ছোটগল্প/উপন্যাস

মনের মত পাত্রী

রায়হানের খুশি যেন উথলে উঠে উপচে পড়ছে। গত রাতের কথা মনে করে আজ পড়ন্ত বিকালে, ক্লান্ত শরীরে, জনাকীর্ণ স্টেশনে দাঁড়িয়েও সে আনমনে মুচকি মুচকি হেসে চলেছে। তিন বছর যাবত সাধ্য সাধনার পর বাবামা ওকে বিয়ে করাতে রাজী হয়েছেন।

শুরু করেছিল মাকে তৈলমর্দন করে। বাবাকে একদিন বুঝাতে গেলে বাবা লেকচার ঝেড়ে দিলেন, ‘রাডইয়ার্ড কিপ্লিং পড়েছ? তাহলে আর পড়েছ কি? পড়লেও পড়েছ ‘জাঙ্গল বুক’। লেখা নেই, পড়া নেই, নেই জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহ; দায়িত্বশীলতা শেখনি, অথচ বিয়ে বিয়ে কর! টারজান টারজান খেলায় মেতে থেকে তো আর বিয়ের যোগ্যতা হয়না!’ তারপর থেকে মাকে বুঝানোর দায়িত্ব রায়হানের, বাবাকে বুঝানোর দায়িত্ব মায়ের।

অবশেষে ওরা যখন রাজী হলেন তখন রায়হানের অবস্থা হয়ে গেল বসতে দিলে শুতে চায় টাইপের। সে মা’কে বোঝালো, ‘আমার এখন তেইশ বছর বয়স, যথেষ্ট ম্যাচিউর হয়েছি আমি। সুতরাং, আমি চাই নিজে মেয়ে খুঁজতে, নিজের মনের মত বৌ সংগ্রহ করতে। ভয় পেয়োনা, আমার ভুল করার বয়স আর নেই। আমি যাকে পছন্দ করব তাকে তোমাদের পছন্দ হবে’। মা বাবাকে বোঝাতে গেলে তিনি আবার লেকচার ঝাড়লেন, ‘মা ছেলের আদিখ্যেতা দেখে আর বাঁচিনা! রাডইয়ার্ড কিপ্লিং কি বলেছেন জানো? তেইশ বছর বয়সে একজন যুবকের সবকিছু সুন্দর লাগে। এই বয়সের একটা ছেলে কোন ঘোড়া ভাল আর কোন ঘোড়া খোঁড়া তাই তো বোঝেনা, আর সে কি’না করবে বৌ পছন্দ! তোমাদের দু’জনেরই মাথা খারাপ!’

বাবার অবস্থা দেখে মা এসে চুপি চুপি বললেন, ‘শোন বাবা, আমরা আগের দিনের মানুষ। বাপমা যেখানে বলেছে সেখানে বসে পড়েছি। কিন্তু তাই বলে তোমরা তো আর তা করবেনা! আমি সেটা আশাও করিনা। ভেবেছিলাম আমরা কয়েকটা পাত্রী দেখে সেখান থেকে তোমাকে নির্বাচন করতে বলব। কিন্তু তুমি নিজেই মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছ। তা যাও, তুমি দেখেশুনে আমাকে জানাও। তোমার বাপকে নাহয় আমি বুঝাব’।

ট্রেন এসে পড়েছে। ট্রেনে উঠে পড়ে রায়হান। বসার জায়গা নেই। কম্পার্টমেন্টের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। এখান থেকে পুরো বগিটাই এক নজরে দেখা যায়। ট্রেনে কতরকম মানুষ! তার অর্ধেক অন্তত নারী প্রজাতির। আচ্ছা, এখানে কি এমন কেউ থাকতে পারেনা যাকে ওর পছন্দ হবে? চোখ বুলায় রায়হান। কেউ আধুনিকা, শরীর ঢাকার মত পোশাকের ঘাটতি সে কথা জানান দিচ্ছে সবাইকে। কথা বলছে উচ্চস্বরে, হাসছে ততোধিক জোরে, হাসিটা কেমন যেন জবরদস্তি মার্কা, কেমন যেন ভুখানাঙ্গা টাইপের। কিছু মেয়ে সচেতন, নিজের শরীর নিজের সম্পদের মত আগলে রেখেছে পোশাক এবং আচরন দিয়ে। মাঝে মাঝে ইতিউতি চাইছে, কিন্তু কারো সাথে চোখাচোখি করছেনা। একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে যায় রায়হানের। শুকনা পাতলা, নম্রভদ্র চেহারা, সুন্দরী নয় তবে মায়াবতী, পোশাকে শালীনতা- পুরো ট্রেনে এই একজনই নারী এক টুকরো কাগজ নিয়ে কি যেন লেখালেখি করছে, কোনদিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করছেনা, গল্প করছেনা কারো সাথে। রায়হান ভাবে, ‘এই মেয়েই আমার চাই! বাবা সবসময় বলেন আমি নাকি অকম্মার ঢেঁকি, এই মেয়ে তো ট্রেনে ভ্রমনের সময়টুকুও লেখাপড়া করছে। এমন মেয়ে আমি পছন্দ করেছি দেখলে বাবার তাক লেগে যাবে। মা একজন সঙ্গী পাবেন যার সাথে কথা বলে আরাম পাওয়া যায়। আর আমি পাব একজন জ্ঞানী বৌ’।

এসব ভাবতে ভাবতে দেখে মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে, ওর স্টেশন এসে পড়েছে। এখন কি করা উচিত? সাতপাঁচ ভেবে মেয়েটির স্টেশনেই নেমে পড়ল সে। মেয়েটির পিছু পিছু প্ল্যাটফর্ম থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠল, স্টেশন থেকে বের হয়ে গেল। দেখল মেয়েটি একটি গাড়ীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভিড় ঠেলে ওখানটায় পৌঁছতে পৌঁছতে মেয়েটার গাড়ী চলে গেল।

প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে সারারাত ভাবল রায়হান। ভোরের দিকে মাথায় এলো, মেয়েটি যেহেতু ট্রেনে বসে পড়াশোনা করছিল হয়ত সে কোন প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী। সাধারনত অফিস আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একই সময় ছুটি হয়। তাই তো ওরা একই সময় ট্রেনে ছিল। যারা ট্রেনে যাতায়াত করে তারা সাধারনত প্রতিদিন একই কম্পার্টমেন্টে ওঠে। সুতরাং, ওদের আবার দেখা হবে নিশ্চিত। হয়ত আগেও দেখেছে বহুবার কিন্তু এই দৃষ্টি নিয়ে দেখেনি তাই চোখেই পড়েনি। এখন তো সে এটাও জানে মেয়েটা কোন স্টেশনে নামে। সুতরাং, খুঁজে তাঁকে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। আশান্বিত হয়ে নব উদ্যমে প্রস্তুত হয় রায়হান।

কাজের ভিড়ে সারাটা দিন কেটে যায় কল্পনার সোনালী পাখায় ভর করে। কাজ শেষে আর তর সয়না তার। ছুটতে ছুটতে ট্রেন স্টেশনে পৌঁছয় সে। ট্রেন আসতেই লাফিয়ে উঠে পড়ে। কম্পার্টমেন্টের দেয়ালে ওর অবজারভেশন পোস্ট থেকে দ্রুত রেকি করে নেয়। নাহ, মেয়েটিকে পাওয়া যাচ্ছেনা। লোকজন ঠেলে পুরো বগি ঘুরে আসে সে। নাহ, নেই। সারারাত ভাবে, ভুলটা কোথায় হোল। ভোরের দিকে টের পায়, অতিরিক্ত অস্থিরতায় সে সম্ভবত গত দিন যে ট্রেনে উঠেছিল তার আগের ট্রেনে উঠে পড়েছে। নাহ, এত অস্থির হলে কি চলে? আজ সুস্থির হয়ে কার্যসিদ্ধি করতে হবে। আবার আশায় বুক বাঁধে রায়হান।

আজ আর ভুল হোলনা। অফিসে ভালভাবে কাজ শেষ করে, সব গুছিয়ে, ধীরেসুস্থে হেঁটে স্টেশনে আসে রায়হান। সঠিক ট্রেনে ওঠে। মেয়েটিকেও খুঁজে পায়। এমনকি বসার জায়গাও পেয়ে যায়। এবার কেবল অপেক্ষা। কখন মেয়েটির স্টেশন আসে। ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারলেই বাবামাকে বলবে ওর অভিভাবকদের সাথে কথা বলতে। মেয়েটি আজও কি যেন লেখালেখি করছে। কিন্তু একজন অপরিচিত পুরুষ ওর দিকে বার বার তাকালে ব্যাপারটা হয়ত ওর চোখে পড়ে যেতে পারে। বাইরে দেখতেও ভাল লাগছেনা। যে পথ প্রতিদিন দু’বার যেতে আসতে হয় তাতে আর দেখার কি আছে? রায়হান আপাতত চুপচাপ চোখ বুজে আসন্ন বিবাহের সুখ কল্পনায় ডুবে যায়। হঠাৎ চোখ খুলে বুঝতে পারে তন্দ্রামত এসে গেছিল। ট্রেনে মেয়েটি নেই। বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারে ওর স্টেশন চলে গিয়েছে আরো কিছুক্ষণ আগে। নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হয় রায়হানের। কিন্তু পর পর দুই রাত না ঘুমালে তন্দ্রা আসাটাই স্বাভাবিক, শরীরের আর কি দোষ! নাহ, আজ ভালমত ঘুমিয়ে চাঙ্গা হয়ে তবেই কাজে নামতে হবে।

ঘুম ভালোই হোল। ভোরের দিকে নামাজ পড়তে উঠে মনে হোল, আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয়? সে তো জানেই মেয়েটি কোন স্টেশনে নামে, ক’টা বাজে নামে। তাহলে আগেভাগে ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তাই আজ আগের ট্রেন ধরে মেয়েটির স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল রায়হান। ঐতো মেয়েটির গাড়ীও এসেছে। ভালই হোল, গাড়ীর নাম্বার দিয়ে সার্চ দিলে ঠিকানা জানা যাবে। প্রচন্ড গরমে দরদর ঘামছে সে। গাড়ীর ভেতর লোকজনও সম্ভবত এ’কারণেই গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। একটা লোক দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত ড্রাইভার। সাথে দু’টো ছেলেমেয়ে, মেয়েটির বয়স পনেরো ষোল হবে, ছেলেটির নয় দশ। এরা হয়ত মেয়েটির ছোট ভাইবোন হবে। লোকটি ওদের দু’টো আইসক্রিম কিনে দিল, আরেকটি নিজের হাতে রাখল কিন্তু খেলোনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটি এসে পৌঁছলো। ছেলেমেয়ে দু’টি উৎফুল্ল হয়ে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরল। লোকটি এগিয়ে এসে হাতের আইসক্রীমটি মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলো। কিন্তু ওরা যেভাবে একে অপরের দিকে তাকাল তাতে রায়হানের খটকা লাগল। মেয়েটি গিয়ে ড্রাইভারের পাশের সীটে বসে পড়ল। সে কৌতুহলী হয়ে গাড়ীর দিকে এগিয়ে গেল। এ কি! মেয়েটি আর লোকটি আইসক্রীম শেয়ার করে খাচ্ছে! লোকটি গাড়ীতে স্টার্ট দিল। পেছনে থেকে পনেরো ষোল বছর বয়সী মেয়েটি বলতে শুরু করল, ‘আম্মু, জানো আজকে আবরার স্কুলে কি করেছে? …’ ওর কথা কাটা পড়ল পাশে বসা নয় দশ বছর বয়সী ছেলেটির চিৎকারে, ‘নাআআআ, আম্মুকে বলা যাবেনাআআআ’। গাড়ীটা দূরে চলে গেল। রায়হান হতভম্ব হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। হায়রে, মেয়েদের বয়স বোঝার বয়সই যার হয়নি সে কি’না খুঁজবে মনের মত পাত্রী!

মোবাইল বের করে মাকে ফোন করে রায়হান, ‘মা’।

ওদিক থেকে মা বলেন, ‘বল বাবা’।

‘আমার মনে হয় কি, তোমরা কয়েকটা মেয়ে দেখে একটা শর্টলিস্ট কর। তারপর আমি ওখান থেকে একজনকে পছন্দ করে নেই। তাহলে তোমাদেরও শখ পূরণ হোল, আমিও তোমাদের পছন্দের গন্ডির মধ্যেই আমার রুচি অনুযায়ী পছন্দ করার সুযোগ পেলাম। কি বল?’

‘ঠিক আছে, তুই যা ভাল মনে করিস’।

ফোন রেখে বাবাকে ঘটনাটা বলতেই বাবা অবাক হয়ে বলেন, ‘তুমি কিভাবে বুঝেছিলে রায়হান ঘুরেফিরে এই পয়েন্টেই আসবে?’

মা বলেন, ‘তুমি সারাজীবন আমাদের খোঁচালে, ‘রাডইয়ার্ড কিপ্লিং পড়েছ? তাহলে আর পড়েছ কি?’ আর তুমি জিজ্ঞেস করছ এই কথা? তিনি কি বলেছেন? বলেছেন, ‘A woman’s guess is much more accurate than a man’s certainty’- তোমরা যখন নিশ্চিত হও, তখনও নারীদের আন্দাজের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারোনা। তোমার রাডইয়ার্ড কিপ্লিং আমাদের সম্মান করলেন, অথচ তোমার কাছে আমি কোনদিন আমার মেধার মর্যাদা পেলাম না’।

বাবা আরাম কেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘কে বলে মর্যাদা দিলাম না? এই যে ত্রিশটি বছর তোমার কথায় ওঠাবসা করছি, সুখে দুঃখে তোমার হাতটি ধরে আছি, আমাদের উদ্ভট সন্তানদের শেয়ার করছি, সেকি সাধে? তোমায় দেখে হয়ত আমার বাবামা এনেছিলেন, কিন্তু পছন্দ আমি করেছি, ভাল আমি বেসেছি, মর্যাদা সেও তো আমিই দিয়েছি তা সে মুখে আমি যাই বলিনা কেন’।

মুখের হাসিটা লুকানোর জন্য পরম নির্ভরতায় স্বামীর কাঁধে মাথা গুঁজে দেন রায়হানের আম্মা।

 

– রেহনুমা বিনতে আনিস

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button