মহারাষ্ট্রে কৃষকের আত্মহত্যা

প্রবল খরা। ধু ধু মাঠের বিস্তীর্ণ জমিনটা— জলহীন, প্রানহীন। ফেটে-ফুঁপে থাকা জমিনে হাত বিছিয়ে বৃষ্টির আশায় সারাদিন বসে থাকে গরীব কৃষকটা। তার সতর্ক দৃষ্টি ঊর্ধ্বাকাশে। জীর্ণ ঘরটাতে উনুন জ্বলেনি অ-নে-ক দিন। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে থাকে সর্বদা হাড় জিরজিরে সন্তানগুলোর একঘেয়ে চাঁপা কান্নায়। ওদিকে গত বছর এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের বোঝাটা বুকে চেপে বসেছে দৃঢ়ভাবে। চওড়া সুদ গুণতে হয় মাস পেরোলেই। একদিকে প্রবল ক্ষুধা আর সীমাহীন দারিদ্র্য। আর অন্যদিকে সুদের অভিশাপ। সীমাহীন ক্ষুধা আর এনজিও বাবুদের চোখ রাঙানির প্রতিনিয়ত ভয় নিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে একটা সময় মৃত্যুকেই সহজ সমাধান মনে হতে থাকে তার কাছে। বহুবছর আগে স্ত্রীকে কিনে দেওয়া লাল শাড়িটা পেঁচিয়ে তাই শান্ত- গভীর এক রাতে সে ঝুলে পড়লো বাড়ির পেছনের আম গাছটাতে। নীরব-অভিমানী সে রাতটাতে কেউ জানতে পারলো না হতদরিদ্র এই কৃষককে কীভাবে, কারা হত্যা করল। কেউ ঘুণাক্ষরেও কখনো টের পেল না, পুঁজিবাদ নামক রাক্ষুসে প্রাণীটা এক এক করে হতদরিদ্র মানুষগুলোকে হত্যা করে যাচ্ছে দিনের পর দিন।
ভারতের মহারাষ্ট্রে খরার প্রভাবে শুধুমাত্র চলতি বছরের শুরুতেই আত্মহত্যা করেছেন ৮৯ কৃষক। বিগত ১৯ বছরের পরিসংখ্যানটা আরও ভয়াবহ। ১৯৯৫-২০১২ পর্যন্ত মোট ৫৭,৮০৪ জন আতমহত্যা করেছেন শুধুমাত্র এই অঞ্চলেই। জী ঠিকই শুনছেন— মহারাষ্ট্রের কথা-ই বলছি। যে মহারাষ্ট্রে আইপিএল নামক কোটি টাকার জুয়ার আসরের ১৯টি খেলা হতে হচ্ছে এবার। যার মাঠ তৈরিতে খরচ হবে ৬০লাখ লিটারেরও বেশি পানি। যে পানির অভাব কেড়ে নিচ্ছে কৃষকদের তাজা প্রাণ, সে পানি দিয়ে হবে ডাংগুলি খেলা।
গরিবের রক্তের চাইতে ডাংগুলি খেলার দর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ঢের দামী। বিকোয় চওড়া মুল্যে। এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা; পেটে যাদের ভাত নেই, পাঁজরের হাঁড়গুলো যাদের গোণা যায় একটা একটা করে, ধনীর ফেলে দেওয়া কেকের টুকরায় যারা কুকুরের সাথে মুখ থুবড়ে ভাগ বসায়, সেসব ‘অসভ্য’ লোকগুলোর মুখে ডাংগুলি খেলার কারিকুরি রোচে না। ওষুধের অভাবে যারা চোখের সামনে পরিজনকে মরতে দেখে, নিজ সন্তানকে যারা বিক্রি করে স্বল্পমূল্যে, তারা গাল ভর্তি রঙ মেখে ‘জেন্টেল ম্যানস গেম’ দেখতে প্রস্তুত নয়। আমি-আপনি এতে মজতেই পারি, কারণ আমার-আপনার পেটে ভাত আছে, পরনে কাপড় আছে; ওদের নেই।
অভাব মানুষের ধর্মবোধ কেড়ে নেয়। শয়তানকে সুযোগ করে দেয় টোপ ফেলার। প্লেটভর্তি সাদা ভাতের দৃশ্য কল্পনায় যার দিন কাটে; ধর্মের বুলি তার কাছে কৌতুকস্বরূপ। আমরা প্রায়শ:ই হৈহৈ করে উঠি। মিশনারিরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের ঈমান কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু আমরা যেটা বুঝতে চাই না তা হল— মিশনারিরা কাউকে তত্ত্বকথা শুনিয়ে ধর্মান্তরিত করছে না, করছে ক্ষুধার্তের মুখের সামনে খাবার তুলে দিয়ে, রোগক্লিষ্টের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে, ভালো ব্যবহার আর ভালোবাসা দিয়ে। যাদের খাওয়ানোর কথা ছিল আমাদের, যাদের পরানোর কথা ছিল আমাদের, তাদের আমরা ছেড়ে দিয়েছি মিশনারিদের কাছে। যারা সন্তানের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে পারে না, তারা সত্যধর্ম-মিথ্যাধর্মের কী পার্থক্য করবে?
ইসলাম সত্যধর্ম বলেই মানুষের অধিকারটুকু নিশ্চিত করেছে। যাকাতের মাধ্যমে ধনীর টাকায় গরিবের অংশটা নিয়ে গরিবকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। পুঁজিবাদী রাক্ষসের কবলে সেই অধিকারটুকু আজ আমরা দিতে নারাজ। ধনী-গরিবের ব্যবধান যত বাড়ছে, ধর্মকে অধর্ম দিয়ে পরিবর্তনের হার ততই বাড়ছে। যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি ব্যবস্থার কাছে আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে। সমাধানটা ইসলাম থেকে খুঁজতে হবে। দরিদ্রের প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দিতে হবে। আর তা না হলে শেষ বিচারের দিন গরিবের অধর্মের ভারটা নিজের কাঁধে তুলে নিতে আমরা প্রস্তুত তো?
Zakat Fair