মা বড্ড ভারী, ছেলেমেয়ের সংসারে তার জায়গা নেই
আমাদের গর্ভধারিনী মাকে আমরা আগামী মাসে বৃদ্ধাশ্রমে দিতে যাচ্ছি।
আমার মায়ের চার ছেলে, আমি একমাত্র মেয়ে, সবার ছোট। বাবা যখন মারা যান তখন আমার কেবল ছয় বছর বয়স। বড়ভাইয়া মাত্র কলেজে। পাঁচটা নাবালক সন্তান নিয়ে সেই সময়টা মা গভীর সমুদ্রে হাবুডুব খাওয়ার মত অবস্থা। মায়ের মনোবল ছিল অসীম।
একটা কলেজে মা তখন ইরেজী পড়াতেন। আমাদের মা ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজীতে মাষ্টার্স করেছিলেন। বাবার ছিল মোটামুটি একটা বিজনেস। আমরা সুখী পরিবার ছিলাম। কারন মা চাকরীর পাশাপাশি আমাদের এবং সংসারের প্রতি খুব কেয়ারিং ছিলেন।
বাবা-মায়ের সম্পর্কটাও ছিল শ্রদ্ধাপূর্ন।
হঠাৎ একদিন সকালে আমাদের বাবার আর ঘুম ভাঙলো না। মা যতটা ভেঙে পড়লেন, তার চেয়ে বেশী আমাদেরকে বুকে আগলে নিলেন। আমরা মায়ের পাঁচটি পিতৃহীন সন্তান, মায়ের কাছে হয়তো সেটাই মূখ্য হয়ে উঠেছিল।
বাবা টাকা পয়সা তেমন কিছু রেখে যেতে পারেননি, শুধুমাত্র আমাদের এই একতলা বাড়িটা ছাড়া। বাবা মারা যাবার কয়েকমাস পর মা ব্যাংক থেকে কিছু লোন নিয়ে দুস্থ মহিলাদের কাজে লাগিয়ে একটা বুটিক শপ্ চালু করলেন।
চাকরী-ব্যবসা সব মিলে মা তখন চরম ব্যস্ত সময় কাটাতেন আমাদেরকে নিজের পায়ে দাড় করানোর যুদ্ধে। আমাদের যোদ্ধা মা আমাদেরকে কোন কষ্ট বুঝতে দিতে চাইতেন না। ঘামে ভেজা মুখটা সব সময় আমাদের পজিটিভ কথা শোনাতেন।
সময়ে আমরা বড় হতে থাকলাম। বড়ভাই ডাক্তার হবার পর মায়ের পাশে দাড়াতে মা যেন এক শক্তি ফিরে পেলেন। মেজভাই মায়ের আপত্তি সত্বেও বন্ধুদের সাথে ব্যবসা শুরু করলেন। সংসারের প্রতি তার কোন দায়িত্ববোধ কাজ করতো না। সেজভাই একটা এনজিও তে ভালো অবস্থানে আছেন। আর ছোটভাইটা হেলথ্ মিনিষ্ট্রিতে।
আমাকেও মা নিজে পছন্দ করে ডাক্তার ছেলে দেখে বিয়ে দিলেন। মোটামুটি সবার ঘর সংসার ছেলেমেয়ে নিয়ে পরিপূর্ন বাগান হয়ে উঠলো।
শুধু সেই বাগানের মালীর কথা, তার ত্যাগের কথা আমরা ভুলতে বসলাম যেন!
মা আমাকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে দিলেও এরফানকে একদমই আজকাল সহ্য করতে পারেন না মা। কারন একটাই, এরফান সাভারে যে প্রাইভেট হসপিটালে চাকরী করতো, হঠাৎ করেই সে সেই চাকরী ছেড়ে বাসায় বসে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করে দিল। তার বক্তব্য হলো, দু’দিন পরপর গার্মেন্টসের ছেলেরা হাসপাতাল ভাঙচুর করবে আর কসাই বলে মারমুখী আচরনে শার্টের কলার চেপে ধরবে, এটা আমি মানবো না।
আমি তার সাথে পেরে উঠিনি, তাই ভাগ্যকে মেনে নিয়ে মোটামুটি দৈন্যদশাময় এক জীবন কাটিয়ে যাচ্ছি। সাভারের দুই কাঠা জমিতে আমাদের তিন রুমের ছোট্ট একটা বাসা। সামনের রুমে এরফানের চেম্বার। ভিতরের দুটো রুমে একটাতে আমার নবম শ্রেনী পড়া মেয়ে এশা থাকে, আরেকটাতে আমরা। ড্রইং, ডাইনিং বলে কিছু নেই। বারান্দায় পলিথিনে ঘিরে একটা খাবার টেবিল।
আমার ভাইদের অবস্থার কাছে আমার অবস্থা শোচনীয়। তাদের বাড়িঘর কাচের মত ঝকঝকে। আভিজাত্যের ছোঁয়া চোখে পড়ার মত।
মায়ের কাছে মাঝেমাঝে আসি। মা বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন আমার কথা ভেবে। ভায়েদের সমৃদ্ধ জীবনের ছবি তুলে ধরেন আমার সামনে। সেখানে এরফান পরাজিত কেউ। যাকে দেখলেই মা সহ্য করতে পারেন না। কারন এরফানের কাছে মায়ের প্রত্যাশা ছিল বেশী। একমাত্র মেয়ের এই জীবন মায়ের কাম্য ছিল না।
বাবার এই বাড়িটাতে মা এখন একাই থাকেন। সাথে থাকেন আমাদের পুরাতন মানুষ মতিয়াখালা। মা ফুলের চাষ করেন, এক ঝাঁক কবুতরও আছে, আর আছে মায়ের একটা পোষা বিড়াল । এই ছিয়াত্তর বছর বয়সে মা নিজের মত করে বাঁচতে শিখে গিয়েছেন।
ভাইয়েরা যার যার মত। মাঝেমাঝে চোখের দেখাটাদেখে যান। মা এতেই খুশী! আমি আর এরফান সকাল সকাল সাভার থেকে রওনা হলাম। আজ শুক্রবার। ভাইয়ারা জরুরী মিটিং এ ডেকেছেন। এর আগে তো কখনো এভাবে ডাকেননি! কী এমন জরুরী কথা। বৈষয়িক কোন ব্যাপার? এরফানের বৈষয়িক ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই। তার জন্য সন্যাস জীবনই উত্তম ছিল হয়তো।
আমাদের বাড়িতে বহুদিন পর আমরা পাঁচ ভাইবোন একত্রে হয়েছি। আমি এরফানকে বললাম, ওর বন্ধু শামীম ভাইয়ের কাছে থেকে একটু ঘুরে দুপুরের মধ্যে যেন ফিরে আসে। মায়ের বিরক্ত মুখ আমার দেখতে ভাল লাগে না।
বসার ঘরে ভাইয়েরা ফাইল পত্র নিয়ে খুবই গুরু গম্ভীর ভাবে আলোচনা শুরু করেছেন। আমি তেমন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। মা রান্নাঘরে মতিয়া খালাকে নিয়ে ব্যস্ত রান্না-বান্নায়, কোন ছেলে কী খাবে! কতদিন পর মায়ের এই সুযোগ হলো!
দুপুরে খাবার শুরু করার আগেই বড় ভাইয়া মূল আলোচনায় বসলেন। আজ তো জুম্মাবার। নামায বাদ দেয়া যাবে না। আমাদের বাড়িটা যেহেতু ব্যস্ত লোকেশনে সুতরাং এটাকে এভাবে ফেলে রাখা অযৌক্তিক।
মায়েরও বয়স হয়েছে, এভাবে একা থাকা নিরাপদ না। সুতরাং বাড়িটাকে ভেঙে এ্যাপার্টমেন্ট বানানোর জন্য ভালো একটা ডেভেলোপারের সাথে চুক্তি ফাইনাল হয়ে গেছে। এখন মায়ের মতামত।
মা হয়তো বলার মত কোন কথা পাচ্ছেন না। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন বহুদিন আগের বাবার লাগানো কামিনী গাছটার দিকে। আমি নীরবতা ভেঙে বললাম, মা তাহলে কোথায় থাকবেন?
ভাইয়েরা নানা অজুহাত দাড় করালেন। ভাবীদেরও তো বয়স হয়ে গেছে, মাকে কিভাবে টেককেয়ার করবেন! কারো আবার গেষ্টরুম নেই, কারো গেষ্টরুমে কুত্তা বিড়াল পালে, কারো বাচ্চাদের পড়ালেখার বড্ড চাপ!
আমি ভাবছি কী ভয়ঙ্কর সমস্যা জর্জরিত আমার ভাইদের জীবন!!! কুত্তা বিড়ালের ঘর হয়, অথচ একজন মায়ের ঘর হয় না। যে মা না থাকলে তারা কুত্তা বিড়ালের সমানও হতে পারতো না।
মেজভাইয়া বললেন, মাকে নিয়ে চিন্তা কিসের?
আমরা একটা ভালো ওল্ড হোমের সাথে যোগাযোগ করে মোটামুটি সব ফাইনাল করে এসেছি। এ.সি রুম, খাওয়া দাওয়া ভি.আই.পি মানের, পরিবেশটাও মনোরম। আরো অনেকেই যেহেতু আছেন, মায়ের নিঃসঙ্গও লাগবে না। তাছাড়া আমরাও রেগুলার মাকে দেখতে যাবো, মা মাঝেমাঝেই আসতেও পারবেন আমাদের কাছে।
কী বলো, মা?
মা শান্তভাবে বললেন, তোমরা এখন বড় হয়েছো, বুঝতে শিখেছো। যতটা তোমরা বোঝো, ততটা হয়তো আমি বুঝিনা। আমাকে কবে যেতে হবে সেখানে?
মাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হচ্ছে!! আমাদের মা বড্ড ভারী। ছেলেমেয়েদর সংসারে তার এতটুকু জায়গা হচ্ছে না।
আমিও তো আমার মায়ের সন্তান। দশ মাস আমিও তো মায়ের পেটে ছিলাম, প্রসব বেদনা তো ছেলে বা মেয়ে ভেদে ভিন্ন নয়!
তবে আমি কেন চুপ করে আছি? সেদিনের পর থেকে আমি কেন ঘুমাতে পারছি না? এরফান ঠিকই বুঝেছে আমার কষ্ট!
বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি। মধ্যরাত, আমি বারান্দাতে বসে আছি। এরফান আলতো করে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো,
-তুমি কাল সকালের বাসে ঢাকা যাবে।
-কেন?
-মায়ের কাছে।
-কোন মুখে যাবো?
-কাল সারাদিন মায়ের টুকটাক গোছগাছে করে দেবে।
-মানে?
-আমি পরশু সকালে একটা মাইক্রোবাস নিয়ে আসবো।
-কেন?
-মা আসবেন তাই। আমরা এখন থেকে মায়ের সাথে থাকবো।
-আমরা নিজেরাই তো ভালমত চলতে পারি না।
-এখন থেকে চলবো। ছোটবেলা থেকেই আমার মা ছিল না বলেই হয়তো আমি ছন্নছাড়া টাইপের।
মা আসলে আমি সব গুছিয়ে নেব। হাসপাতালে জয়েন করবো, এশার ঘরের পাশে মায়ের জন্য একটা বারান্দাসহ ঘর বানাবো সামনে কামিনী ফুলের একটা গাছ থাকবে। আর মতিয়া খালাও মার সাথেই থাকবেন। যাও এখন শুয়ে পড়ো। সকাল সকাল রওনা হবে কিন্তু! আমি এশাকে স্কুলে দিয়ে আসবো।
কি এক অচেনা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। অসম্ভব মিষ্টি সে ঘ্রান ! আমি এরফানের হাতটা ধরে আছি। এতকাল আমি মানুষটাকে কত সাধারণ ভেবেছিলাম। অথচ সে মানুষ হিসেবে কত রথী, মহারথীর উর্ধে বুঝতেই পারিনি !!
লেখিকা: ……..