সমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

অশ্লীলতার পরিণাম ঘাতক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব

বর্তমানে আমাদের দেশে অশ্লীলতার সয়লাব চলছে। ফলে নানা রকম মরণব্যাধি মহামারীর আকারে ধেয়ে আসছে। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে অশ্লীলতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর এ কারণে প্রতিনিয়ত ব্যভিচারের প্রসার ঘটছে এবং মানুষ জটিল সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচারের কারণে সিফিলিস, গনোরিয়া, ক্ল্যামাইডিয়া, মোনিলিয়াসিস, ট্রাইকোমোনিয়াসিস, ব্যাকটেরিয়াল ভেজাইনোসিস, জেনিটাল হার্পিস, জেনিটাল ওয়ার্টস প্রভৃতি মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। আর ঘাতক ব্যাধি এইডস ও এ্যাবোলা এখন অপ্রতিরোদ্ধ মরণ ব্যাধি। অথচ অশ্লীলতার নিকটবর্তী হ’তে কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ইসলামে। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ- ‘তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা সমূহের নিকটবর্তী হয়ো না’ (আন‘আম ৬/১৫১)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيْلًا ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটেও যেও না, কারণ এটি অশ্লীল ও মন্দ পথ’ (বনী ইসরাইল ১৭/৩২)।

অশ্লীলতা বেড়ে গেলে মহামারীও বেড়ে যাবে। এমর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,خَمْسٌ إِذَا ابْتُلِيتُمْ بِهِنَّ وَأَعُوْذُ بِاللهِ أَنْ تُدْرِكُوْهُنَّ لَمْ تَظْهَرِ الْفَاحِشَةُ فِىْ قَوْمٍ قَطُّ حَتَّى يُعْلِنُوْا بِهَا إِلاَّ فَشَا فِيْهِمُ الطَّاعُوْنُ وَالأَوْجَاعُ الَّتِى لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِىْ أَسْلاَفِهِمُ الَّذِيْنَ مَضَوْا. ‘পাঁচটি জিনিস দিয়ে তোমাদেরকে পরীক্ষা করা হবে। সেই জিনিসগুলোর সম্মুখীন হওয়া থেকে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। যখন কোন জাতির মাঝে ব্যভিচার ও অশ্লীলতা প্রকাশ পায় এমনকি তা তারা ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যে করতে থাকে, তখন তাদের মাঝে মহামারী, প্লেগ ও জনপদ বিধ্বংসী ব্যাধি দেখা দিবে, যা তাদের পূর্ব পুরুষদের মাঝে ছিল না’।[1] অন্যত্র তিনি বলেন, مَا ظَهَرَ فِى قَوْمٍ الرِّبَا وَالزِّنَا إِلاَّ أَحَلُّوْا بِأَنْفُسِهِمْ عِقَابَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ ‘যখন কোন সম্প্রদায়ে বা কোন জনপদে সূদ ও ব্যভিচার বৃদ্ধি পাবে, তারা নিজেরা আল্লাহর শাস্তিকে অবধারিত করে নিবে’।[2]

যেনার সাথে আরও একটি জঘন্যতম ব্যভিচারের নাম সমমৈথুন ও সমকামিতা। সমমৈথুন সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে যখন পাঁচটি জিনিস আরম্ভ হবে, তখন তাদেরকে নানা প্রকার রোগ ব্যাধি ও আযাবের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়া হবে। তন্মধ্যে একটি হ’ল নর ও নারীর মধ্যে সমমৈথুন প্রচলিত হওয়া’।[3]

সমকামিতা একটি ঘৃণ্য অপরাধ এবং কবীরা গুনাহ। এই পাপের কারণেই বর্তমান পৃথিবী এইডসের মত মরণ ব্যাধিতে ভরে গেছে। এটা আল্লাহর গযব। এ অপরাধের কারণে বিগত যুগে আল্লাহ তা‘আলা কওমে লূতকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন (আ‘রাফ ৭/৮০-৮৪; হিজর ১৫/৭২-৭৬)। এর শাস্তি হ’ল সমকামীদের উভয়কে হত্যা করা। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ وَجَدْتُمُوْهُ يَعْمَلُ عَمَلَ قَوْمِ لُوْطٍ فَاقْتُلُوا الْفَاعِلَ وَالْمَفْعُوْلَ بِهِ  ‘তোমরা যাকে লূৎ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের মত (পুরুষে পুরুষে) অপকর্ম করতে দেখবে, তাদের উভয়কে হত্যা করবে’।[4] তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা কওমে লূতের ন্যায় অপকর্মকারীদের প্রতি লা‘নত করেছেন, তিনি এ কথাটি তিনবার বললেন’।[5]

বর্তমানে পুরুষে পুরুষে, নারী-নারীতে ও নারী-পুরুষে সমকামিতায় লিপ্ত হচ্ছে। কুরুচিপূর্ণ পুরুষরা নারীদেরকে সমকামী হিসাবে পায়ু পথে গমন করছে। আর নারী-পুরুষ অবৈধ যৌন মিলনে সিফিলিস, প্রমেহ, গনোরিয়া, এমনকি এইডসের মত মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যে সমস্ত বিবাহিতা নারীর দেহে অস্ত্রপচার করা হয়, তাদের শতকরা ৭৫ জনের মধ্যেই সিফিলিসের জীবাণু পাওয়া যায়।[6] আর সিফিলিস রোগে আক্রান্ত রোগী সুচিকিৎসা গ্রহণ না করলে মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হয়।

আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে দ্বীন ইসলামের নির্ভুল বিধানের মাঝে বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন সত্যের সন্ধান ও আশ্রয়। আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকাসহ অন্যান্য উন্নত দেশে মাত্র কয়েক বছর পূর্বে এমন রোগ দেখা দিয়েছে এবং অল্প সময়ে তা বিভিন্ন দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে হাযার হাযার মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই ভয়ঙ্কর রোগটি Acquireid Immune Deficiency Syndrome (একোয়ার্ড ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি সিন্ড্রম) নামে খ্যাত। একে আরবীতে বলা হয়, انهيار وسائل الدفاع الطبيعية فى الجسم‘অর্জিত শরীর সুরক্ষাকারী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিলুপ্ত হওয়া’। এইডস রোগের ভাইরাসের নাম Human Immuno Deficiency Virus সংক্ষেপে (HIV) এইচ আই ভি। এ ভাইরাস রক্তের শ্বেত কণিকা ধ্বংস করে। এ রোগ ১৯৮১ সালে প্রথম ধরা পড়ে এবং ১৯৮৩ সালে একজন ফরাসী বিজ্ঞানী এইচ আই ভি ভাইরাসকে এই রোগের কারণ হিসাবে দায়ী করেন।[7]

এইডসের ফলে সকল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিনষ্ট হয়ে যায়। ফলে ঐ ব্যক্তি যে কোন সময় যে কোন রোগে আক্রান্ত হ’তে পারে। এখন পর্যন্ত এইডসের কোন প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। তাই এইডস হ’লে মৃত্যু অবধারিত। একুশ শতকে বিজ্ঞানীদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এইডসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করা। ১৯৮১ সালের ৫ জুন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম এইডস শনাক্ত করা হয়। অতঃপর এশিয়ার থাইল্যান্ডে ১৯৮৪ সালে, ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯৮৬ সালে এবং বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৮৯ সালে এইডস শনাক্ত করা হয়।

এইডস বিস্তারের উল্লেখযোগ্য কারণ অবৈধ যৌনাচার। এছাড়া যেসব কারণে এইডস হ’তে পারে সেগুলো হচ্ছে- পতিতালয়ে গমন, জীব-জানোয়ারের সাথে যৌন মিলন, সমকামিতা ইত্যাদি।

ডাঃ রবার্ট রেডফিল্ড বলেন, AIDS is a sexully transmitted disease. অর্থাৎ এইডস হচ্ছে যৌন অনাচার থেকে সৃষ্ট রোগ। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সমাজের (মার্কিন সমাজের) অধিকাংশ নারী-পুরুষের নৈতিক চরিত্র বলতে কিছুই নেই। কম-বেশী আমরা সকলেই ইতর রতিঃপ্রবণ মানুষ হয়ে গেছি। এইডস হচ্ছে স্রষ্টার তরফ থেকে আমাদের উপর শাস্তি ও অন্যদের জন্য শিক্ষাও বটে’।

আমেরিকার প্রখ্যাত গবেষক চিকিৎসক ডনডেস সারলাইস বলেন, বিভিন্ন ধরনের পতিতা আর তাদের পুরুষ সঙ্গীরা এইডস রোগের জীবাণু তৈরী করে, লালন করে ও ছড়ায়। ডাঃ জেমস চীন বলেছিলেন, দু’হাযার সালের আগেই শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ইতর রতিঃপ্রবণতা প্রাধান্য লাভ করবে। পেশাদার পতিতা ও সৌখিন পতিতাদের সংস্পর্শে যারা যায় এবং ড্রাগ গ্রহণ করে তারাই এইডস জীবানু সৃষ্টি করে এবং তা ছড়ায়। এককথায় অবাধ যৌনাচার, পতিতাদের সংস্পর্শ, সমকামিতার কু-অভ্যাস ও ড্রাগ গ্রহণকেই এইডসের জন্য দায়ী করা হয়।

ডঃ নযরুল ইসলাম বলেন, এইডস সংক্রমণের প্রধান পন্থা যৌন মিলন। শতকরা ৭০-৭৫ ভাগ রোগীই এ পদ্ধতিতে আক্রান্ত হয়েছে। সারা বিশ্বের সমাজ বিজ্ঞানীসহ বিশ্ব মানবাধিকারের প্রবর্তকরা ঐ সমস্ত ভয়াবহ যৌন সংক্রামক ব্যধিতে আক্রান্ত হওয়া এবং তা দ্রুত ছড়াবার প্রধান কারণ হিসাবে সমকামিতা, বহুগামিতা এবং অবাধ যৌনাচারকে চি‎‎হ্নত করেছেন। যৌন সংক্রামক রোগগুলি যেমন এইডস, সিফিসিল, গনোরিয়া, শ্যাংক্রয়েড, লিম্ফোগ্র্যানুলোমা, ভেনেরিয়াম, ডানোভেনোসিস ও অন্যান্য। এর মধ্যে এইডস সবচেয়ে ভয়াবহ। এই রোগগুলিতে আক্রান্ত রোগীর সাথে মেলামেশা বা যৌন মিলনের মাধ্যমে সুস্থ লোক আক্রান্ত হয়।

ডাঃ মুহাম্মাদ মনছূর আলী বলেন, বর্তমান কালের সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাধি এইচ.আই.ভি। এইডস এমনই এক সময়ে সমগ্র বিশ্বে চরম আতঙ্ক এবং অতিশয় হতাশা সৃষ্টি করেছে, যখন চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নতির অত্যুঙ্গ শিখরে অবস্থান করছে। এই মরণ ব্যাধির উৎপত্তি এবং বিস্তারের কারণ হিসাবে দেখা গেছে চরম অশ্লীলতা, যৌন বিকৃতি ও কুরুচিপূর্ণ সমকাম ও বহুগামিতার মত পশু সুলভ যৌন আচরণের উপস্থিতি। শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ সমকামী এবং বহুগামী পুরুষ ও মহিলাদের মাধ্যমে এইডস সমগ্র বিশ্বে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। দিন দিন এইডস আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। সারা পৃথিবীতে বল্গাহীন ব্যভিচারের ফলে এই রোগ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ডাঃ হিরোশী নাকজিমা বলেন, জনসাধারণের মধ্যে এইডস বিস্তার লাভ করলে সমগ্র মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে।[8]

মহান আল্লাহ সতর্ক করে বলেন,فَأَصَابَهُمْ سَيِّئَاتُ مَا كَسَبُوْا وَالَّذِيْنَ ظَلَمُوْا مِنْ هَؤُلَاءِ سَيُصِيْبُهُمْ سَيِّئَاتُ مَا كَسَبُوْا وَمَا هُمْ بِمُعْجِزِيْنَ ‘তাদের দুষ্কর্ম তাদেরকে বিপদে ফেলেছে, এদের মধ্যে যারা পাপী তাদেরকেও অতিসত্বর তাদের দুষ্কর্ম বিপদে ফেলবে। তারা তা প্রতিহত করতে সক্ষম হবে না’ (যুমার ৩৯/৫১)। তিনি আরো বলেন,قُلْ هُوَ الْقَادِرُ عَلَى أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِنْ فَوْقِكُمْ أَوْ مِنْ تَحْتِ أَرْجُلِكُمْ  ‘তুমি বল, তিনি (আল্লাহ) তোমাদের উপর থেকে অথবা নীচে থেকে তোমাদের উপর আযাব পাঠিয়ে দিতে সক্ষম’ (আন‘আম ৬/৬৫)।

এইডস নামক মরণ ব্যাধি আক্রান্ত ব্যক্তিকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দিয়ে মৃত্যুর পূর্বেই হাযার বার মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করায়। জিম শ্যালী এইডস রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৭ সালের ৭ই মার্চ মারা যায়। মৃত্যুর পূর্বে সে বলেছে, আমার শরীরে একটা ভাইরাস আছে। সেটা আমার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খেয়ে ফেলছে। মাঝে মাঝে আমি জেগে উঠি। তখন আমি ওর অস্তিত্ব টের পাই, সে আমাকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলেছে।

বর্তমানে গোটা সমাজই অস্থিরতার মধ্যে অবস্থান করছে। এজন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। আমাদের কৃতকর্মের জন্যই আজ এই বিপর্যয়। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيْقَهُمْ بَعْضَ الَّذِيْ عَمِلُوْا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُوْنَ   ‘স্থলে ও সমুদ্রে মানুষের কৃতকর্মের জন্য বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে’ (রূম ৩০/৪১)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِذَا ظَهَرَ السُّوْءُ فِيْ الأَرْضِ أنْزَلَ اللهُ بَأْسَهُ بِأهْلِ الأَرْضِ وَإِنْ كَانَ فِيْهِمْ قَوْمٌ صَالِحُوْنَ يُصِيْبُهُمْ مَا أَصَابَ النَّاسَ ثُمَّ يَرْجِعُوْنَ إِلَى رَحْمَةِ اللهِ ومَغْفِرَتِهِ ‘পৃথিবীতে যখন অশ্লীল কাজ বেশী বেশী প্রকাশ পায়, তখন আল্লাহ দুনিয়ার অধিবাসীর প্রতি দুঃখ-দুর্দশা ও হতাশা নাযিল করেন। আর তাদের মধ্যে পুণ্যবান  লোক থাকলে তাদের উপরেও ঐ শাস্তি আপতিত হয়, যা অন্যদের উপরে আসে। অতঃপর তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও ক্ষমার দিকে ফিরে আসে’।[9]

১৯৮৫ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৪,৭৩৯ জন এইডস রোগে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ১০,৬৫৩ জন রোগীই পুরুষ সমকামী। অর্থাৎ লূত (আঃ)-এর সম্প্রদায় যে অপকর্ম করেছিল, তারাও সেই অপকর্মে লিপ্ত হয়েছিল। এসম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যখন সে (লূৎ) স্বীয় সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের পূর্বে বিশ্বের কেউ করেনি? তোমরা তো নারীদের ছেড়ে কামবশতঃ পুরুষদের কাছে গমন কর। বরং তোমরা সীমা অতিক্রম করেছ’(আ‘রাফ ৭/৮০-৮১)। অন্যত্র তিনি বলেন,أَتَأْتُونَ الذُّكْرَانَ مِنَ الْعَالَمِيْنَ، وَتَذَرُوْنَ مَا خَلَقَ لَكُمْ رَبُّكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ بَلْ أَنْتُمْ قَوْمٌ عَادُوْنَ- ‘সারা জাহানের মানুষের মধ্যে তোমরাই কি পুরুষদের সাথে কুকর্ম কর? আর তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের জন্য যে স্ত্রীগণকে সৃষ্টি করেছেন তাদেরকে বর্জন কর। বরং তোমরা সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়’ (শু‘আরা ২৬/১৬৫-১৬৬)।

বর্তমান আমেরিকার মত উচ্চ শিক্ষিত সুসভ্য এবং সর্বদিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার হয়ে সমকামীতার মত নিকৃষ্ট, ঘৃণিত ও মানবতা বিরোধী অশ্লীলতাকে যদি আইন করে বৈধতা দেয়, তাহ’লে কিভাবে সম্ভব মানব সভ্যতা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা? কাম প্রবৃত্তি ও লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে লজ্জা-শরম ও ভাল-মন্দের স্বভাবজাত পার্থক্য বিসর্জন দিয়ে আমেরিকান পার্লামেন্টে সমকামিতা বিল পাশ করেছে। ব্যভিচার যখন পার্লামেন্টে বৈধ ঘোষণা করা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা সমাজে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। আর তখনই সেই সমাজ আল্লাহর গযবের উপযুক্ত হয়ে যায়। মানুষের পাশবিক আচরণ যে কত দ্রুত সমাজ সভ্যতাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এসম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَالَّذِيْنَ كَسَبُوا السَّيِّئَاتِ جَزَاءُ سَيِّئَةٍ بِمِثْلِهَا وَتَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ مَا لَهُمْ مِنَ اللهِ مِنْ عَاصِمٍ  ‘যারা নিকৃষ্ট বস্ত্ত অর্জন করেছে, তার বদলাও সেই পরিমাণ নিকৃষ্ট। অপমান তাদের চেহারাকে আবৃত করে ফেলবে। তাদেরকে আল্লাহর হাত থেকে বাঁচাতে পারবে এমন কেউ নেই’ (ইউনুস ১০/২৭)।

আজ এইডস, এবোলা আতংকে সমগ্র বিশ্ব প্রকম্পিত, সমস্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত, সারা বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ এই ভয়াবহ মরণব্যাধি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা মানব জাতিকে রক্ষা করার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। কিন্তু সকল প্রচেষ্টা সমূলে ব্যর্থ হয়েছে। তারা এখন বলতে বাধ্য হচ্ছে, এইডস রোগের কোন চিকিৎসা নেই।

বর্তমান দুনিয়ায় পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে যে অশান্তি বিরাজ করছে তার কারণ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ বিমুখিতা। অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি এবং বিভিন্ন দুরারোগ্য ও ধ্বংসাত্মক ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় হ’ল মহান আল্লাহর প্রেরিত পবিত্র কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ ও যাবতীয় বিধি-নিষেধ যথাযথভাবে পালন করা। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,اسْتَجِيْبُوْا لِرَبِّكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لَا مَرَدَّ لَهُ مِنَ اللهِ مَا لَكُمْ مِنْ مَلْجَإٍ يَوْمَئِذٍ وَمَا لَكُمْ مِنْ نَكِيْرٍ  ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে অবশ্যম্ভাবী দিবস আসার পূর্বে তোমরা তোমাদের পালনকর্তার আদেশ মান্য কর। সেদিন তোমাদের কোন আশ্রয়স্থল থাকবে না এবং তা নিরোধকারী কেউ থাকবে না’ (শূরা ৪২/৪৭)।

বিশ্বের এই মহা দুর্যোগের সময় ইসলামের হুঁশিয়ারী বাণী উপলব্ধি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এইডস প্রতিরোধে ধর্মীয় অনুশাসনের কথা বলছে। WHO এ মর্মে ঘোষণা করেছে, Nothing can be more helpfull in this preventive effort than religious teachings and the adoption of proper and decent behavior as advocated and urged by all divine religions. অর্থাৎ ‘এইডস প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় ধর্মীয় শিক্ষাদান এবং যথাযথ নির্মল আচরণ প্রবর্তনের চেয়ে আর কোন কিছুই অধিক সহায়ক হ’তে পারে না, যার প্রতি সকল ঐশ্বরিক ধর্মে সমর্থন প্রদান ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে’।[10]

‘এ্যাবোলা’ রোগ এইডস-এর মতো মহামারী আকার ধারণ করছে। পশ্চিম আফ্রিকায় এইডসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে এ্যাবোলাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন সেন্টার (সিডিসি) জানিয়েছে যে, এই রোগ প্রতিরোধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া না হ’লে আগামী এক বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী এ্যাবোলা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫ লাখে। এত দ্রুত ছড়ানোর কারণ হ’ল মানুষের শরীর নিঃসৃত রস থেকে এ্যাবোলা ভাইরাস অতীব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

টম ফ্রিডেন বলেন, বিশ্বকে দ্রুত কাজ করতে হবে, যাতে করে এ্যাবোলা ‘পরবর্তী এইডস’-এর মত মহামারী হয়ে না দাঁড়ায়। এ্যাবোলা  মোকাবিলায় দীর্ঘ যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিতে হবে। তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘জনস্বাস্থ্যে আমি ৩০ বছর ধরে কাজ করছি। এইডসের মত অনুরূপ মরণ ও ঘাতক ব্যাধির সহোদর হ’ল ‘এ্যাবোলা’। পশ্চিম আফ্রিকার এ্যাবোলা প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি বলে অভিহিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।

স্মর্তব্য যে, মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন প্রকার চ্যালেঞ্জ চলে না। আমরা যতই কূট কৌশল করে হারামকে হালাল বানানোর চেষ্টা করি না কেন, আল্লাহ হ’লেন সর্বোত্তম কৌশলী। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা জাগিয়ে অবাধ যৌনাচার থেকে বিরত রাখার মধ্যেই রয়েছে এইডস ও এ্যাবেলার মত রোগের একমাত্র প্রতিবিধান। চরিত্রের উত্তম গুণাবলী অর্জন ও পাশবিকতা বর্জন এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে অশ্লীলতা প্রতিরোধ করতে হবে। এ ব্যাপারে সমাজকে সোচ্চার হ’তে হবে। সকলের মাঝে আল্লাহভীতি ও স্ব স্ব মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। পাপের পথ থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে। নচেৎ আমরা সকলে অচিরেই লূৎ (আঃ)-এর জাতির মত ধ্বংস হয়ে যাব। মহান আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার তাওফীক দান করুন-আমীন!!

 

– লিলবর আল-বারাদী



[1]. ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯; ছহীহাহ হা/১০৬।

[2]. আহমাদ হা/৩৮০৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৬৩৪।

[3]. ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৯৭৮।

[4]. তিরমিযী হা/১৪৫৬; আবুদাউদ হা/৪৪৬২; মিশকাত হা/৩৫৭৫।

[5]. আহমাদ হা/২৯১৫; ছহীহাহ হা/৩৪৬২।

[6]. Dr. Lowry, Her self, P-204.

[7]. কারেন্ট নিউজ, ডিসেম্বর ২০০১ সংখ্যা, পৃঃ ১৯।

[8]. The New Straits Jimes, (Kualalampur, Malaysia, 23 june 1988), P-9.

[9]. ছহীহুল জামে‘ হা/৬৮২।

[10]. The role of Religion and ethics in the prevention and control of AIDS. Page 3, Para 9, Published by WHO.

মন্তব্য করুন

Back to top button