প্রায় পিছলে পড়েই যাচ্ছিলো আরকি! মা সময়মতো ধরে ফেললেন। তত্তচান মায়ের কানে ফিসফিস করে বললো, “আমরা যে লোকটার সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলো তিনি নির্ঘাৎ একজন স্টেশনমাস্টার।”
মা বললো, “ওম্মা! কেন?”
তত্তচান বললো, “তুমিই না বললে লোকটা হেডমাস্টার। আর, যেহেতু এই রেলগাড়িটা তার- তাহলে তিনি নিশ্চয়ই একজন স্টেশনমাস্টার!”
তত্তচানের অদ্ভুত যুক্তি শুনে মা হেসে ফেললেন।
মা আর তত্তচান যখন অফিসঘরে ঢুকলেন একজন বৃদ্ধ লোক চেয়ার থেকে উঠে তাদের স্বাগত জানালেন। তার মাথায় বেশি চুল ছিলো না। আর কয়েকটা দাঁতও ছিলো না। কিন্তু এ বয়সেও তিনি একদম সুস্থ- সবল ছিলেন। তিনিই হেডমাস্টারমশায়। তাঁর নাম সোসাকু কোবাইয়াশি।
তত্তচান প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা আপনি কি ইস্কুল-মাস্টার নাকি স্টেশনমাস্টার?”
প্রশ্ন শুনে মা লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই মিস্টার কোবাইয়াশি হাসিমুখে বললেন, “আমি এই ইশকুলের হেড-মাস্টার!”
তত্তচান বললো, “খুব খুশী হলাম শুনে। হেডমাস্টারমশায়, আমাকে আপনার ইশকুলে ভর্তি করে নেবেন? আপনার ইশকুলটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে!”
হেডমাস্টারমশায় বললেন, “আচ্ছা তুমি এই চেয়ারটাতে বসো তত্তচান।” মায়ের দিকে ফিরে বললেন, “আপনি এখন বাড়ি যেতে পারেন। আমি তত্তচানের সাথে কথা বলতে চাই।”
মা চলে যাওয়ার পর হেডমাস্টারমশায় বললেন, “ বেশ! তত্তচান তাহলে তুমি আমাকে তোমার সম্পর্কে বলো। তোমার যা কিছু বলতে ইচ্ছে করে সব বলতে পারো।”
“আমার যা ইচ্ছে করে তা-ই বলবো!?”
“হ্যাঁ। তোমার যা ইচ্ছা তাই।”
তত্তচান ভেবেছিলো তিনি প্রশ্ন করবেন আর তাকে উত্তর দিতে হবে। কিন্তু তার বদলে যা ইচ্ছা তাই বলার সুযোগ পেয়ে তত্তচান তো মহা খুশী! সে জীবনেও এমন সুযোগ পায় নি। সে তাই মহা আনন্দে গল্প বলা শুরু করলো। বাড়ি থেকে ইশকুলে আসার পথে যা যা দেখেছে, তারা যে রেলগাড়িতে করে এসেছে তা কত জোরে যায়, রেলের টিকিট কালেক্টরমশায়কে তত্তচান অনুরোধ করেছিলো টিকিটটা সে রেখে দিতে পারে কী না- কিন্তু তিনি টিকিটটা নিয়ে গেলেন, তার আগের ইশকুলের গল্প, তাদের পোষা কুকুর রকির কথা, আগের ইশকুলে যে একটা পাখির বাসা ছিলো- সে গল্প, বাবা খুব ভালো সাঁতার জানে, সে আজকে যে জামাটা পরে এসেছে সেটা মামণি কীভাবে বানিয়েছেন- সে কথা- এমনি আরো অনেক অনেক গল্প- তত্তচান বলেই যাচ্ছিলো- বলেই যাচ্ছিলো! মিস্টার কোবাইয়াশি হাসিমুখে শুনছিলেন সব। আর একটা গল্প শেষ হলেই বলছিলেন, “তারপর?” তত্তচান তখন মহা উৎসাহে আরেকটা গল্প শুরু করে!
একটা সময় তত্তচান আর বলবার মতো কিছু খুঁজে পেলো না। তার গল্প-বলা শেষ। হেডমাস্টারমশায় তখন তত্তচানের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিলেন, আর বললেন, “তুমি এখন থেকে এই ইশকুলে পড়াশুনা করবে!”
এই মুহূর্তে পৃথিবীতে তত্তচান যেন সবচেয়ে সুখী মানুষ! তখুনি সে হেডমাস্টারমশায়কেও সে খুব ভালোবেসে ফেললো। কারণ, তত্তচানের ছোট্ট জীবনে আর কেউ এত দীর্ঘক্ষণ যাবৎ তার কথা এত মনোযোগ দিয়ে শোনে নি। তার আগের ইশকুলের শিক্ষকেরা তো তত্তচানের বকবকানিতে বিরক্ত হতেন।
তত্তচান মায়ের সাথে এই ইশকুলে যখন এসেছিলো তখন ঘড়িতে সকাল আটটা। আর এখন বারোটা বাজে। সে এখনো ঘড়ি দেখতে শেখে নি। নাহলে সে বুঝতে পারতো মিস্টার কোবাইয়াশি দীর্ঘ চারঘন্টা যাবৎ তার গল্প শুনেছিলেন!! মা-ও জানলে অবাক হতেন- একটা সাত বছরের বাচ্চার চারঘন্টা অনবরত কীইবা এত কথা বলার থাকতে পারে!
সাগর থেকে কিছু আর পাহাড় থেকে কিছু
মিস্টার কোবাইয়াশি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আরে, দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেলো যে!” তিনি তত্তচানকে ইশকুলের খাবার ঘরে নিয়ে গেলেন। সেটা ছিলো তারই আপিসঘরের উপরতলায়। ততক্ষণে ইশকুলের বাচ্চারা আর মাস্টারমশায়েরা সবাই এসে গেছেন।
মোটামুটি পঞ্চাশজনের মত বাচ্চা রয়েছে। তত্তচান একটু অবাক হলো। তার আগের ইশকুলে তো এক ক্লাসেই আরো বেশি বাচ্চা গিজগিজ করতো।
বাচ্চারা সবাই চেয়ার ও ডেস্ক টেনে ঘরে মাঝে গোল করে সাজাচ্ছিলো। সাজানো হয়ে গেলে সবাই যার যার চেয়ারে বসে পড়লো। হেডমাস্টারমশায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা সবাই সাগর থেকে কিছু আর পাহাড় থেকে কিছু এনেছো তো?”
সবাই সমস্বরে উত্তর দিলো, “জ্বি এনেছি।”
তিনি বাচ্চাদের করা বৃত্তের চারপাশ একবার ঘুরে ঘুরে দেখে আসলেন।
বন্ধুরা, তোমাদের জানিয়ে রাখি, এই ইশকুলের নিয়ম হলো টিফিনে ‘সাগর থেকে কিছু আর পাহাড় থেকে কিছু’ আনতে হবে। তার মানেটা বুঝেছো তো? ‘সাগর থেকে কিছু’ মানে হলো- সাগর/নদীতে পাওয়া যায় এমন খাবার অর্থাৎ কোনো মাছ, আর ‘পাহাড় থেকে কিছু’ মানে স্থলে হয় এমন খাবার যেমন ভাত, রুটি, আলু, শাক-সবজি ইত্যাদি।
যদিও তত্তচান বুঝলো না ‘সাগর থেকে কিছু আর পাহাড় থেকে কিছু’ মানে কী। সে এটা বুঝলো যে, এই ইশকুলের সবকিছুই অন্যরকম।
আজ যেহেতু তত্তচান টিফিন আনে নি, সে হেডমাস্টারমশায়ের সাথে খেতে বসলো।
জানালার ফাঁক দিয়ে দুপুরের মিঠে রোদ এসে ঘরে আলো করে দিলো। আগামীকাল থেকে ‘তোমাই’ ইশকুলে তত্তচান পড়তে আসবে। তত্তচান জানে তার নতুন একটা জীবন শুরু হতে যাচ্ছে। সে অতীতে আর কোনো ‘আগামীকালে’র জন্য এত অধীরভাবে অপেক্ষা করে নি!
(প্রথমাংশ)
– রাহনুমা সিদ্দিকা
মূল: তোৎসুকো কুরোইয়ানাজি, Totto-Chan: The Little Girl at the Window